কিছুদিন আগে আমার আমেরিকায় থাকা বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল। বন্ধুটি বেশ ধর্ম কর্ম করে কিন্তু সেও বেশ বিরক্ত হয়ে বলছিল,এত ধর্ম অনুষ্ঠান হচ্ছে এখন খুব বেশি বেড়ে গেছে এই হিন্দু গুলো। প্রতি মাসে ত্রিশ দিনে চল্লিশ অনুষ্ঠান ধর্মের এত কিছু করতে হচ্ছে কেন? না গেলে সমস্যা, এত অনুষ্ঠানে যাওয়া সম্ভব বলো। বিদেশে মানুষ খুব ব্যাস্ত প্রতিদিন ধর্মে ব্যাস্ত থাকলে বাকি কাজ করবে কখন। বন্ধুটি নিজে হিন্দু হয়েও এত অনুষ্ঠানের আয়োজনে সত্যিকার অর্থেই বিরক্ত হচ্ছিল। আমাকে বলছিল, তুমি লিখ তো এ বিষয়ে।
ধর্ম খুবই স্পর্শকাতর বিষয় মানুষের। তা নিয়ে লিখতে ইচ্ছা করে না। লেখা হয়নি। কিন্তু আমাদের কথোপকথনের দিন দশেকের মধ্যেই শুরু হলো দাঙ্গা ভারতে, উত্তাল দিল্লী। মুসলিম মারার জন্য উগ্রপন্থীরা নির্মম আক্রমণ শুরু করল। সহ্য হয় না এমন সব ছবি দেখে ক্লান্ত হতে হতে আমার কেবল আমার মায়ের কথা তখন মনে হতো। মায়ের দেখা রায়ট সেই সময়ে পাশাপাশি থাকা মানুষদের শত্রু হয়ে উঠা ধর্মের নামে। আবার বুক পেতে সামনে দাঁড়িয়ে বাঁচানোর গল্পগুলোও একই রকম ছিল। মায়ের জীবনের এক সময়ের ট্রোমা সেই স্মৃতি। তারপরও মা ছিলেন উদার পন্থী। সমান ভাবে মিশতেন জাতীধর্ম উঁচু নীচু নির্বিশেষে সবার সাথে সমান ভাবে। বুক দিয়েই আগলে রাখতেন মানুষকে জাতী ধর্ম ভেদাভেদ না করে।
সেই সময়ে, মায়ের কাছে শোনা গল্প লিখতে শুরু করে এক সময় দেখলাম প্রায় সাত পাতা লিখে ফেলেছি কিন্তু আরো লিখতে হবে। তারপর ভাবলাম থাক এ লেখা ফেসবুকে, ব্লগে দেওয়া লাগবে না। যদি স্মৃতিকথার বই করি সেখানে জুড়ে দিব।
যখন বড় সর প্রাকৃতিক বিপর্যয় গুলো আসে কোন কিছু রক্ষা করতে পারবে না মানুষকে এমন ভয় ঢুকে যায় মনে। মানুষ অসহায় হয়ে পরে সে অবস্থায় ধর্মের লেজ ধরে উদ্ধার পাওয়ার জন্য অদৃশ্য শক্তির উপর নিজেকে সমর্পন করে স্বস্থি পায় সেই আদিকাল থেকে । যখন মানুষের অনেক কিছু জানার সুযোগ ছিল না। অদৃশ্য শক্তির উপর ভরসা করে বেঁচে থাকাই তাদের শক্তি ছিল। সেই বিশ্বাস এখনও অনেকে যত্ন করে মনে রেখেছে। সেই বিশ্বাস এখনো চলছে তাতে সমস্যা নাই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখন অনেক মানুষ ধর্ম মানতে চায় না আর ধর্মপ্রবন মানুষ জোড় করে ধর্ম করাতে চায় তাদের দিয়ে।
বিশাল একটা ফারাক দুই দলে। যারা ধর্ম মানে না তারা কিন্তু ধর্ম মানা লোকদের বলে না আমাদের দলে আসো কিন্তু ধর্ম পালনকারী সারাক্ষণ ডাকতে থাকে আমাদের সাথে যোগ দাও। ধর্মের নামেই বেশ কবছর ধরে নানা রকম যুদ্ধ চলছে নানা দেশের মাঝে।
ধর্ম আবার নানা প্রকার। নানা রকমের কোনটা রেখে কোনটা বিশ্বাস করা হবে । এবং সব ধর্মই সবার উপরের ধর্ম।
ধর্ম আদি অন্ত বিশ্বাস যেমন আছে তেমন ধর্মকে অবলম্বন করে ব্যবসা, নানা জনের অজ্ঞতার সুযোগে তাদের উপর সুযোগ নেয়া। অর্থ দণ্ড থেকে, ভক্ত করে রাখা, নানা রকম নির্যাতন থেকে যৌন নির্যাতন করে চুপ করিয়ে রাখা। যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্মসেবীরা করেছে সাধারন মানুষের উপর নির্যাতন হয়েছে, হচ্ছে।
এক সময়ে পা্দ্রীদের দ্বারা নির্যাতিত শিশুরা এখন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে। পৃথিবীর মানুষ অবাক হয়ে দেখছে যাদের কাছে ভালো রাখার জন্য শিশুদের রাখা হয়ে ছিল, তারা কেমন অত্যাচার করেছে। বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া ফাদারদের বিচার হচ্ছে আজকের দিনে। আর এখন বেরিয়ে আসছে মোল্লাদের, নানান অবৈধ কৃর্তি। সাধুদের সেবাদাসীদের সাথে অবৈধ ব্যবহার। ভক্তকুলের কাছে অর্থ নেয়ার গল্প।
যখন আমি বিদেশে এলাম গীর্জা ছাড়া আর কোন উপাশনালয় তেমন ছিল না। কিন্তু দিনে দিনে মন্দির মসজিত প্যাগডার সংখ্যা বাড়ছে। গীর্জাগুলো কমে যাচ্ছে।
তখন প্রতিটি গ্রীর্জা থেকে মানুষকে সাহায্য করা হতো। আশ্রয়হীনের থাকার ব্যবস্থা থেকে খাওয়ার ব্যবস্থা। নতুন আসা মানুষকে নানারকম আসবাবপত্র থেকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা গীর্জা থেকে দিতে দেখেছি। ক্রিসিমাসের সময় শিশুদের জন্য উপহার পাঠানো হতো বাড়ি বাড়ি। ধর্ম নির্বিশেষে সব শিশুরা ক্রিসমাসের সময় উপহার পেত গীর্জা থেকে।
বেশ কবছর থেকে গীর্জাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু মসজিদ, মন্দির থেকে ঈদ পুজায় প্রতিটি বাড়িতে কোন উপাহার আসে না। খাওয়ার দিয়ে সাহায্য হয় না কোন রাস্তার মানুষকে। থাকার ব্যবস্থাও করা হয় না। সেই নজরুল যেমন দেখেছেন, "আমার ক্ষুধার অন্ন তা'বলে বন্ধ করনি প্রভু তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি, মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!' খাবার ভর্তি মসজিদ মন্দিরে মোল্লা-পুরুত তালা মারছে সে সময়েও এ সময়েও তেমনই আছে। অথচ জাকজমক চমকে মনে হয় না তাদের অভাব আছে। বরং দালান কোঠার চাকচিক্য বাড়ছে ক্রমাগত।
যে দেবালয় থেকে মানুষের জন্য সাহায্য আসে না, সেখানে শুধু প্রার্থনা করে কি উপকার হয়।
উপাসনার ঘর তো মানুষের নিজের দেহ। মন থেকে প্রার্থনা যে কোন স্থানে বসে করা যায়।
আজ নয় আশির দশকে বেড়াতে গিয়ে ছিলাম রাজস্থান রাজ্যে আজমিরে দরগাহ খাজা মইনুদ্দিন চিশতির মাজারে। সকালবেলা দরগার গেইটে ঢুকতেই অনেক লোক এসে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল।
কি নিব। কি কিনব। তা তারা জানতে চায়। দরগায় গেলাম একজন অলি আউলিয়ার কবর আছে তা দেখার জন্য। সেখানে কিছু কিনতে হবে সে ধারনা প্রস্তুতি কিছুই ছিল না।
ভীড় ভাট্টার মানুষ থেকে চোখ সরিয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম অনেক ছোট ছোট ছাপড়া দোকান। সেখানে এক একটা ডালা সাজিয়ে বসে আছে। সে ডালার ভিতর আছে গোলপের পাপড়ি, তোবারক এবং আরো কি কি সব মনে নাই এখন। তবে ছোট থেকে বড়লাল সোনালী ঝালর, রঙিন জড়ির ওড়নায় ঢাকা সাজ এবং আকারের উপর নির্ভর করছে এক একটা ডালার দাম। পাঁচ থেকে একশ রূপি। যেন যত দামি ডালা কিনব তত পূণ্য হবে।
কিন্ত্র ডালা কিনে পূণ্য করার কোন ইচ্ছা আমার নেই। আমি কিছুই কিনলাম না। আমার মা ছিলেন সাথে মা যদিও সঠিক ভাবে ইবাদত বন্দেগী করেন তবু লোকদের আহবানে একটু দোদুল্যমান হলেন, করুণ ভাবে বললেন, কিনে ফেলি একটা। আমি কঠিন ভাবে বাঁধা দিয়ে ভিতরে গেলাম ঘুরে দেখে চলে আসলাম কোন অর্থ ব্যয় না করে।
মাজার দরগা যা করা হয়েছে যে মানুষটা মরে গেছে তার তো কোন অদৃশ্য শক্তি নেই আমার জন্য কিছু করার বা কারো জন্যই কিছু করার। বরং আমরা তাঁর জন্য দোয়া করতে পারি, মাকে তাই করতে বললাম।
মাজারে দরুদ দোয়া কালাম, নফল নামাজ পরার চেয়ে এক পাশে বসে ভক্তকুলের মাথা নাচিয়ে শরীর দুলিয়ে গান গাইতে দেখলাম। লালন শাইয়ের আখড়ার চেয়ে আলাদা কিছু না। তাহলে বাউলদের গান শুনে অনেকের গা জ্বলে কেন সেটাও বুঝতে পারি না।
একটা গাছে অসংখ্য লাল ফিতা, কাপড়, সূতা বাঁধা দেখলাম। গাছের আর কোন খালি জায়গা নেই। সে কাপড় ফিতাও কিনতে হবে পাঁচ রূপি দিয়ে তারপর বেঁধে দিতে হবে ইচ্ছা পূরণের জন্য। ফিতা বাঁধার ইচ্ছা পূরণ অনেকটাই হাস্যকর আমার কাছে। কিন্তু অনেকে অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করেন। যেমন অনেকে তালা বাঁধেন ব্রীজের উপর।
গত বছর একটা ছবি দিয়েছিলাম আমার ফেসবুকে তালা বাঁধা ব্রীজের উপর। আসলে আমি তালা লাগাইনি। ব্রীজে কেউ বেঁধে ছিল তার সাথে ছবি তুলেছিলাম বেলজিয়ামের ব্রুস শহরে বেড়াতে গিয়ে।
এই সময়ে যারা ধর্ম ঈশ্বরকে অবলম্বন করে বাঁচতে চান তারা ঘরে বসে উপাসনা করুন। নিজের উপাসনালয়ে। অহেতুক ভীড় করে খামখা মার খাবেন না প্রহরিদের হাতে।
আপনাদের ভীড় এড়ানোর জন্য তারা এই ব্যবস্থা নিয়েছে। উপাসনালয় বন্ধ করা এখন মানুষের জন্য উপাসনার মতন বেঁচে থাকার জন্য। সময়ের দাবীকে মানাই ভালো।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০২০ সকাল ৮:১৪