somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: যেতে যেতে পথ- ১ম পর্ব

১৪ ই জুন, ২০২১ সকাল ১১:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


.
নিস্তব্ধ রাত। মৃদুমন্দ বাতাস। আলোআধারিতে কেমন রহস্যের আভাস। ঠিক এমনি সময়ে কুকুরটা ডেকে উঠলো বিশ্রীভাবে। দ্রুতধাবমান একটি গাড়ির পিছনে ছুটছে একটা মোটরবাইক। গাড়ির ভিতর থেকে একজন নারীর আর্তচিৎকার ভেসে আসছে।গাড়িটা হঠাৎ কড়া ব্রেক কষে। মোটরবাইক আরোহী কোন মতে ব্রেক করে পিছলে গাড়ির পাশ ঘেষে স্কিড করে একপাশের রাস্তায় উল্টে পড়ে। গাড়িটা ধীর লয়ে ডানে মোড় নিয়ে চলে যায়, আর্তনাদটাও ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে যায়।
.
মুখে মাস্ক পড়া দুই যুবক হে হে করে হাসছে। মিতালীর চিৎকারে ওরা আনন্দ পাচ্ছে। নিজের অসহায়ত্ব বুঝতে পেরে মিতালী চুপ হয়ে যায়। গাড়ির দরজা খুলে লাফ দেওয়ারও কোন সুযোগ নেই। দুই বদমাইশ ওকে মাঝখানে বসিয়ে দরজা লক করে দিয়েছে। নিজের এই অবস্থার মধ্যেও তালহার জন্য চিন্তা হচ্ছে। মোটরবাইক উল্টে ওর কোন ক্ষতি হলো না তো? সামনের সিটে বসে থাকা যুবকের ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেল পিছনের যুবকদ্বয়। ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় মিতালী কিছুটা ধাতস্থ হয়ে সামনের যুবককে লক্ষ্য করে বলে, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?
ঘাড় ঘুরিয়ে মিতালীর দিকে তাকিয়ে যুবক বলে, তা জেনে আপনার কোন লাভ হবে না। তারপর পিছনের দু’জনকে চোখ টিপে ইশারা করে। মিতালী কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা রুমাল দিয়ে নাক-মুখ চেপে ধরে দুই যুবক। মিতালী ধস্তাধস্তি করতে করতে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।
.
এদিকে ঢাকায় মিতালীর বাবা তালহার নামে থানায় জিডি করে অপহরণ মামলার। সেদিনের ঘটনায় তালহার পা ছিলে গেছে এবং বাম হাতে ব্যান্ডেজ। পুলিশ ওর মার অনুরোধ উপেক্ষা করে ওকে থানায় নিয়ে এসেছে। তালহা ওসির কাছে সেদিনের রাতের বর্ণনা দেয়। ওসি ওকে বিশ্বাস করে না। উনার ধারণা, বড়লোকের মেয়েকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে তালহা বিয়ের নাম করে মেয়েটাকে গায়েব করে দিয়েছে। পাড়ায় মাস্তান ও প্রতিবাদী যুবক হিসেবে তালহার পরিচিত আছে। এই প্রতিবাদ করতে গিয়েই একদিন মিতালীর সাথে ওর পরিচয়।
.
একটা রিকশা থামিয়ে তিন যুবক মিতালীর মোবাইল ও ব্যাগের সমস্ত টাকা নিয়ে চম্পট দিচ্ছিল। সন্ধ্যা হয়েছে মাত্র। আশেপাশে অনেকে মজা দেখছে। কেউ এগিয়ে আসছে না। তালহা দৌঁড়ে গিয়ে প্রথমে একটার দু’পায়ের মাঝখানে জায়গা মতো এক লাথি হাকালো। ‘ওরে মা রে বাবা রে’ বলে ছোকরা ওই জায়গা চেপে ধরে বসে পড়লো। তারপর ক্যারাতের ভংগিতে ডান হাতটাকে চালিয়ে দিল আরোকটার ঘাড় বরাবর। ঘটনার আকস্মিকতায় তিন ছিনতাইকারী হতবাক হয়ে যায়। এমন প্রতিরোধ ওরা আশা করেনি। নার্ভাস হয়ে তৃতীয় ছিনতাইকারী গুলি চালিয়ে দেয়। তারপর দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। এবার উৎসাহী জনগণ বাকী দু’জনকে উত্তম-মধ্যম দিতে থাকে। মিতালী এগিয়ে এসে তালহাকে ধন্যবাদ জানায়। তালহা অনুভব করে ওর বাম পায়ের মাসলটা জ্বলে যাচ্ছে। ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে জিনসের প্যান্টটা ছিঁড়ে গেছে। গুলিটা চামড়া ছুঁয়ে গেছে। ক্রমশ: জায়গাটা লাল হয়ে ওঠছে।
মিতালী ওকে নিয়ে পাশের একটা ওষুধের দোকানে নিয়ে ড্রেসিং করিয়ে দেয়। তারপর একটা হাসপাতালে নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়। যদিও তালহা ডাক্তারের কাছে যেতে চায়নি। কিন্তু মেয়েটা নাছোড়বান্দা।
একটা উবার ভাড়া করে ওকে বাসায়ও পৌঁছে দেয়। রাতে আবার তালহাকে মোবাইলে ফোন করে। তালহা তখন ওর মার সাথে বসে গল্প করছিল। ও একটু অস্বস্তি বোধ করে। মার সামনে কোন মেয়ের সাথে ও কখনো কথা বলেনি। ব্যাপারটা মিতালী আঁচ করতে পেরে একটু অবাক হয়, খুশিও হয়। এই যুগে এমন ছেলে পাওয়া ভার। তারপর মোবাইলের এই যুগে দু’জনের মধ্যে সম্পর্কটা গভীর হতে সময় লাগেনি। তালহা মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। মা ও ছোট বোনকে নিয়ে তাদের সুখের সংসার। বাবার মৃত্যুর পর মা ই চাকরি করে তাদের মানুষ করেছেন। সে চায়নি উচ্চবিত্ত ঘরের মেয়ের সাথে জড়াতে।
.
ওসি বিভিন্ন রকম প্রশ্ন করে ওর আর মিতালীর সম্পর্কে জানতে চাইলে এই কথাগুলোই তালহা ওসিকে জানায়। ওসি এবার সরাসরি জিজ্ঞাসা করে, বিয়ের সিদ্ধান্তটা কার?
- ওর। আমি মানা করেছিলাম। ওর পরিবার ওর বিয়ে দিতে চাইছিল বলে আমাদের বাসায় এসে পড়ে।
- আপনারা বিয়ে করেছেন?
- না। কাজী অফিসে গিয়েছিলাম বিয়ে করতে। ওদের পরিবারের লোক আমাদের ওপর কড়া নজর রাখছিল। তারা পুলিশে খবর দেয়। ঝামেলা হবে বুঝতে পেরে কাজী সাহেব বিয়ে পড়াননি।
- হুম । তারপর ওসি বিড় বিড় করে বলে, তা হলে তো কিছুটা বেঁচে গেলেন।
- ওসি সাহেব, আপনি কি আমাকে কিছু বললেন?
- না, তেমন কিছু না।
তারপর বেশ কিছুক্ষণের নিরবতা। ওসির শ্যেন দৃষ্টি তালহার উপর। তালহা অস্বস্তি বোধ করে।
ওসি ভেবে চলেছে, তালহা কি লোক দিয়ে অপরহণের ঘটনাটা সাজিয়েছে? ওকে সেলে ভরে একটু বাজিয়ে দেখলে কেমন হয়? না, ছোকরার লম্বা-চওড়া সুঠাম দেহ দেখে বোঝা যাচ্ছে সহজে স্বীকার করবে না। ঘটনাটা অন্য কেউ ঘটালে ও তো কিছু বলতে পারবে না। তার চেয়ে বরং একটু ভালো মানুষ সেজে ওকে ছেড়ে দেই। তারপর মোবাইলে ওত পেতে বাছাধনের সমস্ত গোপন খবর জেনে নেব।
নিজেই নিজের বুদ্ধিতে চমকিত হয়ে মনে মনে বলে, সাবাস জুলহাজ! চালিয়ে যাও!
সেপাইটাকে ডেকে পাশের দোকান থেকে চা আর গরম গরম সিঙারা নিয়ে আসতে বলে। কিছুক্ষণ তালহার সাথে খোশ গল্প করে। তালহাকে বিদায় জানানোর সময় যেন হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেছে এমন ভাব করে ওসি বলে, আপনি কিন্তু এলাকা ছেড়ে কোথাও যাবেন না। কোথাও যেতে হলে আমাকে জানিয়ে যাবেন।
.
তালহার মা-বোন ওর জন্য অধীর আগ্রহে বাসায় অপেক্ষা করছিল সন্ধ্যা থেকেই। রাতে ছেলেকে ফিরে পেয়ে উনি ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। তারপর ওসি সাহেবের সাথে কী কথা হয়েছে তা জানতে চান। তালহা মাকে সব খুলে বলে। এবার মার চিন্তা হয় মিতালীর জন্য। মাত্র এক সপ্তাহ ওদের বাসায় ছিল মেয়েটা। ওরা কত বড়লোক। কিন্তু মেয়েটা ওদের সংসারে কেমন সুন্দর মানিয়ে নিয়েছিল। রাতে হবু ননদ সায়মার সাথে ঘুমাতো মিতালী। সারারাত দু’জন কী এতো গল্প করতো মা বুঝে ওঠতে পারেন না। এদিকে ওদের পরিবার থেকে তালহাকে বিভিন্ন রকম হুমকি দিচ্ছে। তালহার একটু একলা থাকতে ইচ্ছে করছে। এই সব সময়ে ওদের দোতলা বাড়ির ছাদটা ওর প্রিয় জায়গা। ও মোবাইলটা নিয়ে ছাদে চলে যায়। গুমোটা আবহাওয়া। আকাশ মেঘলা। আজ কি অমাবস্যা? এমনি এক অমাবশ্যা রাতে ঘুট ঘুটে অন্ধকারে ঢাকা আকাশে দিকে তাকিয়ে মিতালীর সাথে মোবাইলে গল্প করছিল। মিতালীও ওদের বাসার ব্যালকনিতে বসে ছিল। ওর রবীন্দ্র সংগীতের গলা খুব ভালো। একটা গান শোনার জন্য তালহা আবদার করে। তখন ও গানটা গিয়েছিল,
যেতে যেতে পথে
অমাবস্যা রাতে
চাঁদ ছিল না গগনে,
দেখা হয়ে ছিল
তোমাতে আমাতে
কি জানি কি
মহা দুর্যোগে
চাঁদ ছিল না গগনে-------

তালহা অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল, এ আবার কেমন রবীন্দ্র সংগীত। মিতালী হাসতে হাসতে বলেছিল, এটা মিতালী-তালহা সংগীত। আমাদের পরিচয়ের সংগীত। ও আরো বলেছিল, দুর্যোগেই তো মানুষকে চেনা যায়। তাই অমাবস্যার অন্ধকার আমার প্রিয়, যেখানে কেউ তোমাকে দেখবে না, শুধু আমি তোমার উপস্থিতি টের পাবো, আর তুমি আমার। মিতালী এতো সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারতো, তালহা শুধু অবাক হয়ে শুনতো। তালহা ওতো গুছিয়ে কথা বলতে পারে না।
নিজের অজান্তেই তালহার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে।
অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে তালহা চিৎকার করে ওঠে, মিতালী, তুমি কোথায়?
.

চলবে..

১২ জুন, ২০২১
মো. শামছুল ইসলাম








সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০২১ সকাল ১১:৪৫
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×