ছেলেবেলায় আমাদের বইয়ে একটা ছড়া ছিল, "তাই তাই তাই মামা বাড়ি যাই। মামা দিল দুধভাত, পেট ভরে খাই। মামী এলো লাঠি নিয়ে পালাই পালাই..."
সেইসময় ছড়াটা যতবারই পড়তাম কিন্তু এর সঠিক মানেটা ঠিক বুঝতে পারতাম না। কারণ আমাদের মামী কখনোই খাবার খেয়ে ফেলার কারণে আমাদের লাঠি নিয়ে তাড়া করতেন না বরং তিনি আমারা খাবার না খাওয়ার কারণে চিৎকার চেঁচামেচি করে বাসা মাথায় তুলে নিতেন এবং এখনো নেন।
মায়ের অসুস্থতার কারণে বছরের অনেকটা সময় আমারা মামা বাড়ি থাকতাম। কিন্তু কখনো একটি বারের জন্যেও মনে হয়নি আমাদের প্রতি মামীর ভালোবাসা কমে গেছে। বরং আমাদের মামী আমাদের প্রত্যেকদিন বিভিন্ন কায়দায় ভালোবাসার থেরাপি দিতেন আর আমরা তার ভালোবাসা পেয়ে বিড়াল ছানার মতো তার আশেপাশে লুটোপুটি খেতাম।
আমাদের প্রত্যেকটা কাজিনকে মামী কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন। অথচ এই দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়নি।তিনি নিজেই সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। আমাদের মায়েরা আমাদের জন্ম দেবার পর বাকি কাজ গুলো আপন হাতে তিনি সামলে নিয়েছেন। শুধু আমাদেরই না তিনি তার নিজের ভাই-বোনদের বাচ্চাদেরও কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন। উনি কখনো তার সন্তান আর আমাদের মাঝে বিভেদ করেননি।
এই মানুষটা যে শুধু আমাদের মানুষ করার দায়িত্ব পালন করেছেন তা কিন্তু না। তিনি সমস্ত রকমের কাজ কে তার দায়িত্ব হিসেবে হাতে তুলে নিতেন আর নিপুণ হাতে তা যথাযথভাবে পালন করতেন। শয্যাশায়ী মা-বাবা আর শ্বশুর-শ্বাশুড়ির মধ্যে ভেদাভেদ না করে দিনরাত তাদের সেবা করেছেন। প্রত্যেক টা মানুষ শয্যাশায়ী অবস্থায় থেকে তার সেবা পেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
ছেলেবেলায় আমি ভালোবাসা আর নির্ভরতার আশ্রয় বলতে বুঝতাম আমার মামী কে। তার ছত্রছায়ায় দিনদিন যত বড় হচ্ছিলাম ততো তার আচরণ দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। কি করে একটা মানুষ এতোটা নির্ভেজাল আর আত্মত্যাগী হতে পারে! কি করে একটা মানুষ সমস্ত মানুষ গুলোকে বুকে জড়িয়ে ভালো থাকতে পারে!
এই মানুষটার মূল উদ্দেশ্যেই হচ্ছে সবাইকে জড়িয়ে ভালো থাকা এবং প্রতিবেশীরাও এর বাইরে নয়। আশেপাশের প্রত্যেকটা মানুষ আমার মামীর ভালোবাসায় মুগ্ধ। সারাক্ষণ বাসায় প্রতিবেশীদের পদচারণা লেগেই থাকে শুধু মামীর সংস্পর্শ পাবার আশায়। এই মানুষ গুলোর অধিকাংশ মানুষই স্বল্প আয়ের লোক। মামী কে দেখতাম সবমসময় চেষ্টা করতেন স্বল্প আয়ের লোকেদের সাথে চলাফেরা করার। তাদের দান করে বা খাবার দিয়ে উনি যে কি ভীষণ তৃপ্তি পেতেন তা উনার মুখ দেখলে যেকেউ অনুমান করতে পারতেন।
ছেলেবেলায় দেখতাম মামী তার টুকটাক কজে হেল্প করার জন্য একটা ছেলেকে বাসায় রেখেছিলেন। কাজের কাজ কি হতো জানিনা কিন্তু ছেলেটা মামীর সংস্পর্শ থেকে লেখাপড়া থেকে শুরু করে অনেক কিছু শিখেছিলো যা তার ব্যক্তিগত জীবনকে সাফল্য মন্ডিত করেছে। এই ছেলেটা আর আমাদের মধ্যে মামী কোনো ভেদাভেদ করতেন না। আমরা একসাথে বেড়াতে যেতাম, খেলতাম, খেতাম এবং ঘুমাতাম।
মামী তার কাজে হেল্প করা মেয়েদের মাথায় বিলি কেটে দেয়, চুলে তেল দিয়ে দেয়, চুল বেঁধে দেয় মাঝে মাঝে একসাথে ঘুমায়ও। আর খাবার দাবার তো আমরা একসাথে এক টেবিলে বসেই খাই। মামীর রাজ্যে উঁচু-নিচু বলে কোনো কথা নেই। তার কাছে সবাই মানুষ, সবাই সমান।
আমার মামা বলেন এই পুরো সংসার জীবনে মামী নাকি নিজের জন্য কোনোদিন কিছুই চায়নি।কি অদ্ভুত না? আসলেই আমি সবসময় মামীর মুখে কার কি নেই, কাকে কি দিতে হবে এসব শুনেই বড় হয়েছি। উনার নিজের কিছু নেই, নিজের কিছু চাই তা কখনোই বলতে শুনিনি।
আমরা কাজিনরা সবাই বড় হয়েছি। অনেকেই বিয়ে করে বাচ্চাকাচ্চার বাবা হয়ে গেছে কিন্তু মামী এখনো আমাদের প্রতি দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াননি। আমাদের সেই ছোট্ট মনে করে এখনো দায়িত্ব পালন করেই যাচ্ছেন।
যেখানে মামার সংসারে মামীর চিৎকার চেঁচামেচিতে ভাগিনা ভাগ্নিদের ঘুম ভেঙে যাওয়ার কথা সেখানে ভোরবেলা যাতে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে না যায় সে জন্য মামী আমাদের রুমের আশেপাশে কাউকে কথা বলতে দেন না।
শুনেছি অনেক মামীর সংসারে ভাগিনা ভাগ্নীদের খাবার জুটেনা। অথচ আমার মামী আমরা কি পছন্দ করি না করি এর উপর ভিত্তি করে যুগ যুগ ধরে খাবার রান্না করে যাচ্ছেন যাতে করে আমিরা তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারি।
কিছুদিন আগে শুনলাম আমার এক বন্ধু কে নাকি তার মামী কালো জাদু করেছে। আমার বন্ধুর অপরাধ সে স্টুডেন্ট ভালো এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। এই হিংসায় তার মামী তাকে দমিয়ে দেয়ার জন্য কালো জাদু করেছে। আর এদিকে আমার মামী আমাদের মঙ্গল কামনায় ঘণ্টার পর ঘন্টা জায়নামাজে বসে কাঁদেন।
যখন রবীন্দ্রনাথের ছুটি গল্পটি পড়তাম তখন মামী চরিত্রের ওই মহিলার উপর ভীষণ রাগ হতো। মনে হতো ওই মহিলাকে আমার মামীর সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলি কিভাবে ভাগিনা-ভাগ্নিদের ভালবাসতে হয় তা আমার মামীর কাছ থেকে শিখে নিন। বেচারা ফটিকের জন্যও খারাপ লাগতো। ও যদি আমার মামীর মতো মামী পেতো তাহলে এভাবে ওকে অকালে চলে যেতে হতো না।
আমার মামী আসলে প্রত্যেকটা জায়গায়ই শ্রেষ্ঠ। আমাদের কাছে উনি শ্রেষ্ঠ মামী, আমার মা-খালা আর মামাদের কাছে শ্রেষ্ঠ ভাবি, আমার অন্যান্য মামাদের বাচ্চাদের কাছে শ্রেষ্ঠ কাকি, তার ভাই-বোনদের কাছে শ্রেষ্ঠ বোন আর তাদের বাচ্চাদের কাছে শ্রেষ্ঠ ফুপু-খালা, উনি শ্রেষ্ঠ মেয়ে, শ্রেষ্ঠ বোউ।
হ্যাঁ এই ভালো মানুষটাই আমাদের মামী। সে আগে যেমন ছিলেন এতোগুলা বছর পরেও ঠিক তেমনই আছেন।এই মানুষটা কে নিয়ে লিখে শেষ করা যাবেনা আর আমি সে সাহসও করিনা।কারণ কিছু মানুষ কে নিয়ে সত্যিই লিখে বা বলে শেষ করা যায় না।
আমরা চির-ঋণী এই মানুষটার কাছে। এই ঋণের বোঝা আমাদের সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে কারণ কিছু ঋণের কোনো শোধ হয় না। আমাদের ভাবতেই নিজেদের ভীষণ অহংকারী মনে হয় যে আমাদের তার মতো একটা মামী আছে আর সারাজীবন আমরা তাকে নিয়ে এই অহংকারটা করেই যেতে চাই। আমাদের মামী আমাদের সবার আয়ু নিয়ে বেঁচে থাকুন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ বছর। ❤
ছবি গুগল থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৩ সকাল ১১:৫৭