
অনেক দিন ধরে একটা পোষ্ট দিতে চাই কেন যেন দেয়া হয় না। ভ্যাকসিন নিতে অনেকটা পথ পেরিয়ে যাওয়ার কথাটা লেখেছিলাম তখন ডাঃ এম এ আলী বলেছিলেন সেই অভিজ্ঞতা এবং ছবি শেয়ার করার জন্য। প্রতিদিন ভাবলেও কেন যে লেখাটা হয়ে উঠছিল না। আজ লিখেই ফেললাম। কিছু ছবি দুবছর আগের তলানীতে ঢুকে গেছে তাদের খুঁজে বের করে জুড়ে দিলাম।
আসলে পোষ্টটা হবে ছবির পোষ্ট। আমার একটু আলসেমী আছে অনেক ছবির ভীড় থেকে ছবি খুঁজে বের করার। আর ছবি দিতে গেলে উল্টা পাল্টা হয়ে পোষ্ট হয়ে যায় সব মিলিয়ে আমার ছবি দেওয়ার খুব বেশি ইচ্ছা করে না।
এ জন্যই পোষ্ট দেয়া পিছিয়ে যায়। অথচ যত দিন যাচ্ছে তত ছবির ভীড় বাড়ছে আরো।
দু হাজার বিশ সাল আমাদের জীবনের এক নতুন অধ্যায় ছিল। পৃথিবীর মানুষ জেনেছিল কত ভয়াবহ হতে পারে মহামারী। যা আমরা শুনেছিলাম মা বাবা ,দাদা নানা পূর্ব পুরুষের মুখে। তাঁরা দেখেছিলেন, গিয়েছিলেন ভয়াবহ অবস্থার মধ্য দিয়ে। কলেরা, বসন্ত, ম্যালেরিয়া এমন সব ভায়াবহ রোগ হতো তখন বছর বছর গায়ের মানুষ উজাড় হয়ে যেত। মড়ক লাগত মানুষের জীবনে।
আমরা তার ভিতর দিয়ে গেলাম দু হাজার বিশ সালে। রোগটা ছিল কোভিড ১৯। আরো একটা নতুন মহামারী সংযোগ হলো মানব ইতিহাসে। পরে আমরা সহজ করোনা নামেই ডাকতে শুরু করি।
সারা পৃথিবীর মানুষের জীবন যাত্রা থমকে গিয়েছিল অদ্ভুত ভাবে। মানুষ ঘরে বসে দিন কাটাবে এমনটা কল্পনা করারও সুযোগ ছিল না। তাও করে ছিল বিশ্বের মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে । কাজ কাম বাদ দিয়ে এই ব্যাস্ত জীবনে ঘরে বসে দিন কাটাবে মানুষ। রাজপথ অলিগলি মানুষ যানবাহন শূন্য। বাজার , শপিং মল, অফিস, উপাসনালয়, স্কুল, কলেজ সব বন্ধ, কি ভয়াবহ একটা অবস্থা ছিল।
এমন ভয়াবহ অবস্থায় পরে আমরা তখন নির্ভর করেছিলাম বিজ্ঞানের উপর। ভ্যাকসিন আবিস্কার হবে এবং আমরা নিস্কৃতি পাবো মহামারীর হাত থেকে। বেরিয়ে পরব আবার পথে, কাজে সহজ জীবনে।
বিজ্ঞানই তখন আমাদের ঘরে বসে কাজ করার সুবিধাও দিয়েছিল, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে। অনেক সংস্থা সেই অবস্থা ঘরে বসে কাজ করার ব্যবস্থা এখনও রেখে দিয়েছে।
বাচ্চাদের পড়া লেখার ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল ঘরে বসে অন লাইনে । মানুষ জীবনের প্রয়োজনে শিখে নিয়েছিল নতুন করে বাঁচতে।
অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে ভ্যাকসিন এসেছিল বাজারে। আমরা আনন্দের সাথে অপেক্ষা করেছিলাম ভ্যাকসিন নিয়ে নিজেকে সুরক্ষা করার। কিন্তু সেটাও সহজ ছিল না।
প্রথমত যারা বয়োবৃদ্ধ যারা বেশি অসুস্থ এবং যারা চিকিৎসা ও রোগীর সাথে সরাসরি কাজে জড়িত তাদের জন্য বরাদ্দ হলো ভ্যাকসিন নেয়া।
অপেক্ষার পালা দীর্ঘ হতে থাকল ভ্যাকসিন নেয়ার তারিখ পাওয়ার। একটা সময় অনলাইনে বসে নানা কেন্দ্রে নিজের নাম দিয়ে রাখতাম যেখান থেকে তাড়াতাড়ি ডাকবে সেখানে চলে যাবো ভ্যাকসিন নেয়ার জন্য।
কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী এলাকা ভিত্তিক কেন্দ্রে যখন সময় হলো তখনই ডাকল ভ্যাকসিন নিতে যাওয়ার জন্য। ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হওয়ার পর আমার সিরিয়াল আসার অপেক্ষার পালা ছিল দীর্ঘ পাঁচ মাসের।
আমাকে যেতে হয়েছিল একটি ইউনিভার্সিটিতে। যেটা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে খ্যাত। যত রকম গবেষণা গাছপালা নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়। বেশ কয়েক বছর আগে তাদের কৃষি ব্যবস্থা দেখার জন্য একবার গিয়েছিলাম। আবার গেলাম ভ্যাকসিন নেয়ার জন্য সেখানে। আমার বাড়ি থেকে দূরত্ব প্রায় পঁচাশি কিলোমিটার।
ঘন্টাখানেক সময় লাগে সেখানে যেতে। অনেকে বলবেন এত সময় লাগার কথা না এতটুকু পথ যেতে। খুব জোড়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। গতি বেঁধে দেয়া আছে চলার কখনো পঞ্চাশ কখনো আশি, সত্তর এমন। খানিকটা জোড়ে গেলেও খুব একটা সময় বাঁচানো যায় না তাই তাড়াহুড়ো করে লাভ হয় না। এখন জিপি এস সময় দেখিয়ে দেয় কতটা লাগবে যেতে। আবার রাস্তায় কোন সমস্যা থাকলে সেটাও হিসাব করে দেয়।
যা হোক এ্যাপয়নমেন্টের সময় হিসাব করে হাতে একটু সময় বেশি নিয়েই রওনা দিলাম। অনেকদিন পরে মানুষের মধ্যে যাবো ভেবে কেমন উৎসব আনন্দ হচ্ছিল।
যদিও গ্রোসারী দোকানে যেতাম এই এক বছর কিন্তু মাক্সে মুখ ঢেকে কেমন বিষাদগ্রস্ত হয়ে থাকতাম। সব মানুষের থেকে দূরে কারো দিকে তাকিয়ে কেউ হাসে না পর্যন্ত। কথা বলা তো দূরের ব্যাপার। বাজার নিয়ে এসেই সব পরিস্কার করে নিজেকে পরিস্কার করতে শুরু করতাম। পরিবারের লোকজনের সাথেও কথা বলা এবং কাছে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা ছিল পরিচ্ছন্ন হতে হবে আগে।


মে মাসের শুরুতে বসন্ত আসেনি তবে বসন্তের আবহাওয়া। দারুণ রোদের ঝলমলো দিন ছিল বেরিয়ে পরার শুরুতে। নিরব পথের দুপাশে মাঠ গুলোতে কেবল সবুজের আভাস লেগেছে। কিছু কৃষক মাঠে নেমে চাষের উপযোগী করে ফেলেছেন ক্ষেত। কখনো পথে দেখা হয়ে গেলো কিছু ট্রাক্টার এবং ভাড়ি মেশিনের সাথে। আঁকাবাঁকা উঁচু নীচু পথ বেয়ে ছোট ছোট শহর আর বিস্তৃর্ণি ফসলী ক্ষেত কিছু আঁকাবাঁকা নদীর সাথে পথ চলে সময়ের কিছু আগে পৌঁছে গেলাম। সব পার্কিং ফ্রি করে দেওয়া হয়েছে ভ্যাকসিন নেতে আসা মানুষের জন্য। অথচ রেগুলার ইউনিভার্সটি এলাকায় পার্কিং অনেক বেশি থাকে।
কেন্দ্রে পৌঁছে দেখলাম অনেক মানুষের ভীড় লম্বা লাইন। সেচ্ছাসেবক যারা ভার্সিটির স্টুডেন্ট মনে হলো, তাদের নতুন মাক্স দিলেন পরতে। হাত স্যানেটাইজ করতে হলো সাথে।
তারপর নাম ঠিকানা বলে লাইনে অপেক্ষা করতে হলো অনেকটা লম্বা লাইনের পিছনে।
অনেকগুলো বুথ একটার পরে একটা। অনেক নার্স ডাক্তার কাজ করছেন।
ইংজেকশন নেয়ার পর অপেক্ষা করতে হবে পনের মিনিট যদি কোন সমস্যা হয় সে জন্য। পনের মিনিট পর কোন সমস্যা না হলে বাড়ি যাওয়া।
এক সময় আমি লাইনের প্রথমে আসলাম। কোন বুথে যাবো দেখিয়ে দিলেন একজন বয়স্ক সেচ্ছাসেবক। যারা সারাক্ষণ সবার দিকে নজর রাখছেন এবং সুশৃঙ্খল ভাবে পরিচালনা করছেন এত মানুষের লাইনকে।
একজন ডাক্তার আমাকে ভ্যাকসিন দিবেন। তিনি আমাকে দেখালেন নতুন এম্পুল বের করে। প্যাকেট থেকে নতুন সিরিঞ্জ বের করলেন। সাথে আমার নাম ঠিকানা জেনে ঠিক করে নিলেন আমিই সঠিক মানুষ। তাকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম আমার সাথের মানুষ কি ছবি তুলতে পারবেন ভ্যাকসিন নেয়ার। বললেন হ্যাঁ অবশ্যই। আমরা টুকটাক কিছু কথা বললাম। হাসলাম এই মহামারী থেকে বেরিয়ে আসব আমরা আবার স্বাভাবিক জীবন যাপন করব এসব বিষয়ে। ধন্যবাদ দিলাম তাদের এই মানবিক কাজে নিজের জীবনের রিক্স নিয়ে কাজ করাকে।
দুই সেকেন্ড আমার ভ্যাকসিন নেয়া শেষ হলো। তারপর পনের মিনিট অপেক্ষা করে রেজিস্ট্রেশন করে চলে এলাম। আবার আরেকটা ভ্যাকসিনের সময় হলে জানানো হবে আমাকে।
বাইরে বেরিয়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অসম্ভব সুন্দর গাছ এবং ফুলের বাগান দেখে তার প্রেমে পরে গেলাম আমি। এত সুন্দর ফুল। ফুটে আছে চারপাশে । এখানের ফুলগুলো যেন অনেক বেশি সতেজ এবং সুন্দর। কারণ তারা গাছের পুষ্টি বিষয়ে খুব ভালো জানে।
বসন্তের প্রথম ফুলগুলো সেবার ওখানে প্রথম দেখলাম।


গাছে পাতা হওয়ার আগে ফুলে ছেয়ে যায়। একেই মনে হয় বলে ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে ।

গোলাপী ফুলের এই গাছটার নাম উইলো। উইলো গাছ অনেক দেখেছি ক্রন্দনরত উইল বলা হয়, ডাল থেকে পাতা নিচের দিকে ঝুলে পরে গাছ ঢেকে দেয় যেন মুখ লুকিয়ে কাঁদছে।
কিন্তু গোলাপী ফুলের এই উইলো আগে কখনো দেখিনি। প্রায় ঘন্টা ধরে আমি এই গাছের নিচে বসে তার সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম।


মাটি ঘিরে থাকা ফুলগুলোও আরো ঘন হবে কেবল জাগছিল তারা তখন। কত ভিন্ন প্রজাতির পাতা ফুল থোকা থোকা লাগিয়ে রাখা হয়েছে। ছবি নিতে নিতে অনেক গাছের ছবি নেওয়া হয়নি। আবার এখানেও দিতে পারলাম না অনেক ছবি।
ছবি নেওয়ার কোন পরিকল্পনা ছিল না। ভ্যাকসিনের সময়ের ছবি ছাড়া। তাই সব ছবিই তোলা হয়েছে মোবাইলে।


ভ্যাকসিন নিতে গিয়ে ফুলের সাথে একটা সুন্দর পরিবেশে থাকার সুযোগ পাওয়াটা ছিল বাড়তি পাওয়া।
ফল, সবজী হওয়ার সময় তখনও হয়নি।
অনেকটা সময় সুন্দর বাগানে বসে থেকে পাখি কাঠবেড়ালী, খরগোসের পদচারণায় মুখর ক্যাম্পাস দেখে অতপর বাড়ির পথ ধরলাম তবে সরাসরি বাড়ি ফিরে গেলাম না। আরো কয়েকটা শহর ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করলাম প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটারের মতন। মাঝে মাঝে বৃষ্টি আসছিল। আকাশ অন্ধকার কালো মেঘের ভেলা তার ভিতর থেকে সূর্যের আলো রঙধনুর খেলাও দেখতে পেলাম। এমন পথ চলা সব সময়ই চলি তবে সেদিনের পথচলাটা ব্যাতিক্রমী ছিল। নতুন একটা পদক্ষেপ জীবনের ভয় থেকে বের হয়ে আসার।

সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০২৩ রাত ১:৩০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


