জুলুম-নির্যাতন, দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে ফের ঘুরে দাঁড়াচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। ঈমান ও ইসলাম রক্ষার দাবিতে চলমান আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে চলছে নানা প্রস্তুতি। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে পিছু না হটে রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন হেফাজতে ইসলামের নেতারা। এদিকে শাপলা চত্বর ট্র্যাজেডির এক মাস পূর্ণ হচ্ছে আজ বুধবার। বিগত ৫ মে হেফাজতে ইসলামের ঐতিহাসিক মহাসমাবেশে মধ্যরাতে চালানো হয় যৌথ বাহিনীর নিষ্ঠুরতম অভিযান। ১৩ দফা দাবিতে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি শেষে শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশ প- করতে রাতের আঁধারে অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী।
নিরপরাধ আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ এবং তৌহিদী জনতার শান্তিপূর্ণ অবস্থানে পরিচালিত নজিরবিহীন এ সাঁড়াশি অভিযানে দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক তোলপাড় হয়। দীর্ঘ এক মাসেও ওই অভিযানের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন হয়নি। সেখানে হতাহতদের সংখ্যা সম্পর্কেও সরকারীভাবে এখনও পর্যন্ত কোন তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
তবে শাপলা চত্বরের নিষ্ঠুরতম অভিযানের পর হেফাজতে ইসলাম তথা এদেশের আলেম-ওলামা ও তৌহিদী জনতার উপর সরকারী জুলুম, নির্যাতন, মামলা, হুলিয়া, ধরপাকড় এখনও চলছে। হেফাজত কর্মীরা পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মীদের ভয়ে কোথাও নিরাপদে থাকতে পারছেন না। হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতাসহ অসংখ্য নেতাকর্মী মিথ্যা মামলায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরীসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতারের পর তাদের উপর চালানো হয় বর্বরতম নির্যাতন। রিমান্ডের নামে নিষ্ঠুর নির্যাতনে জর্জরিত জুনাইদ বাবুনগরী এখনও হাসপাতালে। তার সংকটাপন্ন অবস্থায় দেশবাসী চরম উৎকণ্ঠিত। হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীসহ তৌহিদী জনতা এ ঘটনায় যুগপৎ উদ্বিগ্ন এবং বিক্ষুব্ধ। আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরীর আরোগ্য কামনায় দেশ-বিদেশে দোয়া মাহফিল অব্যাহত আছে।
হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, নবীপ্রেমিক তৌহিদী জনতা ঈমান রক্ষার আন্দোলনে ইতিহাসের বর্বরতম এবং নিষ্ঠুরতম অভিযান পরিচালনা করেও সরকার হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের মনোবল ভাঙ্গতে পারেনি। নির্বিচারে গুলি করে হত্যা, গণহারে আহত এবং গ্রেফতারসহ প্রবল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখেও হেফাজত কর্মীরা ঈমান রক্ষার আন্দোলন বিচ্যুত হয়নি।
১৩ দফা দাবিতে হেফাজতে ইসলাম এখন যেকোন সময়ের তুলনায় সুসংগঠিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারের চরম দমন নিপীড়নে তৌহিদী জনতার মধ্যে চরম ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। দমন পীড়ন বন্ধ না হলে ভয়াবহ আকারে তৌহিদী জনতার ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটবে। তিনি বলেন, শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশে যৌথ বাহিনীর অভিযানে হতাহতদের তালিকা তৈরী করা হচ্ছে। খুব শীঘ্রই জাতির সামনে তা প্রকাশ করা হবে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে অনেকের নাম-ঠিকানা আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। মধ্যরাতের অভিযানে আহত দেড় হাজার নেতাকর্মীর অনেকে এখনও দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে বলেও জানান তিনি।
ঢাকা অবরোধ কর্মসূচীর পর এ পর্যন্ত হেফাজতে ইসলামের লক্ষাধিক নেতাকর্মীকে আসামী করে ৬২টি মামলা দেয়া হয়েছে এবং এসব মামলায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান তিনি। মামলার আসামী ধরার নামে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, বাসা-বাড়ি এমনকি হেফাজতে ইসলামের নেতাদের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িঘরেও অভিযান পরিচালনা করছে।
হেফাজতে ইসলামের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সাথে আলাপ করে জানা যায়, ১৩ দফা দাবিতে চলমান আন্দোলনকে আরও গতিশীল করতে কাজ করছেন হেফাজতের নেতারা। সংগঠনকে গোছানোর পাশাপাশি নেতাকর্মীদের সাথে মতবিনিময় এবং গণসংযোগ অব্যাহত রয়েছে।
আগামী ১৩ জুন থেকে শুরু হচ্ছে কওমী মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে মাদ্রাসাগুলোর সমাপনী পরীক্ষা। পরীক্ষা চলবে ১০ দিন। হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের অধিকাংশ কওমী মাদ্রাসাকেন্দ্রিক হওয়ায় সবাইকে পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। পরীক্ষার ব্যস্ততা শেষে রাজপথের আন্দোলনে সরব হওয়ার প্রস্তুতি চলছে জোরেসোরে।
হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জেলা মহানগর কমিটির নেতারা সাক্ষাত করছেন। তারা তাদের নিজ নিজ এলাকার সাংগঠনিক অবস্থা তুলে ধরে হেফাজতের আমীরের কাছে দিকনির্দেশনা চাইছে। হেফাজতের আমীরও আহতদের সুস্থতায় আল্লাহর রহমত কামনায় দোয়া মাহফিল, খতমে বোখারী মাহফিলের পাশাপাশি সাংগঠনিক তৎপরতা অব্যাহত রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন।
হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী ইতোমধ্যে বিভিন্ন মাহফিলে ঘোষণা করেছেন ১৩ দফার আন্দোলন ঈমান ও ইসলাম রক্ষার আন্দোলন। এর সাথে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই। কোরআন ও ইসলাম রক্ষার এ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে জানিয়ে তিনি বলেছেন, কোন শক্তিই তৌহিদী জনতার আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।
হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতারা জানায়, খুব শীঘ্রই ১৩ দফা দাবিতে মাঠে নামবে হেফাজতে ইসলাম। এ দাবির সাথে যোগ হবে গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের মুক্তি এবং মামলা প্রত্যাহার। কেন্দ্রীয় একজন নেতা জানান, হেফাজতে ইসলামকে আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে নানামুখী চক্রান্ত চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে। চিহ্নিত কিছু সরকারী আলেমকে মাঠে নামানো হয়েছে। তারা হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছে।
তবে অতীতের মতো এসব ষড়যন্ত্র সফল হবে না জানিয়ে ওই কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ঈমান ও ইসলাম রক্ষার আন্দোলনে তৌহিদী জনতা প্রয়োজনে শহীদ হবে কিন্তু কোন অপশক্তির কাছে মাথা নত করবে না।
উল্লেখ্য, ব্লগে চরম ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারণার প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আন্দোলনে নামে হেফাজতে ইসলাম। নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসির বিধান সম্বলিত আইন পাশসহ ১৩ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করে তারা। এ আন্দোলনের সাথে একাত্ম হয়ে মাঠে নামে প্রায় সবকটি ইসলামী দল ও সংগঠন। সরকারী দল আওয়ামী লীগ এবং কিছু চিহ্নিত বাম সংগঠন ছাড়া দেশের প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দল হেফাজতের এ অরাজনৈতিক কর্মসূচিকে সমর্থন দেয়।
১৩ দফা দাবিতে বিগত ৬ এপ্রিল ঢাকা অভিমুখী লংমার্চ শেষে শাপলা চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এবং শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম। সেখান থেকে ঘোষণা আসে ৫ মে ঢাকা অবরোধের। তার আগে দেশব্যাপী শানে রেসালত মহাসমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম। এসব মহাসমাবেশে তৌহিদী জনতার ঢল নামে। সর্বশেষ ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির পর শাপলা চত্বরে মধ্যরাতে অতর্কিতে চালানো হয় নজিরবিহীন অভিযান।
শাপলা চত্বরের ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত না করা সরকারের গণহত্যার প্রমাণÑমজলিসের নির্বাহী কমিটির বৈঠক নেতৃবৃন্দ
স্টাফ রিপোর্টার : গত ৫ মে শাপলা চত্বরে রাতের অন্ধকারে যৌথবাহিনী ক্রাকডাউন সংগঠিত করে বিপুল সংখ্যক নবী (সা.) প্রেমিকদের হত্যা করে গুম করেছিল। হেফাজতসহ দেশের ওলামায়ে কেরাম এবং ইসলামী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে সঠিক চিত্র প্রকাশের দাবি করেছিল। কিন্তু সরকার কর্তৃক এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন তদন্ত কমিটি গঠন না করায় প্রমাণিত হয়েছে সরকার যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালনা করে গণহত্যা করেছিল।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের পল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে একথা বলা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত আমির শায়খুল হাদীস মাও. নেজাম উদ্দীনের সভাপতীত্বে অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত ছিলেন নায়েবে আমির হাফেজ মাহমুদুল হক, মাও. ইউসুফ আশরাফ মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর, যুগ্ম মহাসচিব মাও. তাফাজ্জুল হক আজিজ, সাংগঠনিক সম্পাদক মাও. জালালুদ্দীন আহমদ, মাও. রেজাউল করীম জালালী. মাও. আবু সাঈদ নোমান, মাও. আজিজুর রহমান হেলাল।
বৈঠকে বলা হয় ৫ মে’র অভিযানের পর সারাদেশে পুলিশ ও সরকারদলীয় ক্যাডার ও জনপ্রতিনিধিরা মসজিদের ঈমাম মাদরাসা ছাত্র এবং নবী (সা.) প্রেমিকদের ওপর হামলা হয়রানি ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার আলেমের বিরুদ্ধে গণমামলা দিয়ে গ্রেফতারের আতঙ্কে রেখেছে। মামলার ভয়ে ছাত্র-শিক্ষক এবং আলেম-ওলামা ও ইসলামিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে কওমী মাদরাসার শিক্ষা দারুণভাবে ব্যহত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত অনেক ছাত্র-শিক্ষক মাদরাসায় অনুপস্থিত রয়েছেন। বৈঠকে অবিলম্বে কওমী শিক্ষায় এবং ইসলামিক রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, হামলায় হয়রানি বন্ধ এবং গ্রেফতারকৃতদের মুক্তিসহ ৫ মে’র ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করা হয়। বৈঠকে বলা হয় নির্যাতন করে মামলার ভয় দেখিয়ে এবং গ্রেফতার ও গুম করে ঈমানী আন্দোলন স্তব্দ করা যাবে না। বৈঠকে উদয়ন স্কুলের পিন্সিপালকে অপসরণ এবং তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা মেনে নেয়ার দাবি করা হয়।
Click This Link page_id= 5