ক্লাস শেষে বেশ ক্লান্ত লাগছিল সেদিন। । খাওয়া শেষ করে তাই শুয়েছিলাম। এমনিতে দুপুরে শুয়ে থাকা আমার হয় না। দুপুরটা বেশ ঝিমধরা, শান্ত থাকে। সবাই দুুপুরের ভাত ঘুম পছন্দ করে। সকাল থেকে ক্লাস সেরে একটু ঘুমিয়ে নেয় দুপুরের প্রখর রোদের সময়টা।
রোদ একটু হেলে পরলেই হলের বাইরে ব্যস্ততা বাড়ে। দাদুদের হাঁটাহাঁটি, ডাকাডাকি বাড়ে। রুমে এসে খবর দিয়ে যায়, আপা আপনার ভিজিটার এসেছে। মেয়েরা তখন তৈরি হয়ে ভিজিটারের সাথে দেখা করতে যায়।
এখন হয়তো তেমন নেই। মোবাইলে আগেই জানিয়ে দেয় যে আসছে। মেয়েটিও গেটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পৌঁছানোর আগেই, সময় হিসাব করে।গেটের দাদুদেরও সংখ্যবার হাঁটা হাঁটি করতে হয় না রুমে রুমে চিরকুট নিয়ে। কিন্তু আমাদের সময় এত সহজ ছিল না। ভাবলে এখন অবাক লাগে কত সময়ের অপচয় ছিল। যে মানুষটি আসল, গেটের বাইরে সে ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করে ভিতরের মেয়েটির সাথে দেখা হওয়ার জন্য।
যাক সেটা অন্য বিষয়।
যা বলছিলাম এক শান্ত নিথর বিকালে ছায়া ছায়া অন্ধকার আমাদের রুমের দরজা খুলে একটি মেয়ে ঢুকল। সাধারনত দিনের বেলা দরজা ভেজানোই থাকে। বন্ধ করা হয় না।
আমরা ছিলাম চারজন রুমমেট। চারজন তিন বর্ষে পড়ছি তখন। আমাদের দুজন রুমমেটের নাম ছিল এক । ওরা একজন আরেকজনকে মিতা বলত। তবে তেমন মিতালী ছিলনা তাদের মধ্যে । রুমমেট হিসাবে যতটুকু কথা বলতে হয় ডাকাডাকি করতে হয় ততটুকু মিতা ছিল। তবে দুজনই খুব ভালো মনের মানুষ ছিল। একজন খুব মিষ্টি দেখতে শান্ত হালকা পাতলা মেয়ে। কথা বলত কম। অন্যজন খুব বাক্যবিলাশী মানুষ। মোটাসোটা বড়সর আকৃতির। তবে তার কণ্ঠটা ছিল দারুণ । এত মিষ্টি করে কথা বলত মেয়েটি। ওর কথা বলা শুনলে মনে হতো অন্য কেউ কথা বলছে। কেন যেন ওর দেহ আর কণ্ঠ দুটো আলাদা মনে হতো আমার কাছে। মনে হতো দুটো মানুষ।
এই মেয়েটিকে আমি প্রথম আপাদমস্তক ঢাকা অবস্থায় দেখি। যখনই বাইরে যেত সারা শরীর ঢাকা পোষাক পরে মাথা প্যাঁচিয়ে, মুখ, কপাল ঢেকে, চোখে সানগগ্লাস পরে । হাতে দস্তানা পরে বাইরে যেত। খুব কম সময় ওর মুখ দেখতে পেতাম। খুব যে নামাজী ছিল তানা। কখনো নামাজ কোরান পরতে দেখি নাই। কেন সে এমন পোষাক পরত কখনো জানতে চাইনি। ওর মুখে বড় বড় বসন্তের দাগ গাড় ক্ষত ছিল সে জন্য কি, জানি না জানার সুযোগ আর নাই। ওর পছন্দ ছিল ও পরত এ নিয়ে আলাদ কিছু ভাবিনি।
আর ছিলাম আমরা অন্য দুজন সাধারন। আমরা সবাই নিজেদের মধ্যে, নিজেদের কাজে, পড়ায় বেশি ব্যস্ত থাকতাম। তবে মাঝে মধ্যে চারজনের আড্ডা জমত রাত গভীরে। ব্যাক্তিগত বিষয় নিয়ে কেউ মুখরিত ছিলাম না।
আমার উল্টো দিকের বিছানার কাছে এক মিতার কাছে ঘরে ঢুকা সেই মেয়েটি গেল এবং ঘুমন্ত সবার কান বাঁচিয়ে খুব আস্তে আস্তে নাম ধরে ডাকল।
মিতা উঠে খুব খুশি হয়ে উঠল, আরে ঝিলিক আপা তুমি! ছদ্ম নাম দিলাম।
মেয়েটি ঘরে ঢুকার সময়েই আমি টের পেয়েছি তবে নিজের মতন ছিলাম, চুপচাপ। এখন মেয়েটির নাম শুনে আমার মনে চট করে একটা ঘটনা মনে পরে গেল। মেয়েটির নামটিই একটা আইকন। এমন নাম খুব সচরাচর শোনা যায় না।
এবং আমার খুব লজ্জা লাগল ঘটনাটি মনে পরে। যদিও এই ঘটনার সাথে আমার কোন যোগ সূত্র নাই। তবুও নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হলো। ঘটনাটি বলি।
ঝিলিক নামের মেয়েটি ছোট একটা শহরে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ে। কিশোর বয়সে হঠাৎ একদিন একটি ছেলের সাথে দেখা হয়ে যায়। এরপর দুজনের মধ্যে ভালোবাসা প্রেম হয়।
ছেলেটির বাবা খুব নাম করা ডাক্তার । আর ছেলেটি তখন ক্যাডেট কলজে পরে । ছুটিতে বাড়ি এসেছে। এই সময়ে ঝিলিকের সাথে পরিচয়। টিন এইজ বয়সের গভীর প্রেমে জড়িয়ে পরে তারা। দুজন দুজনকে গোপনে চিঠি লিখে, ছেলেটি ক্যাডেট স্কুলে ফিরে গেলে। কেটে যায় দু বছর। স্কুল গণ্ডি শেষ হয়। ছেলেটি খুব ভালো রেজাল্ট করে। মেয়েটি স্কুল ফ্যাইনাল মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে তখন আর ছেলেটি উচ্চ মাধ্যমিক দিবে দিবে এসময়ে ছেলেটি বাড়ি এলে তারা সিদ্ধান্ত নেয় বিয়ে করার। এবং গোপনে বিয়েও করে ফেলে দুজনে।
কিন্তু বিষয়টা আর গোপন থাক না। পরিবারের কাছে জানাজানি হয়ে যায়।
ছেলের বাড়ি থেকে ছেলেকে নানা শর্ত দেওয়া হয় মেয়েটির সাথে না মেশার জন্য, মেয়েটির সাথে বিয়ে কিছুতেই মেনে নেয় না ছেলের বাবা। ডির্ভোস দেয়ানাের চেষ্টা করে। ছেলে কিছুতেই মানবে না। ছেলে ভুলানোর জন্য তাকে নিয়ে ঢাকা আসা হয়। তাকে ননো কিছু দেখিয়ে ভুলানোর চেষ্টা করা হয়।
এদিকে ক্যাডেট কলেজে পরীক্ষার আগে আগে যখন জানে, ছেলে বিয়ে করে ফেলেছে তাকে নানান শাস্তি দেয়া হয় যেমন শিক্ষকের পক্ষ থেকে তেমনি ছেলেরা মিলে তাকে নানা ধরনের কি বলব, বুলি বা র্যাগিং করে । নির্মম এইসব কর্মকাণ্ড। একটি টেলেন্টেট ছেলে বিয়ে করে ফেলেছে তার মেধা মননের কোন দাম রইল না তাকে শুধু নানারকম ভাবে নির্যাতন করা হলো, যেমন পরিবারে, তেমন শিক্ষাকেন্দ্রে, শিক্ষক এবং ছাত্র মিলে।
একটি উদাহরণ দেই তাকে ড্রেনের ভিতর শুইয়ে দেওয়া হতো এবং নোংরা পানির ধারায় ভেসে যেত সে। সাথে সবাই মিলে আনন্দ উৎসব করত নেচে গেয়ে। ছুঁড়ে ফেলা হতো তার উপর আরো বর্জ্য অবর্জনা।
টেনে ছিঁড়ে ফেলা হতো কাপড়। জামাইবাবু জামাইবাবু বলে আঙ্গুলের আংটি ধরে টানাটানি করত। যেমন ইচ্ছা তেমন ভাবে কেটে দিত চুল। ঠিক জানি না কি ভাবে কোন নিয়মে, আইনে এই সব কাণ্ড একজন ছাত্রের সাথে করা হয় একাডেমিতে। এবং তার পরীক্ষা দেওয়ার উপরও নিষেধাজ্ঞা আসে।
ছেলের বাবা অনেক কিছু করে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দিতে বসার সুযোগ করতে পারেন, তার জন্য।
আর এদিকে ভালোবাসা যা দুটো নিষ্পাপ প্রাণকে এক করেছিল দুজন দুজানার পাশে থাকতে চেয়েছিল মনের আবেগে। তাদের সে বন্ধন ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয় সমাজ ব্যবস্থা।
বংশ মর্যাদা, পারিবারিক বৈষম্য, অপছন্দ কত কিছুর আত্ম গড়িমায় ভেসে যায় দুটি সহজ প্রাণের ভালোবাসা।
এই ছেলেটির পরিবারের সাথে আমার দূর সম্পর্কের আত্মিয়তা আছে। খুব ছোটবেলায় একবার তাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম এতটুকুই মনে আছে। এছাড়া তারা আর আমরা থাকি শত শত মাইলের দূরত্বে। কিন্তু নানা ভাবে জীবনের গল্পগুলো শোনা হয়ে যায়।
যখনই ঝিলিক নামটা শুনলাম একরাশ লজ্জা আমার শরীর জুড়ে রইল। আমি মেয়েটার সামনে দাঁড়াতে পারলাম না। আমার পরিবারের কারো জন্য এই মেয়েটা একটা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে জীবনের এক সময়, এ যেন আমারই লজ্জা, এমনটাই মনে হতে থাকল। তার নামটা শুনে তাকে আমি চিনেছি এবং তার জন্য আমার বুকে কষ্ট জমে আছে।
মেয়েটি চলে গেলে আমার রুমমেট মেয়েটির কথা বলল। এবং আমি বুঝতে পারলাম আমি ঠিক তাকে চিনতে পেরেছি। কিন্তু আমার কিছু করার না থাকলেও আমি মেয়েটি এবং ছেলেটির ভালোবাসার সাথে ছিলাম। তাও তাকে বলা হলো না।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ১:৪৮