ঠিক কত বছর বয়সে হাটে বাজারে নামের বনফুলের লেখা বইটি পড়েছিলাম মনে নাই। মনে আছে স্কুলে ছোট ক্লাসে পড়তাম তখন। কিন্তু গভীর এক প্রভাব বিস্তার করেছিল সে বইয়ের লেখা আমার মনে। খুব অল্প বয়সে অসম্ভব এক জীবনের গল্প মনে ভীষণ ভাবে দাগ কেটেছিল। সে দাগ কাটার আরো কারন ছিল জীবনের ছবিটা আমার চোখের সামনে প্রতিদিন দেখতে পেতাম। যেন হাটে বাজারে ঘুরে ঘুরে অতি সাধারন মানুষের চিকিৎসা দেওয়া মানুষটি আমার খুব আপন একজন,অতি পরিচিত মানুষ। চিকিৎসক, রোগীর মধ্যে একটা আত্মীয়তার বন্ধন। অর্থ কাড়ি থাকুক না থাকুক চিকিৎসক বড় ভরসা। জ্বর কমছে না, খেতে পারি না। ঔষধ খাব কি খাবার খেতে পারি না। তারপারও চিকিৎসক যদি একবার দেখেন তাতেই যেন পাওয়া যাবে ভালো হয়ে উঠার আশ্বাস।
রাত বিরাতে দরজায় ধাক্কা দিতে কেউ দ্বিধা করে না চিকিৎসকের দরজায়।অস্থির হয়ে ডাকে। আর তাড়াহুড়ো করে চিকিৎসকও বেরিয়ে পরেন বোগী দেখতে যাওয়ার জন্য। গভীর রাত বা কোন মানুষের শত্রুতা বা কোন ধরনের বিপদের কথা মনে থাকে না শুধু চিন্তা কতক্ষন রোগী দেখে তাকে সুস্থ করে তুলবেন। রাত পেরিয়ে যায় কখনো রোগীর পাশে বসে থেকে। স্বস্থি পান যখন রোগী সুস্থ হয়ে উঠে উঠে। অসহায় মানুষের সাথে অতি সাধারন কথা এক মাত্র চিকিৎসকই বলতে পারেন। ধরেন তাদের হাত।
পরে জেনেছিলাম বনফুল ছদ্ম নামে যিনি লিখেন,তাঁর আসল নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। পেশায় তিনি চিকিৎসক হলেও সাহিত্য ছিল তাঁর প্রাণ। চিকিৎসক যেন নিজের জীবনের আশেপাশে ঘটা ঘটনাগুলোই গল্পে সাজিয়েছেন, যা বইয়ে পড়েছি। পরে আগ্রহ সহকারে উনার আরো অনেক বই পড়েছি। জীবনের গল্পই তিনি বলতেন, সচেতনতার কথা বলতেন। কিন্তু "হাটে বাজারে" প্রথম পড়া সে বই প্রথম প্রেমের মতন অন্তরে গেঁথে আছে সব সময়।
মৃনাল সেনের পরিচালনায় অগ্নীশ্বর সিনেমাটি দেখছিলাম আবার। যতবার দেখি ততবার চোখ ভিজে উঠে।
আগের মানুষগুলোর সাধারন জীবন আর দরিদ্রতা কী ভয়াবহ ভাবে ফুটে উঠেছে প্রতিটি ঘটনায়, দৃশ্যে। প্রতিটি মানুষের জীবন যাপনের ভিতর এক সীমাহীন কষ্ট অথচ সুখে থাকার আনন্দ, সহজ সরলতা যেমন আছে তেমন জটিল কুটকৌশলের অধিকারীরা যে তখন থেকেই এই বাংলায় রাজত্ব করছে সে বিষয়ে সন্দেহ করার কিছু থাকে না। বরং আরো পাকাপুক্ত হয় অসাধু মানুষের অবস্থান বিচরণ সম্পর্কে ধারনা।
মহানায়ক উত্তম কুমারের চেহারার সাথে কি বলাইচাঁদের বেশ মিলছিল। যা হোক তিনিও অসম্ভব ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন চরিত্রটি ঠিক যেন লেখক যা বলতে চেয়েছেন, যেমন জীবন যাপন করতেন একজন অসম্ভব আত্মসচেতন মানুষ সবটা চোখের সামনে ভাসে। অন্তর থেকে এক আত্মা হয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জাগে।
দেশে ইংরেজদের অবস্থান তখনও। আর তাদের খেদানোর জন্য কত প্রাণ নিজে উৎসাহী হয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য কত রকম আত্মত্যাগ করেছিলেন। দু চারজন পরিচিত নামের বাইরেও ছিল অসংখ্য অচেনা নামের স্বাধীনতাকামী মানুষ। তাদের কিছু ঘটনাও জানার সুযোগ হয়। যাদের কথা ইতিহাসে নেই। কেউ কখনো জানতে পারবে না তাদের গৌড়ব উজ্জ্বল আত্মত্যাগের কথা।
পাঠ্য বইএ সে সময় একটি গল্প ছিল "মানুষের মন" নামে। এ গল্প অনেকেই পড়েছেন, নরেশ ও পরেশ সহোদর দুই ভাই। কিন্তু দুজনের বিশ্বাস দুই দিগন্তের। নিজেদের সম্পর্ক সাপে নেউলে হলেও ছোট ভাইয়ের বাচ্চাটিকে দুজনে কি ভয়ানক আদর করেন। তার অসুখ হলে দুই বিশ্বাসে দুজন যে কি ভাবে ঝাঁপিয়ে পরেন বাচ্চাটিকে ভালো করার জন্য। এই গল্পটিও উদাহরণ দেয় আমাদের সমাজের বিশ্বাস আর বিজ্ঞানের প্রচণ্ড দ্বন্দকে। বনফুলের সমাজ নিয়ে লেখাগুলো অসাধরন।
১৮৯৯ সালের ১৯শে জুলাই বনফুল বিহারের মনিহারি নামের এক জায়গায় জন্মগ্রহণ করেন । ১৯৯৭ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি এই সাহিত্যিক চিকিৎসক মানবিক মানুষটির মৃত্যু হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ রাত ১:৩১