১৬ মে ২০০৩, অস্ট্রেলিয়ায় আসার মাস খানেক পরই আব্বার অসুস্থতার খবর পেলাম। ১৭ আগস্ট তিনি মারা গেলেন। কী নিদারুণ অসহায় দিন কেটেছে! সামর্থ্যরে অভাবে দেশে যেতে পারিনি। কতবার যে আব্বার লাশ-কবর-গোরস্থান দেখে ঘুমের মধ্যে ডুকরে কেঁদে উঠেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। হতাশায় ডুবে যেতে যেতে একসময় অনুভব করেছি, কখন যেন হতাশাগুলোই আমার মধ্যে ডুবে গেছে।
বাবাকে কবর দিতে না পারলেও গত আট বছরের প্রবাসজীবনে বিভিন্নজনের মৃত্যুতে সিডনির রকউড গোরস্থানে যেতে হয়েছে। অনেকবার। এ দেশে শনি-রবিবার মৃত্যু হলে জানাজা-ভাগ্যে দু-চারজন মানুষ জোটে, নয়তো তা-ও জোটে না। সামর্থ্য কিংবা আনুকূল্য থাকলে লাশটি দেশে নিয়ে যেতে পারে। নয়তো সৎকার হয় পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। অস্ট্রেলিয়ানরা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় লোক ভাড়া করে প্রার্থনা, কান্নার ব্যবস্থা করে। বাঙালিরা আপনজনের মৃত্যুতে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করবে, নাকি কান্নাকাটি করবে? কান্নার লোকেরও বড় অভাব। কায়মনে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব মেলাতে পারি না। বুকের গভীরে আমার অপ্রাপ্তি আমাকে দেশে যেতে বলে। আমার বৈষয়িক প্রাপ্তি আমাকে সশ্রম কারাদণ্ডে আরো শক্ত করে বেঁধে রাখে। নিজেকে প্রশ্ন করি, বিদেশে আসে কারা? অতি ভাগ্যবান নাকি অতি অভাগারা?
ফোনালাপে দেশে ফেরার কথা তুললেই স্বজনেরা বলে, ‘দেশে আসবি মরতে? ওখানেই তো ভালো আছিস।’ কেমন আছি, বোঝাব কী করে? বিদেশের মাটিতে বাঁচা-মরার কী যে কষ্ট, ব্যথার সাতকাহন! বলব কীভাবে? এ মাটি আমার না, আমিও এই মাটির না। বহু সংস্কৃতির এই দেশে একই গোরস্থানে বহু রকমের কবর। খেজুর পাতায় ঘেরা কবর থেকে শুরু করে শ্বেত পাথরে বাঁধানো কবরের সমাবেশ। ফলকে ফলকে বহু ভাষার এপিটাফ, তাজা কিংবা প্লাস্টিকের ফুলে ফুলে সজ্জিত চিরনিদ্রা। মনে পড়ে যায় মাদারীপুর দরগাহ খোলার জরাজীর্ণ গোরস্থানের কথা। ছোটবেলায় সন্ধ্যার পর ওখান দিয়ে চলাচল করতে ভীষণ ভয় করত। এই বিদেশ-বিভুঁইয়েও কবরস্থানের অনুভূতি একই, মনের ওপর কেমন যেন চাপ ফেলে। অচেনা ভয়, বিষণœতা, নিঃসঙ্গতা, আততায়ীর মতো জাপটে ধরে।
জন্মভূমি ছেড়ে কোন দূর দেশে পড়ে আছি। ইচ্ছে করে পাখি কিংবা হাতি হয়ে যাই। শুনেছি, পূর্ণবয়স্ক পাখিরা নাকি আগাম মৃত্যুর খবর পায়। যখন তারা বুঝতে পারে, তখন দলবল ছেড়ে গহিন অরণ্যের দিকে যাত্রা করে। সেই গহিন অরণ্যে একাকী মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে। আর হাতিরা নাকি বয়স হলে একদিন হঠাৎ সঙ্গী-সাথিদের ছেড়ে বনের মধ্যে একলা কোনো এক দিকে চলে যেতে থাকে। সে হাঁটতে থাকে হাঁটতে থাকে আর হাঁটতে থাকে। একসময় পৌঁছে যায় কোনো এক জায়গায়, যেখানে চারদিক জঙ্গল আর মাঝখানে খানিকটা ফাঁকা জমি। যেখানে আরো সব হাতির হাড়গোড় পড়ে আছে। সেখানে গিয়ে একটু জায়গা খুঁজে নিয়ে হাঁটু গেড়ে আস্তে আস্তে বসে পড়ে। নীরবে অপেক্ষা করতে থাকে। তারপর একসময় মরে যায়। নিজে নিজেই মরে যায়।
জীবনসায়াহ্নে একদিন আমিও পাখির মতো, নয়তো বয়স্ক হাতির মতো হারিয়ে যাব এই অচিন দেশের কোনো এক জনারণ্যে...।