বৃষ্টি থেমে গেছে। বৃষ্টি শেষে চারপাশে কেমন জানি সাদা হয়ে যায়। আলোময় মনে হয়। এই পরিবেশটা আমার খুব ভাল লাগে। পরিষ্কার আলোয় ছুটে চলা সাদা সাদা মেঘ। আকাশটাকে আরো নীল মনে হয়।
এখন এই ঝুম বৃষ্টির পর রাস্তার পাশ দিয়ে কলকলিয়ে ধেয়ে যাচ্ছে জলধারা। অস্থির প্রাইভেট কার দু’পাশে জল-কাদা ছিটিয়ে ছুটে চলেছে বেপরোয়া ভাবে আমি নিউ মার্কেটের ওভার ব্রিজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছি । মঙ্গলবার মার্কেট বন্ধের দিন। তাই অন্যদিনের তুলনায় আজ লোকজন বেশ কম। তারপরেও বৃষ্টি থেকে বাঁচতে অনেকেই ঠাঁই নিয়েছে এখানে। লোকজনের গাদাগাদি না হলেও জটলা তো বটেই।
পাশের লোকটা ফস করে সিগারেট ধারালো। সিগারেটের ধোঁয়া ইদানিং অসহ্য লাগে। যখন সিগারেট খেয়েছি তখন কিন্তু এমন মনে হত না।
এই তো সামনেই হকার্স মার্কেট। ওখানে স্ন্যাকস কর্ণারে কতদিন বন্ধুদের সাথে ফুলুরি, কলিজার সিঙ্গারা আর জিলাপি খেয়েছি। জমজমাট হৈ হুল্লোড় আর আড্ডা।
চা-সিগারেট, বৃষ্টির দিনে গরম সিঙ্গাড়া খাওয়া আর আড্ডার সময়গুলো কত দ্রুতই না ফুরিয়ে গেল! এখন অনেকের মুখে জিলাপি হয়ে গেছে জেলেবি !
আড্ডার বন্ধুরা অনেকেই মুঠোফোনে ডিলিট হয়ে গেছে। নতুন করে সেভ করতে আর মন চাই না। সময় চলে যায় সাথে আমাদের কত কিছুই যে নিয়ে যায়! কী নির্মম নিষ্ঠুরতা!
পাশে দাঁড়ানো সিগারেট টানা লোকটার ছেড়ে দেয়া নিকোটিন পোড়া ধোঁয়া চোখে লাগছে। কী সিগারেট কে জানে?
আমি যখন সিগারেট ধরি তখন বাংলা ফাইভের দাম ছিলো তিন টাকা। আমি আর তুই ভাগাভাগি করে কত খেয়েছি। অঞ্জন দত্তের ‘শুনতে কি চাও--’ শুনতে শুনতে আয়েশি টান। আমি তখন খাতা কলম হাতে শব্দ জোড়া দিয়ে দিয়ে দু’চারটি নতুন বাক্য বানাবার চেষ্টা করতাম। তুই বলতি, দেখি কী লিখেছিস? আমার আপাত অর্থহীন সে সব লেখার তুই কতই না নতুন নতুন অর্থ আবিস্কার করতি। অবাক হবার ভান করে বলতি, কি অদ্ভুত লিখেছিস রে! চল দোস্ত তোকে সিঙ্গাড়া খাওয়ায়। হয়ত বাইরে তখন বৃষ্টি। যাবো কীভাবে? তুই বলতি, ভিজতে ভিজতে যাবো। ভিজতে ভিজতে খাবো। আমরা বৃষ্টিতেই রাস্তায় নেমে আসতাম। হা হা করে হাসতাম। আকাশ থেকে নেমে আসতো অঝোর বৃষ্টিধারা। আমাদের কাছে মনে হত, যেন অবিরল কবিতার পংক্তিমালা। আমরা সেগুলো মিছেমিছি ধরার চেষ্টা করতাম। তুই বলতি, ধর ধর দোস্ত। হাত গলিয়ে যেন বেরিয়ে না যায়।
আমি বলতাম, 'আকাশ পরিশুদ্ধ করে বিষাক্ত ক্লেদ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে।'
তুই বলতি, 'এই বৃষ্টি অনাবাদি ভূমির উর্বরতা বাড়াবে। মাটির বুক ফুঁড়ে মাথা তুলবে সাহসী বীজের অঙ্কুরোদম । যেমন শোষিত মানুষ মাঝে মাঝে সাহসী হয়ে মাথা তোলার চেষ্টা করে।'
এভাবেই যোগ হত নানান সব অধিবিদ্যার পংক্তিমালা।
তোর সাথে বহুকাল যোগাযোগ নেই। তোর সাথে যেদিন শেষ দেখা, সেদিন আমরা গোল্ডেন ট্রিনিটি নিয়ে কথা বলেছিলাম। তুই সেদিন ছিলি খুব আনমনা। সিগারেট টানছিলি ভাবলেশহীন। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলি, ভাতের দাম খুব বাড়ছে রে দোস্ত। তুই ভালো থাকিস। বলে হনহন করে চলে গেলি। একবারও পিছনে না তাকিয়ে।
পাশের সিগারেট টানা লোকটার ধূমপান শেষ। চলে যাচ্ছে কিছুটা যান্ত্রিকভাবে। ঠিক তুই যেভাবে চলে গিয়েছিলি। কোথায় যেন ভীষণ তাড়া । ওভার ব্রিজের নিচে বাস-ট্যাক্সি-স্কুটার-অটো রিক্সা অবিরাম ছুটে চলেছে। যেটা যাচ্ছে সেটা আর দৃশ্যমান হচ্ছে না। তোর মত।
আমি তাকিয়ে থাকি। সাইন্সল্যাব পেরিয়ে, মিরপুর রোড ধরে, বহুদূরে। তোর কথা মনে হচ্ছে খুব। কী করছিস, কেমন আছিস, এখনও কী ভাতের দাম বাড়লে তোর দুশ্চিন্তা বাড়ে? পয়সার অভাবে কি তোর আজো রোজদিন ভরপেট খাওয়া হয়না? মনে আছে, একদিন সন্ধ্যায় তুই এসে ভাত খেতে চাইলি। আমি মেসে খাই। হিসাবের রান্না। তোকে হোটেলে নিলাম। সাধারণত তুই দুই প্লেট ভাত খেতিস। কিন্তু তুই সেদিন, এক্সট্রা প্লেট খেয়েও বললি, দোস্ত, আজ খাবার পরে একটা সিগারেট ভাগ করে খাব। তিনটাকা তো বাঁচবে। বরং আর এক প্লেট ভাত বলি। সারাদিন খাওয়া হয়নি তো।
আমি কিছু বলিনি । আমরা মাঝে মাঝে রাস্তায় হাঁটতাম আর বলতাম ,
"দেখিস বন্ধু, আমরা একদিন এই শহরের সমস্ত রাস্তা ঘাট কিনে ফেলবো। "
এই শহর খ্যাপাটে কবির অভিমান জমা করে। চাইলেই খ্যাপাটে কবিরা এই শহরকে কিনে নিতে পারে।
জানিস , ওই সিগারেট খাওয়া লোকটার মত তুই যদি এখন আমার পাশে এসে দাঁড়াতি! বিশ্বাস কর বন্ধু, সেদিন আর গোল্ডেন ট্রিনিটির মানে খুঁজতাম না। মানিক-রবি- অঞ্জন -সুমন বাদ দিয়ে বলতাম, চল তোকে পেট ভরে ভাত খাওয়াই। তুই হয়ত বলতি, বৃষ্টি তো, যাব কী করে! আমি বলতাম ভিজতে ভিজতে যাব। ভিজতে ভিজতে খাব। দু’জনে আগের মত হা হা করে হাসতে হাসতে নেমে যেতাম রাস্তায়। এই শহর বহুদিন পর কবিদের ভিজতে দেখতো।
বেশ জোরে মেঘ ডেকে ওঠায় ভাবনায় ছেদ পড়ে। চেয়ে দেখি আকাশে মেঘ জমছে। ক্রমশ ঝাপসা হচ্ছে শহর। আবার বোধহয় বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির আগে শহর ঝাপসা হয়ে যায়। চোখ আর শহরের কি অদ্ভুত মিল !
ছবি: ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০২২ সকাল ৯:৫১