মানুষ কখনোই মানুষ কে ভালোবাসতে পারেনা; কারণ দিনশেষে মানুষ কেবলমাত্র নিজেকেই ভালোবাসে, সময়ে সময়ে মানুষ মানুষের প্রেমে পড়ে কিন্তু সেটা ভালোবাসা নয়।প্রেম হচ্ছে চোখের বিভ্রম যা, কিছু সময়ের জন্য মানুষের মনে বিপরীত ব্যাক্তির প্রতি আলোড়ন সৃষ্টি করে, ঘোর কেটে গেলেই আবার নতুন কোনো ঘোরের দিকে পা বাড়ায়।
মানুষ আসলে মানুষ কে অন্বেষণ করতে ভালোবাসে, এটা একটা নেশা বলা যেতে পারে। যখন একটা মানুষ আরেকটা মানুষ কে উল্টেপাল্টে জেনে ফেলে, নতুন করে আর কিছুই জানার থাকেনা, যখন সকল কথারা ফুরিয়ে যায় নতুন করে আর কিছুই বলার থাকেনা তখন মানুষ আবার নতুন করে নতুন কিছুকে জানতে পা বাড়ায়।
আমি আমার কলেজ ভার্সিটি লাইফে খুব করে চাইতাম আমরা নিজের একটা মানুষ থাকুন, যার পুরোটাই আমার।
যাকে আমি শতবার ভেঙ্গে, হাজার বার নিজের মতো করে গড়ব। যার ভেতর-বাহির সমস্ত জায়গায় আমার অবাধ বিচরণ থাকবে। তার পুরো শরীর হবে আমার ক্যানভাস; কখনো আমি আমার আঙুলের ডগায় সেই ক্যানভাসে ভালোবাসার আল্পনা আঁকব, আবার কখনো ডুব দিয়ে ঘুরে আসবো গহীনের গভীর থেকে।
কিন্তু এসব আমার ভাবনার খাঁচাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে, এর বাইরে এসে ডানামেলে উড়তে পারেনি কখনো। আমি বন্ধু মহল বা পরিচিতজনের গভীর সম্পর্ক দেখে যেমন ভালোবাসাকে কাছে পেতে চাইতাম, দুদিন পরে সেই গভীর সম্পর্কের কাদা ছোড়াছুড়ি দেখে তেমন তার থেকে পালিয়েও বেড়াতাম।
আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, এইতো দুদিন আগেও দুইজন মানুষ কেউ কাউকে ছাড়া নিজকে কল্পনা করতে পারত না, কখন খেলো, কখন ঘুমালো, কোথায় গেলো, কার সাথে গেলো, কি রঙের কাপড় পড়লো, কিভাবে দিনমান কাটালো সহ মোট কথা দৈনন্দিন জীবনের সবকিছুই একে অন্যের জানার বিষয় ছিলো অথচ কিছু সময়ের ব্যবধানে কিভাবে সব আমূলে পাল্টে ঘৃণায় রুপ নিলো! কিভাবে দুটি মানুষ তাদের পথ দুদিকে বাঁকিয়ে নিলো সকল সুখ-স্মৃতি ভুলে! কিছু সময়ের ব্যবধানে দুজন মানুষ ভিন্ন দুটি মানুষও জুটিয়ে নিলো নিজেদের নতুন করে ভাগ করে নিতে।
আমি যারপরনাই ইমোশনাল মানুষ, যেখানে আমি আমার বাসায় দুদিনের জন্য কোনো আত্মীয় এসে চলে গেলে তার জন্য বিষাদে মুখ ভারী করে রাখতাম দিন কয়েক সেখানে একটা মানুষের সাথে এভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে আচানক তার চলে যাওয়ায় আর যাইহোক নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার শক্তি যে আমার ছিলোনা; তা আমি ঢের বুঝতে পেরেছিলাম সাথে এটাও বুঝতে পেরেছিলাম কারো হাত ধরে অনেকটা পথ একসাথে পাড়ি দেওয়ার পর সেই হাত অকস্মাৎ ছুটে গেলে সেখান থেকে একা আর পিছনেও ফিরবার শক্তিও আমার নেই। তাই নানা ইঙ্গিত আর প্রস্তাবনা পেলেও আমি তার থেকে দূরে থেকেছি সর্বদা। এভাবেই আমার কলেজ ও ভার্সিটি লাইফ শেষ হয়েছে।
কিন্তু বিপত্তি বাঁধল এসে বুড়ো বয়সে। মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ এর মধ্যে শুরু হলো লকডাউনের সাথে বন্দী জীবন। দিনমান আতঙ্ক আর জেলখানার কয়েদিদের মতো কাটাতে হচ্ছে সময়। সেইসময় একদিন আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে কথা হচ্ছিলো, আমার দিন কাটে তো রাত কাটেনা টাইপ অবস্থা দেখে সে বললো, চাইলে তুই একজনের সাথে কথা বলে সময় পাড় করতে পারিস। আমার খুব পরিচিত এবং আমার মনে হয় তোরা ভালো থাকবি। ওর চিন্তাচেতনাও তোর মতো এবং মাঝেমধ্যে আমার এটাও মনে হয় তোরা একে অন্যের জন্যে পারফেক্ট। আমি এর আগেও তোকে বলতে চেয়েছি কিন্তু তোর আগ্রহ নেই বলে বলা হয়নি। আমি ফেসবুক আইডি দিচ্ছি কথা বলে দেখ কেমন লাগে। সে ম্যাসেঞ্জারে আইডি লিংক দিলো, লিংক ওপেন করে দেখি এমা! সেতো আমার লিস্টে আগে থেকেই আছে, ভাবলাম একটা টেক্সট করি, টেক্সট করতে গিয়ে আরেক ধাক্কা খেলাম; দেখছি বছর তিনেক আগে সে আমাকে, কেমন আছেন লিখে টেক্সট করে রেখেছে তার উত্তর করা হয়নি। টেক্সটের রিপ্লাই দিলাম, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন? কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে উত্তর এলো, এতো বছর পর আপনার সময় হলো টেক্সট এর উত্তর দেওয়ার? আমি একটু রসিকতা করে উত্তর দিলাম, সময় কে সুন্দর করে তুলতে ব্যস্ততাকে ছুটি দিলাম। ওপাশ থেকে উত্তর এলো, আরোও আগে ব্যস্ততাকে ছুটি দিলে বিগত বছর গুলোতেও হয়তো আমরা সুন্দর কিছু সময়ের অংশীদার হতাম।
কিছুদিন চ্যাটিং এর পরে নাম্বার আদান-প্রদান হলো, তারপর শিডিউল মেনে ননস্টপ যাত্রা শুরু করলো আমাদের কথার রেলগাড়ি। নিজেদের কথা, পরিবারের কথা, ভালোলাগা-মন্দলাগার কথা, মন খারাপের কথা, মন ভালোর কথা সহ দুনিয়ার এমন কোনো কথা নেই যা আমাদের কথার টপিকে থাকতো না। একে অন্যের মাথায় বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া, খাবার খাইয়ে দেওয়া, একে অন্যের সেই লেভেলের কেয়ার নেওয়া, এসব কিছুই ফোনকলে হতো। এমন অবস্থা হয়েছিলো একটা সময়, সে আমার একটা হাঁচির শব্দ শুনলেও তার হার্ট অ্যাটাক হবার যোগড় হতো। আমার অসুস্থতায় দিনরাত এক করে খবর রাখতো, সুস্থ না হওয়া অবধী আমার চিন্তায় বিচলিত হয়ে থাকতো।
খুব ভালোই সময় পাড় করছিলাম আমরা, এরপর লকডাউনের অবসান হলো। আমরা আমাদের ব্যস্তময় জীবনে পা রাখতে শুরু করলাম। এরপর থেকেই সবকিছু কেমন যেনো পালটে যেতে শুরু করলো। সে আর আগের মতো টেক্সট করেনা, কলও দেয় না। আমিই নিজ থেকে টেক্সট করি, কল করি , কথা বলি। আমি বুঝতে পারছিলাম তার আগ্রহ কমে গেছে আমার প্রতি; তবুও মন কে পজিটিভ কিছু বুঝিয়ে টাচে থাকার ট্রাই করতাম। এসবের মধ্যেই তার একটা প্রাইভেট ব্যাংকে জব হলো, তখন থেকে তার প্রায় লাপাত্তা হবার অবস্থা। আমিও নিজ থেকে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম। তার পরিবর্তনে দিনমান ভেতরে যে করুণ সুর বাজছিলো তা আর দীর্ঘায়ীত করতে চাইনি আসলে। তাকে আমি তার মতো ছেড়ে দিলাম, সেও নিরুদ্দেশ হলো।
এখনো আমার শরীর জুড়ে ব্যামোদের মেলা বসে, এখনো বিষাদে আমার মনের আকাশ কালো গম্ভীর হয়; কিন্তু বছর পেরুলেও তার আর কোনো খবর পাওয়া যায় না। যে মানুষ টার আমার হাঁচির শব্দে হার্ট অ্যাটাক হবার জোগাড় হতো, সে এখন আমি অসুস্থ হয়ে দিনের পর দিন বিছানায় পড়ে থাকলেও টের পায় না। এইতো কয়েকদিন আগে আমি জ্বরে টানা ১০ দিনের মতো বিছানায় পড়েছিলাম। এরমধ্যে একদিন সকালবেলা দেখি রাতে সেই মানুষটি আমাকে বার কয়েক কল করেছিলেন কিন্তু জ্বরের ঘোরে টের পাইনি। আমি কল ব্যাক দিলাম, কল রিসিভ হবার পর রাতে কল রিসিভ না করার কারণ জানতে চাইলে, বললাম আমার জ্বর ছিলো ১০৪ তাই বুঝতে পারিনি। এই কথা শুনে সে জাস্ট ওহ টাইপের উচ্চারণ করলেন, যেনো আমার তেমন কিছুই হয়নি। টুকটাক কথা হবার পর ফোন রেখে দিলাম। এরপর আর সে একটি বারের জন্যেও কল করে আমার খব নেয়নি যে আমরা অবস্থা কেমন, বা আমি সুস্থ হয়েছি কিনা। আমর ভাবতে ভীষণ অবাক লাগে এই মানুষটাই কী আমার জন্য এতো ব্যাকুল ছিলো নাকি অন্য কেউ? এর উত্তর আমার কাছে নেই। তবে যে উত্তর টা আমার কাছে আছে তা হলো ঘোর কেটে গেলে সব কেটে যায়। আমি এই ঘোর কে ভয় করি, আমি এই ঘোর কে ঘৃণাও করি।
তার পরিবর্তনে প্রথম প্রথম অনেক যন্ত্রণা হয়েছে আমার, বিষাদের পেয়ালায় ডুবিয়ে রাতের ঘুমেরাও পালিয়েছিলো আমাকে রেখে। ক্ষণে ক্ষণে তার তার জন্য বুকের বাঁপাশে টাটিয়ে উঠতো, ব্যথায় আমি কুঁকড়ে যেতে থাকতাম কিন্তু তার সাথে আর যোগাযোগ করিনি ইভেন আমি চাইওনি সে আবার আমাকে ধ্বংস করেতে ফিরে আসুক। আমি এখন ঢের ভালো আছি, দিনে বারকয়েক নিজের প্রেমে পড়ি, নিজেতে মুগ্ধ হই; আর আত্মিক প্রশান্তি পাই।
ছবিঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০২৩ বিকাল ৩:১২