আমি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্র। যাকে আমি সবসময় চৌবাচ্চা বলেছি। চৌবাচ্চা বলার পেছনে কারনও আছে- আমাদের নিজস্ব কোন মাঠ নেই, বড় পরিসরে কিছু করার মত জায়গা নেই, মুরুগীর খাচার মত কয়েকটা বির্ল্ডিং সেখানে সময়মত ব্যাংকে টাকা ভর আর পড়তে থাকো এরপর ভাগো। সবাই যেন একেকটি রোবট। একসময় একটা দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির হালচাল নিয়ে কলামও লিখেছিলাম। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর কোথাও ভর্তির সুযোগ না পেয়ে এক প্রকার বাধ্য হয়েই আমার অতীত ইউনিভার্সিটি AIUB (American International University Bangladesh) - এ ভর্তি হয়ে যাই। ক্লাস শুরূ করার পর আশপাশের ছেলে-মেয়েদের মনে হল এরা সবাই যন্ত্রের মত ছুটছে ত ছুটছেই। কিন্তু এরা কিসের পিছনে ছুটছে তা তারা মনে হয় নিজেও জানে না। পোড়াশোনার পাশাপাশি শিল্প-সংস্কৃতির সাথে সম্পর্ক তৈরির ব্যাপারে সবসময়ই একটা তাড়না বোধ করতাম। ছবি তোলার সখ জেগেছিল কলেজে পড়ার সময় থেকেই। তখন ফিল্প ক্যামেরা ব্যবহার করতাম। হিসেব্ করে ছবি তুলি। ভাল-খারাপ মিলিয়ে ছবি তুলে যাই। পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ তৈরি হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ হওয়ার পর থেকেই। পত্রিকার পাতায় নিজের ছবি ছাপা হলে আনন্দে মনটা ভরে উঠতো। আলোকচিত্রের সাথে ধীরে ধীরে একটা সখ্যতা গড়ে উঠে আর সাথে সাথে ঘুরে বেড়েনোর নেশাটাও চেপে বসে। নানা জায়গায় ঘুরে ফিরে প্রদর্শনী দেখি। বিশেষ করে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির photography club এর প্রদর্শনীগুলো ঘৃরে দেখতাম আর সেগুলোর থোজখবরগুলো পত্রিকার পাতায় তুলে ধরতাম। পরবর্তিতে আমাকে আর প্রদর্শনী খুজতে হত না বরং প্রদর্শনী আমাকে ডাকতো। ২০০৫ এর কথা, তখন Dhaka Uni, North-south Uni, Brac Uni, East-west Uni গুলো আলোকচিত্র চর্চাতে বেশ এগিয়েছে বলা চলে। অনেক প্রদর্শনীর আয়োজনও করেছে। আমার মনেও একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল যে আমার ইউনিভার্সিটিতে এমন আয়েজন হয় না কেন? আমাদের মধ্যে কি ছবি তুলতে পছন্দ করে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না! খোঁজ নিয়ে জানলাম আমাদের ইউনিভার্সিটিতে এমন কোন ক্লাব নেই। তখন রাহাতের সাখে আমার পরিচয় হয়, আমার মনের কথাটা তাকে জানাতেই সে আমাকে উৎসাহ দেয়। রাহাতের সাথে অফিসিয়ালদের বেশ খাতির ছিল। সে আমার কিছু ছবি নিয়ে তাদের দেখায় এবং কিভাবে যেন রাজি করিয়ে একটা ফটোগ্রাফি ক্লাব করার জন্য অনুমতি নিয়ে ফেলে। আমরা মহা আনন্দে একদিন আমাদের স্টাডি রূমে ছোট আকারে ইউনিভার্সিটির একটা ইভেন্টের ছবি আর আমার কিছু ছবি দিয়ে স্টুডেন্টদের জন্য একটা প্রদর্শনী করি। সবাই ছবিতে নিজের চেহারা দেখে খুশি হয় আর জানতে পারে AIUBPC নামে আমাদেরও একটা Photography club আছে। তখন থেকেই মূলত স্বপ্ন দেখতে শুরূ করি আমাদের এ ক্লাব থেকেই একসময় অন্যদের থেকে ভাল একটা আলোকচিত্র প্রদর্শনী হবে। আমাদের সাথে তখন আরো কয়েকজন সতীর্থরা যোগ দিয়েছিল। একটা বেসিক ওয়ার্কশপেরও আয়োজন করেছিলাম। তখন তেমন কারো কাছেই DSLR Camera ছিল না। এরপর অনেকদিন কেটে গেল, আবার পরীক্ষা, এসাইনমেন্ট এ সবাই বুদ হলো। কাউকে খুঁজে পেলাম না। আমিও ব্যর্থ মনোরথে হতাশ হয়ে অন্যপথে হাটা শুরূ করলাম। নামে মাত্র ক্লাবটা রয়ে গেল। চেষ্টা গুটি কয়েকবার করেছিলাম কিন্তু একা আর বেশিদূর এগুতে পারি নি।
দিন যেতে থাকলো আর আমার সময়ও শেষ হয়ে আসলো। এরপর একদিন ২০১১ সালে হঠাৎ একদিন দ্রিক এ গিয়ে আবিষ্কার করলাম একটা প্রদশনী চলছে। আর তার আয়োজন করেছে আমার ইউনিভার্সিটির জুনিয়ররা। মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল, তোমরা আমার স্বপ্নটা পূরণ করেছো, তোমাদের কাছে আমি ঋণি। আমি পারিনি কিন্তু তোমরা সবাই পেরেছো। প্রদর্শনীর বইতে লিখেছিলাম মনের ব্যথিত কথাগুলি। দ্বীপ এর দায়িত্ব নিয়েছিল, তাকে ডেকে ধন্যবাদ দিতে গি্য়ে ধরা পড়ে গেলাম। সবচেয়ে ভাল লেগেছে তারা আমায় অবগ্যা করেনি, ধিক্কার দেয়নি, তারা আমাকে সন্মান দিয়েছে।
গত ৩০সেপ্টেম্বর ছিল এর দ্বিতীয় প্রদর্শনীর শেষ দিন। এবার এর আয়োজনের সাথে ছিল- অমিত, তারিকুল, উইলসন, ফাহিম, ফয়সাল সহ অনেকেই। তারা অনেক আগে থেকেই আমার সাথে যোগাযোগ করলো, ছবি পাঠাতে বলল। আমি স্বাচ্ছন্দে তাদের ডাকে সাড়া দিলাম এবং বিচারকদের বিবেচনায় আমার দুটো ছবিও তাদের ছবিগুলোর সাথে যোগ হলো্। গত ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ সেপ্টম্বর পর্যন্ত ধানমন্ডির দ্রিক গ্যালারিতে চলেছিল আমদের এ প্রদর্শনী। অংশগ্রহন করেছিল মোট ২৪ জন। সবার ছবি দেখে মনে হল তাদের ছবি তোলার হাত ভাল। স্থান পাওয়া ৪২টি আলোকচিত্রের মধ্যে ছিল প্রকৃতি, মানুষ, জীবনবোধ, পরিবেশ, আবেগ সহ অনেক বিষয়। প্রদর্শনীতে সবার সাথে দেখা হলো, পরিচয় হলো, আমি ওদের একজন হয়ে গেলাম। আমার দুঃখবোধটা পুরোপুরি চলে গেল। চৌবাচ্চা এখন নদীতে রূপান্তর হয়েছে। তাদের উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা আর আগ্রহ আমাকেও অনেক প্রেরণা জুগিয়েছে। শেষ দিনে তারা আমাকে Founder Member crest আর Certificate দিয়ে যে সন্মান দেখাল তাতে আমি সত্যিই অভিভূত। আমাকে কিছু বলতে বলা হয়েছিল কিন্তু আমি ভাল বক্তা নই তাই তোমাদের উদ্দেশ্যে লিখলাম।
কিছৃ কথা মনে রেখ - তোমরা এ প্রদর্শনী করেই মনে করো না এখানেই শেষ, আমাদের আরো ভাল করতে হবে, অনেক ভাল ছবি তুলতে হবে। আরো বড় আকারে প্রদর্শনী করতে হবে। ঘুরাঘুরি করো তাহলে ছবি তোলার নানা বিষয় পাবে আর ক্যামেরাকে তোমার বন্ধু ভাবতে শিখো। যারা ভাল কাজ করে তাদের ছবি দেখ আর নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করো। সমালোচনায় কান না দিয়ে কাজ করে যাও। নিজের সখের জিনিসগুলোকে জীবনে জায়গা করে নিলে সেগুলো তোমাদের আরো সামনের দিকে নিয়ে যাবে।
আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য, সন্মানিত করার জন্য তোমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ এবং আমি তোমাদের পাশে সবসময় থাকবো।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০১২ দুপুর ১:৫৩