somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মধ্যবিত্তের বেড়ে উঠা আর জীবন সংগ্রাম। প্রেক্ষাপটঃ একজন মেয়ের বাস্তব জীবন।

০৯ ই এপ্রিল, ২০১২ দুপুর ১:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তার ছোট বেলা আমার দেখা হয়নি। যেটুকু জেনেছি তাতে তার দস্যিপনা আর দুঃসাহসী কার্যকলাপের কথা শুনে বেশ ঈর্ষা করেছি। থেকেছে ঢাকায়। আর ছুটিতে মামা বাড়ির পুরো গ্রাম জুড়ে ছিল তার অবাধ বিচরন। একটু বড় হবার পরই একইসাথে দায়িত্ব নিতে হয়েছে বাবার সংসারের। বাবা ছিলেন ৫ ভাই বোনের মধ্যে একমাত্র শিক্ষিত ছেলে। পাঠক ৩৫/৪০ বছর আগের কথা বলছি। টিপিক্যাল মধ্যবিত্তদের মত সরকারি চাকরিজীবী বাবা চার সন্তানসহ থাকতেন ঢাকা। আর মা ছিলেন বড় গৃহস্থ যৌথ পরিবারের গৃহবধূ যাকে অধিকাংশ সময় সংসারিক প্রয়োজনে, শ্বশুর শাশুড়ির কথামত থাকতে হতো গ্রামে।

এইসময় তিন ছোট ভাই বোনের খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে পড়াশুনার দেখভালের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। কতই বা বয়স তখন তার? স্কুলে পড়তেন এতুকু জানতে পেরেছি। বাবার সিমিত আয়ের টাকায় সংসার চালানোর পাশাপাশি নিজেও কাজ করে কিছু আয় রোজগার করতেন। তাতে নিজের স্কুলের খরচ আর রিক্সা ভাড়াটা হয়ে যেত।

৪ ভাই বোন আর তাদের বাবা সরকারী কোয়ার্টারে থাকতো দুই রুমের ফ্ল্যাটে যার এক রুম সব সময়ের জন্য ব্যয় সংকোচন নীতিতে সাবলেট দেওয়া হতো। যে প্রতিষ্ঠানের অনেক নিচু কর্মচারীরা সেই সময় রেডিও টিভি কিনেছে, ঢাকায় জমি বাড়ি করেছে তাদের থেকে অনেক উপরে থাকার পরও সততা রোগে আক্রান্ত মেয়েটির বাবা ঢাকায় করতে পারেনি কিছু। যাই হোক মেয়েটির কথায় ফিরে আসি। পরিবারের চাপ সামলিয়ে, ছোট ছোট ভাই বোনদের দেখাশুনা করেও দেখা গেল মেয়েটা একদিন ম্যাট্রিক পাস করে ফেলেছে প্রথম বারেই। তাও আবার কোন গৃহশিক্ষকের সাহায্য ছাড়াই, তাছাড়া সেই সময় মেয়েদের পিছনে ব্যয় করার জন্য এত সময় বা টাকা কেই বা খরচ করতো?

হঠাত মেয়েটা প্রেমে পড়ে গেল। হ্যাঁ, প্রচণ্ড বাস্তব বোধ সম্পন্ন মেয়েটা বোকার মত প্রেমে পড়ে গেল এক বেকারের। তাও আবার গুলি খেয়ে হাসপাতালের বেড থেকে সদ্য উঠে আসা এক ছেলের। ছেলেটার কোন দোষ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর দশটা নিরীহ গোবেচারা ছেলের মতই কারো সাতে পাঁচে না থেকে দিন কাটানো একটা প্রচণ্ড মেধাবি ছেলে রাজনৈতিক অস্থিরতায় উত্তাল ক্যাম্পাসে কিছুই না বুঝে উরুতে হজম করে বসলো একটা গুলি। পাঠক একবার ভাবুন, কোন অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই চোখের সামনে ছেলেটির উরু থেকে ডাক্তার কেটে নিল ৩/৪ কেজি মাংস। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেল। পা টিও হারাতে হয় নি শেষ পর্যন্ত। এমন ছেলের প্রেমে পড়া কোন মধ্যবিত্ত মেয়ের জন্য শুভ লক্ষন নয় মোটেই।

মফস্বল শহরের সেই চালচুলোহীন ছেলেটিকেই বিয়ে করে মেয়েটি। তবে কাপুরুষের মত নয়। বাবা, মা, আত্মীয় স্বজন সবাইকে মানিয়ে তবেই। বিয়ের পর ঢাকার পাঠ চুকিয়ে এবার বেকার স্বামীর হাত ধরে কলেজে পড়া মেয়েটির মফস্বল জেলা শহরে যাত্রা। সময়টা হল ১৯৮৭। জেলা শহরে বাসা হলেও বিবাহিত জীবন শুরু হয় গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে। শ্বশুর, শাশুড়ি, দুই ভাসুর, দুই জা আর দুই ননদের সংসারে কম কথা শুনতে হয়নি সদ্য বিবাহিত মেয়েটিকে। হাজী বাড়ির ছোট বউ বলে কথা। কোথাও গেলে বোরকা পড়ে রিক্সার চারপাশে কাপড় পেঁচিয়ে তারপর যেতে হতো। স্বামীর বেকারত্ব যেন ছিল শাশুড়ি আর সবার বড় ভাসুরের ঝাড়ি দেবার লাইসেন্স । ১ বছর ১ মাসের মাথায় প্রথম সন্তান। কিছু দিন পর গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা। সবার তীব্র বিরোধিতা সত্তেও স্বামীর উৎসাহে পড়াশুনা চালিয়ে যায় মেয়েটি। যতটুকু শুনেছি, ভোর বেলায় সদ্য হাটতে শেখা বাচ্চা নিয়ে ভদ্রলোক বের হয়ে যেতেন সবার অগোচরে (সেই ছোট্ট বাচ্চাই আজ এই পোস্টের লেখক)। এই ফাঁকে পড়াশুনা করতে হতো। কেউ টের পেলেই সর্বনাশ। এভাবেই চলছিল। স্বামীর স্বপ্ন স্ত্রীকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। দুর্ঘটনায় পড়ে নিজে যা পারেনি স্বপ্ন স্ত্রীকে সেই পর্যন্ত নিয়ে যাবেন। আস্তে আস্তে স্বামী নিজের পেশায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাঝে মেয়েটি প্রাইমারি স্কুলে চাকরীও পায়।
কিন্তু বিধি বাম। একদিন তার শরীরের বাম পাশ পুরোটাই প্যারালাইজড হয়ে গেল। সময় ১৯৯৫। স্বামী সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করে বাঁচাতে। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ৩/৪ মাস এক প্রফেসরের অধীনে থেকে চিকিতসা নেয়। কিছুটা উন্নতিও হয়। তবে তা যে আরও খারাপের পূর্বলক্ষণ কে জানত?

পুরো ট্রিটমেন্ট ভুল ডায়াগনোসিস এর ভিত্তিতে হয়েছিল। ফলাফল আবারো শয্যাশায়ী। এবার শেষ চেষ্টা ঢাকায়। কিন্তু রাজনীতি বারবার পরীক্ষা নিচ্ছিল তাদের। অবস্থা যখন অন্তিম পর্যায়ে, ঢাকা নিয়ে আসার সব ব্যবস্থা চুড়ান্ত তখন আওয়ামী লিগের ৯৬ ঘণ্টার অসহযোগ আন্দোলন। ৪ দিন সে কি বেঁচে থাকবে এই প্রশ্নের উত্তরে স্থানীয় ডাক্তার রা থেকেছিল নিরব। যাই হোক ৪ দিন টিকে গেল। গন্তব্য তখনকার পিজি হাসপাতাল। ৬ মাস দীর্ঘ চিকিৎসার বেঁচে থাকার মত অবস্থা নিয়ে আবার ফিরল স্বামীর ঘরে। তবে হার্ট আর কিডনিতে স্থায়ী সমস্যা নিয়ে। ডাক্তারের কথা মত ২১ দিন পর পর আজীবন নিতে হবে ১২ লাখ পাওয়ার এর ইনজেকশন। টেনশন করা নিষেধ আর সব ধরনের ভারি কাজ হারাম। ডাক্তাররা বার বার বলে দিলো এর পর বাচ্চা নিলে খারাপ কিছু হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। ৭ বছরের ছেলেটির মা না থাকলে কি হবে এই টেনশনে তাঁকে পেয়ে বসেছে তখন। স্বামীর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পড়াশুনা আর চালিয়ে যেতে পারলনা।

কিন্তু বসে থাকা তার ধাতে নেই। একটা কিছু করতে হবে। মেতে উঠলো সংগঠন নিয়ে। স্থানীয় নারী সমাজ ও দুঃস্থ মহিলাদের উন্নয়নকল্পে কাজ শুরু করল। নিজের অসুস্থতাকে ভুলে থাকার জন্য কাজের মাঝে ডুবে গেল। গ্রামের অনেক মহিলাদের নিয়ে শুরু করল হস্তশিল্পের প্রোজেক্ট। প্রোজেক্ট মানে বিদেশি টাকায় চালানো পেপার ওয়ার্ক নয়। নিজের টাকা, মেধা, শ্রম, ঘামে গড়ে তোলা প্রোজেক্ট। স্বীকৃতিও পেল। কয়েক বছরের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে জাতীয় যুব পুরস্কার, দিল্লিতে কমনওয়েলথ উইমেন্স এন্ট্রাপ্রেনার কনফারেন্সে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নেয়।
প্রচণ্ড ইচ্ছায় ডাক্তারদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দ্বিতীয় বারের মত মা হন। এবার মেয়ে।
১৯৯৯ সাল। এবার আরেক বিপর্যয়। তার একমাত্র ছেলে রিউমেটিক ফিভারে আক্রান্ত। প্রথমে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ তারপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ। ১০৭ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে ডাক্তারদের ভবিষ্যৎ বানী উপেক্ষা করে আল্লাহ্‌র রহমতে ফিরে এল মৃত্যুর দরজা থেকে।

এরই মাঝে ছেড়ে দেন প্রাইমারী স্কুলের হেডমিস্ট্রেস এর চাকরি।
কিন্তু হঠাত তার মনে হয় অসমাপ্ত শিক্ষা জীবনের কথা। আবার পড়াশুনা শুরু। তবে এবার নিজের ইচ্ছায় আর অর্থে। আইন প্রথম পর্ব করা ছিল আগেই। সেই কাগজ পত্র নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। প্রতি সপ্তাহে এক বার ২৫০+২৫০ কিলোমিটার যাতায়াত করেছেন ভার্সিটি তে ক্লাস করার জন্য। টানা দুই বছর চলে এমন করে। একসময় ডিগ্রি নেওয়া হল তারপর প্র্যাক্টিশনার হিসেবে সনদও পেলেন

(লেখাটা বড় হয়ে যাচ্ছে। আরেক পর্বে শেষ করবো।)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০১২ সকাল ১০:০৯
৩১টি মন্তব্য ২৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×