‘দেখেছিস উইমলা, ছেলেগুলো ক্যামন ড্যাব ড্যাব করে তাকাচ্ছে?’
‘হু, কিন্তু তুমি তাকাচ্ছো কেন, মিহনী? মেয়েদের গোসল করতে দেখলে তো ওরা তাকাবেই।’
এক পশলা মুগ্ধ হাসিতে গুন্নেদু বললো, ‘আমার কিন্তু খারাপ লাগছে না। ছেলেগুলো সুন্দর আছে...।’
তিন কন্যার একে অপরের চোখে চোখ পড়তেই বাঁধভাঙ্গা হাসি, পর্বতের নিরবতা ভাঙ্গা হাসি। থামেই না। হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে পড়ছে, ঝরনায় জলকেলী করছে। রূপবতীদের কিন্নরী হাসিতে অরন্যের ঝরনায় স্বর্গীয় তাল বেজে উঠে। এক পর্বতের গা থেকে আরেক পর্বতের গায়ে প্রতিধ্বনি হতে থাকে। এমন বসন্ত দিন নীল পর্বতে আর কখনও আসেনি।
সেই হাসিতে নেপিয়ান উপজাতির পথ হারানো রাজপুত্ররা শুধু শিকার করতেই ভুলে গেল না, নিজেরাই শিকার হয়ে গেল। কাটুম্বা উপজাতির রাজকন্যারা ঝরনায় নিয়মিত স্নান করতে আসে, রাজপুত্ররাও রূপের মায়ায় হারিয়ে যেতে থাকে। দিনে দিনে রূপের সাথে রূপের, মনের সাথে মনের এক ঐশ্বরিক যোগাযোগ বাড়তে থাকে। রূপমুগ্ধ পুরুষ, প্রেমময়ী নারীর সেই যোগাযোগ সব কিছুকে ছাপিয়ে উঠে। কিন্তু এভাবে মনের কথা মনে মনে আর কত দিন বলা যায়? তাই রাজপুত্ররা বিবাহের প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু উজানের সাথে কি ভাটির মানুষের সম্পর্ক কখনো ভালো থাকে? থাকে না। কাটুম্বা ঝরনার পানির উপরই নেপিয়ানদের বাঁচা-মরা। নেপিয়ান নদীর জীবন। পানির জন্য দুই উপজাতির মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহও কম হয়নি। তা ছাড়া কাটুম্বাদের মধ্যে ভিন্ন গোত্রে বিবাহ স¤পুর্ন নিষিদ্ধ। কেউ করলে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
রাজপুত্ররা কোনো ভাবেই তা মেনে নিতে পারে না। যে কোনো মুল্যে কাটুম্বার রাজকন্যাদেরকেই বিবাহ করবে। কিন্তু কাটুম্বা রাজার এক কথা-- প্রয়োজনে যুদ্ধ তবুও বিবাহ নয়। ভয়াবহ যুদ্ধ বেঁধে গেল। সেই যুদ্ধে উভয় গোত্রের অনেকে নিহত হলো। যুদ্ধ যখন নেপিয়ানদের জয়ের দ্বার প্রান্তে ঠিক তখন কাটুম্বাদের এক বৃদ্ধ যাদুকর রাজকন্যাদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য পর্বত বানিয়ে ফেলে। সেই থেকে তারা হয়ে গেল পার্বতী। যাদুকর ছাড়া আর কেউই জানে না, কোন পর্বতগুলো সেই রাজকন্যারা? শুধুমাত্র সেই যাদুকরের মন্ত্র কিংবা রাজকন্যাদের প্রকৃত প্রেমিকই পারবে রাজকন্যাদের জীবন ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু সেই যাদুকর পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে দাস হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে হঠাৎ একদিন আত্মহত্যাকেই বেছে নিল।
যুদ্ধ শেষে পার্বতীরা প্রেমিকদের প্রতীক্ষায় দিন গুনতে থাকে। কিন্তু প্রেমিকরা তো আর আসে না। রাজকন্যারা পর্বত হয়ে গেলেও একে অপরের সাথে কথা বলতে পারে। বাতাসের কানে আকাশের পানে বিরহের গান করে। চাঁদ, তারার সাথে কথা বলে। রাতের আকাশে উল্কার জ্বলে ওঠা দেখে মনে মনে উইশ করে। প্রতিদিন কত কত অভিমানী কথা ঠিক করে! রাগ হয়...আবার ভুলেও যায়। আবার রাজপুত্রদের স্বপ্ন দেখে। ঝরনার জলে স্নান, জলকেলীর সেই বসন্ত দিনগুলি। আরো কত কী...।
রাজপুত্ররা বনফুল হাতে একের পর এক পর্বতের কাছে হাটু গেড়ে প্রেম নিবেদন করতে থাকে। কোনো পর্বতই সাড়া দেয় না। বিষধর সাপ, লাল মাকড়শায় ভরা শাপদ-সংকুল পথ পাড়ি দিয়ে দুর্গম গিরিপথে ছুটে চলে। এক পর্বতের গুহা থেকে আরেক পর্বতের গুহায় রাত কাটায়। কিছুতেই প্রিয়তমাদের খুঁজে পায় না।
ওদিকে শেষ বিকেলের কনে দেখা আলোয় পার্বতীরা সোনার মেয়ে হয়ে বসে থাকে। প্রতীক্ষা করতে করতে বিরহ-বেদনায় নীল হয়ে যায়। অষ্ট্রেলিয়ার আকাশে দ্বিগুন বড় চাঁদ উঠে। জোৎস্না রাতে মেঘের ছায়া কখনও চাঁদের, কখনও পার্বতীদের মুখ ঢেকে দেয়। এমনই কোনো এক রাত্রীর দ্বিপ্রহরে চাঁদ ডুবে যাবার আগে আগে গুন্নেদু মিহনীকে জিজ্ঞেস করলো--
‘ওরা বেঁচে আছে তো?’
‘হু, আছে।’
‘কিভাবে বুঝলে?’
‘প্রকৃতি কি এত নিষ্ঠুর হয়?’
‘ওরা কী সত্যিই আমাদের ভালোবাসে?’
‘...বাসে।’
‘কিন্তু একবারও তো বলেনি।’
উইমলার আর ভালোলাগে না। তাই একটু রেগেমেগেই বলে উঠে, ‘ভালোবাসে... না ছাঁই। একটুও বাসে না। তাহলে কী আর এত দিন লাগে?’
কিছুক্ষণ পর মিহনী একটা দীর্ঘ নি:শ্বাস নিয়ে বললো,--‘ভালোবাসা... অপেক্ষায়ও মধুর। ‘ভালোবাসি’ কথাটি বলা লাগে না রে...।’
----------------------------------------------------------------------
* (অস্ট্রেলীয় রূপকথা ‘থ্রি সিষ্টারস’ এর ছায়া অবলম্বনে।)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১৪ ভোর ৬:৪৬