কাজিনকুজিনদের মধ্যে আমার ফুপাতুত একটি বোন যখন মারা গিয়েছিল। তেমন বেশি আবেগ প্রবণ হয়নি মন। বোনটা ছিল নিরবে ওর মায়ের গা ঘেষা বাচ্চা। ওর ছোট বোনরা যখন স্কুল কলেজ পাশ দিচ্ছে ও তখন নিজেকে সব কিছু থেকে আড়াল করে রাখত। তখন বয়স এবং বুদ্ধি বৃত্তি এতটা ছিল না। অন্য রকম মানুষদের বুঝতে পারতাম না। আমাদের সমাজে শিক্ষায় স্বাভাবিকের চেয়ে অন্যরকম মানুষদের চিনতে শেখানো হয় না ছোটবেলা থেকে।
শুধু শুনেছিলাম সাজু মারা গেছে। অল্প মনে পরে ওর কথা শুধু হাসত খুব শান্ত ছিল। ডাকলে কাছে আসত না। ওর সাথে তেমন ভাবই করতে পারিনি কখনো।
এরপর শুনেছিলাম পরিবারের সবচেয়ে বড় ভাইয়ের খবর, যার জীবনধারা ছিল বড় বৈচিত্রময়। সব সময় নতুন নতুন সাজ পোষাক আর ফ্যাশনে যাকে আমরা দেখতাম। আজ ধুতি তো কাল পাঞ্জাবী। পরশু সার্ট তো পরের দিন স্যুট টাই পরে এক বন্ধুর সাথে দুজনে একই রকম পোষাক পরে ঘুরে বেড়াতেন।
হঠাৎ জানলাম মিলিটারিতে যোগ দিয়েছিলেন । পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছেন। গোলগাল স্বাস্থ পোষাকের মতন লম্বা চুলে নানা সময়ে নানা রকম ডিজাইনে থাকত উনার ।
মানুষটা লম্বা একটা ট্রেনিং সেরে যখন ফিরে এলেন। পেস্তা বাদাম আখরুটের নানা রকম নতুন খাবার গুলো ফুপুর বাড়িতে গিয়ে অন্যরকম স্বাদের উপভোগ করেছিলাম সে সব খাবার আর উনার নতুন অভিজ্ঞতার নানা রকম মজাদার গল্প, ট্রেনিংয়ের সময়ের ভয়াবহ কষ্টের কথাগুলো হা করে শুনতাম। নতুন এক ধরনের জীবনের খবর জেনেছিলাম যা আমাদের পরিবারের এই মানুষটি যাপন করে এসেছেন। আর দেখেছিলাম ফর্সা গোলগাল মানুষটি কেমন চিকন আর বাদামি রঙের হয়ে গেছেন।লম্বা চুল দুই পাশে সিঁথি কেটে উঁচু করে রাখা বা সিঙ্গারা কাটিং এ একপাশে দারুন রকম উঁচু করে আঁচড়ানো। সাধের সে চুল এতই ছোট করে কাটা হয়েছে মনে হয়, উনার মাথায় চুলই নাই।
ছুটি শেষে উনি কাজে ফিরে যাওয়ার পরই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধের মাস গুলোতে সারাক্ষণ পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজতেন। লেফটেন্যান্ট হিসাবে ট্রেনিং করানোর সময় সিপাইদের বলতেন, জয় বাংলা বলে দৌড় দেওয়ার জন্য।
এখনো সেদিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে হয়। একাত্তর সনের শেষের দিকে ইণ্ডিয়ান রেডিও থেকে বলছে। একজন বাংলাদেশি জওয়ান পাকিস্থানের সীমানা পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। যখন সে জওয়ানের নাম বলল, লেফটেন্যান্ট ইকবাল হোসেন চৌধুরী আমরা সবাই চিৎকার করে উঠলাম। এতো আমাদের পরিবারের মানুষ।
আমার বাবার চেহারাটা ভাসছে চোখের সামনে। বাবা হাসবেন না কাঁদবেন এমন একটা অবস্থা। প্রথম ভাগ্নে যাকে কোলে পিঠে মানুষ করেছেন। সেই মানুষের খবর রেডিওতে বলছে এমন যুদ্ধ সময়ে। যে বেঁচে আছে কিনা নেই তাই জানার উপায় ছিল না অনেকদিন, সে পালিয়ে এসেছে শত্রু শিবীর থেকে। মাশুক আমাদের মাশুক বাবা অস্থির হয়ে বারেবারে বলছেন। আহা এখনো গায়ের রোম শিহরিত হয়ে উঠে। কানে ভাসে রেডিওর শব্দগুলো।
দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয় উনাকে সেই বর্ডার এলাকা থেকে। ফিরে এসে তিনি যা সব গল্প বলতেন সবই ভয়ানক রোমান্চকর মনে হতো। শত্রুশিবির থেকে অসংখ্য সতর্ক চোখ এড়িয়ে পালিয়ে যাওয়ার সেই গল্প ছিল অসাধারন। গ্রেনেড পকেটে নিয়ে পাহাড়ি চড়াই উৎরাই পথ শীতের সময়ে জীবন হাতে নিয়ে পারি দিচ্ছেন। ষাট সত্তর মাইল পেরিয়ে ভারতের সীমান্তে পৌছানো। সেখানেও সতর্ক দৃষ্টি এবং তাদের কাছে নিজেকে জয়বাংলার লোক প্রমাণিত করা। এত কিছু তিনি একা পেরিয়ে আসার পরই আমরা জানতে পারি রেডিওর মাধ্যমে।
আমাদের ছোট শহরে একটি ভক্সওয়াগন গাড়ি চালিয়ে বেড়াতেন। গাড়িতে না চড়েও আমরা আমাদের বাসার সামনে দিয়ে গেলে হৈ চৈ করতাম খুশি হয়ে উঠতাম। আর্মি থেকে অবসরে চলে যান পঁচাত্তরের পরে। এক সময় জানালেন চেয়ারম্যান হবেন । স্বতন্ত্র প্রার্থি হিসাবে চেয়ারম্যান হলেন তারপর এমপি, মন্ত্রী হলেন।
অনেকদিন যোগাযোগ ,দেখা একদমই ছিল না দেশে থেকেও। যে যার জীবনে ব্যস্ততায়। শেষবার উনাকে দেখেছিলাম কোন এক ঈদের দিন, এক আত্মিয়র বাসায়। সেই ছোটবেলার মতন অনেক সুন্দর সাজগোজ করে আছেন। পাঞ্জাবী পরেছিলেন বিশাল বড় গোঁফ। সরু চিকন পাকানো দুপাশ গালের উপর উঠে গেছে। সেই গোঁফে তা, দিতে দিতে গান করছিলেন, সই ভালো ক'রে বিনোদ–বেণী বাঁধিয়া দে মোর বঁধু যেন বাঁধা থাকে বিননী–ফাঁদে মাথা নাড়িয়ে মুচ বাগিয়ে বাঁধিয়া দে তে তান দিচিছলেন। একই রকম মজার কথা বার্তা। আমি কি দাঁতের ফাঁকে মাংস লেগে থাকবে এই ভয়ে খাচ্ছি না নাকি মোটা হবার ভয়ে খাচ্ছি না। ঈদের দিনের খাবার কার্পন্য না করে বেশি করে খেতে হবে। আমাকে ক্ষাপানোর চেষ্টা করছিলেন। যেন আমি সেই ছোটটিই আছি।
অনেক দেরিতে বিয়ে করার জন্য যখন মারা গেলেন উনার তিনটে বাচ্চা ছোটছোট তখনও। আমি তখন কেবল বিদেশে এসেছি। হঠাৎ এখানে থাকা পাড়াতুত এক বোন ফোন করে জানাল উনার মৃত্যু সংবাদ। আমাদের পরিবারের সবচেয়ে বড় ভাইয়ের মৃত্যুর খবর জেনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। যোগাযোগ ব্যবস্থা কত কঠিন ছিল তখন।
উনার খালা মামারা বেঁচে আছেন অথচ এত অল্প বয়সে এমন হাসিখুশি একজন মানুষ কেন চলে গেলেন বিস্তারিত আর জানাই হয়নি কখনো কারো কাছে।
এর পর শুনলাম মেঝফুপুর বড় ছেলেরও চলে যাওয়া। যার জীবনটা পান খাওয়া গান গাওয়া আর খেলার মধ্যেই কেটে গেল। একটা অদ্ভুত বিষয় এই দুই ভাইয়ের বউরাও বাচ্চা রেখে স্বামীদের কাছে পরপারে চলে গেছেন খুব তাড়াতাড়ি।
আমার একটি খালাত বোন মারা গেছে। যে মেয়েটির মরে যাওয়ার কথা ছিল ওর কুড়ি একুশ বছরে। প্রচণ্ড ভালোবাসায় পরিবারের লোকজন আর ডাক্তারের চেষ্টায় সে মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল।
মাথায় একটা টিউমার হয়ে গিয়েছিল।
ঢাকায় হাসপাতালে যেদিন ওর অপারেশন হবে ভেবেছিলাম ও আর বাঁচবে কিনা। পরদিন চিটাগাঙ্গ বেড়াতে যাবো আগে থেকে ঠিক ছিল । রাতের ট্রেনের টিকেট কাটা। তারপরও সবাইকে বাসায় দাওয়াত দিয়েছিলাম । সারাদিন ওদের সাথে কাটিয়ে রাতে রওনা হয়েছিলাম।
অপারেশনের পর সে মেয়েটি একদমই নর্মাল জীবন যাপন করছিল।
একবার হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় ওর ভাই নিজে বাস চালিয়ে ওকে ঢাকায় হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল, এম্বুলেন্সের অভাবে। ভাগ্য ভালো ওর নিজেরই গাড়ি রাস্তায় চলত। বোনের জীবনের জন্য ভাই সব ঝুঁকি নিজের উপর তুলে নিয়ে আর কিছুর তোয়াক্কা না করে রংপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে চলে এসেছে হাসপাতালে।
আমাদের দেশের যাতায়াত ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য সেবা জনগণের সুবিধা আরো কুড়ি একুশ বছর আগে কেমন ছিল আজকের প্রজন্মের কল্পনা সে জায়গায় পৌঁছাবে না। এখনও তেমন কিছু অগ্রগতি হয়নি। ঢাকা ছাড়া অন্য শহরে সেবা পাওয়া কঠিন।
পরিবারের এই আদর এই ভালোবাসায় মেয়েটি নতুন জীবন পেয়েছিল। ভালো হয়ে বেঁচে থাকার পর স্বাভাবিক ভাবে মেয়েটির বিয়ের কথা ভাবেন বাবা মা। ভালো একজন স্বামীর সংসার করে। দুটি সন্তান হয়। সন্তান স্বামী নিয়ে সুখে সংসার করছিল পলাশ। অর্নাসে পরছে ওর ছোট বাচ্চাটি। বড়টি আইন পড়া শেষ করে কাজ করছিল।
কিছুদিন আগে নতুন একটি কাজে যোগ দিয়েছিল ছেলেটি । অফিস ছিল বনানী এফ আর টাওয়ারে। যেদিন আগুন লেগেছিল ঐ ভবনে ছেলেটি ছাদে উঠে অন্য বিল্ডিংয়ের ছাদে লাফিয়ে পার হয়। খবরটা যখন ফোনে বাবাকে দিচ্ছিল। পাশ থেকে মা কেবল শুনেছিল ছেলে যেখানে কাজ করে সেখানে আগুন লেগেছে। তারপর সে অজ্ঞান হয়ে যায়। এই জ্ঞান আর ফিরে আসল না। ছেলের চিন্তায় আতংকে একজন মা জ্ঞান হারিয়ে কাটিয়ে দিল কয়েকটা মাস। এতদিন নানা রকম চিকিৎসা দিয়েও আর তাকে জাগরত করা যায়নি। সে একবারই ঘুমিয়ে পরল শেষ পর্যন্ত।
এই ভয়াবহ খবরটা না পেলে হয় তো বাচ্চাদের কাছে এই দরদী মা আরো কিছুদিন থাকতে পারত। কিন্তু খুবই সুক্ষ অনুভুতি প্রবণ সরল মানুষটি, ভয়াবহ খবরটাকে সহ্য করতে পারেনি।
মায়ের দিক থেকে দ্বিতীয় বোনটিকে হারালাম, বড় খালার মেয়ে। প্রথমজন চলে গেছে অনেক আগে হঠাৎ অসুস্থতার ডাক জেগে ছিল শরীর জুড়ে। কেবল বিয়ে হয়েছিল শুধুমাত্র বাচ্চাটি হলো অথচ তারপরই অসুস্থ। সে অসুস্থতা থেকে আর ফিরা হলো না। শত চেষ্টা উপেক্ষা করে, সবমায়া কাটিয়ে এত অল্প বয়সে পারি দিল অন্যলোকে। কত কঠিন ক্যানসারের রোগী এখন ভালো হয়ে যায়। অথচ সে কোন সুযোগই পেল না। বড় মামার বড় মেয়েটি পরিবারকে এক সমুদ্র দুঃখে ভাসিয়ে চলে গিয়েছিল। সেই মেয়ের বাচ্চা মেয়েটি নানীকেই মা বলত। এখন ডাক্তার হয়ে সেবা করছে মানুষের আমেরিকায়।
বড় ফুপুর বড় মেয়েটি খুব ছোট বয়সে বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। তারপর অদ্ভুতভাবে চুপ হয়ে ছিলেন নিজের মতন। একদিন নিরবেই চলে গিয়েছিলেন।
এবছর ফেব্রুয়ারিতে চলে গেলো চাচার বড় ছেলে। যার বাচ্চাগুলো এখনও স্কুল শেষ করেনি। চাচী এখনও বেঁচে আছেন। আর কদিন আগে পাওয়া মৃত্যু সংবাদ আমার সব কাজ করার ক্ষমতা স্থবির করে দিয়েছে।
আমার সবচেয়ে ছোটবোনের স্বামী। চলে গেলো গত দশ জুন। যে ছিল আমাদের ছোট ভাই । সারা শহর শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে ওর মৃত্যু সংবাদে। একজন মানুষের বন্ধু থাকে এক দুইজন। কিন্তু ওর হরিহর আত্মা বন্ধুর সংখ্যা অগনিত।শহরে যারা থাকত তারা প্রতি দিন দীর্ঘ সময় এক সাথে কাটাত। আর যারা শহরের বাইরে দেশে বিদেশে থাকত, ঈদে পরবে, ছুটিতে শহরে এলে বন্ধুরা ওকে ঘিরে কাটিয়ে দিত দীর্ঘ সময় বাড়ির কথা ভুলে। ওর মা এবং বড় ভাই বোনরাও বেঁচে আছেন অথচ জীবনের অদ্ভুত হিসাবে ও চলে গেলো পরপারে। শহরের খুব জনপ্রিয় জুটির এই এই ভাঙ্গন সবার মন ভেঙ্গে গেছে। জানি না আমার আদরের বোনটি কিভাবে সামলে উঠবে এই একাকিত্ব।
ভাঙ্গনের শুরু হলো অদ্ভুত ভাবে। যাদের সাথে খেলাধূলা বেড়ে উঠা এক বিশাল পরিবার হয়ে তাদের কতজন হারিয়ে গেল অন্যলোকে। মৃতদের জন্য ভালোবাসা তবু একই রকম জেগে থাকে। মন আদ্র হয় তাহাদের কথা ভেবে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০২৪ রাত ২:২০