কাল ছিল ফসল তোলাদিন। হার্ভেস্ট ডে। মে মাসে অনেক আদর যত্ন করে যে বীজ মাঠ ভর্তি করে বোনা হলো ধীরে ধীরে তারা ডালপালা মেলে বড় হলো ফূল ফোটাল। সবুজ রঙের আলো ছড়িয়ে হাসল মাঠ জুড়ে। সাদা ফুলের হাসিতে ভরে উঠল ক্ষেত। যেন অপূর্ব সাদা ফুলের বাগান। তারপর এক সময় ফসলের ভাড়ে নুয়ে পরে জীবন দিয়ে দিল। আর তারপরই সময় হলো ফসল তোলার।
সময়ের সাথে সাথে কত রঙ বদল হলো মাঠ জুড়ে। করা হলো কত কঠিন কাজ। অন্ধকার থাকতেই মাঠে নেমে পরতে হতো কোনদিন। সারাদিন চলত কাজ।
সব কাজ খুব মশৃণ ছিল না। বরফ ঢাকা ভেজা মাঠ ঠিক মতন শুকানোর আগেই কাজ শুরু করতে হলো সময়ের প্রয়োজনে। আর তাতে পেতে হলো কত রকমের যন্ত্রনা। কখনো মাটিতে দেবে গেলো মেশিন। তা তোলা কঠিন সমস্যা। সময় বাঁচাতে তাড়াহুড়ো করে নষ্ট হয়ে যায় অনেক সময় দু তিনটা দিন।
মাঠ ভর্তি আগাছা বুনো ঘাস লতাপাতা আপন মনে বাড়ে। অথচ তাদের সরিয়ে না দিলে ফসলের ক্ষতি। তাদের দখল করে বসে থাকা জমি থেকে তাদের সরিয়ে দখল নেয়া চাট্টি খানী কথা নয়। অনেকটা সময় ব্যায় করে তাদের সাথে ডিল করতে হয় চলে যাওয়ার জন্য। তারপর তারা বিদায় হলে শুরু হয় খুঁড়াখুড়ি চাষবাস। তারও আগে পরীক্ষা করে নিতে হয় মাটি। কোন খনিজ কতটা আছে কোনটার কমতি, কোনটার আধিক্য। সেই হিসাবে প্রস্তুতি নিতে হয়। হোক আধুনিক প্রযুক্তির লাঙ্গল তবু তো নানা রকম ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে পুরো মাঠ জুড়ে তাকে চালাতে হয় সময় দিতে হয় অনেকটা সব প্রস্তুতির।
একটু একটু করে মসৃণ নরম মাটি তৈরি হলে লাইন করে বুনে দিতে হয় বীজ সে সবার শেষের কাজ। তারপর অপেক্ষা তাদের মাটির উপর মুখ তুলে চাওয়ার। কখনো অকারণ অসময়ের ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে উঠে সদ্য গজানো বাচ্চগুলো। কখনো জোড় বরষণ তীব্রভাবে হামলে পরে তাদের সদ্য তোলা মাথা লক্ষ করে। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় ডাল পাতা। আবার কখনো তীব্র রোদের আঁচড় এসে জ্বালিয়ে দেয় মুখগুলো। আর প্রায় হয় অসম্ভব জোড়ে হাওয়া, যেন ঝড় বইছে, লণ্ড ভণ্ড করে উড়িয়ে নিতে চায়। মাটি মাকে আঁকড়ে তারা তখন চেষ্টা করে উড়ে না যেতে বাতাসের তোড়ে, কখনো মুখ থুবড়ে পরে। শক্তি সঞ্চয় করে আবার মাথা তুলে। এতসব প্রাকৃতিক অত্যাচারের মাঝেও তারা চেষ্টা করে নিজের মতন বাড়তে। সময়ের মধ্যে ফুলবতি প্রসুতি হয়ে ফসলের ভাড়ে কৃষকের প্রাণ জুড়িয়ে দিতে।
এসবের জন্য মাঝে মাঝে তাদের জন্য বাড়তি ফেস্টের ব্যবস্থা করা হয়। কখনো পানির ধারায় ভিজিয়ে দেয়া হয়, শুকিয়ে যাওয়া মাঠের জমিন। কখনো বাড়তি খাবার সারের ব্যবস্থা করা হয়। আর কখনো ছিটিয়ে দিতে হয় পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে প্রকৃতির সহন যোগ্য এবং খাদ্যে দূষণ হয়না এমন কীটনাশকও।
ঝাঁকড়া ফুল পাতা দেখলেই অনেক রকম কীট পতঙ্গ উড়ে আসে ছুটে আসে। খায়দায় বাসা বাঁধে নিজেদের জীবন বংশ বাড়ায় আর ক্ষতি করে দেয় মাঠের ফসলের। তাই অনাকাঙ্খিত কীট পতঙ্গ তাড়াতে ব্যবস্থা নিতেই হয় পুরো সিজনে দু তিন বার এসবের বিরুদ্ধে।
তিনমাস মাথা দুলিয়ে হাসতে থাকা সবুজ মাঠ মন ভুলিয়ে দেয়।
এবারের ফসল ছিল আলু। আলু অনেক মানুষের প্রধান খাদ্য। ভাতের সাথে তাদের পরিচয় নেই। থাকলেও তারা ভাতের চেয়ে আলু ভালোবাসে। আলুর নানারকম রেসিপি খেয়েই জীবন কাটিয়ে দেয়।
ধান, গমের মতন প্রচুর চাহিদা আলুর উত্তর আমেরিকা, ইউরোপের মানুষের কাছে।
নতুন প্রযুক্তির বিশাল বড় বড় মেশিন সারাদিন মাটি খুঁড়ে আলু তুলে নিল। মাটি ঝেড়ে মুছে পরিচ্ছন্ন করে ট্রাকের পিছনের বড় বড় গহ্বরে পাঠিয়ে দিচ্ছিল।
বানিজ্যিক ভাবে এসব কাজ শেষ হওয়ার পর ম্যাক্সিকান কৃষকরা এখন ফিরে যাবে ঘরে নিজের পরিবারের কাছে। পুরো গ্রীষ্ম জুড়ে তারা নিজেদের পরিবার ছেড়ে আয় রোজগারের জন্য কাজ করেছে উত্তর আমেরিকার মাঠে মাঠে।
সব কাজ সেরে কৃষকরা চলে গেলে ফাঁকা মাঠের মাঝে নেমে ঘুরছিলাম আমি। এতদিনের এত কাজ সব সাঙ্গ হলো আজ। ফসল তোলার পর ফাঁকা মাঠ দেখে মনে হচ্ছিল এযেন হেমন্তের ধান কাটা ক্ষেত।
সূর্য তখন পশ্চিমের আকাশে ঢলে পরেছে মাটির কাছাকাছি। চড়ুই আর ঘুঘুগুলো উড়ছে, খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে মাটি থেকে দানা তুলে আর বইছে অনেক হাওয়া। হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে আমি কুড়াচ্ছিলাম মাঠের মাঝে ছড়িয়ে পরে থাকা আলু।
মনে হচ্ছিল যেন আমি না খেতে পাওয়া সেই কৃষকের সন্তান । ফসলের মাঠে পরে থাকা ফসল কুড়িয়েই যাদের জীবন বাঁচে। যাদের মুখের হাসি অকৃত্তিম আনন্দে ছড়িয়ে পরে ফসল কুড়ানোর উৎসবে। আমার খুব আনন্দে হচ্ছিল মাঠে পড়ে থাকা ফসল কুড়াতে।
হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বেশি দূর যেতে পারলাম না। অল্প একটু খানি জায়গায় আলু কুড়িয়ে অনেকটা আলু পেলাম। ছোট ছোট আলু খুঁজে পেয়ে আমার খুব বেশি আনন্দ হলো। মনে পরে গেলো নানীকে দেখতাম ঝুড়ি ভর্তি ছোট আলু নিয়ে কাটারি দিয়ে কাটছেন বিশাল উঠানে বসে। আমি তার পাশে বসে থাকতাম আর ছোটো ছোটো আলু নিয়ে খেলতাম। কখনো পাঠ কাঠি নিয়ে আমরা দৌড়াতাম ভাইবোন একজন আরেক জনের পিছে। অথবা ফর্সা সুন্দর পাটকাঠির ঠুনক শরীর মুড়মুড় করে ভেঙ্গে মজা পেতাম।
এগুলো খুব মজার বিষয় ছিল মামা বাড়িতে গেলে। আমাদের বাড়িতে এসব দেখতে পেতাম না। পাঠকাঠি পাটের শাক এসব কিছুই দেখতাম মামাবাড়ির দিকে বেশি। ছোট আলুর স্বাদ অনেক বেশি। ছোট আলু ভাজা বা অনেক সজবীর মধ্যে মিশিয়ে রান্না। বা আলুর ডাল যা শুধু আলু দিয়ে করা হতো। এসব রান্না দাদার বাড়ির দিকে খুব পেতাম না।
আমার নিজের বাগানের আলু তুলে বেশ কবছর থেকে ছোটবেলার সেই স্বাদ পাচ্ছি আবার। গ্রীষ্মকালে নিজের তোলা ফসল ছাড়াও দোকান থেকেও অনেক সময় কেনা যায় ফার্মার মাকের্টের নানান তাজা সবজী। যার স্বাদ. গন্ধ আলাদা বিশাল ক্ষেতে চাষ করা ফসলের চেয়ে। অনেকে অগার্নিক জৈব সার ব্যবহার করেন আমি তো কিছুই ব্যবহার করি না। মাটি নিজে থেকে যে টুকু দেয় তাতেই সন্তুষ্ট থাকি । অসাধারন তাদের ঘ্রাণ এবং টাটকা স্বাদ। যা দোকানের কেনা সবজীতে কখনো পাই না। নানা বর্ণের এবং আকারের স্বাদ গন্ধবিহীন টমেটো পাওয়া যায় দোকানে। টমেটোর একটা নিজস্ব ঘ্রাণ আছে যে ঘ্রাণের জন্য ছোটবেলা টমেটো আমার অসহ্য লাগত। কিন্তু এখন সেই ঘ্রাণ পাই নিজের বাগানোর টমেটোর মাঝে এবং ভালোলাগে খুব।
গতকাল বিকালে মাঠের এককোনা থেকে এত্ত আলু তুললাম। পুরো মাঠ থেকে সব আলু কুড়াতে পারলে একটা স্টোরেজ দরকার পরত রাখার জন্য। আরো কিছু তুলব ভাবছিলাম কিন্তু আজ আরো তুমুল হাওয়া বইছে আকাশ অন্ধকার। তাই মাঠে নামা হলো না ।
কিছু সময় কিছু স্মৃতির সাথে মিলে মিশে আনন্দ দেয় অনেক।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০২২ রাত ১২:০৯