ঘুরে বেড়ানো নেশার মত। দিগ্বিদিক ছুটে চলা, আর ঘর ছেড়ে বের হওয়া মানে যেন কোন পিছুটান নেই। একত্রিশ বছর বয়সি হেন্স রাশান এর কি সত্যিই কোন পিছুটান নেই! ঘুরে বেড়ানোর সখটা তার সেই ছেলেবেলা থেকেই। আর হেন্স এর প্রিয় বাহন সাইকেল। সেই বাহনকে সঙ্গী করেই পণ করলো পৃথিবী ভ্রমণে বের হবে। এগার বছর একটি বিছানা তৈরির কোম্পানীতে কাজ করে তারপরে সত্যি সত্যি পৃথিবী জয়ের নেশায় বের হয়ে পড়লেন নিজের দেশ অস্ট্রিয়া থেকে। আর ঘুরতে ঘুরতে চলেও এলেন এই সবুজের দেশে। কি অবিশ্বাস্য তাই না!
অস্ট্রিয়া থেকে সাইকেলে চড়ে আঠারোটি দেশ ঘুরে হেন্স পৌঁছেছে নদীর দেশ এই বাংলাদেশে। তার সাথে দেখা হবার পরই রোমাঞ্ছের গন্ধ শুকতে শুরূ করলাম। বললাম, “ এমন বুদ্ধি তোমাকে কে দিল, মানে অনুপ্রেরনা কোথা থেকে পেলে?” হেন্স হেসে বলল, “আমি নিজেই আমার অনুপ্রেরণা”। বাংলাদেশে সে প্রবেশ করেছে ভারতের চেংড়াবান্দা বর্ডার দিয়ে। তারপর সাইকেল চড়ে উত্তরবঙ্গের রাস-া মাড়িয়ে ঢাকায় এসেছে। পৃথিবীতে এমন পাগলামী অনেকেই করেছে। লোকে তাদেরকে পাগল বলেছে কিন-ু আসলে যে অভিজ্ঞতা তারা অর্জন করেছে তা কারো সমকক্ষ নয়। আমরা রামনাথ বিশ্বাসের কথা জানি, যিনি ১৯৫৩ সালে সাইকেলে চড়ে বিশ্ব ভ্রমণে বের হয়েছিলেন। আর এ যুগে আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বলও আছেন যিনি সাইকেল নিয়ে পাড়ি দিয়েছে পৃথিবীর অর্ধেক দেশ। হেন্সকে দেখে তাই অবাক হইনি বরং তার মতো ঘুরে বেড়াতে উৎসাহ পেয়েছি। হেন্স তার সাইকেলে এ পর্যন- আসতে পাড়ি দিয়েছে ১৩০০০কিলোমিটার পথ। তার সাইকেলে লাগানো ছোট্ট একটা যন্ত্রই তাকে এত হিসেব করে দিয়েছে। পথে পথে নানা অভিজ্ঞতার ঘটনা তার নিত্তনৈমিত্তিক তাই বিশেষ করে সে কোন ঘটনাকে দেখে না। একেক দেশের মানুষ একেক রকম, বিচিত্র তার আচার আচরন, সংস্কৃতি। সবকিছুই তাকে আনন্দ দিয়েছে আবার এর মাঝে বেদনারও ছিটেফোটা ছিল। বাংলাদেশ কেমন লেগেছে জানতে চাইলে হেন্স বলল, ‘এদেশের মানুষেরা অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ সরল আর আন-ারিক’। মজার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বলেন, ‘রাস-া দিয়ে যখন আমি সাইকেল চালিয়ে আসছিলাম, পথে যেখানেই আমি থেমেছি মনে হয়েছে যেন আমি একজন পপস্টার, কারন আমাকে ঘিরে রেখেছিল প্রায় দুইশত লোকজন। সবাই শুধু আমাকে দেখছিল, বেশ আনন্দ পেয়েছি তখন।’ হেন্স তার দেশ অস্ট্রিয়া থেকে বিশ্ব ভ্রমণের যাত্রা শুরূ করেছে এবছরের মার্চ মাস থেকে। এগার বছর চাকরি করার পরে সে চাকরিটা ছেড়েই দিল, আর জমানো টাকা নিয়েই বেড়িয়ে পড়ল বিশ্ব দেখতে। হেন্স সাইকেল চালায় সেই এগর বছর বয়স থেকে। একটু বড় হলে সাইকেল রেইসে সে নিজের নাম লেখায়, আর পুরষ্কারও পেতে থাকে একে একে। কিন-ু সাইকেল দৌড়ে জিততে হলে প্রচুর শক্তি দরকার তাই সবাই প্রথম হতে নানা ধরনের শক্তি বর্ধক ঔষধ ব্যবহার করা শুরু করে, যা শরীরের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর। হেন্স তাই ঠিক করলো সে এমন ঔষধ ব্যবহার করে আর রেইস খেলবে না। তাই ছেড়েই দিল প্রতিযোগীতা। তখন তার বয়স ২০বছর। ‘এরপর নিজে নিজেই সাইকেল চালিয়েছি, আর রেইসে যাই নি’ বলল হেন্স। সাইকেলের এ যাত্রায় সে কত না নতুন দেশ দেখেছে, বিচিত্র সব সৌন্দর্যে ভরা একেকটি দেশ, যেন পুরো ওয়াল্ড ম্যাপটাই তার হাতের মুঠোয়। কোন কোন দেশ ঘুরে আমাদের দেশে এসেছে জিজ্ঞেস করতেই একে একে সবকিছু দেখিয়ে দিল ম্যাপে। পুরো ম্যাপ যেন তার মুখস'। অস্ট্রিয়া থেকে প্রথমে যাত্রা শুরূ হয়েছে স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েসিয়া, বোসনিয়া, মোনটানেগরো, সারভিয়া, কোসোভো, মাসেরোনিয়া, গ্রিস, তুর্কি, জর্জিয়া, আমিনিয়া, ইরান, সিরিয়া, লেবানন, সাইপ্রাস তারপর আবার তার্কি ফিরে গিয়ে সেখান থেকে উড়োজাহাজে করে সাইকেল সমেত নিউ দিল্লী এরপর আবার চালানো শুরূ হলো দিল্লী থেকে নেপাল হয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে হেন্স এক মাস থেকেছে, এর মধ্যে ঘুরে এসেছে সেন্টমার্টিন, বরিশাল, মানিকগঞ্জ আর ঢাকার অলিগলিতে। হেন্স সবমিলিয়ে ৫০টি দেশ ঘুরে বেড়াবে বলে পরিকল্পনা করেছে। বাংলাদেশ থেকে সে যাবে আবার উড়োজাহাজে করে থাইল্যান্ড, এরপর কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, তারপর আবার ফিরে যাবে থাইল্যান্ড সেখান থেকে মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুর থেকে নৌপথে যাবে ইন্দোনেশিয়া, সেখান থেকে মালয়শিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার অংশ বোনিয়া এরপর ব্রুনাই। ব্রুনাই থেকে আবার নদীপথে ইশতিমোর। সেখান থেকে আবার নদীপথে ইন্দোনেশিয়ার জায়াপুরা হয়ে পাপুয়া নিউগিনি আবার নদীপথে ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপ। সেখান থেকে উড়োজাহাজে করে তুর্কির ইস-াম্বুল শহরে। যাত্রা হবে ইজিপ্ট, জর্দান, সিরিয়া, হয়ে তুর্কি। এরপর আবার সাইকেলে করে গ্রিস, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, মলদাভিয়া, ইউক্রেইন, বেলারূশ, লিথুয়ানিয়া, লাথভিয়া, ইসতোনিয়া, ফিনল্যান্ড। ফিনল্যান্ড থেকে নদীপথে জার্মানি, সেখান থেকে সাইকেল চালিয়ে নিজের দেশ আস্ট্রিয়াতে। যেখানে হেন্সের জন্য অপেক্ষা করছে তার ষাট উর্ধ্ব বাবা-মা এবং দুই ভাই। হেন্সকে জিজ্ঞেস করলাম ‘তোমার এতগুলো দেশ ঘোরার উদ্দেশ্য কি?’ উওরে বলল, ‘আমি পৃথিবীটাকে দেখতে চাই, এ পৃথিবীর নানা জাতের নানা মানুষ দেখতে চাই।’
বাংলাদেশে তার স্মরনীয় ঘটনা ঘটেছে পুলিশের সাথে। উওরবঙ্গ থেকে সাইকেলে ফেরার পথে তাকে যমুনা সেতু পার হতে হবে, কিন-ু সাইকেল চালিয়েতো সেতু পার হওয়া যাবে না, পুলিশ আটকে দিল হেন্সকে সাইকেল সমেত। আনেক উৎসুক নজরে তার দিকে তাকালো, খোজখবর নিল তারপর হেন্সকে অনেক খতির করে পুলিশের গাড়িতে চড়িয়ে সেতু পার করে দিল। পুলিশ কোন টাকাও চায়নি বরং তাদের খাবার থেকে হেন্সকে খাওয়াতে চাইল। তারদেশেতো এমন ব্যপার সত্যিই অদ্ভুত। উল্টো জরিমানা আদায় করতো পুলিশ। আরেকবার হেন্স সাইকেল চালাচ্ছিল তুরস্কের কোন পথে, সেখানে ছোট ছোট বাচ্চারা তাকে দেখেই পাথর মারতে শুরু করলো। বেশ রাগ হয়েছিল তখন তার, আর অমনি একটাকে ধরে দিল এক কিল বসিয়ে। বাচ্চাটা কাঁদতেই তার বাবা-মা ঘর থেকে বের হয়ে হেন্সকে বকতে শুরু করলো।
কোচ সার্ফিং নামে একটি ওয়েবসাইট আছে যার মাধ্যমে এ ধরনের পরিব্রাজকদের সহযোগীতা করা হয়। হেন্সকে তাই এসব দেশগুলোতে থাকা খাওয়ার জন্য তেমন কোন অসুবিধা হয়নি। তবে একবার ইরানে সে বিপদে পড়েছিল। ইরানে যার বাসায় ছিল সেই লোকটি তাকে এক আর্মি এলাকায় নিয়ে যায়। হেন্সকে আর্মিরা সন্দেহ করলো কোন গুপ্তচর হিসেবে আর অনুসন্ধান করা শুরূ করলো। অনেক সময় আটকে রাখলো হেন্সকে আর্মিরা। বাংলাদেশে হেন্স উঠেছে আরেক পর্যটক মুনতাসির মামুন ইমরানের বাসায়। হেন্স ঢাকার ম্যাপ সাথে রাখতো, মনে হয় তার সব জায়গায়ই চেনা পরিচিত। বাংলাদেশ তার অনেক পছন্দ হয়েছে, আবার সুযোগ পেলে হেন্স এ দেশে আসবে বলে জানায়। আগামী বছর আগস্ট এ গিয়ে তার এই বিশ্ব ভ্রমণ শেষ হবে। এরপর পরিকল্পনা করে রেখেছে দশ বছর পর আবারও বিশ্ব ভ্রমণে বের হবে যে দেশগুলো দেখা বাকি আছে তা দেখে ফিরবে। এমন সাহসী অভিযানের পেছনে রয়েছে মূলত প্রবল ইচ্ছা। হেন্স আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে সবসবময়।