somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশ ভারত ছিটমহল ইস্যু সমাধান

২০ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১০:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডের নতুন একটি ইতিহাস। ঐতিহাসিক তথ্যমতে ৬৮ বছর ধরে প্রত্যক্ষভাবে জিইয়ে থাকা বাংলাদেশ ভারত ছিটমহল ইস্যু। ৬৮ টি মোমবাতি জ্বালিয়ে ৩১শে জুলাই দিবাগত রাত ১২ টায় (১লা আগস্ট) পরিচয়বিহীন কিছু জনপদ নিজেদের জাতীয়তার পরিচয়প্রাপ্তির আনন্দ উদযাপন করেছে। সহস্র মোমবাতির আলো তাদের মাথায় স্বীকৃতভাবে এসে পড়েছে- এটুকু বাস্তব। হয়ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সামগ্রিক অর্থে কতগুলো মান নির্ধারণী মাপকাঠিতে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয়েরই সংযোজন হয়েছে, তবে সর্বোপরি এই মুহূর্তে বলা যায় এটি বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের মূল কাঠামোতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
এক.
গঠনগত ভূমিবিষয়ক পরিসংখ্যানটা খুব জটিল কিছু নয়। ‘ছিটমহল’ বা ‘Enclave’ শব্দটির অনেক ধরণের (যেমনঃ অভিধানগত, সমাজবিজ্ঞানগত, নৃতাত্ত্বিক, সংবিধানগত, আন্তর্জাতিক ইত্যাদি) সংজ্ঞার মধ্যে যে মূল বিষয়টি বোঝা যায় তার একটা সরলিকরণ আছে।
প্রথমতঃ ‘ছিটমহল হচ্ছে এমন একটি মহল বা ক্ষেত্র যার তূলনামূলক বৃহৎ একটি ভূ-খণ্ড আছে, জনগোষ্ঠী আছে।’
দ্বিতীয়ত এই ভূখণ্ড আর জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ঠ্য নিয়ে কোথাও স্বল্প কোথাও একটু বিস্তৃত বলা হয়েছে। ‘ভূখণ্ডটির অধিকাংশ বা পুরোটাই এক রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে এবং অধিবাসী জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি(Culture) ও জাত্যবোধ(Ethnicity) অন্য একটি রাষ্ট্রের(গোত্রের)।’
এই ভুখণ্ডটি আসলে কোন রাষ্ট্রের সরাসরি ও প্রামাণ্য কোন অধিকার পায় না। জনগোষ্ঠীর কোন জাতীয়তা সাধারণত থাকে না। অর্থাৎ তাদের কোন একটি রাষ্ট্রের বিশেষায়িত কোন পরিস্কার পরিচয় নেই।
দুটি পাশাপাশি সাধারণ সীমানাবেষ্টিত রাষ্ট্রের পারস্পরিক ছিটমহল থাকলে তা সাধারণত সীমান্তবর্তী এলাকায় হয়ে থাকে। যেমন বাংলাদেশ ভারতের ছিটমহল। আবার তা নাও হতে পারে যা প্রায় ব্যতিক্রম। যেমন লন্ডনে চীনাভাষী জনগোষ্ঠীর একটি ছিটমহল। (তবে ‘চিনাটাউন’ নামে একটা চাইনীজ জনগোষ্ঠী পৃথিবীর বহু সমুদ্রপাড়ে তাদের সৌখিন কুটিরশিল্পকেন্দ্রিক বসতি করে অভ্যস্ত যা সর্বক্ষেত্রে ছিটমহল নয় যেমন কক্সবাজারের বার্মিজ টাউনও ছিটমহল নয়।)
বাংলাদেশ ভারতের সীমান্তে সর্বমোট ১৬২টি ছিটমহল আছে। এর মধ্যে ১১১টি বাংলাদেশের ভূখণ্ডে যার ভূমির পরিমাণ ১৭,১৬০.৬৩ একর অর্থাৎ প্রায় ৭০ বর্গ কিলোমিটার। আর ৫২টি ভারতের ভূখণ্ডে যার ভূমি ৭‌১১০.২০ একর অর্থাৎ প্রায় ২৯ বর্গ কিলোমিটার। সর্বশেষ দ্বিপাক্ষিক জরীপে(২০০৭) সর্বমোট জনসংখ্যা পাওয়া যায় ৫১,৫৪৯ যার মধ্যে বাংলাদেশের ১১১টি ছিটমহল অংশে ৩৭,৩৩৪ ও ভারতের অংশে ১৪,২১৫।
এই ছিটমহলগুলোর একটি প্রধান লক্ষনীয় দিক হলো অধিবাসী জনগণের কোন বিশেষ জাতীয়তার পরিচয় নেই। আপনি খাচ্ছেন, ঘুমাচ্ছেন এমনকি কাজও করছেন। দিন মাস বছর পার হচ্ছে। কিন্তু আপনার কোন প্রামাণ্য দালিলিক পরিচয় নেই। জমি চাষ করছেন। কিন্তু জমিটা হয়ত আপনার দখলে নেই। এ অবস্থায় এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগে মানুষগুলো কিভাবে থাকতে পারে? তাই বোধ হয় খুব বেশী লোকজন থাকেও না।
তিন বিঘা করিডোরের গঠনটা একটু আলাদা। ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বার নিজে দেখার সুযোগ হয়। অনেকটা বড় প্রায় কয়েকশ’ একর ধানী জমির প্রায় মাঝখানে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর একটা ১৮৫মি লম্বা রাস্তা্। রাস্তাটির দুপ্রান্তে দুইটি গার্ডরুম। রাস্তাটির দু’পাশে তারকাঁটার দেয়াল এবং রাস্তার গা ঘেঁষে গার্ডরুমের কাছে ত্রিশ বাই বিশ ফিট সাইজের একটি ফোর্স-ব্যারাক আছে। করিডোরটির অনেকটা দূরে দিগন্তের সাথে মিশেছে গ্রাম। রাস্তাটির সাথে উল্লম্ব অর্থাৎ পূর্ব-পশ্চিম বরাবর রাস্তা বের হয়ে বাংলাদেশের পাটগ্রাম(লালমনিরহাট) ও দহগ্রামকে সংযুক্ত করেছে। করিডোরটি দিয়ে চলাফেরার ক্ষেত্রে সান্ধ্য আইন আরোপিত। দু’দেশের সীমানা নিরাপত্তা বাহিনী সার্বক্ষণিক কড়া নজরদাড়িতে রাখে পুরো করিডোরটি।
বাংলাদেশের মধ্যকার ভারতের সবচেয়ে বড় ছিটমহল হলো কুড়িগ্রামের ‘দাশিয়া ছড়া’।প্রায় সাত হাজার একর জুড়ে এর বিস্তৃতি।
দুই.
বাংলাদেশ ভারত সীমান্তবর্তী ছিটমহলের ঐতিহাসিক সংক্ষিপ্ত প্রেক্ষাপটে আসা যাক এবার।
১৯৪৭ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বৃটিশরা ভারতবর্ষ ছেড়ে যাবার সময় বৃহত্তম ভারতকে দুটি ভাগ করার ব্যবস্থা ক’রে যায়। তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্ব-বাংলার বৃহত্তর রংপুর আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় এই অংশগুলোয় উভয় দেশের কিছু ছিটমহল তৈরি হয়। আপাতদৃষ্টিতে দেশভাগের সময়ই এই ভূখণ্ড বিভাজন প্রক্রিয়া থেকেই এর উৎপত্তি বলে মনে হয়। এর কারণ কী তা পরবর্তী সময়কালীন ফলাফল দেখলেই অনেকটা অনুধাবন করা যায়- সেই আলোচনা এখানে করছি না।
১৯৫৮ সালে ভারতের জওহরলাল নেহেরু ও পাকিস্তানের ফিরোজ খান নুন ছিটমহল বিনিময় বা সমাধানের উদ্দেশ্যে একটা চুক্তি করতে উদ্যত হন। তখন ভারতের অংশে ‘দক্ষিণ বেগুনবাড়ী’ ছিটমহল নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং ভারতের পার্লামেন্টে চুক্তিটি অনুমোদন পায় না। পরবর্তিতে বিভিন্ন ইস্যুতে দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেতিবাচক দিকে গেলে চুক্তিটি অ্মীমাংসিত থেকে যায়।
১৯৭১-এ পূর্ববাংলা স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হলে ছিটমহল ইস্যুটা আবারও আলোচ্য হয়ে ওঠে।
১৯৭৪ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান ইন্দিরা গান্ধীর সাথে শেখ মুজীব চুক্তিটি নিয়ে বসেন। দু’দেশের মধ্যে ‘স্থল সীমানা চুক্তি’/ ‘Land Boundary Agreement’/LBA নামে একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি লিখিত হয় যা প্রধানমন্ত্রীদ্বয় স্বাক্ষর করেন ২৬শে মে, ১৯৭৪। তখন বেরুবাড়ী-১২ ইউনিয়নের ছিটমহলটি ভারত রাখতে চায় এবং বাংলাদেশ রাখতে চায় আঙ্গুরপোতা ও দহগ্রাম। সেই সাথে ইন্ডিয়ার ওই অংশে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশের জন্য শেখ মুজীব একটি রাস্তা(১৭৮মি*৮৫মি) বা করিডোরের প্রস্তাব রাখেন যা ‘তিন বিঘা করিডোর’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চুক্তিটি ওই সময় দ্রুত অনুমোদন দেয়। তবে (তখনও) বিশেষত আরও তিনটি জায়গার সীমানা নির্ধারণে অস্পষ্টতা থাকে-
১) পশ্চিমবঙ্গের দইখাতা-৫৬
২) ত্রিপুরার বেলোনিয়ায় মুহরী নদী এবং
৩) আসামের ডুমাবাড়ীর লাঠিকিলা
এতে চুক্তিটি ভারতের দিক থেকে চূড়ান্তকরণে সময়ক্ষেপণ হয় এবং এবারও অমীমাংসিত থাকে।
এরপর ১৯৮২ সালের ৭ই অক্টোবর বাংলাদেশ ভারত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে তিন বিঘা করিডোরের ইজারার শর্তাবলী স্পষ্ট করে একটি পত্র বিনিময় হয়। পত্রে ভারতের পরিস্কার নিয়ন্ত্রণ সুস্পষ্টভাবে লক্ষনীয়।
১৯৯২ সালে তিন বিঘা করিডোর বাংলাদেশকে ’৭৪-এর চুক্তি ও ’৮২-এর পত্রের আলোকে ইজারা(Lease) দেয়া হয়। এ বিষয়ে দু’দেশের মধ্যে পত্র বিনিময় হয় ২৬ মার্চ এবং তাতে স্বাক্ষর করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জে. এন. দিক্ষিত এবং বাংলাদেশের অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব এ এইচ মাহমুদ আলী।
১৯৯৭ এ দু’দেশের যৌথতায় ছিটমহলগুলোর একটা তালিকা তৈরি করা হয়।
২০০১ এ দু’দেশের সম্মিলিত উদ্যোগে ছিটমহলগুলোর বিস্তারিত বিবরণ তৈরী হয়।
২০০৭ এ আবারও দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগে ছিটমহল এলাকায় আদমসুমারী হয়।
২০১১’র ৬ই সেপ্টেম্বরে ঢাকায় ১৯৭৪-এর চুক্তিতে কিছু সংযোজনের মাধ্যমে দু’দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। এতে বলা হয় ১৬২টি ছিটমহলের ৫১টি থাকবে ভারতের যার ভূমির পরিমাণ ৭১১০.০২ একর এবং বাঁকি ১১১টি পাবে বাংলাদেশ যার ভূমি ১৭১৬০.৬৩ একর।
সর্বশেষ ২০১৫ এর ১৭ই মে চুক্তিটি ভারতের লোকসভায় অনুমোদিত হয় এবং রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী তার অনুমোদন দেন ২৮শে মে ২০১৫। আর ঢাকায় এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তা অনুমোদন দেন ৬ই জুন ২০১৫। ৩১শে জুলাই দিবাগত রাত ১২টায় অর্থাৎ ১লা আগস্ট ছিটমহল বিনিময় চুক্তির ঐতিহাসিক কার্যকারিতা শুরু হয় দু’দেশের ‘সংলগ্ন স্থানীয় প্রশাসন’র উপস্থিতিতে।
ইতিহাসটা মোটা দাগে এইরকম।
তিন.
বাংলাদেশ ভারত ছিটমহলের অস্তিত্ব এখন আর নেই আছে একটা চুক্তি। ১৯৭৪ এর LBA (Land Boundary Agreement) কোন কাঠামোগত চুক্তি (Framework of Agreement) নয় বরং বাংলাদেশ-ভারত সীমানা সম্পর্কিত একটি পূর্ণাঙ্গ কার্যকর-উপযোগী চুক্তি। এর ভিত্তিতেই তৈরী হয় সর্বশেষ ২০১৫ এ চূড়ান্ত ও কার্যকরী হওয়া চুক্তিটি। এই চুক্তিটির বিশেষ একটি দিক হলো অধিবাসীদের ইচ্ছেমত জাতীয়তার পরিচয় পাবার সুযোগ। চুক্তিটির ভিতর থেকে একটু ঘুরে আসা যাক।
Annexure (I) & (II) তে সীমান্তবর্তী এলাকা এবং সমগ্র ছিটমহল নিয়ে পৃথক দুটি মানচিত্র নির্ধারিত হয়েছে। এতে (Annexure II) দেখানো হয়েছে মোট ১৬২ টি ছিটমহলের মধ্যে বাংলাদেশের মধ্যে ভারতীয় ছিটমহল ১১১টি আর ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের ছিটমহল ৫১টি যার ভূমির পরিমাণ আগেই বলা হয়েছে।
Annexure (III) হলো ১৯৭৪ এর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি। এই চুক্তিটি মূলত বাংলাদেশ ও ভারতের সাধারণ সীমানাবর্তী ভূখণ্ডের সুস্পষ্ট অবস্থান ও নির্দেশনা দেয়া আছে। এর মধ্যে কয়েকটি অংশের অবস্থান নিয়ে দ্বিপাক্ষিক সিদ্ধান্ত এবং সিদ্ধান্তের ভবিষ্যৎ নির্দেশনার কার্যকারিতা তখনও চূড়ান্ত না হওয়ায় তা ছিটমহল হিসেবে অমীমাংসীত থাকে। ’৭৪-এর চুক্তির এরকম একটি অংশ উদাহরণ হলো আর্টিকেল-১ এর ৫নং দফা। এখানে লেখা আছে, “The boundary in tha area should be demarcated along the mid stream of the course of Muhuri River at the time of demarcation. This boundary will be a fixed boundary. The two governments should raise embankments on their respective sides with a view to stablishing the river in its present course.” অর্থাৎ দুই দেশের সীমানা মুহুরী নদীর মাঝ বরাবর বাঁধ দিয়ে আলাদা হবে। এতে তাৎক্ষণিকভাবে আরও দেখা গেল নদীর একদিকের অংশের জনগোষ্ঠী যে দেশের ভাগে পড়ে তাদের একটা অংশ ওই দেশের পরিচয় চায় না। আবার বাঁধটা দিতে একটা ন্যূনতম সময়েরও প্রয়োজন। পরবর্তীতে এই সমস্যার সমাধান করা হয় ধীরে ধীরে যা মূলত Annexure V- এ বিবৃত।
Annexure IV হলো ১৯৯২ সালের ২৬শে মার্চের তিন বিঘা করিডোর নিয়ে দু’দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে স্বাক্ষরকৃত পত্র বিনিময়। এটি মূলত ১৯৮২ সালের পত্রের চূড়ান্তরূপ। এতে প্রথমেই বলা আছে, “Indian flags will fly at the four corners of the tin bigha corridor as a manifestation of India’s sovereignty over the area;” অর্থাৎ করিডোরটির একচ্ছত্র সার্বভৌমত্ব ভারতের থাকবে। পূর্ব-পশ্চিম বরাবর অনুপ্রবেশের রাস্তার ব্যাপারে Clause#4 এ যদিও বলা হচ্ছে, “Two check points each are to be set up at both ends of the East-West road where it touches the Bangladesh boundary. They will be separately manned by Bangladesh and Indian authorities with a view to regulating the movement of traffic”/রাস্তাটির দু’প্রান্তেই বাংলাদেশ ও ভারতীয় নজরদারী চলবে। ঠিক পরেই Clause#5 এ লেখা আছে, “Traffic will be regulated by the Indian authorities” অর্থাৎ লোক চলাচল নিয়ন্ত্রণ করবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।
Annexure V এ ১৯৭৪ এর চুক্তির সমস্যার সমাধানকল্পে ৭৪’র সমন্বিতরূপ হিসেবে ২০১১-এ তৈরী হয় একটি প্রটোকল যাতে পররাষ্ট্রসম্পর্কিত আচরণবিধি ও নির্দেশনার সুস্পষ্ট রূপরেখা উল্লেখ করা হয়েছে। এর আর্টিকেল-২ এর ১ দফায় বলা হয়,
“Aricle 1 clause 5 of the 1974 agreement shall be implemented as follows:
Muhuri River (Belonia) sector.
Boundary in this segment shall be drawn westwards from the existing Boundary Pillar No. 2159/48-S along the agreed line as depicted in the index map prepared jointly till it meets the southern limit of the Burning Ghat as shown in jointly surveyed map of Muhuri river area in 1977-78. Thereafter it shall follow the external limit of the Burning Ghat in south west direction and then turn external limit of the Burning Ghat till it meets the centre of the exsting Muhuri river. thereafter it shall run along the mid stream of the existing Muhuri River upto Boundary Pillar No. 2159/3-S. This boundary shall be the fixed boundary. The governments shall raise embankments in their respective sides with a view to stablishing the river in its present course as stipulated in the 1974 agreement. The parties agree to fencing on ‘zero line’ in this area.” এতে সীমানা নির্ধারক বাঁধ ও তারকাঁটার সুস্পষ্ট অবস্থান উল্লেখিত হয়। এভাবে অমীমাংসীত ছিটমহলগুলোর সীমানা নির্ধারণপ্রক্রিয়া সরলিকরণ করা হয়।
Annexure VI ও VII এ যথাক্রমে ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোর একটা চূড়ান্ত তালিকার উল্লেখ করা হয়।
সব শেষে Annexure VIII ও IX এ সীমান্তে যথাক্রমে বাংলাদেশ ও ভারত কী পরিমাণ ভূখণ্ড একে অপরকে ছেড়েছে তার একটা তালিকা দেয়া আছে। এতে দেখা যায় বাংলাদেশ ছেড়েছে ২৭৭৭.০৩৮ একর আর ভারত ছেড়েছে ২২৬৭.৬৮২ একর। বাংলাদেশকে বেশী ছাড়তে হয়েছে ৫০৯.৩৫৬ একর।
২০১৫ এর ৩১শে জুলাই দিবাগত রাত ১২টায় অর্থাৎ ১লা আগস্ট এই যুগান্তকারী চুক্তি কার্যকরণ শুরু হয়। ফলে বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত ছিটমহল বাংলাদেশের এবং ভারতের মধ্যকার ছিটমহল ভারতের অধিকারে চলে যায়। আর জনগোষ্ঠীর জাতীয়তার পরিচয় স্বেচ্ছায় নেয়ার সিদ্ধান্তটা স্বাধীন করে দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ জানামতে ভারতের ছিটমহল থেকে কেউ বাংলাদেশের পরিচয় নিতে চায় নি। বাংলাদেশের ১০২৪ জন ভারতের পরিচয় নিতে চেয়েছে। এই ১০২৪ জনকে ভারতে চলে যেতে হবে ৩০শে নভেম্বরের মধ্যে।
চার.
বর্তমানে বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোর সার্বিক অবস্থা কী তা এতক্ষণে আমরা কিছুটা অনুধাবণ করেছি। বিদ্যুতের একটা খুঁটি যেখানে নেই সেখানে কতকিছুরই যে প্রয়োজন তার ইয়ত্তা নেই।
ছিটমহলগুলোর কোনটি কোন ইউনিয়ন বা থানার অধিভুক্ত হবে তা নির্ধারণ করা সরকারের প্রাথমিক কার্যক্রমের একটি। মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য বা জমির মালিকানার জন্য সুনির্দিষ্ট ঠিকানা প্রয়োজন। আবার সরকারের কোন জনসুবিধা প্রদান বিষয়ক কার্যক্রম(যেমন, বিদ্যুৎ বিতরণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি) শুরুর জন্যও সংশ্লিষ্ট এলাকাটিকে কোন ইউনিয়ন বা থানার অধিকারে নেয়া প্রয়োজন। এইসব প্রয়োজন মিটাতে সরকারের ইতিবাচিক ও বাস্তবসম্পন্ন উপায়ে ধাপে ধাপে কিছু নির্দিষ্ট প্রকল্পপ্রনয়ন প্রয়োজন যা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে বলে গনমাধ্যম রিপোর্ট করেছে যদিও সরকারের এই প্রকল্পে অর্থব্যয়ের সম্ভাব্য খতিয়ান জানা যায় নি। উল্লেখ থাকে যে, ওদিকে মোদী সরকার সেদেশের ছিটমহলের প্রাথমিক উন্নয়নপ্রকল্পে দুই বিলিয়ন রুপী বাজেট ধার্য করেছে যার মধ্যে থেকে মমতা(পশ্চিমবঙ্গের জন্য) ইতিমধ্যে কিছু ডিমান্ড করে বসেছেন বলে জানা যায়।
মোট কথা বাংলাদেশ কিছু ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠিত অধিকারে নিয়েছে যেখানে কোন রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো নেই বা কোন রাষ্ট্রযন্ত্রও আগে থেকে ছিল না। এখানকার মানুষ সাদা কাগজের খসরা মানচিত্রে জমি চাষ করেছে যুগ যুগ ধরে। এই অঞ্চলের সার্বিক ক্রমোন্নতি শুরুর পুরো দায়ভারই মূলত রাষ্ট্রের। সেখানে শুধু সাঁইত্রিশ হাজার মানুষ গুনলেই চলবে না, মানুষের শুধু কাগুজে পরিচয় দিলেই হবে না- সেখানে নিশ্চিত করতে হবে মানুষের মৌলিক অধিকার ও জীবনের সার্বভৌমত্ব, সেখানে নিশ্চিত করতে হবে-
১) ভূমির সঠিকতর ও সুষ্ঠু অধিগ্রহণ ও ব্যবহার
২) শিক্ষার জন্য বিদ্যাপিঠ
৩) জনস্বাস্থের জন্য চিকিৎসাকেন্দ্রের সহযোগিতা
৪) ন্যয়বিচারের জন্য দৃপ্ত প্রশাসনযন্ত্র এবং
৫) সীমানা সম্পর্কিত পর্যাপ্ত জননিরাপত্তার সুব্যবস্থা।
সীমানাসংলগ্নতার কারণে সার্বভৌমত্বের সঠিক রূপরেখা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি অধিবাসী জনগোষ্ঠীর সকলের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।
সর্বশেষ কথা//
ছিটমহল সমস্যার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এটা বোঝা যায় যে এর সমাধানকল্পে বহু বছর ধরে এদেশের ভেতরে জনসাধারণের অবস্থান থেকে কিছু আন্দোলনপ্রয়াস চলে আসছিল। এক্ষেত্রে বিশেষত, ফেলানী হত্যামামলার প্রসিকিউটর এডভোকেট আব্রাহাম লিংকনের সমন্বয়ে গড়া ‘ছিটমহল বিনিময় কমিটি’ (Enclave Exchange committee) এর কথা খুব প্রণিধানযোগ্য। সম্প্রতি ১০শে আগস্ট ২০১৫ এই কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে এবং বর্তমানে তা গণ-অধিকার কমিটি(Civil Rights’ Body)তে রূপান্তরিত হয়েছে যার সমন্বয়ক অপরিবর্তিত। সরেজমিনে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে খুব দ্রুত এই এলাকায় সরকারদলীয় ও আসনসর্বস্ব বিরোধীদলীয় ভাগে উক্ত কমিটিসহ বিভিন্ন মহলের মানুষজন বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। এই চিত্রটা অদূর ভবিষ্যতে আর একটি নেতিবাচক দিকের ইংগিত দেয়। সরকারের নিকটসম্ভাব্য উন্নয়নমূলক কার্যক্রম মানেই হলো সম্ভাব্য অর্থ বা পুঁজি। এই পুঁজিকে কেন্দ্র করে বরাবরের মত দলীয় প্রভাবযুক্ত দূর্নীতি, পেশীশক্তি নির্ভর অর্থে অনিয়মতান্ত্রিক দলীয় টেন্ডারবাজী, সদ্যজাত স্থানীয় ক্ষমতা দখলের সন্ত্রাস আর মালিকবিহীন ভূমি আত্নসাতের নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই সুবিধাবঞ্ছিত দারিদ্র অধ্যুষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঘটে যেতে একের পর এক খুনের নিয়ন্ত্রণহীন লীলাখেলা। এ খেলা তো এদেশে স্বাধীনতার পর থেকে গুণোত্তর হারে বেড়েই চলেছে। সরকারের এদিকে সার্বিক সতর্কতা, সচেতনপ্রয়াস ও পদক্ষেপ আশু প্রয়োজন।
এতসব ভয়াবহ সমস্যার সম্ভাবনার মধ্যেও আগামীর সুন্দর কলূষতামুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখি। মারামারি কাটাকাটি ছাড়াই মিলে মিশে একে অপরের হাত ধরে ছিটমহলের প্রতিটি অংশ সুন্দরভাবে গড়ে উঠবে, জ্বলে উঠবে তাদের প্রতিটি ঘরে শিক্ষা সচেতনতা মনুষ্যত্ব আর প্রগতির উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো সেই প্রত্যাশাই করি।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১০:৫৮
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিসের সনদের মান নির্ধারণ করা শয়তানী কাজ

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪০



সূরাঃ ৯ তাওবা, ১০১ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০১। মরুবাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের আশেপাশে আছে তাদের কেউ কেউ মুনাফিক। মদীনাবাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ মোনাফেকী রোগে আক্রান্ত। তুমি তাদের সম্পর্কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছায়ানটের ‘বটমূল’ নামকরণ নিয়ে মৌলবাদীদের ব্যঙ্গোক্তি

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



পহেলা বৈশাখ পালনের বিরোধীতাকারী কূপমণ্ডুক মৌলবাদীগোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক পেইজগুলোতে এই ফটোকার্ডটি পোস্ট করে ব্যঙ্গোক্তি, হাসাহাসি করছে। কেন করছে? এতদিনে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে রমনার যে বৃক্ষতলায় ছায়ানটের বর্ষবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কটের সাথে ধর্মের সম্পর্কে নাই, আছে সম্পর্ক ব্যবসার।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৫০


ভারতীয় প্রোডাক্ট বয়কটটা আসলে মুখ্য না, তারা চায় সব প্রোডাক্ট বয়কট করে শুধু তাদের নতুন প্রোডাক্ট দিয়ে বাজার দখলে নিতে। তাই তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ড্রিংককেও বয়কট করছে। কোকাকোলা, সেভেন আপ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×