আরিফের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীর দোতালার ছোট পড়ার ঘরে। সদ্য তরুণ একটি ছেলে মায়াময় চেহারা মুখে মিষ্টি হাসি। সেদিন সম্ভবত শুক্রবার ছিল। দুপুরবেলা আরিফ এসেছিল একটি গাড় মেরুন রঙের পাঞ্জাবী পরে। এক মাথা ঝাকড়া চুল। এমন চুল সাধারনত দেখা যায় না। সুন্দর হাসিখুশি চেহারা।
প্রথম দেখায় আরিফের দুটো বিষয় আমার নজরে পরে ছিল। গাঢ় রঙের পাঞ্জাবী যা আশির দশকে ছেলেরা পরত না। আর ওর থুতনিতে এক গুচ্ছো দাড়ি। এ সময়ে সব ছেলেরাই দাড়ি রাখে, ফ্যাশন ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবে। দাড়ি ছাড়া এ সময় ছেলেরা মনে হয় সময়ের বাইরে। কিন্তু আশির দশকে ব্যাপারটা ছিল অন্য রকম।
সে সময়ে জামাত শিবিরের উত্থান হচিছল। ভেবেছিলাম ছেলেটা কি শিবির করে নাকি।
কিন্তু পরিচয় পেতে পেতে জানলাম ভুল ছিল প্রাথমিক ভাবনা আমার।
ছেলেটা প্রগতিশীল ভাবনার মানুষ। একটু বেশি রকমই প্রগতিশীল।
আরিফের মা রওশন আপা, ছেলে মেয়েকে মানুষ করেছেন আধুনিক ভাবনা দিয়ে। সমাজের সব রকম পিছন ফিরে তাকানোকে দূরে রেখে প্রগতি, খোলামনের মানবিক হওয়ার মন্ত্র দিয়ে। আরিফের বোন তুলি, অত্যন্ত সচেতন সাহসী একটা মেয়ে সেই সময়ে। লজ্জাবনত নতজানু নয় বরং নিঃসঙ্কোচ সহজ। কতদিন আরিফদের বাসায় যাওয়া হয়েছে যখন তখন হিসাব ছাড়া। আরিফের মা, একা সামলেছেন জীবনের অনেক যুদ্ধ। তিনি হয়ত দিব্যচোখে দেখতে পেতেন। তিনি আমাকে বলতেন, তোমার মধ্যে পাহাড়ের মতন দারুণ এক শক্তি আছে। তোমাকে আমি ডাকব পাহাড়িকা।
সে সময় আরিফ আবৃত্তি, নাট্য চর্চার সুুতিকাগার টি এস সিতে কেবল আসা শুরু করেছে নতুন। কবিতার প্রতি আগ্রহ নিয়ে যুক্ত হয় আবৃত্তির ক্লাসে। আরিফ আবৃত্তিশিল্পী হাসান আরিফ হয়ে উঠে ধীরে ধীরে। কতবার কত জায়গায়, কত শহরে এক সাথে গিয়েছি আমরা কবিতার দল বেঁধে। কবি, আবৃত্তিকার মিলে।
সে সময় ছিল কবিতায় প্রতিবাদ করার সময়। রাজপথে শহীদমিনারে আবৃত্তি, কবিতার ছড়াছড়ি।
একবার আমরা কুমিল্লা গিয়েছিলাম অনেকে মিলে। আহা কতজন নাই হয়ে গেছেন সেই সময়ের। সমুদ্রগুপ্ত মনে হয় সেই অনুষ্ঠান করে আসার অল্প দিন পরই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পরেন। সেই অসুস্থতা থেকে আর বের হতে পারলেন না। চলে গেলেন সবার আগে অন্যলোকে। আর আজ সবার ছোট হাসান আরিফ চলে গেল। খুব খারাপ লাগছে ভাবতে। খবরটা প্রথম দেখলাম আবৃত্তিকার মেহদী হাসানের ওয়ালে। বুকের মাঝে ধক করে একটা কষ্ট জেগে উঠল। এভাবে চলে যেতে হয়। শুনেছিলাম কিছুদিন ধরে অসুস্থ কিন্তু ভালো হয়ে উঠল না ছেলেটা। অপেক্ষা ছিল ভালো হয়ে ফিরে আসার হাসপাতাল থেকে। অথচ শোকে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেল ।
কুমিল্লায় সেবার আমরা তিনদিন ছিলাম। খুব মজা হয়ে ছিল। সেই থাকার ব্যবস্থা হয়ে ছিল আরিফের খালার বাসায়। বিশাল বাড়ি পুরোটাই খালী ছিল। খালা থাকতেন ঢাকায়। কিন্তু বাড়ি তত্বাবধানের লোক ছিল। প্রতিটি ঘর নিপুন করে সাজানো গোছান। বাইরে উঠান গাছপালা। পুরানো বনেদি বাড়ি, ঝকঝকে তকতকে। আমাদের খুব আনন্দ হলো এমন হাতপা ছড়িয়ে নিজের মতন পুরো একটা বাড়ির সব টুকু উপভোগ করার সুযোগ পেয়ে।
যেদিন দুপুরে আমরা ঢাকা থেকে গেলাম তারপর দিন ছিল আমাদের কবিতার অনুষ্ঠান। পরেরদিন থেকে ঘুরে ফিরে আমরা ফিরেছিলাম। আর এই তিনদিন আমাদের জন্য তিনবেলা সে কি রাজকীয় খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা। নিজেদের মধ্যে গল্প আড্ডা। কবিতা কথন হৈ চৈ দারুণ একটা সময় ছিল কবিতার অনুষ্ঠান করার পাশাপাশি।
সেবার পরিচয় হলো ফুটফুটে একটা মেয়ের সাথে বড় টিপ ফর্সা কপাল জুড়ে। সুন্দর মায়াময় দুটো চোখ। কালো কুচকুচে চুলের ফর্সা রমনী। তাঁতের শাড়ি কি সুন্দর করে পরে আর সব চেয়ে ভালো গুণটি হলো দারুণ আবৃত্তি করে। লায়লা আফরোজ।
এক সময় দেখলাম দক্ষ আবৃত্তি শিল্পী হয়ে উঠা হাসান আরিফ আর লায়লা আফরোজ এক সাথে জোট বেধেছে ভালোবাসায়।
তারপর কেটে গেছে সময় কতদিন দেখা হয় না আর। কিছুদিন আগে জানলাম রওসন আপা চলে গেছেন অন্যলোকে। আর আজ ছেলেও চলে গেল মায়ের কাছে।
সেই ছোট আরিফ নিজের গুণে নিজের মতন জায়গা করে নিয়েছে মানুষের মনে। দারুণ একটা জায়গা ভালোবাসা পাওয়ার। বাংলাদেশের গুণিজন উপস্থিত হাসান আরিফকে বিদায় জানাতে।
গতকাল দেখছিলাম ভালোবাসায় উপচে পরা মানুষের ভীড় শহীদমিনারে যেখানে শেষবার দেখার জন্য রাখা হয়েছিল হাসান আরিফকে। সম্মান সে নিজেই অর্জন করেছে। খুব মন খারাপ হয়ে গেল। কত স্বপ্ন ছিল ওর সবটুকু শেষ করার সময় পেলো না।
খুব অল্প সময়ে চলে গেল। মন খারাপ হয়ে গেলো তুলির কথা শুনে। ওদের ভাইবোনদের বন্ধন ছিল দারুণ।
মানুষের জীবনটাই এক অদ্ভুত মরীচিকা।
যেতে যেতে মানবিক শেষ কাজটি করে গেল আরিফ নিজের শরীরটি দান করে গেছে মানবিকতার কাজে। সবাই এতটা সাহসী হতে পারে না। আরিফ তার আধুনিক ভাবনার প্রতিফলন রেখে গেলো আমাদের মাঝে।
ভালো থেকো আরিফ অন্যলোকে ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০২২ রাত ১১:২৯