somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শাওন আহমাদ
স্বপ্নপূরণই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়।তাই বলে স্বপ্নকে ত্যাগ করে নয়,তাকে সঙ্গে নিয়ে চলি।ভালো লাগে ভাবতে, আকাশ দেখে মেঘেদের সাথে গল্প পাততে, বৃষ্টি ছুঁয়ে হৃদয় ভেজাতে, কলমের খোঁচায় মনের অব্যক্ত কথাগুলোকে প্রকাশ করতে...

স্মৃতিচারণঃ আমাদের আব্বা

১১ ই মে, ২০২৩ বিকাল ৩:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমি আমার আশেপাশে বাবা-ছেলেদের যে মধুর সম্পর্ক দেখে বড় হয়েছি,আমাদের সাথে আমাদের আব্বার এমন সম্পর্ক কল্পনা করাও ছিলো কল্পনাতীত। যে মানুষটার গলার শব্দ শুনে আমাদের প্রাণবায়ু বের হয়ে যাবার উপক্রম হতো, যার চোখের চাহনীতে আমাদের শিড়দাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যেতো, তাঁর সাথে আমাদের মধুর সম্পর্ক হওয়াটা সত্যি কল্পনাতীত'ই ছিলো বটে। আমরা আমাদের আব্বাকে এতোটাই ভয় পেতাম যে আমাদের সম্পর্ক ছিলো চিল আর মুরগির ছানার মতো। মুরগির ছানারা যেমন চিলের আনাগোনা পেলে দৌড়ে গিয়ে মায়ের ডানার নিচে লুকায়, আমরাও তেমন বাবার সাড়াশব্দ পেলে দৌড়ে গিয়ে মায়ের আঁচলের নিচে মুখ লুকাতাম বা বাড়ির এমন কোনো জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিতাম; যেখানে আব্বা খুব একটা যেতেন না।

এই ভয়ের কারণেই আব্বার সাথে আমাদের দূরত্ব ছিলো ঢের।আমাদের কাছে আমাদের আব্বার উপস্থিতি আনন্দের চেয়ে ভয়েরই ছিলো বেশি। আব্বা তাঁর ব্যবসার কাজ ছাড়া যতোটা সময় বাসায় থাকতেন এই পুরোটা সময় আমাদের শ্বাস বন্ধ হবার জোগাড় হয়ে থাকতো। ভয়ে আমরা পড়ার টেবিলে বা অন্য কোনো জায়গায় জড়সড় হয়ে বসে থাকতাম। সারা বাড়ি জুড়ে তখন মৃত্যু শোকের মতো নীরাবতা বিরাজ করতো। আমরা সাধারণ বিষয় নিয়েও আব্বার সাথে নিজে থেকে কথা বলতাম না; আমাদের কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে মায়ের কাছে জানাতাম, মা আব্বার কাছে বলে সেগুলো আদায় করে দিতেন।

আমাদের লেখাপড়ার প্রথম টিচার আব্বাই ছিলেন, অক্ষর চিনানো হাতে ধরে লেখা শিখানো সব আব্বার কাছ থেকেই হয়েছে। অবশ্য আব্বার কাছে পড়তে বসলে যতোটা না আমরা পড়তাম তার চেয়ে বেশি ভয়ে কাঁপতাম। একটু এদিক রেখে ওদিক হলেই ঠাস ঠাস পড়তো গালে। পড়ালেখার বাইরে কোনো অপরাধ করলে তার শাস্তি আরও ভয়ংকর ছিলো। আমরা তখন মায়ের ডানার নিচে গিয়ে লুকাতাম। মা আমাদের বুক দিয়ে আগলে রাখতেন আর সমস্ত ঝড় তার উপর দিয়ে যেতো। ঝড়ঝাপটা শেষে প্রকৃতি শান্ত হয়ে গেলে আমারা ডানার নিচ থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক চলে যেতাম।

আব্বার কথা ছিলো একটাই, খাওয়া ঘুম আর পড়া। এর বাইরে কিছুই করা যাবেনা। সপ্তাহে একদিন মানে শুক্রবারেও কখনো আমরা আব্বার কাছ থেকে টেলিভিশন দেখার অনুমতি পেতাম না। সন্ধ্যায় আলিফ-লায়লা দেখতে না পারার আফসোস নিয়ে আমরা পড়ার টেবিলে বসে থাকতাম; কিন্তু পড়াশোনা কিছুই হতোনা কারণ তখন মন বিচরণ করতো আলিফ-লায়লা জুড়ে। শুক্রবারও যথারীতি আমাদের দিন শুরু হতো শাসন আর পড়াশোনা দিয়ে, সপ্তাহে একদিন যে বেলাকরে ঘুমাব তার যো ছিলো না। আমার আব্বার ভয়ে পাড়ার ছেলে-পেলেরাও আমাদের সাথে মিশত না খুব একটা। যদিওবা কেউ ভয়ে ভয়ে আমাদের কাছে আসতো; কিন্তু আব্বার কন্ঠ শুনলেই ভোঁ দৌড় দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচত, সে বেলায় আর তার ছায়াকেও আমাদের বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখা যেতো না। আব্বা যখন তার ব্যবসার কাজে কিছুদিনের জন্য দূরে কোথাও যেতেন আমরা তখন আমাদের নিজস্ব রাজ্যের রাজা বাদশা হয়ে যেতাম, আমাদের আকাশে তখন ঈদের চাঁদ দেখা দিতো; দিনমান খেলাধুলা আর লাফালাফিতে ব্যতিব্যস্ত থাকতাম আমরা। তিনি বাসায় ফিরে এলেই সব আবার আগের মতো রঙহীন আর মৃত্যুশোকে ছেয়ে যেতো।

আব্বার নীল রঙের একটা সুজুকি মটরসাইকেল ছিলো, এর শব্দ ছিলো অন্য সব মটরসাইকেলের চেয়ে আলাদা। আব্বা যখন মটরসাইকেল নিয়ে বাসায় আসতেন আমরা মটরসাইকেলের শব্দ শুনে সুবোধ ছেলের মতো শান্ত হয়ে পড়ার টেবিলে বসে থাকতাম; কিন্তু আমরা ডালে ডালে চললে আব্বা চলতেন পাতায় পাতায়। মাঝেমাঝে আমাদের পরীক্ষা করার জন্য আব্বা অফিসে মটরসাইকেল রেখে বাসায় আসতেন; আর এসেই যদি আমাদের এলোমেলো দেখতেন শুরু হয়ে যেতো ধুমধাম। অবশ্য অন্য ভাইয়েদের চেয়ে আমি ভাগে সবসময়ই কম পেতাম; কারণ আব্বা বলতেন আমার চোখের দিকে তাকালে নাকি তার মায়া হয় খুব এ জন্যই আমি বরাবর বেঁচে যেতাম। যদিও আমি আমার কোটেরে ঢোকা ডার্ক-সার্কেল পরা চোখে মায়ার ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাইনা কখনো।

আব্বা আসলে এসব করতেন কারণ তার বাচ্চারা যেনো অন্য বাচ্চাদের চেয়ে আলাদা হয়, তার বাচ্চারা যেনো সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ পায়। আমাদের জন্যই তিনি দিনরাত খাটতেন; কিন্তু ছোটবেলায় বাবা কে ভয় পাবার কারণে আমাদের মাথায় তাকে অন্যভাবে দেখা ছাড়া আর কিছু কাজ করত না। যেদিন সকালবেলা আব্বা মারা গেলেন মা আমাদের জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। আমরাও মায়ের সাথে গলা মিলিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলাম। যাকে আমরা সবমসময় চাইতাম দূরে থাক সেই মানুষটাই যখন চিরতরে দূরে চলে গেলো তখন তাকে ছাড়া কিভাবে বেঁচে থাকবো এই ভেবেই হাউমাউ করে কাঁদছিলাম,এতোগুলো বছর পরেও কাঁদি।

বাবারা আসলে এমনই হয় তারা খুব একটা ভালোবাসা প্রকাশ করেন না। তারা বুকে ভালোবাসা জমিয়ে রেখে সন্তানের জন্য ভবিষ্যৎ গড়ায় ব্যস্ত থাকেন। আমার আব্বাও তাই করতেন। আমাদের এমনও দিন গিয়েছে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ আমাদের আব্বার সাথে দেখা হতো না। তিনি তার ব্যবসার কাজ নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকতেন যে, আমরা রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পর তিনি বাসায় আসতেন; আবার ভোরবেলা আমাদের ঘুম থেকে উঠার আগেই বাইরে চলে যেতেন। এই সকল পরিশ্রম, আরাম-আয়েশ বিসর্জন সব আমাদের ভালো রাখার জন্যই করতেন। তখন আব্বার অনুপস্থিতি আমাদের মনে ভালো লাগার সঞ্চার করলেও এখন তার সেইসব দিনের ত্যাগের কথা হৃদয় পটে উঁকি দিলেই বিষাদে বুক ভারী হয়ে যায়, আঁখি যুগলে ঘোর বর্ষা নামে।

ছবিঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০২৩ বিকাল ৩:১৯
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস-পরীক্ষার হলে দেরিঃ পক্ষ বনাম বিপক্ষ

লিখেছেন BM Khalid Hasan, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



বর্তমানের হট টপিক হলো, “১ মিনিট দেরি করে বিসিএস পরীক্ষার হলে ঢুকতে না পেরে পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ।” প্রচন্ড কান্নারত অবস্থায় তাদের ছবি ও ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কারণ সারাজীবন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

×