প্রথম পর্বে এই লিঙ্ক এর মাধ্যমে যেতে পারবেন।
রাশিয়াতে এসে সর্বপ্রথম যে অনুভূতিটা মাথায় আসলো, সেটা হল, "চলেই আসলাম তাহলে অন্য একটা দেশে।"
মস্কো দামোদেদোভা এয়ারপোর্ট।
ঠিক একটি দিনের মাথায় দেশ থেকে ৫৫০০ কিলোমিটার দূরে চলে আসলাম। সকাল ৮ টা থেকে রাত ১০টা। আস্তে আস্তে কিছু বাঙ্গালী, যাদের সাথে একসাথে আসলাম, তাদের সাথে এয়ারপোর্টের নিয়মকানুন পালন করে সামনে অগ্রসর হচ্ছি। এক পর্যায়ে মাইগ্রেশন কার্ডটা পূরণ করে, এখানকার কাস্টমস এ আসলাম। প্রথম আলো এর রস+আলো- তে যে রাশিয়ানদের কৌতুকপ্রবনতার কথা শুনেছিলাম, তা এক কাস্টমস আফিসারের রঙ্গ-তামাশা দেখেই বুঝে গেলাম। কোথায় আমাদের কাস্টমস আফিসাররা নিজেদের "FBI এজেন্ট" ভেবে প্রশ্ন এর পর প্রশ্ন করে যায়, আর এরা কিনা রঙ্গ-তামাশা করে। যাইহোক, হয়তোবা ওই ২ মিনিটের রঙ্গ-তামাশা মানসিকভাবে শক্ত হয়ে সাহায্য করেছিল। 'ব্যাগ এন্ড ব্যাগ্যজ' নেবার জায়গায় চলে আসলাম। খুব সহজেই পেয়ে গেলাম, এবং এই রুম এর বাহিরেই আসল মস্কো আমার জন্য অপেক্ষা করছে। যাদের সাথে আসলাম তাদের সাথে বিদায় নেবার সময়টাও পেলাম না যখন কোন এক রাশিয়ান লোক এর হাতে আমার নাম লেখা কাগজ দেখলাম। আরও চোখে পড়ল বিভিন্ন দেশের লোকরা নানান ধরনের নাম নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমি তখনও ওই লোকটার থেকে অনেকটাই দূরে। কিভাবে যেন লোকটা আমাকে দূর থেকেই ডাক দিল আর আমার জিনিসপত্র বহন করার জন্য সামনে এগিয়ে এসেই হান্ড-শেক এর জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। কিভাবে আমাকে চিনে ফেল্ল,তা এখন পর্যন্ত আমার মাথায় ঢুকেনি। যাইহক,তার সাথে তার গাড়ি পর্যন্ত আসলাম, আর আস্তে আস্তে মাথা ঘুরিয়ে মস্কো দেখতে লাগলাম। ভাগ্য ভালো যে-, লোকটা সামান্য ইংরেজি বুঝে।
তার গাড়িতে ভ্রমন এবং আমার প্রথম BMW- চরণ ।
লোকটার ব্যবহার অতিরিক্ত রকমের ভালো লাগলো। সব থেকে বেশি যেটা ভালো লাগলো, সেটা হল, লোকটা খুব আগ্রহের সাথে কথা বলছিল। কোন মানুষের চোখের দিকে তাকালেই তার কথা বলার আগ্রহ এর পরিমাণটা জানা যায়। সে আমাকে রাশিয়ান বা ইংলিশ বা অঙ্গ-ভঙ্গির মাধমে রাশিয়া সম্পর্কে এবং নতুন পরিবেশ সম্পর্কে বুঝাতে থাকল। আর আমি তার কথা শুনে আর গাড়ি থেকে মস্কো দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ট্রেন স্টেশনের দিকে। একসময় সে এক বিশাল বিল্ডিং দেখিয়ে আমাকে বলল, এটা Bank of Moscow। যাইহোক, দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম মস্কো এর এক রেল স্টেশনে। এখানে আর একজন মহিলা আমাদের দিকে এগিয়ে আসলো, এবং পরে জানতে পারলাম, তিনি নাকি আমার ভার্সিটি এর টিচার, যদিও তাকে আর পরে কোনদিন দেখিনি বিধায় ভেবে নিলাম, তাদের কথা ঠিক বুঝতে পারিনি মনেহয়। তিনি আমাকে কিছু খাবার কিনে দিলেন এবং ট্রেন এর সিট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বললেন পরেরদিন ১০টায় আমি আমার গন্তব্য, মানে রস্তভ শহরে পৌঁছে যাব। প্রথমে ভাবলাম, এ আর কি? রাতে ঘুমালেই কেটে যাবে, কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম এটা পরদিন সন্ধা/রাত ১০টা। তারা দু'জন আমাকে শুভ-কামনা জানিয়েই নেমে গেল ট্রেন থেকে, আর আমার শুরু হল একদিনের নিঃসঙ্গ ট্রেন ভ্রমন।
"ঝক ঝকাঝক ট্রেন চলছে রাত দুপুরে ঐ, ট্রেন চলছে ট্রেন চলছে, ট্রেনের বাড়ি কই"
ট্রেনের যে কামরায় আমার স্থান হল, সেখানে আমার সাথে আরও দুজন আছে। একজন মধ-বয়স্ক যুবক এবং একজন তরুণী। কিছুক্ষন বসে বসে বাহিয়ে তাকিয়ে ছিলাম।বলা যায়, উদাশিন-ভাবে। ক্লাস এইট থেকে যখন নাইন এ উঠি, তখন আমার রেসাল্ট কার্ডে আমার শ্রেণীশিক্ষক লিখেছিলেন,"ফলাফল ভালো তবে ক্লাসে একটু উদাসীনভাব লক্ষ্য করা যায়।" এটা বলার কারণ হল, তখনও সেরকম ভাবেই অনেকটা সময় পাড় করেছিলাম। তারপর চিন্তা করলাম একটু গান শুনি। সিমকার্ড এমনিতেও কাজ করছে না। তাই মোবাইলের প্রয়োজনীতা গান শোনার মাধ্যমেই মেটানো ভালো। গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়েও গেলাম। ঘুম ভাঙল সকাল ৮ তায়।এখনো ১২ ঘণ্টা। এই প্রথম কামরার তরুণীটা কিছু বলল, যদিও আগা মাথা কিছুই বুঝি নি। অন্যজন ও একবার কথা বলতে চাইল কিন্তু ভাষাগত সমস্যায় তা আর বুঝে উঠা সম্ভবপর হয়ে উঠল না। এরই মাঝে পুলিশ টাইপ কেউ একজন পাসপোর্ট চেক করল। চেক করার আগে জিজ্ঞাসা করল আমি ফ্রেঞ্চ কিনা। যাইহোক, বেপারটা তে মজা লাগলো। সে চলে গেলে, আবার চলল সেই একাকী বসে থাকা, তবে এখন আরও বিরক্ত লাগছে। ট্রেন চলেই যাচ্ছে, আর আমার মনে হচ্ছে ঘুরে ফিরে একই জায়গায় আসছি।মহা বিপদ। রাশিয়ার বিশালতার সামান্য পরিচয় পেয়েই গেলাম বতে।নানা জল্পনা কল্পনা পাড়ি দিয়ে এসে পড়লাম রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে। ট্রেন স্টেশনে চলে এসেছে, আমি আমার জিনিশপত্র নামাচ্ছি কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না ঠিক, এখানেই কি নামব নাকি। কেউ একজন নিজে থেকেই সাহায্য করল আর বলল আমি আমার গন্তব্যে এসে পড়েছি। বলতে বলতেই দেখলাম দু'জন বাঙ্গালী চলে এসেছে। ঐ লোকটাকে ধন্যবাদ দিয়ে ট্রেন থেকে নেমে আসলাম। দেশের বাহিরে দুটা দেশ এ আসলাম আর ট্রেন ভ্রমন করলাম, অথচ নিজের দেশের ট্রেনে এখন পর্যন্ত চড়া হল না। যাইহোক।
ট্যাক্সিতে চড়ে ২০ মিনিট রস্তভ শহর দর্শন ও হোস্টেলে পদার্পণ।
রস্তভ শহরটা কেন যেন আসার সাথেই সাথেই পছন্দ হতে শুরু করল।২০ মিনিটেই মনে ধরে গেল। কিছু সপিং-সেন্টার, গাড়ির দোকান আর রাত ১২টার রস্তভ শহরে কিছুক্ষন নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ফেলতেই পৌঁছে গেলাম আমার হোস্টেলে। এবং এর পর রুম নাম্বার ৩১১ তে। সেই রুমেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থেকেছিলাম। দেশের বাহিরে আমার উচ্চশিক্ষাটা শুরু হতে চলল তাহলে। দীর্ঘশ্বাস।
স্বপ্ন, স্মৃতি,অভিজ্ঞতা এবং বাস্তবতার মূল কেন্দ্রে রয়েছে এই রস্তভ শহরে কাটানো সময়। রয়েছে নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, নতুন আবহাওয়া, নতুন ভাষা সাথে নিয়ে অভিজ্ঞতার সাগরে সাঁতরে যাবার কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুভূতি। সে কথা না হয় আর একদিন বলা যাবে।
আগের পর্বের মতনও এই পর্বের সমাপ্তিটা একই ভাবে করি।সবসময় কোন লেখা শেষ করার সময় একটা উক্তি দিয়ে শেষ করা,আমার মতে ভাল।
"Get Busy Living Or Get Busy Dying" - আশা করছি যে আমি উক্তিতার প্রথম অংশেই আছি।
শান্তনু সেন। ( রাত ৩ টা বেজে ১৮ মিনিট, রবিবার ২২-০১-২০১২)