somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবাকে মনে পড়ে!

০৫ ই অক্টোবর, ২০০৬ দুপুর ২:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জীবনের তেত্রিশটি বছর যে বাবা ছিলেন সার্বক্ষণিক আশীর্বাদের সেই বাবাকে নিয়ে কতোটুকু লেখা যায়! মা-বাবাকে নিয়ে লেখার কী শেষ আছে? পৃথিবীর তাবৎ সমুদ্রের পানি কালি করে লিখলেও কী শেষ হবে তাঁদের ঋণের কথা? প্রতি বছর এই সময়টাতে বাবাকে মনে পড়ে বেশি। অক্টোবর 6, বাবার মৃত্যুদিবস। মৃত্যুদিবসে আমরা ভাইবোনেরা আসলে তেমন কিছুই করি না। বাবার জন্য একমাত্র দোয়া-দরুদই সম্বল। কেউ নিরবে নিভৃতে চোখের পানিও ফেলেন। যেমন আমি নিজে। যে ঘটনার জন্য আমার চোখে বেশি পানি আসে তার কথাই বলবো আজ।

আমার বাবা তেমন শিক্ষিত ছিলেন না। প্রাইমারির দোরগোড়া পেরিয়েছিলেন হয়তো। কৃষিই মূলত পেশা ছিলো বাবার। ভালো আরবি পড়তে পারতেন তিনি। বাংলায় চিঠি, হিসাব রাখা, বই পড়ার সামর্থ্যও ছিলো বেশ ভালো। বাবার হাতের লেখা খুব আবছা মনে পড়ে। হঁ্যা, ভালোই তো ছিলো। শেষ জীবনে বাবা গ্রামের মসজিদের ইমামতি করতেন। সে তুলনায় আমরা ভাইবোনেরা তেমন ধর্ম-কর্ম করিই না বলতে গেলে।

আমার বাবা একটাই বড়ো কাজ করে গেছেন। আমাদের সব ভাইবোনদের ভালোমতো মানুষ করেছেন। আমার বোনদের ভালো বিয়েও দিয়েছেন। সহায়-সম্পত্তি বলতে যা ছিলো তা আমাদের জন্য খুইয়েছেন। সে বিষয়ে আমাদের ভাইবোনদের কারো কোনো আফসোস নেই। কারণ জীবন চলার পথে আমাদের মেধাকে তিনি উত্তোরণ ঘটিয়েছেন প্রচন্ডভাবে। সেটাই আমাদের সবার বড়ো সম্পত্তি। আর সেজন্যই আমরা সবাই লেখাপড়া জানা এবং চাকুরীজীবি।

আজ একটি ঘটনায় স্মরণ করবো আমার মরহুম বাবাকে। 1974 সালের কথা। সারা দেশে দুর্ভিক্ষের ঝড় বয়ে গেছে। আমারাও বাদ যাইনি। তবু বাবা লেখাপড়া থামিয়ে দেননি কারোই। আমি প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েছি থানা সদরে। সাথে আছেন আমার বাবা। প্রথমদিন সকালে বাংলা পরীক্ষা। মানুষের প্রচন্ড ভীড়। মনে পড়ে- রচনা কমন পড়েনি কারো। 'লঙ্গরখানা' নিয়েও একটি রচনা এসেছিলো। আমি লিখেছিলাম 'আদর্শ গ্রাম'। পরীক্ষার আগে পড়েছিলাম 'আমাদের গ্রাম'। সেখান থেকেই একটু বুদ্ধি খাটিয়ে লিখেছিলাম 'আদর্শ গ্রাম'।

পরীক্ষা প্রায় শেষ। বাইরের মানুষের চাপ বাড়ছে হলের দিকে। তাছাড়া আমার মাথার উপর পেছনে কেউ না কেউ এসে দাঁড়িয়ে থাকছে। এক শিক্ষক আরেক শিক্ষককে বলছে। এক পুলিশ আরেক পুলিশকে বলছে। সবাই একবার এসে আমার খাতা দেখার চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে একটু ভয়, একটু অস্বস্তিও কাজ করছে মনে। তবে পওে আর কিছুই মনে হয়নি। কারণ তারা আমার হাতের লেখা এবং কী লিখি সেটাই দেখছে। আর অন্যের কাছে প্রশংসার বাণী ঢেলে তাকেও উদ্বুদ্ধ করছে আমার কাছে আসতে।

যাই হোক, প্রায় শেষ করে ফেলেছি 'আদর্শ গ্রাম'। ভীড় ঠেলে বাইরের মানুষ ছুটে আসছে ভেতরের দিকে। হলের শিক্ষকেরা, গার্ডরাও পড়ে গেছেন বেকায়দায়। তখনও মিনিট পাঁচেক বাকি। আমিও গুছিয়ে এনেছি- সব দিক দিয়ে দেখতে গেলে আমাদের গ্রাম একটি আদর্শ গ্রাম। এক শিক্ষক এসে ছোঁ মেরে আমার খাতা নিয়ে গেলো। অন্যান্যদের খাতাও নেয়া শেষ। যে শিক্ষক আমার খাতা নিলেন তাকে শুধু বললাম- স্যার আমার খাতা কিন্তু স্ট্যাবলার করা হয়নি। শিক্ষক বললেন- ঠিক আছে করবো।

একটু পরে দেখি আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক এসে হাজির। উনাকে আমার খাতা স্ট্যাবলারের কথাটা আবার বললাম। উনি সামনে গিয়ে নিশ্চিত হয়ে এলেন। কীভাবে হঠাৎ বাবা চলে এসেছেন বুঝতে পারিনি। সেই বুড়ো বয়সেও বাবার গায়ে তাহলে বেশ শক্তিই ছিলো! না হলে এতো ভীড় ঠেলে এলেন কীভাবে বাবা? কখন তাঁর কোলে উঠে গেছি বুঝতেই পারিনি। বাবা আমাকে ভীড়ের মধ্যে কোলে করে হল থেকে বেরুচ্ছেন। আমার বেশ শরম শরম লাগছে। যদিও হলের অন্যান্য সব ছাত্রদের চেয়ে বয়সে, সাইজে বেশ ছোটোই ছিলাম। আবার বেশ আনন্দও লাগছিলো। কারণ একটু বড়ো হয়ে জ্ঞান হবার পর ওটাই ছিলো আমার প্রথম এবং শেষ বাবার কোলে ওঠা।

আজ বাবাকে মনে পড়ছে। মনে পড়ছে ঐ কোলো ওঠার দৃশ্যের কথা। ভীষণ দুষ্টু ছিলাম ছোটোকালে। কবুতরের খোপে ডিম-বাচ্চা দেখা, চড়ুই পাখি-ঘুঘুর বাসা থেকে বাচ্চা এনে খাঁচায় পালন, বেশ উঁচু গাছে ওঠা-ফল পাড়া, রাগের মাথায় লাউ গাছ গোড়া থেকে কেটে ফেলা- এসবের জন্য কতো মারই না খেয়েছি বাবার হাতে। তবু বাবাই আমার আদর্শ। মাঝে মাঝে মা'র কাছেই বলি বাবার নানান প্রশংসার কথা।

আমি সেবার প্রাথমিক বৃত্তি পেয়েছিলাম। তখন উপজেলাভিত্তিক টেলেন্টপুল বা মেধা তালিকা ছিলো না। ছিলো জেলাভিত্তিক তালিকা। আমি হয়েছিলাম সমস্ত টাঙ্গাইল জেলায় মেধা তালিকায় প্রথম। শিক্ষাজীবনের সাফল্যগুলো যতোবারই মনে হয় ততোবারই মনে পড়ে প্রিয় বাবার কথা। আজ এই দিনে একটাই কথা বলতে ইচ্ছে করছে শুধু- বাবা তুমি যেন জান্নাতবাসী হও, অনেক অনেক ভালো থেকো পরপারে!

06.10.2006
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০০৬ বিকাল ৩:০১
১৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:১৫

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

ছবি, এআই জেনারেটেড।

ইহা আর মানিয়া নেওয়া যাইতেছে না। একের পর এক মামলায় তাহাকে সাজা দেওয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

এমন রাজনীতি কে কবে দেখেছে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২০


জেনজিরা আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামল দেখেছে। মোটামুটি বীতশ্রদ্ধ তারা। হওয়াটাও স্বাভাবিক। এক দল আর কত? টানা ১৬ বছর এক জিনিস দেখতে কার ভালো লাগে? ভালো জিনিসও একসময় বিরক্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের কবিতাঃ আমি বীরাঙ্গনা বলছি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১৫


এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে আমার অত্যাচারিত সারা শরীরে।
এখনো চামড়া পোড়া কটু গন্ধের ক্ষতে মাছিরা বসে মাঝে মাঝে।

এখনো চামড়ার বেল্টের বিভৎস কারুকাজ খচিত দাগ
আমার তীব্র কষ্টের দিনগুলোর কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন নারী শিক্ষিকা কীভাবে কন্যা শিশুর সবচেয়ে অসহায় মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করতে পারেন?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৩


বাংলাদেশে মাঝে মাঝে এমন সব মানুষ রূপী শয়তানের সন্ধান মেলে যাদের দেখে আসল শয়তানেরও নিজের উপর হতাশ হওয়ার কথা। এমন সব প্রজাতির মানুষ বাংলাদেশে বসবাস করেন যাদের মস্তিষ্ক খুলে দেখার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মানুষ মানুষকে কীভাবে এত অপদস্ত করে এই ব্লগে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৪

আমি তো কারও সাতেও নাই পাঁচেও নাই। এত সময়ও নাই মানুষকে ঘাঁটার। ব্লগের ব্লগারদের সম্পর্কেও তেমন কিছু জানি না। তবে পোস্ট পড়ে কিছুটা আন্দাজ করা যায় -কে কী রকম। আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×