ঢাকার তপ্ত গরমের মধ্যে হুট করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির মধ্যে মৃদু পায়ে হাটছে রনি আর শ্রাবনী।বৃষ্টির শুরুতে কিছু টা বিরক্ত হলেও এখন মনে হচ্ছে আজন্ম ধরে ওরা এই বৃষ্টির অপেক্ষায় ছিল। দুজনেরই হাতে জুতো, কাধে ব্যাগ।আজকে দুজনেই জিন্স পড়ছে যা নিচের দিকে হালকা গোটানো, রনির গায়ে টি শার্ট আর শ্রাবনীর কামিজ। দুজনেই এসেছিল ভার্সিটিতে। ক্লাস শেষে দুইজনে হাটা শুরু করেছিল ক্যাম্পাসের রাস্তা ধরে।ওরা কলেজ জীবন থেকে পরিচয়, বন্ধুত্ব, অতঃপর প্রেম, ভালোবাসা। এক সাথে জীবনের রাস্তায় এগিয়ে যাওয়া৷হঠাৎ করেই শুরু হলো চৈত্রের বৃষ্টি। শ্রাবনী এক হাতে সামলাচ্ছে জামার এক প্রান্ত আরেক হাতে ধরে আছে জুতো। রনি এক হাতে জুতো আরেক হাতে ধরে আছে শ্রাবনীর হাত।একজন আরেকজনের হাত ধরে হেটে যাচ্ছে লক্ষ্যহীন ভাবে৷ বৃষ্টির ফোটা গুলো বলের মতো আকার নিচ্ছে রাস্তায় মিশে যাওয়ার আগে। রাস্তার ধারের রিকশাওয়ালা গুলো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।
দুপুরের খাবার খেয়ে ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার সময় বৃষ্টির কারনে যাত্রী ছাউনিতে আশ্রয় নেওয়া সাজেদুলও চেয়ে আছে অপলক ওদের দিকে৷ তার গ্রামে রেখে আসা নতুন বৌ এর কথা মনে পড়ছে৷সে বিয়ে করেছে বছর পুরো হয়নি৷ ভালোবেসে বিয়ে করেছে পশ্চিম পাড়ার প্রেরনাকে।ওকে বিয়ে করতে গিয়ে অনেক ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়েছে তাকে৷ গ্রাম্য মাতব্বর প্রেরনার বাবা।সাজেদুলের সাথে বিয়েতে রাজী ছিল না উনি৷ সাজেদুলের অবস্থা দেখে ওর মা কয়েকবার প্রস্তাব পাঠিয়েছিল প্রেরনাদের বাড়ি।কিন্তু কোন কাজ হচ্ছিল না৷ শেষমেষ উপায় না দেখে সাজেদুল প্রেরনা কে কাজী অফিসে নিয়ে বিয়ে করে। ক্ষেতে কাজ করার সময় বৃষ্টি শুরু হলে সেও বৌ এর হাত ধরে বাড়ি এসেছিল। ওদের হাত ধরে বৃষ্টিতে হাটা দেখে তার বৌ এর নাকফুল পড়া চেহারা ভেসে উঠল চোখের সামনে। তখন ই সে সিদ্ধান্ত নিল আর কিছু টাকা জমিয়ে ছুটি নিয়ে সে বাড়ি চলে যাবে। কয়েক মাস ধরে সে বৌকে দেখে না৷
শাকিল হাইকোর্টের মোড় থেকে সিএনজি চালিয়ে আসছে। ইন্টার পাস করার পরে পড়ালেখার খরচ না চালাতে পেরে ঢাকায় এসেছে রোজগারের আশায়। এক মহাজনের সিএনজি চালায় দৈনিক ৫০০ টাকার বিনিময়ে।বৃষ্টির মধ্যে সিএনজি চালিয়ে যাচ্ছিল ফার্মগেট। ফাকা রাস্তা পেয়ে জোরে চালাচ্ছিল। হঠাৎ ওদের দেখে স্পিড টা কমিয়ে দেয়। ওদের বৃষ্টির মধ্যে হাটা দেখে ওর স্মৃতিতে ভেসে ওঠে ওর স্কুল জীবনের ভালোবাসা রুপার কথা।এক মুহুর্তে সে চলে যায় স্কুল জীবনে।
রুপা আর ওর এক ক্লাসের ব্যবধান ছিল।শাকিল প্রচন্ড ভালোবাসতো রুপাকে। এক বৃষ্টির দিনে রুপা আর শাকিল স্কুল শেষে বাড়ি ফিরছিল। বাড়ির গলিটা ভিজেছিলো তখন শ্রাবণ জলে। সেই জলে একপা দু'পা করে স্কুল ড্রেস পড়ুয়া রুপা ছাতা হাতে হাঁটছিলো। আর কাঁধের ব্যাগ সামলাচ্ছিলো৷ শার্টের ইন খুলে শাকিলও আসছিলো রুপার পিছন পিছন, রুপার চোখে লজ্জা। শাকিলের চোখে উন্মাদনা।
রুপা হাঁটছে ধীরে ধীরে যেন শাকিলের চেয়ে তফাৎ না
বাড়ে। রাস্তায় পানি জমেছে- গলিটা ভিজছিলো আপন মনে। শাকিলের বুকে হাতুড়ি বাজছে যতোই রুপার কাছে যাচ্ছে। রুপার পিঠের ব্যাগ ভিজে গেছে। চুলের বেনী ভিজে গেছে। বেনীতে বাঁধা সাদা ফিতেও। শাকিলের ও খেয়াল নেই হাত ঘড়িটা ভিজে নষ্ট হয়ে গেলে বাসায় বকবে। একটু বাঁক নিয়েই রুপা ইটের রাস্তায় টুপ করে ঢুকে গেল।
শাকিলের গলার কাছে দলা পাকালো শূন্যতা- হারিয়ে গেলো মেয়েটা! ও একটু জোরে হেঁটে যেই ইটের রাস্তায় গলির মুখে দাঁড়ালো; ওমনি ওর পা কেঁপে উঠলো। মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে ছাতা হাতে। শাকিল রাস্তার পানিতে টুপ টুপ করে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। পানিতে ওর পায়ের শব্দ ওর মুখ লজ্জায় আরো লাল করে দিল।
ও রুপার সামনে এসে দাঁড়ালো। নীল সাদা ইউনিফর্মে মেয়েটাকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মনে হচ্ছে। দু'জনের ছাতায় টপ টপ বৃষ্টির শব্দ। কেউ কারো চোখে এক সেকেন্ডের বেশি তাকাতে পারছে না। শাকিলের চিবুকে দুর্বাঘাসের মতো দাড়িতে বৃষ্টির ফোটা লেগে আছে। রুপা হাত দিয়ে মুছে দিতে চেয়েও দিল না। দুজনেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কোন কথা বলতে পারছে না৷ শাকিল ই ওর হাত টা বাড়িয়ে মেয়েটির গালে হাত রাখল। রুপার সমস্ত শরীর কেপে উঠল ওর শীতল স্পর্শে। হঠাৎ রিকশার টুংটাং আওয়াজে দুজনে সরে গেল।
প্রথম প্রেম ভিজছিলো তখন গলির সাথে শ্রাবণ জলে। ওরা হাঁটছে দুই দিকে আর ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখছে পিছু ফিরে ফিরে।
শাকিল ব্যাগে করে রুপার জন্য কদম ফুল এনেছিলো। ব্যাগ খুলতেই দেখে কদম ফুল তেমনই আছে। কিন্তু প্রথম প্রেমের ফুল কখনো কি আর দেয়া হবে!
শাকিল হাঁটছে, বৃষ্টি বাড়ছে। রুপা কাঁদছে গুমরে গুমরে- ওর যে সেই শীতল স্পর্শটা চাই। শাকিল হাতটা নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ নিতে চাইলো। শিউরে উঠলো। কেমন একটা মন ভরে দেওয়া গন্ধ।
রুপার বিয়ে হয়ে যায় এস এস সির পরে।শাকিলের সাথে ওর সম্পর্কের কথা জেনে যাওয়ায় জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় ওর বাবা। রুপার হাজার বারন কোন কাজে আসেনি। শাকিল এর পরে কাউকে এখন ও ভালোবাসতে পারেনি।
ও রুপাকে মনের মাঝেই কবর দিয়েছিল। ভেবেছিল ভুলে যাবে ওকে৷ আজকে ওদের দেখে আবার মনের অজান্তেই বলে উঠল ভালোবাসি রুপা, ভালো থেকো তুমি, সুখে থেকো৷ প্রেমিক যুগলের দিকে আরেকটি বার তাকিয়ে স্মিত হেসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিএনজির স্পিড বাড়িয়ে চলে যায়।
সবার নজর কাড়া প্রেমিক যুগল আপন মনে হেটে চলে।সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলেও তারা কারো দিকে না তাকিয়ে হাটতে থাকে নিজের গন্তব্যের দিকে।
রনি আর শ্রাবনী সেই চৈত্রের বৃষ্টির মাঝে হেটে কত দূর গিয়েছিল, কোথায় আছে, কেমন আছে তা লেখকেরও অজানা.....
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ১২:১৪