somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

থানচি বাজারের সকাল, খেই মা প্রুই এবং ক্রেঙ

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

থানচি বাজার একদম ছোট

বান্দরবন ভ্রমণের চতুর্থ দিন সকালে উঠে থানচি বাজারের পাড়ার সরু গলিগুলো দিয়ে হেঁটে যাই, তবে বেশি ভেতরে না। সেখান থেকে ভেসে আসে মারমাদের গান। মারমা বুঝলাম এ কারণে যে, ঠিক একই গান এবার পার্বত্যমেলাতেও শুনেছি। এই গানে ছিল তাদের বোতল কিংবা কলসি নাচ। ব্যাপারটা ঘটনার কাকতাল নাকি স্বাভাবিকতা ঠিক বোধে আসে না। তাদের খুব জনপ্রিয় গান হবে হয়তো! সেখানে হাটতে দেখি জনৈক পাহাড়িকে, ফোনালাপে ভিন্ন ভাষায় কথা বলে যাচ্ছে সে। পাহাড়ি বাচ্চারা আনন্দে হেসেখেলে বেড়ায়, জীবনের জটিলতা তাদের স্পর্শ করেনি। অনেকে ব্যস্তপদে বাজারের দিকে যায় আবার কেউ হাতে ঝুড়িভর্তি বাজার করে ফেরত আসে। পাড়ার দোকান বা বাড়ি বাঁশের গাত্রে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। চোখ বন্ধ করা কোন মানুষকে যদি শুধু সেই বিজ্ঞাপনগুলোর সামনে নামিয়ে দেয়া যায় তাহলে সাথে সাথে বুঝে ফেলবে সে বান্দরবনের থানচিতে আছে! থানচি বাজারে অনেক বাঙালির পাশাপাশি উপজাতিদের মধ্যে প্রধানত মারমা আর বমদের বাস। আমরা রাতে যার বাড়িতে ছিলাম তারা ছিল বম উপজাতীয়। সেখানে থাকা নিয়ে মূলত এক বম নারীর সাথেই কথা হয়। তার পুত্র জনসন বম বাংলায় পটু। কথায় সে তার মাকেও টেক্কা দেয়!

থানচি বাজারের পাড়ার সরু গলি দিয়ে হেঁটে যাই।

থানচি বাজার একদম ছোট। কিন্তু কোন জিনিসের সম্ভবত অভাব নেই। বাজারের পেছনেই বয়ে চলেছে শঙ্খ নদ। বাজারে রাত আটটা সময় দোকানগুলোর ঝাঁপি নামতে থাকে আর নয়টা নাগাদ সমস্ত বাজারে নিশুতি নিরবতা নেমে আসে। পরদিন ভোর হতেই শুরু হয় এই বাজার। পাড়ার গলি ঘুরে এবার সেই বাজারে আসি। সিমেন্টে ঢালাই সড়কের ওপর বস্তা বা চট বিছিয়ে দুপাশে নানা জিনিসের পসরা সাজিয়ে পাহাড়িরা বসে থাকে। মূলত তারাই এই বাজারের প্রধান বিক্রেতা। আর তাদের মধ্যে নারীদেরই প্রাধান্য। চারপাশে পাহাড়ি মুখ আর তাদের অচেনা কথাবার্তা।

বাজারের বিক্রেতা।

চেনা জিনিসপাতির সাথে আছে পাহাড়ি অনেক সবজি। মূলা,সরিষাশাক, কলার থোড়, কাঁচাকলা, ওলকচু, চালকুমড়া আর নানারকম মসলা তো আছেই। লাল রঙের সবজি, পেঁয়াজ পাতার মতন ডাটা, হলুদ কুমড়োর মতন ফুল, এরকম আরো অনেক অচেনা জিনিসও দেখি। ফলের মধ্যে ছিল তেঁতুল, চালতা, আখ, কলা। সবই পাহাড়িদের নিজস্ব বাগান থেকে আনা।

লাল রঙের সবজি।

হাঁটতে হাঁটতে জিনিসগুলোর মধ্যে একটা বেতের বাক্সে রাখা মেটেরঙা আখের দিকে আমার দৃষ্টি আটকে যায়। হঠাৎ জল থেকে লাফ দেয়া মাছের রূপালি ডানায় তীব্র আলোক ঝলকানির মতন আমার মস্তিষ্কে খেলে যায় পুরনো কিছু স্মৃতি।
আমি এগিয়ে যাই আখের দিকে।

শাক, কলার থোড়, চালতা, তেঁতুল

আখের পাশে নিচে পলিথিন বস্তার ওপর বিছানো আরো অনেক রকম ফল আর সবজি। সেখানে বিক্রেতাদের মধ্যে ব্যতিক্রম হিসেবে দণ্ডায়মান এক বয়স্ক বৃদ্ধ। তাকে আখ দেখিয়ে জিগ্যেস করি,
'কত করে এগুলো?'
'একটা দশ টাকা'
আখগুলো উলটে পালটে দেখছি তখন পাশ থেকে আরেকটি নারীকণ্ঠ মিষ্টি সুরে বলে ওঠে,
'নিয়ে যান। খুব ভাল হবে।'
আমি আর আমার সাথের বন্ধুরা তার সাথে কথা বলার আগ্রহ পাই। বৃদ্ধের পাশেই দাঁড়ানো এই মেয়েটির কাছে আমরা কিছু অচেনা সবজি দেখিয়ে তার কাছে নাম জানতে চাই।

হলুদ রঙের ফুলের মতন সবজির নাম থাঁওয়াপো।

হলুদ রঙের ফুলের মতন সবজির নাম থাঁওয়াপো। তেতুলের নাম থাঁলাগো। চালতাকে বলে ছেইজি।
থাঁওয়াপো আগে কখনো দেখি নি। তাই বলি,
'এর কোন বাংলা নাম নাই?'
মেয়েটি বলে, 'আমি জানি না!'
বিষয়টা অবাক করে। কত শত বছর ধরেই না তারা এই সবজিকে থাঁওয়াপো নামে ডেকে আসছে! আজ অবধি সেই নাম এখনো তাদের মুখে মুখে, তাই অন্য কোন নাম জেনেই বা তাদের কি হবে!

ঠিক তাদের পাশেই ছিল আরেক নারী বিক্রেতাদল। তবে তারা র ম্যাটেরিয়ালসের এর বদলে ফিনিশড প্রোডাক্টস, পিঠা বিক্রি করছিল। সরাসরি চালের গুড়া আর নারকেলকোরা দিয়ে তেলে ভাজা পিঠা। একজন পিঠা বানিয়ে দিচ্ছিল, আরেকজন গ্যাসস্টোভে বানানো পিঠা ছেড়ে দিচ্ছিল তেলে। তাদের ঘিরে আরো কিছু নারী বসে বসে পিঠা খাচ্ছিল। মনে হয় বাজার সদাই করে তাদের খিদে পেয়েছে তাই এমন গোল হয়ে থলে একপাশে রেখে পিঠা খাচ্ছে। আমাদের পক্ষেও শীতের সকালে পাহাড়ি পিঠা খাবার লোভ সামলানো গেল না। আমরা তিনটা পিঠা বানিয়ে দিতে বলি। অনেকটা পুলি পিঠার মতন সেই গরম গরম পিঠা খেয়ে ভালই লাগে।

সরাসরি চালের গুড়া আর নারকেলকোরা দিয়ে তেলে ভাজা পিঠা

তারপর আবার ফিরে আসি পাশের দোকানে। আখের ব্যাপারটা তখনো মাথায় ঘুরছে। তাই সবাইকে নিয়ে কিনতে গেলাম আখ। আমরা পছন্দ করে তিনটি আখ নিই। বৃদ্ধ কিছু ভাল আখ বাছাই করে দেয়।
কিছু কেনাকাটা আর দ্বিতীয়বারের মতন সাক্ষাৎ হওয়ায় আমাদের কথাবার্তা আরো সহজ হয়ে এল।
'আপনারা কোথায় থাকেন?'
'ঐ যে দূরে, এক পাড়ায়' বৃদ্ধ দূরে হাত নিশানা করে বলে।
পাশের মেয়েটিকে দেখিয়ে সে আরো বলে, তার কন্যা।
আমরা কন্যার সাথেই কথা বলি।
'তোমার নাম কি?'
'খেই মা প্রুই'
নামটা আমাদের কাছে স্বভাবতই কঠিন, তাই আরেকবার জিগ্যেস করি। তারপর নাম জানা সত্ত্বেও জ্ঞানের স্বল্পতাহেতু বলি,
'তোমরা কোন উপজাতীয়? '
'আমরা মারমা'
পাহাড়িদের মুখে ভাঙা বাংলা শুনতে চমৎকার লাগে। মারমা বলেই তারা প্রধানত বিচিত্র রঙের প্রিন্টের কাপড় পরে। মেয়েটির পরনের কাপড়েও নীল হলুদ ফুলের নকশা।
তারপর সদ্য কেনা আখ দেখিয়ে বলি,
'আমরা তো আখ নিলাম, আচ্ছা মারমা ভাষায় একে কি বলে?'
'ক্রেঙ'
আমি কয়েকবার উচ্চারণ করে নামটা আত্মস্থ করার চেষ্টা করি। ক্রেঙ ক্রেঙ ক্রেঙ। একটু আগে শেখা অন্য নামগুলোও আরেকবার জানতে চাই। যেসব অচেনা সবজি দেখি সেগুলোর খাবার পদ্ধতি নিয়েও কৌতূহল। পেঁয়াজের মতন একটা সবজির ব্যবহার সম্পর্কে সে বলে, 'এটা তরকারিতে দেয়, ঝাল হয়। আর সুন্দর গন্ধ হয়।'
থাঁওয়াপো রান্না সম্পর্কে বলে, 'এটা ভাজা করে খেলে মজা হয়।' মেয়েটি ধৈর্য ধরে হাসিমুখে এসব বলে যেতে থাকে।

সিমেন্টে ঢালাই সড়কের ওপর বস্তা বা চট বিছিয়ে দুপাশে নানা জিনিসের পসরা।

তারপর আমরা খেইমা প্রুইদের কাছ থেকে বিদায় নিই। কারণ থানচি সেতু থেকে চান্দের গাড়ি ধরে বান্দরবন শহর যাবার তাড়া। এই প্রথম পাহাড়ি বাজার চক্কর বেশ ভাল লাগে। হাতে মারমাদের ক্রেঙ। সাজেক সফরে এই ক্রেঙ ছিল কুইসর।

বান্দরবনের গহিনে পাহাড় সফরের শেষলগ্নে আমি হাতে এক টুকরো পাহাড়ের স্মৃতি নিয়ে ফেরত আসি। থানচির কোন এক পাহাড়ি পাড়ায় জন্মানো সাজেকের মতই মেটেরঙা পাহাড়ি আখটি আমার হাতে পাহাড়ের অনুষঙ্গ হয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকে।


পসরা সাজিয়ে পাহাড়িরা বসে থাকে। তাদের মধ্যে নারীদেরই প্রাধান্য।


সতর্কতাঃ
ভ্রমণে পরিবেশ নষ্ট হয় এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকবেন।
স্থানীয় মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অনুভূতিপ্রবণ হওয়া জরুরি।



সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৫৭
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×