প্রচন্ড শীত। সূর্য নেই।
প্রায় দেড় বছর ধরে পুরো পৃথিবী ঢাকা পড়ে আছে শীতের চাদরে, হাড় কাঁপানো শীত। সেই প্রচন্ড শীতের প্রভাবে মারা যাচ্ছে পৃথিবীর মানুষ , মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে। শুধুমাত্র বেঁচে আছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ভাইকিংরা । তারা বিশ্বাস করে , ভয়াবহ সেই শীতও তাদের কাবু করতে পারবে না। হ্যা ঘটনা ঠিক তেমন ই চলছে।
তবে চিন্তার বিষয় হলো, এরপর যে যুগ শুরু হবে, তা কল্পনাতীত , ভয়াবহ ।সেই ভয়ঙ্কর যুগটির নাম ‘পতিতাবৃত্তির যুগ’!
এ যুগে মানবজাতির অবস্থা হবে অতিশয় শোচনীয় । দীর্ঘকালের শীতের প্রকোপে পৃথিবীতে দেখা দেবে চরম খাদ্যসঙ্কট। বেঁচে যাওয়া মানুষেরা খাবারের জন্য একে ওপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে , সেই মরণ লড়াইয়ে মরবে মানুষ। বাপ খুন করবে ছেলেকে , ছেলে বাবাকে , ভাই ভাইকে। তবে সবচেয়ে জঘন্য আর ঘৃণিত ব্যাপার হলো, সেই সময়ে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়বে ইনসেস্ট।
একের পর এক মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানবিক পতন , অপদেবতাদের উত্থান, মৃতদের সেনাবাহিনীর আগমন, দেবতাদের সাথে অপদেবতাদের মরণপণ যুদ্ধ- এই সব নিয়েই ভাইকিংদের 'র্যাগনারক'। নর্স মিথলজি ভয়াবহ 'র্যাগনারক' !
মৃত্যুর পরে মৃত মানুষেরা কি করে ? অপেক্ষা ? কিসের অপেক্ষা ?
ভাইকিং উপকথা বলে , যেদিন থেকে মৃত্যুর শুরু , ঠিক সেইদিন থেকেই মৃত ব্যক্তিরা পৃথিবীর শেষ দিনটির জন্য অপেক্ষা করে আছে। তারা সেইদিন জেগে উঠবে। তবে সবাই নয়।
জেগে উঠবে তারা - যারা খারাপ তারা। যারা নরকে ঠাঁই পেয়েছে তারা।সেইদিন জেগে উঠবে নরকবাসীরা। তারা বিশাল এক নৌকা নিয়ে বেঁচে থাকা মানবজাতির বিরুদ্ধে অগ্রসর হবে।
তবে সেটিও কোনো সাধারণ নৌকা হবে না, সেটি মৃত ব্যক্তির নখ দিয়ে বানানো! সেই নৌকা বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় নখ আসতো মৃত ব্যক্তিদের কাছ থেকে। ভাইকিংদের এমন বিশ্বাসের কারণে , কেউ মারা গেলে তার তার হাত-পায়ের নখগুলো কেটে দিতো। এমন কি অতিরিক্ত সতর্কতা স্বরূপ কখনো আবার পুরো নখটিই তুলে ফেলা হতো। এই বিষয়ে ভাইকিংরা ছিলো খুবই সতর্ক। কারণ তারা মনে করতো নৌকা বানানোর জন্য যথেষ্ট নখ পেয়ে যাওয়া মানেই হলো পৃথিবীর শেষ ঘনিয়ে আসা।
হ্রাইম্র নামক এক দানব নৌকাটিকে দেবতাদের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রের পথে চালিয়ে নেবে, হাল ধরে থাকবে স্বয়ং ধূর্ত দেবতা লোকি। মুখোমুখি হবে চরম সংঘাত !
পৃথিবীর ভয়াবহ সেই ক্রান্তিকালের নাম 'র্যাগনারক'।
'র্যাগনারক' নিয়ে সামান্য ধারণা পাওয়া গেল। বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো। আসুন তার আগে কিছু কুশীলবদের চিনে নেয়া যাক যারা প্রবল অপেক্ষায় বসে আছে পৃথিবীর ক্রান্তিকালের।
ভাইকিংদের উপকথা আর বিশ্বাস মোতাবেক খারাপ দেবতাদের কথা বলা হয়ে থাকে। সেই দেবতারা মানুষদের সবসময় খারাপ কাজে প্ররোচিত করতো। শয়তান যেমন করে। তারা প্রচন্ড শক্তিশালী , ক্ষমতাশালী এমনকি কেউ কেউ এতটাই ভয়াবহ যে, আশেপাশে তাদের উপস্থিতি একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট ছিল। তবে ভাইকিংরা বিশ্বাস করতো খারাপ সে দেবতাদের অনেক আগেই এমন কোনো এক জায়গায় বন্দী করে রাখা হয়েছে যেন তারা কারো কোনো ক্ষতি করতে না পারে। এটাকে সৌভাগ্য বলতে হবে মানবজাতির জন্য ।
ধূর্ত দেবতা লোকি:
দেবালয় অতিষ্ট করে তোলা এক কুখ্যাত দেবতা লোকি। জেনে নেয়া যাক দেবতা লোকির কয়েকটি অপরাধ।
১. ঘোড়ার সাথে সঙ্গম
২. স্বর্গের ভৃত্যদের হত্যা
৩. একদিন একটি ভোজে সে আমন্ত্রিত না হয়েও সেখানে হাজির হয়ে সবকিছু ভন্ডুল করে দেয় ।
৪. দেবতা ওডিনের ছেলে বালডুর কে হত্যা
দেবতারা ধৈর্য ধরে রাখতে পারলেন না। তাকে ভয়াবহ শাস্তি দেয় দেবতারা।
দেবতারা প্রথমে তার সামনে তার ছেলেকে খুন করে। এরপর ছেলেটির নাড়িভুঁড়ি দিয়েই হাত-পা বেঁধে আটকে রাখা হয় লোকিকে। এখানেই শেষ নয় , বেঁধে রাখার পর তার উপর রাখা হয় বিষাক্ত একটি সাপ যার বিষ ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তো তার মুখে, অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে সে ।
লোকির স্ত্রী সিগুনা তাকে এই ভয়ানক যন্ত্রণা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। সে লোকির সাথে সাথে গুহায় অবস্থান করে। সেখানে সাপের মুখ থেকে বিষ ধরার জন্য তিনি একটি থালা রেখেছিলেন। থালাটি পূর্ণ হয়ে গেলে, সে থালাটি খালি করতে একটু সময় নিতো । এই মুহুর্তে, লোকির মুখে পুনরায় সাপের বিষ পড়তে থাকে। বিষের যন্ত্রণা এতটাই প্রখর যে লোকি চেঁচিয়ে চিৎকার করে উঠত । ভাইকিংরা বিশ্বাস করে , প্রতিবার লোকি তীব্র যন্ত্রনায় চিৎকার করে আর মোচড়াতে থাকে। এবং লোকির প্রতিটা মোচড়ের সময় পৃথিবী কেঁপে ওঠে।
লোকির স্ত্রী আজীবন চেষ্টা করে যায় যেন তার মুখে সেই বিষ না পড়ে, তবে বারবার ব্যর্থ হয় সে।
পৃথিবীর চরম ক্রান্তিকালে ভূমিকম্প সংঘটিত হবে। সেই ভূমিকম্পে মুক্তি পাবে ধূর্ত লোকি। হাল ধরবে মানবজাতি আর দেবতাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়া নৌকার।
ফেনরির : নেকড়ে আকৃতির দেবতা। দেবতা লোকির ছেলে।
মানবজাতির ইতিহাস শুরু হওয়ার আগেই ভালো দেবতারা এই ভয়ঙ্কর ফেনরিরকে বন্দী করে ফেলে দেবতারা , জাদুর তলোয়ার দিয়ে আলাদা ভাবে আটকে রাখে তার দুটো চোয়াল। তবে সে একবার ছাড়া পেলে ধ্বংসের মাতম তুলবে গোটা পৃথিবী জুড়ে । মুখ দিয়ে নির্গত আগুনে ছারখার করবে স্বর্গ মর্ত্য !
পৃথিবীর কোথাও বন্দী করে রাখা হয়েছে তাকে। ধারণা করা হয় মাটির নিচে , শেকলে বন্দী। তাকে মুক্ত করতে হলে দরকার ভূমি ছিন্নভিন্ন , খণ্ডিত হওয়া। আর তাই দরকার ভূমিকম্পের। পৃথিবীর ক্রান্তিকালে যখন সেই ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হবে তখন শিকল ছিঁড়ে মুক্ত হবে ভয়ঙ্কর ফেনরির।
আচ্ছা , ভূমিকম্প কেন হবে ? এর পিছনে কেউ কি আছে ? প্রশ্নটা মনের মধ্যে আসতেই পারে।
না , আমি কোন আশার বাণী শোনাতে পারছি না। ভূমিকম্প সংগঠন আপনা আপনি হবে না। কুটিল পরিকল্পনা নিয়ে মানবজাতি আর দেবতাদের পিছনে লেগেছে যে খারাপ দেবতারা। ভূমিকম্প সংগঠিত করার জন্য ফেনরির ছেলেরা শুধু সময়ের অপেক্ষায় আছে।
কল্পনাতীত এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে পৃথিবী , মানবজাতি আর দেবতারা !
মিডগার্ডের সাপ :
পৃথিবীর সূচনা লগ্নে দেবতারা যখন খারাপ দেবতাদের খুঁজছে বন্দী করার জন্য তখন কেউ কেউ অগোচরে চলে গিয়েছিলো। বজ্রের দেবতা থর যখন হন্যে হয়ে খুঁজেছে তখন বিশালাকার দানবীয় সাপ আত্মগোপন করেছিল সমুদ্রের তলদেশে। বিশালাকার এই ভয়ংকর সাপ হচ্ছে মিডগার্ডের সাপ। Jörmungandr নামেও পরিচিত। সাপটি এতটাই বিশাল যে সে অনায়াসে সারা পৃথিবীকে পেঁচিয়ে ধরতে পারে।মিডগার্ডের সাপ উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় আছে ।ভূমিকম্পের পর সমুদ্রের তলদেশ থেকে উঠে আসবে মাটিতে। ভূমিতে চলার কারণে সমুদ্র চাপ সইতে পারবে না।
অতঃপর সমুদ্র ফুঁসে উঠবে , দেখা দেবে ভয়াবহ বন্যা। ভেসে যাবে সমগ্র পৃথিবী।
না , মিডগার্ডের সাপ এখানেই ক্ষান্ত দেবে না। এরপর সে ছড়িয়ে দেবে তার ভয়াবহ বিষাক্ত বিষ , আকাশ আর সমুদ্রে। পৃথিবীর সমস্ত পানি বিষাক্ত হয়ে যাবে আর আকাশ থেকে ঝরে পড়বে বিষাক্ত বৃষ্টি !
পৃথিবী অপেক্ষা করছে চরম ক্রান্তিকালের , সংঘর্ষ আর চরম বিপর্যয়ের।
চলবে......
ছবিঃ গুগল
______________________________________________
প্রিয় ব্লগার শের শায়রী ভাইয়ের ভাইকিং বিভীষিকা
পোস্টটা পড়ে 'র্যাগনারক' নিয়ে লেখার ইচ্ছা জেগেছিলো খুব। বিভিন্ন ব্যস্ততা , ঝামেলার কারণে সময় করে উঠতে পারছিলাম না। আর এই ধরণের লেখায় আমি একেবারেই আনাড়ি। তবুও চেষ্টা করছি। আসলে অনেক পড়াশোনা করতে হবে। পোস্ট দীর্ঘ হতে পারে , তাই আংশিক পোস্ট করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০২০ দুপুর ২:২১