ঈদ নিয়ে উচ্ছাস আমার অনেক বছর নাই। দেশে থাকতে রোজার অনেক দিন ঘুরে ঘুরে অনেক আত্মিয় স্বজনের জন্য কাপড় কিনতাম। কিন্তু নিজের জন্য কিছু কেনা হতো না প্রায় সময় । অনেকের জন্য বাজার করে ক্লান্ত হয়ে যেতাম। নিজের কিছু কেনার জন্য আবার বাজারে যাওয়ার ইচ্ছা করত না। একবার ঢাকায় ছিলাম ঈদের দিন। সেবার চানরাতে সব দোকান খোলা আমিও বাজারে ঘুরছিলাম বেশ রাত অবধি কেনাকাটা ছিল না দেখছিলাম জমজমাট রাতের ঢাকা আর ভাবছিলাম এই বাজারে ঘোরা মানুষ এবং দোকানদাররা কখন বাড়ি যাবে কখন সকালে উঠে ঈদের প্রস্তুতি নিবে।
বাড়িতে দেখতাম মা রান্না করতেন বেশ রাত পর্যন্ত কিন্তু খুব ভোরেই উঠে পরতেন নামাজে যাওয়ার আগে সবার নাস্তা দেয়ার জন্য। নিজেও গোসল সেরে তৈরি হয়ে নিতেন। আমাদের গোসল সেরে ফেলতে হতো ভোরের আলো ফোটার আগেই ছোটবেলায়। বড় হওয়ার সাথে সাথে সে সব বিসর্জন দিয়েছি। ভোরের আলো ফোটার আগে উঠে গায়ে পানি ঢালার ইচ্ছা কমে গেছে।
আমার প্রিয় নতুন শাড়ি পরার দিন ছিল পহেলা বৈশাখ। দুই আড়াইশ তিনশ দামের টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি ছিল আমার প্রিয়। ভোরবেলা সে শাড়ি পরে রমনার বটমূলে গিয়ে গান শোনা। হাত ভরে কাঁচের চুড়ি পরে সারাদিন ঘুরে বেড়ানো ছিল ঈদের আনন্দের চেয়ে বেশি ভালোলাগার।
বিদেশে আসার পর এক বছর ঈদে মেয়ের জন্য কাপড় কিনতে চেয়েছিলাম। মেয়ে সোজা জানিয়ে দিল কিছু যেন না কিনি। ও তো ঈদের দিনও স্কুলে যায়। আর ঈদ উপলক্ষে কেনা দেশিও পোশাক সে কখনো পরার সুযোগ পাবে না।
সেই থেকে বিশ বছর আমরা কোন ঈদের কাপড় কিনি না। আমরা বাড়তি কাপড়ও কিনি না। প্রয়োজনীয় যতটুকু সিজনাল প্রতিদিন পরার পোশাক দরকার হয় তাই কিনি বছরে দু একটা।
ছেলে একদমই পছন্দ করে না। কোথাও যেতে সারাক্ষণ মাথা গুজে পড়ালেখা করে। দেশের পাঞ্জাবি যে কয়টা আছে তাও পড়া হয় না। তাই নতুন করে আর কিছু চায় না। ওর অবশ্য সব সময় স্বভাব আমার বাবার মতন চেনা বামুনের পৈতা লাগে না এই বলে বাবা লুঙ্গি পরেই বাইরে চলে যেতেন অতি সাধারন ভাবে। বাবার জন্য সার্ট প্যাণ্ট কিনলেই রাগ হতেন। কেন খামখা খরচ করো। আমার তো প্রচুর পোশাক আছে। নাতীও তেমনি অতি সাধারন পোশাকে চলতে পছন্দ করে।পোশাক দিয়ে দেখানোর কিছু নাই।
আর আমাদের দেশে যেমন পোশাক পরে দেখানোর এক ধামাকা চলে। বিদেশের মানুষদের দেখি সেই দেখানোর মধ্যে একদম নেই। সহজ আরামদায়ক পোষাক পরতেই পছন্দ করে। যে স্যুট কোট টাই তাদের দেশের আবিস্কার তারা তা পরে বিশেষ কোন অনুষ্ঠান উপলক্ষে। এখানে বিদেশিদের বিয়েগুলোতে দেখি মেহমানরা অতি সাধারন পোশাক পরে। নতুন বউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সাজের কোন বহর নেই। তবে বিদেশের দেশি বিয়েতে দেশের মতনই সাজ সজ্জার বাহার।
নানার নাতীও বড় বড় কোম্পানীতে কাজ করতে প্রতিদিন যায় হাফপ্যাণ্ট আর টি সার্ট পরেই।
সে আবার দেশে গেলে, বাইরে মানুষের মাঝে গেলেও, সেখানের প্রচণ্ড গরমে অভ্যস্ত আরামদায়ক হাফপ্যাণ্ট আর টি সার্ট পরে বাইরে যায় স্বভাব অনুযায়ী।
তবে বাঙালির রুচি অনুযায়ী অনেকের সেটা পছন্দ হয় না। পিছনে সমালোচনা করে, হাসাহাসি করে। বিদেশে থাকা ছেলের এ কি পোশাক। বাড়ির মানুষও অনেকে মানুষের হাসাহাসিতে, সংকোচ বোধ করে আমার ছেলের অমন সাধারন হয়ে থাকা দেখে। বিদেশ থেকে যাওয়া ছেলে স্যুট টাই পরে থাকে না এটা কেমন।
বাঙালিদের এই দেখানো স্বভাবের সুন্দর গল্প আছে মনিকা আলীর লেখা ব্রুক লেইন বইয়ে।
পোশাকে যে মানুষের রুচি, জ্ঞান বিকাশ পায় না, শেখ সাদীর গল্পটা জানার পরও অনেক মানুষ তার চর্চা না করে পোশাকের প্রতিই আকষর্ণ বোধ করে। আর নিজেকে সাজিয়ে মানুষকে দেখাতে খুব পছন্দ করে।
অনেক বছর পরে একটা ঈদের শাড়ি কিনে দিয়েছিল আমার মেয়ে। যখন মেয়েসহ দেশে ঈদ করতে গিয়েছিলাম মায়ের সাথে বছর চার আগে। মেয়ের কিনে দেয়া এই শাড়িটা আমার অনেক প্রিয়। খুব সাধারন সুতি শাড়ি কিন্তু ভালোবাসায় ভরপুর।
দেশে গিয়ে অনেক বছর পর কয়েকটা শাড়ি কিনেছিলাম এই আমার নতুন শাড়ির সম্বল। আর কিছু মায়ের শাড়ি নিয়ে এসেছি।বেশির ভাগ শাড়ি গিফট পাওয়া। তাও সব পরা হয় না এখন। এখন তো শাড়ি পরা হয় না এ দেশের বৈরি আবহাওয়ায়, সম্ভব না শাড়ি পরা। মাঝে মধ্যে শখ করে পরি কোন অনুষ্ঠানে বা বাড়িতেও। যদিও অনেকে মনে করেন বাঙ্গালী ভাব দেখায়, বিদেশি ড্রেস পরে। অনেক বিদেশে থাকা নারী তাই ঝা চকচকে কাতান টাতান পরে ছবি আপলোড দেন ফেসবুকে, মানুষ কি ভাববে এই ভাবনা ভেবে। তবে আমি কি পরলাম খেলাম কেমনে চললাম সেটা আমার নিজের পছন্দ এবং প্রয়োজন একদম নিজের মতন।
ঈদ উপলক্ষে নতুন কাপড় কেনা আমাদের মজ্জাগত একটা বৈশিষ্ট হয়ে আছে। ইচ্ছা করলেও অনেকে সেটা উপেক্ষা করতে পারেন না। তবে বাঙালি মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের সংসারে ঈদ উল ফিতর উপলক্ষেই ভালো কাপড় কেনা হতো আসলে এক সময়। এখন হয়তো তেমন অবস্থা আর নাই। মানুষ এখন বিভিন্ন উপলক্ষ খুঁজে কাপড় কেনে। সবার ঘরেই প্রচুর কাপড় আছে। আমি একটা অফিসের কথা শুনলাম, যেখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে কর্মিদের বাধ্য করা হয় নতুন কাপড় কিনতে তাদের নিজেদেরই খরচে।
এক রকমের কাপড় পরার নিয়ম ছিল স্কুলে। এছাড়া কিছু পেশাজীবি মানুষকে একই রকম ইউনিফর্ম পরতে হয়।
এছাড়া আমার ছোটবেলায় দেখেছি রেলের কুলিরা লাল কাপড়ের সার্ট গায় দিত। এখন অনুষ্ঠান সে বিয়ের আর জন্মদিনের হোক সবাই এক রঙের কাপড় পরে সাজে। আবার স্বামী স্ত্রীরাও মিলিয়ে এক রঙের কাপড় পরে।
আমার ছোটবেলায় দেখেছি, আব্বা রোজার মাঝামাঝি সময় দোকানে গিয়ে কাপড়ের কয়েকটা বাণ্ডিল দোকান থেকে নিয়ে আসতেন। আমিও যেতাম আব্বার সাথে দোকানে। কিন্তু আমাদের পছন্দের উপর মায়ের পছন্দ তাই সব গুলো কাপড় দেখে, তা থেকে মায়ের পছন্দের কাপড় কিনে এক রকমের জামা বানানো হতো আমাদের বোনদের জন্য। একটা সময় সব বোনের এক রকম জামা পরাটা আর পছন্দ লাগত না আমার। মনে হতো স্কুলের বা খেলার টিম বুঝি একই রকম কাপড় পরা। অথচ এখন আবার মেয়ের সাথে একই রকম কাপড় পরেতে হয় কখনো। ও চায় মা যেন ওর মতন কাপড় পরে ও যেটা কিনে সেটা আমার জন্যও একটা কিনে কখনো। তেমনি আমিও কিনি এক রকম জামা দুজনের জন্য।
ঈদ উপলক্ষে কাপড় কেনা অবশ্য একটা বিশাল ব্যাপার যেন সংস্কৃতি জীবনের মুসলমানদের। খৃষ্টানদের দেখি বড়দিন উপলক্ষে সবাইকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাধারন ব্যবহার্য জিনিসপত্র উপহার দিতে। পাড়া ধরে, বাড়ি ধরে চেনা অচেনা বাচ্চাদের গিফট অনেক সময় বাড়ির সামনে রেখে চলে যায় যে কোন ধর্মেে মানুষের জন্য, বিভিন্ন সংস্থা বা ব্যাক্তি মানুষ। উপহার দাতার নাম জানা যায় না। বাচ্চারা বন্ধু থেকে টিচারদের উপহার দেয়। অফিসের সহকর্মিরা একে অপরকে উপহার দেয়। পোষাক তেমন একটা প্রয়োজনীয় না, এইসব উপহারে। আজকাল সবাই উপহারে গিফট কার্ড দিয়ে দেয় নিজের পছন্দে কিছু কিনতে পারে পরিবারের সদস্য, বন্ধুরা।
বাবা মা দিবসেও এমন সব গিফট দেওয়া হয় যা ব্যবহার করা যায় প্রয়োজনীয় গৃহস্থালী জিনিসপত্র। আমাদের উপহার সমগ্রীও শুধু কাপড় আর গহনা কেন্দ্রিক মনোভাবে আটকে আছে। এক সময় বই উপহার দেয়া হতো এখন বই উপহার হিসাবে তেমন যোগ্য কিছু বলে ভাবা হয় না। আমাদের কিশোরবেলায় জন্মদিনের উপহার, বিয়ের উপহারে আমরা বই, গানের ক্যাসেট ইত্যাদি উপহার দিতাম। বাচ্চাদের শুধু কাপড় না দিয়ে বই, রঙ তুলি, স্কুল ব্যাগ। শিক্ষনীয় গেইমস গুলো উপহার দেয়ার চর্চা করা উচিত। বিভিন্ন ব্রাণ্ডের পোশাক, মেকাপের বদলে।
ঈদ উপলক্ষে ছোটবেলায় মায়ের কত আয়োজন ছিল। তেমন আয়োজন কখনোই আমার করা হলো না। ঢাকার বসবাসের জীবনে নিজের মতন ঈদ করার সুযোগ ছিল না। বাড়িতে চলে গেলে মায়ের ঈদের আনন্দে সামিল হওয়াই ছিল বড়। তখন কাজও করতাম না কিছু । আর বিদেশ আসার পর ঈদ উপলক্ষে শুধু বাচ্চাদের জন্য রান্না করতাম কিছু কিন্তু ধীরে ধীরে দেশি খাবারের সাথে বিদেশি খাবার চাওয়ার মধ্যে ঢুকে গেল। ঈদের দিনে পাস্তা বা লাজানিয়। পিজ্জা বা বেকড চিকেন করলে বেশ খাওয়ার ঝোঁক হতো। তাদের পছন্দের খাবার বানানো চলছিল বেশ অনেকদিন। আসলে এখন আমাদের প্রতিদিনের খাওয়াও ঈদের মতন হয়ে গেছে। দেশ গ্রামের মতন একদিন বিশাল আয়োজনে পোলাউ কোর্মা রান্নার মতন অবস্থা নাই। আমরা একই উপকরণ দিয়ে প্রতিদিনের খাওয়াও ভিন্ন রকম করি ফেলি। দেশি স্টাইলের মাছ, মাংস ডাল ভাত প্রতিদিন খাই না।
সেমাই বা লাচ্ছা আমার নিজের কখনো পছন্দ না। লোকরা পা দিয়ে পাড়িয়ে সেমাই বানাচ্ছে এই দৃশ্য কোন ছোটবেলায় মাথায় ঢুকে গেছে তারপর কখনো সেমাই আমার খেতে ইচ্ছা করে না। মায়ের ঘরে বানানো চালের সেমাই ছাড়া।
আগে তো স্কুল ছিল ক্লাস শেষে ঘরে ফিরা ছিল তাদের এখন নিজেদের মতন ব্যস্ততায়। অনেক ঈদে আমাদের দেখাও হয় না। এবং সেটা কোন ব্যাপারও না। সবার সময় সুযোগ হলেই আমরা দীর্ঘ আড্ডায় মেতে উঠি। এবারও কারো সাথে দেখা নেই শুধু ঝুম ভিডিও কথাবার্তা। যেমন মা দিবসে দীর্ঘ কয়েক ঘন্ট লম্বা জুম ভিডিও কথায় কেটে গেল সবার সাথে টেবিল জুড়ে রাত ভর আড্ডার মতন।
আমারও কোন রান্নার ব্যস্ততা নাই। শুধু নিজের কাজে মন দিয়ে কাটিয়ে দেই আরো কিছু লেখার পাতা সমৃদ্ধ করে।
কিন্তু ফাঁকে ফাঁকেই মনে পরে যাচ্ছে আফগানিস্থানের হিংসায় মৃত মেয়েদের কথা পরিবারের আহাজারীর কথা। গাজায় মহিলা শিশু অন্তসত্তা নারীসহ, পুরুষ মৃতদের সংখ্যা বাড়ছে। মৃত ঈদুল ফিতুর হচ্ছে এই মূহৃর্তে। মানুষে মানুষে এই ভেদাভেদ মারামারিই যদি চলবে পৃথিবীতে তা হলে কি হবে এই সব ধর্মের দিবস আর ভালোভালো কথা বলে। ধর্ম পরে হোক আগে আমরা মানুষ হই।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০২১ রাত ১২:১৯