somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতিচারণ মূলক লেখার সময় শেষ... কিন্তু আমি কোন লেখা দিতে পারিনি।

০৯ ই জুন, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ব্লগ টিম চমৎকার সব উদ্যোগ নিচ্ছে। কন্টেন্ট রাইটিং, ফিচার প্রতিযোগিতার, স্মৃতিচারণ প্রতিযোগিতা। আমি ফিচার লিখতে পারিনা। তাই চেষ্টা করেও লেখা হয়নি। অনেকদিন ব্লগের বাইরে ছিলাম। স্মৃতিচারণ প্রতিযোগিতা হচ্ছে জেনেও ব্লগে আসতে পারিনি। সময়ের অভাবে লিখতেও পারিনি। শেষ মুহূর্তে কিছু লিখতে ইচ্ছা হয়েছিল কিন্তু কোন ভাবেই কিছু একটা দাঁড় করানো গেল না ।

ভাবনা এবং লেখায় খরা চলছে। চট করে তেমন কিছু মাথায় আসছে না। আমার শৈশবে আহামরি কিছু নেই যেটা রচনার মত লিখে ফেলা যাবে। স্কুলে থাকতে পরীক্ষায় রচনা লিখতে হতো। সবাই সময়ের মূল্য, শ্রমের মর্যাদা লিখে ২০ শ ১৫ পেতো আর আমি একটি বর্ষনমুখর সন্ধ্যা/রাত, আমার শৈশব স্মৃতি লিখে ১০ও পেতাম না। তারপরেও এই টপিক গুলো কেন বাছাই করতাম কে জানে।
আমার শৈশব ঘটনা বহুল হয়। তবে জীবনের সবাই আনন্দময় আর ক্ষণস্থায়ী সময় বলেই হয় মনে আলোড়ন তোলে। শৈশবের সামান্য কিছু অনুভূতি গুলো দারুণ আবেগি হয়ে উঠে।

ছোট ছোট বিষয় গুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠে। কেন জানি কিছুতেই ভোলা যায়। মন থেকে মুছে যায় না। আহামরি কোন বিষয় না তবুও ক্ষুদ্র বিষয় গুলো ভুলতে পারিনা। বারবার মনে হয়, শিহরণ জাগে , সাথে মন খারাপ হয়।

আমার আব্বা ছিলেন প্রধান শিক্ষক। বিকেলে বাড়ি ফিরতেন। তাঁর জন্য অপেক্ষা করতাম বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে। এই সবই আমার শৈশবের অংশ। আহামরি কিছু নেই। সেই বিকেল গুলোতে অনেক কিছু করার থাকতো। ইমরান খানের ব্যাট হাঁকানো, মাছ ধরা, ফড়িংয়ের পিছে দৌড়ানো। না, সেই সময়টাতে আমি কোন কিছুই করতাম না। পড়ন্ত বিকেলে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতাম রাস্তায়।রাস্তার মাথায় একসময় আব্বা দৃশ্যমান হতেন। অদ্ভুত আনন্দ। এটাই আমার শৈশব ।

১৯৯২ সাল। এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো। ভেড়ামারা পাইলট হাইস্কুলের হেডস্যার হাসিমুখে বাড়িতে ফিরলেন। উনার পিছনে স্কুলের দপ্তরীর দুইহাতে মিষ্টির প্যাকেট। স্কুলের ছাত্র ফেরদৌস ওয়াহেদ তপু বোর্ড স্ট্যান্ড করেছেন। আব্বার হাসিমাখা মুখ দেখে আমার মনটা খারাপ হতে থাকলো। কিছুদিন পর তপু ভাইয়ের সাথে আব্বার ছবি ছাপা হলো। আব্বার পকেটে গোঁজা রেড লিফ কলম আর চোখে কালো ফ্রেমের ভারি চশমা , ঠোঁটের কোণে হাসি। মনটা খারাপ হলো কারণ এমন উপলক্ষের ছবি আব্বার সাথে কোনদিনই তোলা হবে না।

লেখাপড়া আমার কাছে বিভীষিকার মত ছিল যেন। শৈশবের সবচেয়ে ভয়ংকর অধ্যায়। যার ভয়াবহতা এখনো কাটেনি। কিন্তু ক্লাস ওয়ানের সেই সাদা জামা আর নীল হাফ প্যান্ট পড়ে প্রথম দিনটা আর স্কুলে ভর্তি হবার উৎকন্ঠা , আয়োজন কোনটাই কম ছিল না । নিয়মিত স্কুলে না গেলেও ক্লাস ফোর পর্যন্ত আমার রোল নং ছিল এক। ক্লাসের অনেকেই আমাকে এক বলে ডাকতো। ক্লাসে ঢোকা মাত্র অনেকেই বলে উঠত , 'এক' আসছে। 'এক' আসছে।

এক ক্লাসে আসা বিশেষ ব্যাপার হয়তো। কারণ এক নিয়মিত স্কুলে আসতো না। আমার জন্য ফাস্ট বেঞ্চে জায়গা রাখা হতো। আমি ক্লাসে ঢুকে বেঞ্চে চুপ করে বসে থাকতাম। ক্লাসরুম থেকে বেরুতাম না।

টিফিন পিরিয়ডে সবাই হৈ হৈ করে বের হতো। আমি চুপ করে বসে টিফিন সাড়তাম। সবাই যখন স্কুল প্রাঙ্গনে বউচি , গোল্লাছুট খেলছে আমি তখন চুপ করে বসে নিজের মনেই খেলি -- এনা, বেনা , রেস...'

‘কুইন্তের , কন্তের , জেস!’ রাশিয়ান বইয়ের সেই রূপের ডালি খেলার সেই অদ্ভুত খেলাটা যেখানে 'যে ন্যায়পর অজ্ঞতায় আমরা তখন ছিলাম তাতে ভালো মানুষকে ধরা হতো সুন্দর আর খারাপ কে অসুন্দর !'

সাত নম্বর ফ্ল্যাটের নিন্কা ছিল অসাধারণ অসুন্দর! তবুও সেই ছিল আমাদের কাছে সবচেয়ে সুন্দর। আমার শৈশবটা অর্থবহ ছিল। সেই শৈশবে সুন্দরের মানে ভিন্ন ছিল। বড় হয়ে ভুল শিখলাম। ভুলে গেলাম ভালোই সুন্দর।



আমার দাদা মারা গেলেন কোরবানি ঈদের আগে দিন মাগরিবের আজানের পর। ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে উঠোনে এসে থমকে দাঁড়ালাম। সামনেই দাদার ঘর , সেই জানালায় দাদা বসে থাকতেন। জানালায় বসে আমাকে দেখা মাত্রই ' কুটি ভাআআই’ বলে আর কেউ ডাকবে না।

সবাই হুহু করে কাঁদছে। দাদাকে দেখতে বাড়িতে মানুষের ঢল নামছে। সবাই চোখ মুছছে কিন্তু আমার কান্নাটা কোথায় যেন আটকে গেল।

আব্বা আমার মাথার পিছনে হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি আর আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম- আমার দাদা মরিনি, আমার দাদা মরিনি। দূর থেকে ' ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক....' ভেসে আসছে। ঈদের শুভেচ্ছা আর জামাতের সময় নিয়ে মাইকিং বের হয়েছে। ঈদের নামাজ দাদা পড়াতেন। আর পড়াবেন না। কুটি ভাআআই বলে কেউ ডাকবে না। কেউ না। একটু পরে দাদার শোক সংবাদ নিয়ে মাইকিং বের হবে। আগামীকাল ঈদ। কোন আনন্দ নেই। একটুও না।



আমার দাদা যে জানালায় বসে আমাকে ডাকতেন , সবকিছু দেখতেন ঠিক তেমন একটা জানালা আমার আছে। দক্ষিণের জানালা। কাঠের দুইটা পাল্লা , তাতে কাঠের হুড়কো দিয়ে আটকানো। সেই জানালায় আমি শৈশব দেখি। সেই জানালা মাত্রই ধানখেতের সবুজ হাওয়া দোল দিয়ে যায়। আমি খেতের ধার ধরে দৌঁড়াতে থাকি , দৌঁড়াতে থাকি , খোলা প্রান্তরের দিকে।

আমার এই জানালা শৈশবটা এক্কেবারে স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয়। সেই জানালায় আমি একটা ইদরা (কূপ ) দেখতে পায়। সেই ইদরার ধারে ছোটদের যাওয়া মানা ছিল। আমি দুরে দাঁড়িয়ে দেখতাম শুধু। কৌতূহল হতো খুব। কি আছে দেখার জন্য। একবার আব্বা ইদরার ধারে নিয়ে গেলেন। কোলে করে ঝুকে ইদরা দেখালেন । আমি অবাক হলাম , কি গভীর! অনেক নিচে পানি , দড়ি বাধা বালতি ফেলে পানি তুলতে হয়। আব্বা আমাকে চিৎকার করে কিছু বলতে বললেন। আমি চিৎকার করে বললাম , আব্বাআআ !

কি অদ্ভুত ! ভীষণ গভীর থেকে ইদরা যেন আমার কথা ফেরত দিলো।

আমি অবাক হয়ে আবার চিৎকার করে উঠি। দারুন মজার একটা খেলা যেন।

আব্বা বললেন , কেন এমন হয় জানো ?

আমি জানাতাম না এবং সেই সময় জানতেও ইচ্ছা হলো না। কারণে অদ্ভুত খেলায় মেতে থাকতে মন চাইলো।

আমার সেই জানালা এমন অনেক কিছুই দেখায়। আমি বড় হলেও জানালার বয়স বাড়ে না। বাড়ে শুধু স্মৃতি আর শৈশবের অফুরান দৃশ্যপট। আমি যেগুলো বললাম সেগুলো সবই সেই জানালায় ভেসে ওঠা জীবন্ত দৃশ্যপট। আমার জানালা আমার শৈশব আর বাবা ছেলের গল্প গুলো নিখাদ অনুভূতি গুলো কোন এক সুতোয় বেঁধে রাখে। খিল দেয়া সেই জানালা। তবে আমি ইচ্ছে করলেই খুলতে পারি। আহা আমার দক্ষিণ খোলা জানালা......



আমার ছেলে নতুন এক খেলা শিখেছে। আমাদের বাড়িতে দুইতলা নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। নতুন পলেস্তরা করা ঘরে উচ্চস্বরে কথা বললে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। প্রথম দিন ভয় পেয়ে বললো , "বাবা ! কে ছব্দ করে ?"

ব্যাপারটা বোঝার পর ভয় পরিণত হয়েছে খেলাতে , মজার সেই খেলা । বাবা বলে চিৎকার করে উঠে আর বাবা ফিরে ফিরে আসে। দারুন একটা মজার ব্যাপার আর সেই সাথে বিস্ময় ! আমাকে বলে , "বাবা , তুমি বাবা করো।"

আমি চিৎকার করে 'বাবা' বলে উঠি। চার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে শব্দটা অদ্ভুত হয়ে ফিরে আসে। ছেলেটা হা হা করে হেসে উঠে আর হাততালি দেয়। ফিরে আসে হা হা হাসির শব্দ , ফিরে আসে হাততালি , ফিরে শৈশব ! আহ শৈশব ! কি অদ্ভুত শৈশব !!

আমি আবার চিৎকার করে বলি , বা-বা !






সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:৫৮
১৩টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×