আমার বাচ্চাটা স্কুলের পর, বাচ্চাদের একটা ক্লাবে থাকে কিছুক্ষণ। ওটা আসলে স্কুলেরই একটা বর্ধিতাংশ। যেখানে কর্মজীবি মা'র বাচ্চারা সময় কাটায়। আমি কাজ থেকে ফিরে ওকে নিয়ে আসি।
প্রথমে আমি মা, তারপর বাঙ্গালী মা এবং সবশেষে কর্মজীবি মা। মনটা সব সময় চোরের মত হয়ে থাকে। যতক্ষণ স্কুলে থাকে, ততক্ষণ ঠিক আছে। কিন্তু যখনই ওর ক্লাবে যাবার সময় হয়, দূরে বসেও আমার টেনশন হতে থাকে। আহারে! আমার জানটা না জানি, কি করছে?
মাঝে মধ্যে দুই চার মিনিট দেরী হলেই আমার ভেতরটা কাঁপতে থাকে। মনে হয়, এই বুঝি গেলেই ঠোঁট ফুলিয়ে বলবে-"এত দেরী করেছ কেন?"
কিন্তু আমি পৌঁছাবার সাথে সাথেই যে হাসিটা তার দেখি-- আমার বুকের উপর থেকে পাষাণভারটা নেমে যায়। গতকাল গেলাম আমার মা'টা কে আনতে, যথারীতি সে হাসি মুখে এগিয়ে এসে, আমাকে লেখা তার প্রথম চিঠিটা দিল।
চিঠিতে লেখা
মাম্মা দাইসুকি
ইৎসুমো হায়াই ওমুকায়ে
আরিগাতো
বাংলা করলে দাঁড়ায়.. মা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তুমি সবসময় আমাকে তাড়াতাড়ি নিতে আসো দেখে, তোমাকে ধন্যবাদ।
চিঠিটা পড়েই আমার চোখে কি যেন হল, দেখি চোখদুটো ঝাপসা হয়ে গেছে। এটা মেয়ের কাছে থেকে পাওয়া আমার প্রথম চিঠি। আজকাল চিঠির স্বাদ কেমন ভুলেই গেছি। সেদিন আমার মাকে বল্লাম, মা আমাকে একটা বড় করে চিঠি লিখ তো! মা বল্লেন, "বাবা রোজ তো কথা হয়। কি লিখবো, খুঁজে পাইনা যে!"
অথচ আমার মেয়েকে কাগজ কলম দিলেই, নিজেকে আঁকবে, একটা ফুল এবং একটা প্রজাপতি আঁকবে আর আঁকবে আমাকে।
সারাক্ষণ আমাকে আঁকে। অথচ আমি ওর মোটেও ভালো মা নই। যখন তখন রাগ করি। শাসন করি।
আমার চেয়ে মেয়েকে ঢের ভালোবাসে ওর বাবা। ভদ্রলোকের পুরো পৃথিবী এক দিকে আর মেয়ে আরেকদিকে। মেয়েকে বকলে যে মানুষ আমাকে বকতেও এক মুহূর্ত দ্বিধা করেনা। মেয়েটার কল্পনার জগতে সেই মানুষটার ঠাঁই খুব কম। তার পুরো কল্পনার জগতটা জুড়ে আমি।
ওর লুকোনো সব কথা আমার সাথে। ওইটুকুনি বাচ্চা, তবুও এসে ফিসফিস করে বলবে-"মাম্মা আমি একটা নাচ শিখেছি। তোমাকে দেখাবো। বাবাকে যেন বলো না।" আবার বাবা এলে বলবে, বাবা আমি একটা কথা আম্মুকে বলেছি, তুমি শুনে নাও।
ও আমার জীবন্ত খেলনা। প্রতিটা মুহূর্ত ও আমাকে আনন্দে ভরিয়ে রেখেছে।
আজকাল একলা হলেই চোখ মুছি। ও যে আমার রঙ্গীন ঘুড়ি। ওর সূতোটা আমি আমার সমস্ত শরীর, মন আর এই জীবন দিয়ে বুনেছি।
সেই ঘুড়িটা বড় হচ্ছে আর একটু একটু করে শুরু হচ্ছে ওর দূরের আকাশে ওড়াউড়ি। ওর জগতটা আরও বড় হলে আমি কি করে থাকবো? বুঝে উঠতে পারিনা।
তবুও দিনরাত সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, "আমার সন্তান নিরাপদে থাক। পৃথিবীর তাবত হিংস্রতা থেকে দুরে থাক। সুস্থ থাক। হে পরম করুণাময় আমার সন্তানের দুঃখী মুখ যেন আমাকে কখনই দেখতে না হয়।"
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১০ দুপুর ১:০০