
লেখক উৎসবে মার্গারেট অ্যাটউড আসবেন না। এমনটা হওয়ার কথা না। তিনি প্রত্যেক অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ। যুগের পর যুগ।তার অবস্থান সম্মানের এবং আকর্ষণের শীর্ষ স্থানে রয়েছে, সেই প্রথম বই প্রকাশ হয়েছে ১৯৬০ সনে। তখন থেকে উনি এই পর্যন্ত কত অনুষ্ঠানে এবং বিশ্বের কত যে বিখ্যাত এবং প্রেস্টিজিয়াস যত লেখক সম্মেলন, সেখানে যোগ দিয়েছেন এবং পুরাস্কার পেয়েছেন তা আপনারা গুগলে খুঁজলেই পেয়ে যাবেন। আর এ তো উনার নিজের ঘরের অনুষ্ঠান। এখানে প্রতিবার তিনি মাতিয়ে রাখেন। তাকে পেয়ে ধন্য হয় মানুষ। ক্যানাডার রাজধানী অটোয়ায় মার্গারেট অ্যাটউড জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৩৯ সনে। বিশ্ব যুদ্ধের আঁচড় দেখতে দেখতে কেটেছে শৈশবকাল। যুগের সাথে দেখেছেন বিশাল পরিবর্তন মানুষের এবং পৃথিবীর দেশ গুলোর। এবং সব সময়ই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন অত্যন্ত সুক্ষ ভাবেএবং দক্ষতার সাথে লিপি বদ্ধ করেন লেখায়। তাই তিনি এখন বলেন, পৃথিবী আবার হেন্ডমেইডের গল্পের দিকে ফিরে যাচ্ছে। যে বইটির গল্প লিখেছিলেন ১৯৮০ সনে। আজ পর্যন্ত যার আট লক্ষ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে সারা বিশ্বে। এই একটি বই বিক্রি হয়েছে এত গুলো আর বাকি বই তো আছেই । এ পর্যন্ত বইয়ের সংখ্য পঞ্চাশ প্রায়।
চব্বিস তারিখ বিকালে উনার অনুষ্ঠান আছে আর্ন্তজাতিক লেখক উৎসব টিফাতে। এই লেখককে দেখার জন্য দারুণ এক আগ্রহ আমার। লেখক উৎসবে যোগ দিয়েছেন অনেক অভিনেতা অভিনেত্রীও । যাদের মধ্যে ছিলেন জেসি আইজেনবার্গ,একাডেমি পুরস্কার-মনোনীত অভিনেতা এবং লেখক। হলিউডের সবচেয়ে বড় বড় ফিচার ফিল্ম এবং ব্লকবাস্টারে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। তার উঠতি সময় দু হাজার নয়ের দিকে মুভি থিয়েটারে তার ছবি দেখতে যেতাম। "দ্য সোশ্যাল নেটওয়ার্ক," ছবিতে মার্ক জুকারবার্গের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ছিলেন অস্কার বিজয়ী চিত্রনাট্যকার সারা পোলি এবং আরো অনেকে । কিন্তু তাদের দেখার তেমন আগ্রহ হয়নি ।
এছাড়া ছিলেন অগনিত তারকা লেখক সবার সাথে কথা বলা হুটহাট দেখা হয়ে হয়েছে অনেকটা। কিন্তু মার্গারেট অ্যাটউড এর সাথে দেখা করার ইচ্ছাটা মনে পুষে রেখেছি অনেক দিন।
লেখক হিসাবে প্রতিটি অনুষ্ঠানে প্রতিদিন প্রতি পর্বে যাওয়ার সুযোগ আছে আমার । কিন্তু মার্গারেট অ্যাটউড এর অনুষ্ঠানে টিকেট করে যেতে হবে। এবং টিকেট পাওয়াটা দূরহ ব্যাপার। টিকেট বিক্রি শুরু হওয়ার সাথেই শেষ। সব চেয়ে বড় হলটি উনার জন্য বরাদ্দ যাতে তিল ধারণের ঠাঁই থাকবে না। প্রচুর ভক্ত পাঠক আসবে টিকেট কিনে উনার কথা শোনার জন্য।
একজন লেখকের প্রতি মানুষের এতটা আগ্রহ এবং সম্মান দিয়ে আসে উনার কথা শুনতে চায় এটা খুব ভালোলাগার একটা বিষয়। একজন লেখক, বই লিখে মিলিয়নার হতে পারেন। আমরা বাংলাদেশিরা এমনটা ভাবতে পারি না। আমাদের লেখকরা তো রয়ালিটিই পান না। নিজের পয়সায় এখন বই ছাপিয়েও লেখক। আর পাঠক সংখ্যা বিশাল মানবগোষ্টির খুবই সীমিত এখন। পাঠ আগ্রহ কমছে ।
কিন্তু বিদেশে পাঠকরা এখনও যেমন বই পড়েন, লেখকরাও তেমন রয়ালিটি সাথে সাথেই পান। অনেক মিলিয়নার লেখকের সাথে লেখার জীবিকায় জীবন যাপন করার মতন প্রচুর লেখক আছেন।
শুধু ক্যানেডিয়ানরা পাঠক না মার্গারেট অ্যাটউড এর। উনার লেখা অনুবাদ হয়ে প্রকাশিত হয়েছে চল্লিশটি ভাষায় বিভিন্ন দেশের পাঠকের কাছে তিনি পরিচিত, সমাদৃত। টেলিভিশনে চলে উনার গল্পের সিরিজ।
মুভি টিভি সিরিজ হয়েছে ওর গল্পে, বাচ্চাদের কার্টুন প্রতিদিন দেখানো হয় টিভিতে। লেখার বিভিন্ন মাধ্যম সবখানেই পদচারণা উনার । শুরু করে ছিলেন কবিতা লিখে। প্রথম কবিতার বই উনার জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তারপর থেকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি আর। ধর্ম রজনীতির অন্ধত্ব এবং নারীদের উপর নির্যাতনের ছবি আঁকেন গভীর মমত্ব এবং সুচিন্তিত কল্পনায় বাস্তবের মিশেল দিয়ে। ওর লেখা পড়তে গিয়ে ডুবুরির মতন ডুব দিতে হয় গভীর সমুদ্রে। মগ্নতায় তুলে আনতে হয় মনিমানিক্য। পারিপার্শ্বিক অনেক বিষয়ের প্রতি ধারনা না থাকলে, বুঝতে কষ্ট হয় উনার লেখার বিষয়।
অথচ এই উনার উঁচ্চতা লেখার, সহজে যা তিনি ছড়িয়ে যান শব্দর কারুকার্যে। যিনি খুব অল্প বয়সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নিজের জীবনের লেখক হবেন বলে। এবং বিশ্বে পরিচিত একজন লেখক হয়েছেন নিজের কর্মে ।
মনে মনে অনেকদিন ধরেই ক্যানাডিয়ান লিভিং লিজেন্ড মার্গারেট অ্যাটউড এর সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ খুঁছছি। চব্বিশ সেপ্টেম্বর মার্গরেটের আসার কথা, উনার নিজেস্ব অনুষ্ঠান আছে।
দুপুরে হঠাৎ করে বেশ গরম লাগছিল সেদিন। দিনটা রোদ ঝলমল সুন্দর ছিল। সকালটা যদিও হালকা শীতের আমেজ ছিল। আমার অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে আমি তাই একবার গাড়িতে পরনের জুব্বা, বই ইত্যাদি রাখার জন্য পার্কিং লটে গিয়েছিলাম। তখন দেখলাম কেমন সাজ সাজ ব্যাস্ততা, পাহারা বিভিন্ন কর্মকর্তা, পুলিশ, সিকিউরিটি সব বাইরে দাঁড়ানো লাইন দিয়ে। আমার মনে হলো এ্যাটউড আসেছেন, তার জন্যই এত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তাকে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছু সময়, ধীরে সুস্থে পার হলাম পার্কিং লট এরিয়া। একজনকে জিজ্ঞেসও করলাম এখন কি মাগারের্ট আসছেন। তিনি সরাসরি আমাকে না করে দিলেন। আয়োজন দেখে আমার মনে হলে সবাই আছে তার অপেক্ষায় কিন্ত এই মহিলা কিছু জানে না বলল কেন? নিশ্চয় তার আসার বিষয়টা গোপন করে রাখতে চায় তারা, উনারই নিরাপত্তার জন্য। তাই আমি ভিতরে চলে আসি তখন।
বাংলাদেশি কবিতা অনুষ্ঠানে শেষের দিকে উঠে আমি ইয়ুথদের পেন কানাডা গ্রেম গিবসন টক অনুষ্ঠানে, ইটালিয়ান ক্যারেবিয়ান স্প্যানিস কবির কিছু কবিতা শুনলাম। দেশ ছেড়ে আসা, নতুন দেশে বসবাসের যন্ত্রনা। নতুন প্রজন্ম আর পুড়ানো ধ্যানের সংস্কৃতি ধরে রাখা অভিভাবকের সাথে সংঘাত সব দেশের মানুষের মাঝে আছে আছে নতুনকে গ্রহণের সাথে পুরানো হারানোর বেদনা। এমন সব বিষয়গুলোর ঝংকার সুন্দর ভাবে প্রকাশিত শব্দে শব্দে ।
এরপর স্টুডিও থিয়াটারে চলা করিনা চং দুইজন গল্প লেখক পাওলা ফেরান্তে এবং অনুজা ভার্গিস এর সাথে তাদের বই নিয়ে যে আলোচনা করছিলেন তা শেষ করে গ্রীন রুমে ঢুকে পরলাম।
আর সেখানে দেখা হলো সংযোগ কর্মকর্তা জেইনের সাথে। আমি তাকে মার্গারেট অ্যাটউড এর অনুষ্ঠানে ঢুকার একটা সুযোগ করে দেয়ার জন্য নিয়মের বাইরে কিছু হবে না জেনেও বদার করতে থাকলাম। জেইন বলল, হবে না তো, টিকেট সব সাথে সাথেই শেষে হয়ে গেছে হাউস ফুল। কারণ সে মার্গরেট অ্যাটউড! চব্বিশের পরে সাতাশ তারিখে মার্গারেট অ্যাটউডএর অনুষ্ঠান আছে। জেইন আমাকে বলল অন লাইনে দেখতে পারো। রেজিস্ট্রেশন করে নাও। সেটা হতে পারে ঘরে বসেই দেখলাম। কিন্তু ও তো টিভিতে বা অন লাইনে যেমন দেখি তেমনই হবে। আমি তাকে সরাসরি দেখতে চাই। কথা বলতে চাই। কি ভাবে হবে অনলাইনে দেখলে কথা বলা।
মন খারাপের ঝুলি নিয়ে ভাবলাম এখন কফি পান করে চলে যাবো, সেই ভোর ছটায় আজ দিন শুরু করেছি কত পথ পারি দিয়ে এসেছি আবার ফিরতে হবে।
কফির টেবিলের দিকে ঘুরে উঠেই দেখি সুন্দরী মহিলা সরাসরি আমার দিকেই হেঁটে আসছেন। তিরাশি বছর বয়সেও কত শক্ত সামর্থ এবং ঠিক ছবিতে যেমন দেখি তেমনি তিনি। তাকে দেখে আমার হৃদস্পন্ধন থেমে গেলো মনে হয়। যাকে দেখার জন্য সকাল থেকে ভাবছি তিনি আমার সামনে। আমরা একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি।
এক মূহুর্ত আমি কথা বলতেই পারলাম না। স্বপ্নের মতন মনে হলো। আমি অত্যন্ত উচ্ছাসের সাথে বললাম, তোমাকে দেখার অপেক্ষায় ছিলাম আমি। উনি হেসে ফেললেন তাই বুঝি। তাই তো। আমরা যেন কত পরিচিত বন্ধু সহজ ভঙ্গীতে কথা বলছি।
উনার হাত ধরে হাঁটছিল নেনি, সেও হেসে ফেলল আমার কথা শুনে। নেনি ওর হাতটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, তোমরা দুজন হাত ধরাধরি করে হাঁটো। উনি আমার আঙ্গুল ধরে আছেন। কি অদ্ভুত লাগছে আমার। যাকে দেখার জন্য এত ইচ্ছা তিনি আমার হাত ধরে আছেন। আমরা একে অপরের সঙ্গী হয়ে হাঁটছি। আমরা রুম থেকে বের হয়ে সামনের ব্যালকুনিতে চলে গেলাম। গ্রীন রুম তখন প্রায় ফাঁকা। আর ব্যালকুনীতে কেউ নেই। আমাদের পিছনে অন্টারিও লেইকের জলে দিগন্ত ব্যাপী ঢেউ। গোধূলীর মায়াময় আলো ছড়িয়ে আছে ।
আমি বললাম, তোমার লেখার ভক্ত আমি, এ কথা তো অনেকের কাছেই শোন তুমি আমিও একজন সেই অগনিতর মাঝে। আরো একটু আদর করে জড়িয়ে নিলেন আমাকে। অনেক বই পড়েছি তোমার লেখা। আর কিছু কাজ করার সুযোগ হয়েছে তোমার হ্যান্ডমেইড টিভি সিরিজে।
তুমি তো আমার অনেকটা জুড়ে আছো দেখছি। এত মায়া নিয়ে কথা বলেন, একদম সহজ একজন মানুষ। আমিও লেখি তবে তুমি আমার লেখা পড়তে পারবে না। কেন পারব না? আমার লেখা যে অন্য ভাষায়। কোন ভাষায়? বাংলা।
ইস আমি যদি তোমার মতন টেলেন্ট হতাম বাইল্যাঙ্গুয়াল হতাম যদি আমি তোমার ভাষা জানতাম তোমার বই পড়তে পারতাম। ইস মার্গারেট যদি আসলেই আমার বই পড়তে পারতেন কেমন হতো তা হলে।
তুমি যে কেন তোমার ফার্ম হাউসের বাড়ি থেকে এই শহরে চলে এসেছো। ওখানে থাকলে আমি তোমার বাড়িতে প্রায় যেতাম। সেখান থেকে অনেক আগে চলে এসেছি। আর আমি এখন ওদিকে থাকা শুরু করেছি। কেমন লাগে? তোমার মতন অভিজ্ঞতা নেয়া শুরু করেছি। আমরা এলোমেলো অনেক কথাই বললাম।
তুমি কি আমার সাথে একটা ছবি তুলবে? অবশ্যই তুলব। নেনিকে ডেকে অনুরোধ করলাম ছবি তোলার জন্য। ও গ্রীন রুমে খাবার নিতে গিয়েছে। গ্রীনরুমে বেশ ভিড় লেগেছে বাইরে দু চারজন এদিক সেদিক। এসে দাঁড়িয়েছে। আর উনার বন্ধুরা এসে গেছে।
উনারা এসে দখল করে নিল আমার কাছ থেকে মার্গারেটকে। আমি তাও অনেকক্ষণ তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের গল্প শুনলাম পরিচিত হলাম আর অবাক হয়ে লক্ষ করলাম প্রায় আধঘন্টার বেশি সময় উনি হেঁটে চলে ঘুরে বেরাচ্ছেন, দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছেন । বসার কোন লক্ষন নাই যদিও চারপাশে বসার অনেক চেয়ার খালি পরে আছে। যেমন শারীরিক ভাবে তিনি স্বাবলীল চলাফেরা করছেন তার চেয়ে বেশি সক্ষম তার ভাবনার জগৎ এখনও। লিখছেন প্রাণ ভরে।
সেই দুপুরে এসেছেন এখনও সতেজ প্রাণবন্ত। এক সময় নিজে গিয়ে কিছু খাবার নিয়ে ব্যালকুনির চেয়ারে বসলেন। আমিও আর কিছু লেখকের সাথে কথা বলে আড্ডা দিলাম। এক সময় সন্ধ্যা পার্টি সমাপ্ত করে খাবার খেয়ে প্রশান্ত মনে বাড়ি ফিরলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০২৩ রাত ৩:০৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




