
শিক্ষা না কি সততা? আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কোনটি বেশি প্রয়োজনীয়?
একটি জাতির ভাগ্য পরিবর্তন ও উন্নতির স্বর্ণশিখরে পৌঁছুনোর জন্য শিক্ষা ও সততার মধ্যে কোন জিনিসটি বেশি প্রয়োজনীয়?
জানি অনেকেই বলবেন- শিক্ষা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক জাতির কথা জানা যায়, যেখানে শিক্ষার চেয়ে সততা দিয়ে তারা উন্নতির স্বর্ণশিখরে পৌঁছুনোর গৌরব অর্জন করেছে। তারমধ্যে সিম্পল দুটো উদাহরণ- একটি হচ্ছে মুসলিম জাতি আর আরেকটি হচ্ছে সিঙ্গাপুরিয়ান জাতি।
শিক্ষা থাকলেই মানুষ সভ্য হয় না। ইতিহাস সাক্ষী, যত বড়বড় দুর্নীতি আর পুকুরচুরি হয়েছে সবগুলোর পেছনে দায়ী তথাকথিত শিক্ষিত লোকজন। অশিক্ষিত লোকজনের দ্বারা ছিটেফোঁটা ব্যতিক্রম হলেও শিক্ষিত লোকজনই মূলত দুর্নীতি আর দেশের সম্পদ কুক্ষিগত ও দেশের বাইরে পাচার করার ব্যাপারে একমেবাদ্বিতীয়ম। অশিক্ষিত আর সহজ-সরল লোকদেরকে সাত-পাঁচ বুঝিয়ে বোকা বানিয়ে রেখে দিনের পর দিন চুরির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার কারিগর সেই মহান শিক্ষিত লোকজন। একটি বইয়ে পড়েছিলাম- একজন পিস্তলধারী গুণ্ডার চেয়ে একজন ব্রিফকেসধারী উকিল অনেক বেশি টাকা লুটে নেওয়ার সামর্থ্য রাখে।
মুসলিম জাতির ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়- ইসলামের স্বর্ণযুগে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক কম থাকা সত্ত্বেও তাঁরা উন্নতির স্বর্ণশিখরে পৌঁছুতে পেরেছিলেন শুধুমাত্র খোদাভীরুতা আর সততার দ্বারা।
অপরদিকে মাত্র আড়াইশ বর্গমাইলের দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুরের জনগণের প্রবল জনমত উপেক্ষা করে সিঙ্গাপুরকে যখন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী টেংকু আব্দুর রহমান মালয়েশিয়া থেকে আলাদা করে দিলেন, তখন হৃদয় ভাঙ্গা একবুক হাহাকার নিয়ে প্রেসিডেন্ট লি কুয়ান ইউ ৯ অগাস্ট সিঙ্গাপুরের স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে বাধ্য হলেন।
অশিক্ষিত আর বেকার লোকজনে ভরা ছোট্ট দ্বীপদেশ। নেই কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রায় সবাই জেলে, মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। প্রেসিডেন্ট অসম সাহসে বুক বাঁধলেন।
প্রথমে বাছাই করলেন কিছু মেধাবী মানুষ। প্রেসিডেন্ট এই মানুষগুলোর যে গুণটিকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য ও গুরুত্ব দিলেন, সেটি হলো 'সততা'। সিঙ্গাপুরের প্রতিটি মানুষের মধ্যে তিনি এই সততাকে গেঁথে দিয়েছিলেন। তারপর অসম সাহসে বুক বেঁধে একটি পশ্চাতপদ আর দরিদ্র জাতিকে নিয়ে দুস্তর পারাবার পাড়ি দেওয়ার সংকল্পে এগিয়ে যেতে থাকলেন। তারপরের ইতিহাস, সিঙ্গাপুরের অভূতপূর্ব উন্নয়নের ইতিহাস। কালক্রমে সিঙ্গাপুর আজ এশিয়ার অর্থনৈতিক পরাশক্তি। পৃথিবীর যে কোনো উন্নত দেশের সাথে একসারিতে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াবার যোগ্যতা রাখে। তারা এত উন্নত হওয়ার পরও আজও সততাকে বিসর্জন দেয়নি। সততাই তাদের মূল চালিকাশক্তি।
তাই বলছিলাম, একটি জাতির ভাগ্য পরিবর্তন ও উন্নতির স্বর্ণশিখরে পৌঁছুনোর জন্য শিক্ষার চেয়ে সততার গুরুত্ব অনেক বেশি। কথায় আছে দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য। যে শিক্ষায় সততা নেই, সে শিক্ষা গরীবকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে পরিগণিত হবে। আজও আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, যাদেরকে আমরা সভ্য ও উন্নত জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেই, তারা তাদের সততা দিয়েই গোটা পৃথিবীর মানুষের সম্মান ও শ্রদ্ধা কুড়িয়ে নিয়েছে। জাপান তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদের দেশের জাপান প্রবাসী কেউ একজন কোথাও লিখেছিলেন- জাপানে আপনি কোনো কিছু হারিয়ে ফেললে নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, জিনিসটি আপনার বাসায় পৌঁছে যাবে। খোয়া যাওয়ার কোনো ভয় নেই।
আজ যদি আমরা সততাকে প্রাধান্য দিতাম, বিদ্যাপীঠগুলোতে পাঠ্যপুস্তক মুখস্ত না করিয়ে, পুস্তকগুলোতে লেখা নৈতিকতা আর সততার শিক্ষাটাকে বেশি গুরুত্ব দিতাম, তাহলে হয়ত গরীব দেশটা আরও উন্নত হতো। কিন্তু আফসোস! আমরা আমাদের প্রজন্মকে সততার পাঠটা কচি মনের ভেতর প্রোথিত না করে চাকরি আর অর্থ উপার্জনের মুলো সামনে ঝুলিয়ে দিয়ে মুখস্তবিদ্যা আর নকলের যে প্রাণঘাতি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে প্রাণপাত করছি- সে শিক্ষা পরিবার, সমাজ আর দেশের কতটুকু উপকার করবে সেটা একমাত্র আল্লাহই বলতে পারেন।
তবুও আশার প্রদীপ এখনও জ্বালিয়ে রেখেছি। হয়ত একদিন আমাদের বোধোদয় হবে।
ছবি: অন্তর্জাল

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


