সেই ক্লাস থ্রিতে থাকতে সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে যখন প্রথম পড়েছিলাম, বাংলাদেশের একমাত্র মানসিক হাসপাতাল পাবনায় অবস্থিত- তখন থেকেই আমার খুব শখ মানসিক হাসপাতাল ভিজিট করা। অবশেষে ২০১৯ সালের মার্চে পাবনায় একদিনের আন্তর্জাতিক দাবা টুর্নামেন্ট খেলতে গেলে আমার সেই ইচ্ছেপূরণের সুযোগ আসে। শুধু মানসিক হাসপাতালই নয় বরং সুচিত্রাসেনের পৈত্রিক বাড়ি ও স্মৃতি সংগ্রহশালা, শ্রী শ্রী অনুকূল চন্দ্র আশ্রমকেন্দ্র, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ,এক পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ি, অদ্ভুত সুন্দর ইন্টেরিয়রের এক রিডিং ক্যাফে- আমার ধারণাই ছিল না পাবনা শহরে এরকম দুর্দান্ত রিডিং ক্যাফে থাকতে পারে এবং আমার হোটেলের পাশেই পাবনা শহরের একমাত্র সিনেমা হলে লেট নাইট শোতে পুরো হলে মাত্র ১৫-১৬ জন দর্শকের সাথে সামনের সিটে পা তুলে দিয়ে চিপস খেতে খেতে একা একা তাহসান, শ্রাবন্তী, তাসকিনের মুভি দেখা সব মিলিয়ে অস্থির একটা সলো ট্রিপ হয়েছিল সেই পাবনা ট্যুর! যদিও আমার আব্বাজান যদি জানত, তার একমাত্র ছেলে রাত বারোটায় অচেনা শহরে একা একা মুভি দেখে হোটেলে ফিরেছে তাহলে আবারও অভিমান করে কিছুদিন কথা না বলার ছেলেমানুষি করত বলেই আমার ধারণা!
ভার্সিটির এক ছোট ভাইয়ের কল্যানে পাবনা মানসিক হাসপাতালে কর্মরত আনসারের এক সদস্য আমাকে পুরো হাসপাতাল ঘুরিয়ে দেখান আর পুরুষদের বেশ কয়েকটি কেবিনে রোগীদের সাথে কথা বলা ব্যবস্থা করে দেন। বেশীরভাগ মানসিক রোগীই স্বাভাবিক আচরণ করেছিল, অনেকেরই ধারণা তারা সুস্থ হয়ে গেছেন কিন্তু পরিবারের সদস্যরা এখন আর তাদের ফিরিয়ে নিতে চায়না, কাউকে কাউকে নাকি আবার এখানে পাঠিয়ে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছে আপন মানুষেরাই ষড়যন্ত্র করে! কেউ কেউ কাছে যেতেই কবিতা আবৃত্তি শুরু করে আবার কেউবা শুরু করে সুন্দর কন্ঠে মন উদাস করা গান... একজনের সেরকমই এক উদাস করা গান শুনে বললাম, ভাই আপনি এখানে কেন?
কাহিনী খুব মর্মান্তিক, তার প্রেমিকার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল কিন্তু সেই কিশোরী প্রেমিকা তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে না তাই প্রেমিকাকে নিয়ে বাইকে করে পালাতে গিয়ে হাইওয়েতে এক্সিডেন্ট আর প্রেমিকার মাথায় হেলমেট না থাকায় মুহূর্তেই নাকি মাথার মগজ বের হয়ে রাস্তায় পড়েছিল! চোখের সামনে প্রিয় মানুষের এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে সেই অভাগা প্রেমিক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এখন মানসিক হাসপাতালে!
আহারে প্রেম! আহারে ভালবাসা!!
মানসিক হাসপাতালের মতোই অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল ভার্সিটি লাইফের একদম শুরুতে যেদিন প্রথম আলোর একটি ইভেন্টে জাবি বন্ধুসভার সদস্য হিসেবে একদল এসিডদগ্ধা নারীদের সাথে স্মৃতিসৌধ ভ্রমণ করতে যাই। এসিডদগ্ধাদের সাথে কাটানো সেই বিকেলের কথা আমি প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম কিন্তু সম্প্রতি বিশ শব্দের গল্প গ্রুপে আমার এসিড সন্ত্রাস নিয়ে গল্পে অনেক রিএক্ট কমেন্টের ভীড়ে একজনের কমেন্ট ছিল, এখন এসিড সন্ত্রাস অনেক কমেছে...ভেবে দেখলাম আসলেইতো... সেই কমেন্টের রিপ্লাই দিতে গিয়ে আমার হুট করে এসিডদগ্ধাদের সাথে কাটানো সেই অদ্ভুত বিকেলটির কথা মনে পড়ে গেল। সেদিনের প্রতিটি মেয়ের মুখায়ব যেন ছিল দু:খিনী বাংলা মায়ের বাস্তব করুণ প্রতিচ্ছবি! বেশীরভাগ এসিডদগ্ধাদের করুন কাহিনীর পেছনে ছিল প্রেমঘটিত ব্রেকাপ কিংবা প্রেমের প্রস্তাবে রাজী না হওয়া!
আহারে প্রেম! আহারে ভালবাসা!!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০২১ দুপুর ১২:১১