পার্বত্য অঞ্চলগুলোয় মানুষের বসবাস ভৌগোলিক বাধার কারণে অনেকটাই সীমিত। পাহাড়ার যে অংশগুলো কেটে প্রধান রাস্তা করা হয়েছে তারই আশেপাশের অংশে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আবার কোথাও আনসার ক্যাম্প, বিডিআর চেকপোস্ট ইত্যাদি। আদিবাসীদের বাস এই প্রধান সড়কগুলো থেকে বেশ খানিকটা দূরে। রাস্তার আশেপাশে অল্প কিছু দোকানপাট-বৌদ্ধমন্দির/ বিভিন্ন ধর্মীয় অবকাঠামো...। মসজিদ মাদ্রাসা একটু বেশী দৃশ্যমান। এর অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে জাতীয়তাবাদী আমলে, কিছু সামরিক শাসনামলে (আশি ও নব্বুইয়ের দশকে)। অবকাঠামোগত উন্নয়নটা ধর্মীয় ঘরানার মধ্যেই অনেকটা সীমাবদ্ধ।
বান্দরবান শহরে জেলা পর্যায়ের কেন্দ্রীয় ও স্হানীয় সরকারের বিশেষ কিছু typical অবকাঠামো লক্ষনীয়। জেলা পর্ষদ/পরিষদ, পৌরসভা অফিস, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর অবকাঠামো ইত্যাদি। সর্বসাধারণের সুবিধানির্ভর কিছু স্ট্রাকচারও অবশ্য দেখা যায়। কিছু মার্কেট (মাঝারী - একতলা/দোতলা) দেখা যাবে এখানে।
আমাদের সেনাবাহিনী আপ্রাণ প্রচেষ্টায় এখানে অনেক কাজই হয়েছে- যার একটা হলো সড়ক। প্রশ্ন হলো আজকে পর্যন্ত এই যে সেনাবাহিনীর অবস্হান নিয়ে আলোচনা/সমালোচনা- চুক্তি বহু কিছুই হলো বা হচ্ছে তাতে এই পার্বত্য অঞ্চলটার সাধারণ পরিবেশ এবং বসবাসরত মানুষগুলোর কী/কতটাই বা যায় আসে?
আদিবাসীরা বসবাস করে অনেকটাই ভিতরে।
আদিবাসী বলতে এখানে বিভিন্ন আদিগোষ্ঠীর বসবাস। এক 'ম' অক্ষর দিয়েই ম্রো, মুরং, মম্ ইত্যাদি বেশ কতগুলো উপজাতী আদিবাসীর বসবাস। সব মলিয়ে মোটামুটি শ'খানেক জাতের গোষ্ঠী তো আছেই। আমরা এই আলোচনায় খুব সচেতনভাবে যে তে চাই।
চিম্বুক পাহাড়ের আলোচনায় চলে আসি।
বান্দরবান জেলা শহর থেকে প্রায় বাইশ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে চিম্বুক পাহাড় অঞ্চলটির অবস্হান। তিনটি উল্লেখযোগ্য অংশ দৃশ্যমান এখানে।
প্রথমতঃ পর্যটন এলাকা। চিম্বুকের সবচাইতে উঁচু অবস্হানের যে টিলা তার উপরে এর বিস্তৃতি। সাধারণ মানুষজন এবং দর্শনার্থীদের জন্য কিছু প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত।
সাধারণতঃ বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এই পুরো অঞ্চলের সারা-প্রকৃতি! পরিবেশ আবহাওয়া জনমানুষ বন ও বনায়ন ভূপৃষ্ঠের অবস্হানগত বৈচিত্র্যের সে এক সার্বিক চিত্র!
দ্বিতীয়তঃ আদিবাসীদের/স্হানীয় জনসাধারণের অবস্হানগত এলাকা। এই অংশটি প্রধান সড়কগুলো থেকে কিছুটা দূরবর্তী অবস্হানে দৃশ্যমান। এর মধ্যে বেশ কিছুটা বিভাজন পরিলক্ষিত হয়। অর্থনৈতিক বিভাজন। বিভিন্ন এলাকায় এরা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে সাধারণ বাঙ্গালি গ্রামের মতোই অবস্হান করে। প্রতিটা এলাকায় বাসস্হান ছাড়া অবকাঠামোগত খুব বেশী স্হাপনা নেই। বছরে একবারই একটা মেলা হয়। আর সেটি হলো 'বৈশাখী মেলা'।
তৃতীয়তঃ আর্মি ক্যাম্প এলাকা। দর্শনার্থী/পর্যটকরা এখানে বিচরণ করতে পারে তবে অনেকটাই রক্ষণশীল নিয়মকানূন পেরিয়ে। প্রায় পুরোপুরিই রক্ষণশীল এলাকা এটি। প্রায় বিশ তিরিশ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সসস্ত্র সৈনিকের এক একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ টিম/দল এখানে অবস্হান করে। পুরো টিমের দায়িত্বে থাকেন একজন। তিনি কমিশন্ড (সাধারণত সর্বনিম্ন ক্যাপ্টেন) বা সিনিয়র নন্কমিশন্ডও (সাধারণত জিওসি) হতে পারেন। বাঁকি সবাই নন্কমিশন্ড। এই টিমটি বিভিন্ন মেয়াদী হয়। সাধারণতঃ দুই থেকে তিন মাস পরপর জোয়ানদের শিফটিং হয় বা হতে পারে।
প্রধান সড়কের অল্প রেন্জের মধ্যেই কার্যক্রম ও নিরাপত্তাভিত্তিক হালকা অবকাঠামোগত অবস্হান পরিলক্ষিত হয়। ক্যাম্পের এই অবকাঠামোগুলো সচরাচর অত্যাধুনিক তেমন কিছুও নয়। দু'একটা ব্যারাক, হ্যালিপ্যাড (এটি প্রায় প্রতিটা ক্যাম্পেই একটা কমন ফাইন্ডিং), চেকপোস্ট ইত্যাদি। চিম্বুকের আবহাওয়াগত সৌন্দর্য বা বৈচিত্র্যের একটা বড় অংশ এখান থেকে দৃশ্যমান।
মোটামুটি মানুষের অবস্হানগত তিনটি বিভাজন দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে এখানে।
আসি আমরা মধ্যবর্তী মূল কিছু আলোচনায়।
বান্দরবান এলাকাটিতে আদিবাসীদের একটা বড় অংশ এখনও বিদ্যমান যা খাগড়াছড়ির থেকে আলাদা। বহু জাতধর্মের আদিবাসী এবং বিজ্ঞ পাঠকমহল নিশ্চয় স্বীকার করবেন যে এই আদিবাসী - অভিবাসী সব একাকার হয়ে গেছে। মারমাদের মারমাত্ব, গাড়ো'র গাড়োত্ব......(...)'র (...)ত্ব আর বাঙ্গালীদের বাঙ্গালিত্ব সব পাশাপাশি ঠেলাঠেলি ক'রে চলেছে নির্বিকার চিত্তে বিগত কত দশক ধ'রে!
তা জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিভাজন যাই থাকুক অর্থনীতির বাস্তব বিভাজনটাতে একটু আলোকপাত ক'রে নিই।
কৃষি-অর্থনীতি
একটা ছোট্ট সাম্প্রতিক(আধুনিক) উদাহরণ দেয়া যাক।
"হাইব্রিড পেঁপে বীজ" পরিস্কার উচ্চারণে বলতে পারে নিলাদ্রী পর্যটন কেন্দ্র থেকে একটু দূরের ওই মানুষগুলো যাদের ভাষাগত একটা চূড়ান্ত অমিল বাঙ্গালীদের সাথে। হাইব্রিড এই পেঁপে এখানে চাষ করা হয় ব্যাপক পরিমাণে। স্হানীয় বাজারে মূল্য প্রতি কেজি ৩৫ টাকা। এক এক উৎপাদক/কৃষক ২০০ থেকে ৩০০ কেজি (অথবা তারও বেশী) পর্যন্ত উৎপাদন করে। মানে একদম ওই উৎপাদকের হাতেও বেশ কিছু (৮ থেকে ১০হাজার) ক্যাশ/কাঁচা টাকা আসে। তাদের চাষপ্রণালীতে কিছু সুবিধাও বর্তমান।
প্রথমতঃ পানির প্রাপ্যতা বা সেঁচ। আলাদা করে তেমন কোন পানির প্রয়োজন হয় না। মেঘেদের দেশে আবার পানির প্রয়োজন কী- কৃষিতে! দ্বিতীয়তঃ জায়গা/জমির সীমাবদ্ধতাও ততটা নেই বা জমির অভাবও নেই। বরং বলা যায় কষ্ট ক'রে কৃষি করার লোকবলই প্রতুল।
এই হাইব্রিড পেঁপে চাষপ্রণালীটিও যথেষ্ট সহজই। বীজটা সংগ্রহের পর ওরা জমিতে বপন করে। নিরানী বলতে মাটিটা একটু নেড়েচেড়ে দেয়। ব্যস্। তিনমাসের (শরৎ+ শরতোত্তর সময়কাল) মধ্যেই ফল পাওয়া যায়।
যা হোক বলা হচ্ছিল যে ওই উৎপাদকের হাতেও কিছু ত্রৈমাসিক কাঁচাটাকা আসে। তার খরচটা কিন্তু হয় আবার ভিন্নমাত্রিক। কিনতে হয় দৈনন্দিন খাদ্যদ্রব্য বলতে শুধু তেল মূলতঃ (কেরোসিন)। আর লাগে লবনটা। বীজ সংগ্রহ খরচ আর আনুসাঙ্গিক প্রধান আর অপ্রধান খরচ মিলিয়ে হাতে ৩/৪ হাজার ত্রৈমাসিক থাকবে।
আদিবাসীদের তৈরী কাপড়ও অনেকটা স্বস্তা। গুটিসুতা দোকান/বাজার থেকে কিনে বাঁশ ধাপে বাতাবিশেষএর উপর ওই নানারঙ্গের সুতোগুলো নানা শৈল্পিক কায়দায় দৃশ্যতঃ অনেক কঠিন বলে মনে হয় সাজিয়ে গুছিয়ে বিছিয়ে কিভাবে যেন নানারঙ্গের সমন্বিত কাপড় তারা তৈরি করছে।
পানি/খাবার পানির প্রসঙ্গে আসি। বৃষ্টির পানি দিয়ে এরা কৃষিকর্ম ছাড়া আর কিছু করতে পারে না বা সম্ভব হয় না। গৃহস্হালী কর্ম, দৈনন্দিন প্রয়োজন- এসবের জন্য এরা কাছাকাছি কোন পানির উৎস দেখে। সেটা বিশেষতঃ ঝর্ণাই হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় শৈলপ্রপাত-এর কথা। বান্দরবান শহর থেকে ১০/১২ কিমি দূরে চিম্বুকের দিকে যেতে এটি দেখা যাবে।
ওই ঝর্ণার পানিটাই সাধারণত ফুটিয়ে ওরা খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করে।
এ বাদে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন কাজকর্ম করতে পাম্প দিয়ে পানি নীচ থেকে পাইপের সাহায্যে উপরে তোলা হয়।
..........................................................................................
বর্তমানে বান্দরবানের পুর্বে মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ নিয়ে অস্হিরতা চলছে দেশ দুটির মধ্যে। এখানকার (বান্দরবান) আদিবাসীদের ভিতরে কৃষ্চিয়ান মিশন(Christian Mission)'র কর্মকাণ্ড চলছে পুনঃ পুনঃ বিভিন্ন বেসরকারি বিদেশী ফান্ড-সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান। এমনকি জাতিসংঘের অনেক অঙ্গ-সংগঠন ও প্রতিষ্ঠেনগুলোও এই মিশনটির পর্যবেক্ষণে সবসময় ব্যস্ত অত্র এলাকায়। ............(চলবে আশা রাখি)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ১০:৪৬