somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিয়তি কি পূর্বনির্ধারিত?

১৯ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




তিথি নক্ষত্র গ্রহ তারা মিলিয়ে যাঁরা জীবনের সারাৎসার বিচার করেন তাঁরা সাধারণত নিয়তির বিধানেই বিশ্বাসী। আমাদের জীবনের গতিপথ তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আগে থেকেই নির্ধারিত এমনটাই দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেন আবিশ্ব অধিকাংশ মানুষ। স্বভাবতঃই আমরা ভাবতে ভালোবাসি আমাদের জীবনের গতিপথ তিথি নক্ষত্র অনুযায়ী ঈশ্বর কর্তৃক পূর্বনির্দ্দিষ্ট। লোকশ্রুতি অনুযায়ী রাম না জন্মাতেই যেমন রামায়ণ লেখা হয়ে গিয়েছিল আর কি। অর্থাৎ আমাদের জন্মের আগেই আমাদের জীবনের সব কিছু ঠিক হয়ে বসে আছে। আমরা জানি না কাল কি হবে। কিন্তু কাল কি হবে সেটা আগে থেকেই ঠিক করা আছে, আমরা যেটা শুধুমাত্র কালকেই জানতে পারবো। আর তখনই আমরা বিশ্বাস করা শুরু করি মহাশক্তিধর কেউ একজন আমার ব্যক্তিগত জীবনচক্রকে আগে থেকেই এঁকে রেখে দিয়েছেন। তাঁরই লেখা চিত্রনাট্যে আমার ব্যক্তিগত জীবন।

এই যে পূর্বনির্ধারিত কোন চিত্রনাট্য অনুযায়ী আমাদের ব্যক্তিগত জীবনচক্র, এই ধারণা যখন আমাদের গ্রাস করে, তখন স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে, তবে কি আমাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্য নেই? আমাদের স্বাধীন কামনা বাসনা আকাঙ্খার কোন মূল্য নেই। কিংবা আমরা তো জানি, আমরা অনেক কিছুই স্ব-ইচ্ছায় স্বেচ্ছায় করে থাকি, যার উপর কারুর খবরদারী স্বীকার করি না আমরা। তখন নিয়তিবাদী মন এই বলেই সান্ত্বনা খোঁজে, আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছাও তো সেই মহাশক্তির ইচ্ছাধীনে আগে থেকেই নির্দ্দিষ্ট। অর্থাৎ কোনটা আমরা ইচ্ছা আর কোনটা নয়, কোনটা আমার পছন্দ আর কোনটা নয়, কাকে আমার কখন ভালো লাগবে আর কখন লাগবে না, এসব কিছুই তো পূ্র্ব নির্ধারিত!

আমরা সাধারণ ভাবে এই যে পূর্বনির্ধারিত ঘটনাক্রমকেই জীবনের নিয়তি বলে থাকি; মনে করি যার উপরে আমাদের কোন হাত নেই, এই বিশ্বাস ও ধারণাই নিয়তিবাদ। যা নিয়ে যুগে যুগে, মানুষ একদিকে যেমন জীবনের সকল ঘাত প্রতিঘাতকে অম্লান বদনে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছে, তেমনই আবার আর এক দিকে মানুষ কেবলই প্রশ্ন তুলেছে এই মতবাদের সারবত্তা নিয়েই। আমাদের সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের জীবনচক্রে আমাদের সকল সাফল্য ব্যর্থতা, সকল সুখ দুঃখ, সকল পাপ পূন্য আমরা যদি নিয়তি নির্দ্দিষ্ট বলেই চালিয়ে দিই তাহলে মনের মধ্যে এক প্রশ্নহীন অলস শান্তি পাওয়া গেলেও, আমরাই আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার বাইরে ঘটে চলা ঘটনাক্রমকে মন থেকে স্বীকারও করতে পারি না সবসময়। আর পারি না বলেই শোক তাপে কষ্ট পাই এত। নিয়তিবাদী যিনি, তিনি খুব সহজেই বলবেন, ঐ কষ্ট পাওয়াটিও নিয়তি। পূর্বনির্ধারিত। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ঐ কষ্টের কষ্ঠী পাথরেই আমাদের শুদ্ধ করে তোলেন, দৃঢ় করে তোলেন ইত্যাদি।

আমাদের জীবনচক্রের সকল কর্ম ও কর্মফল পূ্র্ব নির্ধারিত হলে, আমাদের জীবনের সকল চাওয়া ও না চাওয়া, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি, সাফল্য ও ব্যর্থতা, নিয়তি পরিচালিত বলে বিশ্বাস করাতে পারলে, ও পারলে অনেক জটিলতা কমে যায়। সমাজ সংসারে অনেকের অনেক সুবিধার পথও প্রশস্ত হয়ে ওঠে। বস্তুত ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়তিবাদের সমাজিক বিকাশেরও ইতিহাস। সমাজের উপরতলার মানুষ চিরকাল এই নিয়তির দোহাই দিয়েই লাখো লাখো সাধারণ মানুষের কায়িক শ্রমকে শোষণ করে নিজেদের ধনসম্পদ বৃদ্ধি করেছে। সেই ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। নিয়তিবাদীরা তখনও তাঁদের যুক্তিতে অটল থেকেছেন এই বলে যে, কে সমাজে শোষণ করে ধনসম্পদ বৃদ্ধি করবে আর কে শোষিত বঞ্চিত হয়ে অর্ধাহারে দিন কটিয়ে অনাহারে বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে, সেওতো, সেই মহাশক্তিধর ঈশ্বর কর্তৃক নির্ধারিত। এটাই নিয়তিবাদ।

অর্থাৎ কে অন্যের পিণ্ডি চটকে সুখে থাকবে আর কে অপরের শোষণের শিকার হবে, সেটিও মহাশক্তিধর ঈশ্বরের হাতেই পূর্ব নির্ধারিত! বেশ, তবে তো বলতেই হয় এই ঈশ্বর মোটেও সাধু নন। দস্তুরমত ভিলেন! না! সে কথা তো বলা যাবে না আবার, কারণ নিয়তিবাদীরা তারও উত্তর প্রস্তুত করে রেখেছেন আগে থেকেই। তারা তো বলেই দিয়েছেন মানুষ তার পূ্র্ব জন্মের কর্মফল ভোগ করে এই জন্মে। আবার এই জন্মের কর্মফল সে ভোগ করবে তার পরবর্তী জন্মে। অর্থাৎ মহাশক্তিধর করুণাময় ঈশ্বর পাপ পূণ্যের জন্যে পুরস্কার ও শাস্তির বিধানও আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন। হ্যাঁ ঠিক এই যুক্তিতেই শোষণবাদীরা চিরকাল লাখো লাখো মানুষকে শোষণ করে এবং শোষণের বিরুদ্ধে জনবিপ্লবের সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে রাখে। এইটিও ভারতবর্ষের ইতিহাস। না শুধুমাত্র ভারতবর্ষেরও নয়, আবিশ্ব সকল ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীরও ইতিহাস এইটিই। আচ্ছা এই যে মহাশক্তিধর করুণাময় ঈশ্বর কর্তৃক আগে থেকেই আমাদের জীবনের সব কিছুই নির্ধারিত, বেশ ধরেই নেওয়া যাক না এইটিই মূল সত্য: কিন্তু ঠিক তখনই একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন কি আমাদের মনে আসবে না, তিনিই যদি গ্রহ তারা তিথি নক্ষত্র মেপে আমাদের জীবনের সব কিছু আগে থেকেই ঠিক করে রাখেন, তবে তিনি কাউকে শয়তান আর কাউকে সাধু বানান কেন? সকল যুগেই অল্প কিছু লোকের হাতে সকল ক্ষমতা তুলে দিয়ে বাকিদের ঢাল তলোয়ার বিহীন নিধিরাম সর্দার বানিয়ে রাখেন কেন? তিনি পরম করুণাময় ঈশ্বর হয়েই তো পৃথিবীর মোট সম্পদের নব্বই শতাংশ মাত্র পাঁচ শতাংশ মানুষের জিম্মায় রেখে দিয়ে বাকি পঁচানব্বই শতাংশ মানুষকে নির্ধন করে রাখেন। কারণ সব কিছুই তো নিয়তির অধীন তাই না? সব কিছুই তাঁরই লীলা। আচ্ছা ধরেই নিলাম সব কিছুই গত জন্মের কর্ম ফল। বেশ তো। খুব ভালো কথা, তবে এই জন্মে ঐ পাঁচ শতাংশ মানুষ যারা বাকি পঁচানব্বই শতাংশ মানুষকে ঠকিয়ে, তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে পাপ করছে তাদের তো পরজন্মে পাপের শাস্তি স্বরূপ শোষিত বঞ্চিত হয়ে থাকার কথা। আর যে পঁচানব্বই শতাংশ মানুষ আজ বঞ্চনার শিকার হচ্ছে তাদের জন্যই তো পরজন্মে সকল সুখের আড়ত খুলে বসার কথা পরম কল্যানকামী করুণাময় মহাশক্তিধর ঈশ্বরের বিধান অনুযায়ী! তাই না? সেই কথাই তো সকল যুগে নিয়তিবাদীরা প্রচার করে থাকেন। তাহলে সরল অঙ্ক আনুসারেই পরজন্মে এই জন্মে বঞ্চিত শোষিত পঁচানব্বই শতাংশ মানুষকেই পৃথিবীর নব্বই শতাংশ সম্পদের মালিক হিসেবে সুখে আনন্দে থাকতে দেখা যেত তাই না? এক জন্মের পূণ্যে পরজন্মে রাজ্যলাভ! পৃথিবীর ইতিহাসে তাহলে কোনো না কোনো যুগে দেখা যেত পঁচানব্বই শতাংশ মানুষ দিব্বি পায়ের উপর পা তুলে নাকে সড়িষার তৈল দিয়ে মাত্র পাঁচ শতাংশ মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে ফুলে ফেঁপে উঠছে। আচ্ছা বিশ্বের ইতিহাসে আমরা এই উল্টো পূরাণ দেখতে পাই না কেন? নিয়তিবাদ ভুল বলে? ঈশ্বরেরে অস্তিত্ব নাই বলে? না কি অর্থনীতির সরল অঙ্কেই এই উল্টোপূরাণ সম্ভব নয় বলে?

যিনি রসিক মানুষ তিনি হয়তো ফস করে বলে বসবেন, মহাশক্তিধর ঈশ্বর অর্থনীতি বিদ্যায় এত কাঁচা নয় বলে। বেশ ধরেই নেওয়া যাক না করুণাময় ঈশ্বর ও তার সৃষ্ট নিয়তির বিধান এত কাঁচা হতেই পারে না। তাহলে আমাদের এই কথা অবশ্যই স্বীকার করতেই হবে যে সর্ব যুগেই মাত্র পাঁচ শতাংশ মানুষ বাকি পঁচানব্বই শতাংশ মানুষের শ্রমকে শোষণ করে, তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে সুখে সম্পদে বলীয়ান হয়ে থাকবেই। আর সেইটিই নিয়তিবাদ অনুযায়ী করুণাময় ঈশ্বরেরে বিধান। বেশ। সেকথাও না হয় মেনে নেওয়া গেল, তাহলে এই বিষয়টি অন্তত পরিস্কার হল, মহাশক্তিমান করুণাময় ঈশ্বরের বিধানে কর্মফলজনিত পাপ পূণ্যের পুরষ্কার ও শাস্তির কোনো প্রভিশান নেই।

অর্থাৎ নিয়তির অমোঘ নিয়মে করুণাময়ের বিধানে একদল চালাক চতুর নীতিহীন বিবেকহীন ডানপিটে গোছের মানুষদের জন্যেই পার্থিব সকল সুখ পূর্বনির্দ্দিষ্ট। তাদের জন্যেই পরম করুণাময় পৃথিবীর পঁচানব্বই শতাংশ সম্পদের মালিকানা নির্ধারিত করে রেখেছেন প্রতিযুগেই। আর যাঁরা নীতিবাগিশ সাধুগোত্রের মানুষ কিংবা ভীতু দূর্বল প্রকৃতির জীব তাদের জন্যে অর্দ্ধাহার অপুষ্টি আনাহারে মৃত্যুই করুণাময়ের বিধানে পূর্ব নিধারিত। সাধু! এইজন্যেই কি তিনি পরম করুণাময়? নিশ্চয়ই তাই। কারণ নিয়তিবাদীরাই বলে থাকেন এইভাবেই তিনি মানুষকে জাগতিক দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিয়ে শুদ্ধ করে তাঁরই কাছে টেনে নেন যাতে আর পার্থিব জন্মচক্রে ঘুরপাক খেতে না হয়। বাহঃ! খুব ভালো কথা। সত্যই তিনি পরম করুণাময়! আচ্ছা তবে তো প্রতি যুগেই পঁচানব্বই শতাংশ মানুষ পার্থিব জীবনচক্র থেকে চিরকালের মতো মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে পরম করুণাময়ের সাথে সহবাসের ছারপত্র পেয়ে। বেশ বেশ! তবে তো পৃথিবীর জনসংখ্যা বেশ দ্রুতহারেই কমতে থাকার কথা ছিল তাই না? কিন্তু একি কথা? মহাশক্তির আধার পরম করুণাময় ঈশ্বরেরে হিসেবেও গণ্ডগোল? পৃথিবীর জনসংখ্যা তো কেবলই বৃদ্ধিই পাচ্ছে। কমার তো কোন লক্ষ্মণই নেই। তাহলে? ওদিকে নিয়তিবাদী যিনি তিনি হয়তো মুচকি হাসছেন অর্বাচীন মানুষের প্রলাপে। আর হাসবেন নাই বা কেন, কারণ তিনি তো আগেই জানেন এই পৃথিবী কয়েক কোটি বছর পরপর মহাপ্রলয়ের সম্মুখীন হয়ে থাকে। যে মহাপ্রলয়ের মধ্যে দিয়েই পরম করুণাময় ঈশ্বর সকল দীন দুখীকে তার কোলে টেনে নেন। সবই পূর্বনির্ধারিত।

আচ্ছা এই যে প্রতিযুগেই মাত্র হাতে গোনা কিছু মানুষ কোটি কোটি মানুষের সম্পদকে লুন্ঠন করে বিত্তশালী হয়ে ওঠে মানুষেকেই শোষণ করে বঞ্চিত করে, এই পাপ তো তাদের নয়! নিয়তির অমোঘ নিয়মে পরম করুণাময় ঈশ্বরেরে অটল বিধানেই তো তারা শোষক হয়ে আধিকাংশ মানুষকে নির্ধন করে রাখে, তাই না? সবই তো ঈশ্বরের লীলা আর অমোঘ নিয়তি, পূর্বনির্ধারিত। আচ্ছা এই রকম কাজ যদি কোনো মানুষ করতো, আমরা কজন তাকে সাধুসন্ত বলতাম? কজন তাঁর বিচার না করে জেলের বাইরে রাখতাম? গণধোলাইয়ের কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল। নিয়তিবাদী পরমজ্ঞানী ব্যক্তিরা যাঁরা এই নিয়তিবাদকে ধরে রাখেন তাঁদের ঐশ্বরিক যুক্তিজালের নিশ্ছিদ্র ফাঁদে, তাঁরা পরমকরুণাময়ের এই বিধানে মানুষের কোন মঙ্গলটি দেখতে পান, আজ অব্দি তাঁরা কিন্তু সে কথা বলেলনি। তাই না? সেটা তাঁদের পূ্র্বনির্ধারিত অজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞানের অভাবে না মানবিক লজ্জায় এ কথা অবশ্য আমাদের জানা নেই।

আমাদের এও জানা নেই পরমকরুণাময় কোনো সত্ত্বার পক্ষে এহেন দ্বিচারীতা করা সম্ভব কি না আদৌ। হাতে গোনা কজনের জন্যে সকল পাপ করার অধিকার দিয়ে বাকিদের জন্যে সততার আঙ্গুল চোষার পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচীতে অর্দ্ধাহারের ক্যালেণ্ডার তৈরী করে রাখায় কোন মঙ্গল কোন পূণ্য সঞ্চয় হতে পারে সে কথা মানুষের পরিষ্কার মস্তিষ্কে অনুধাবন সত্যই অসম্ভব।

না অনেকেই আছেন যাঁরা পরমকল্যানময় ঈশ্বরের গালগল্পে ভোলেন না। কিন্তু ন্যায় নীতি ধর্ম অধর্ম পাপ পূণ্যের উর্দ্ধে এক মহাশক্তিকে বিশ্বাস করেন। করেন প্রচলিত কোনো ধর্মবোধ থেকে হয়তো না। করেন বিজ্ঞানের পথে হেঁটেই। যুক্তির পথে এগিয়েই তাঁদের মধ্যে অনেকেই পরিণত বয়সে জীবনের নানান ঘাত প্রতিঘাতের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েই বিশ্বাস করতে থাকেন নিয়তির পূর্বনির্ধারিত অমোঘ বিধানকে। তাঁরাও বলে থাকেন ব্যক্তি জীবনের সাফল্য ব্যর্থতা আসলেই পূর্ব নির্ধারিত, নিয়তিরই অমোঘ বিধান। ‘সকলই তোমারই ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি, তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি’। বেশ তাঁদের এই বিশ্বাসকেই যদি মর্য্যাদা দিতেই হয় তবে তো আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে যাই আমরা। সবকিছুই যদি কোনো এক মহাশক্তির দ্বারা পূ্র্ব নির্ধারিত সুনির্দ্দিষ্টই হয়ে থাকে, তবে তো গৌতম বুদ্ধ যে মহামানব হবেন তাতে তো কোনো অনিশ্চয়তা ছিল না। অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধের কৃতিত্বের থেকেও আসল সত্যি তাহলে তাঁর জন্যে নির্দ্দিষ্ট করে রাখা পূর্বনির্ধারিত অমোঘ নিয়তি? হজরত মহম্মদ যিশু খ্রিষ্ট গুরু নানক এঁদের জীবন সাধনার মূল্যের থেকেও বড়ো কথা এঁদের ব্যক্তিগত নিয়তির অমোঘ বিধান? আচ্ছা বেশ, তাও যদি মেনে নেওয়া যায়, তবে তাঁদের সাধনায় তাঁদের কৃতিত্ব কোথায়? সবটাই তো আগে থেকে ঠিক করে রাখা একটি পোগ্রামিং তাই না? কৃতিত্ব বরং সেই প্রোগ্রামিংয়ের বা সেটি যিনি বা যে শক্তি সেটি তৈরী করেছিল তাঁরই প্রাপ্য। তাহলে আমরা এই মনুষগুলিকে মহামানব বলবই বা কেন? কেনই বা রবীন্দ্রনাথকে বলবো বিশ্বকবি? সবই তো তাঁর নিয়তি নির্দ্দিষ্ট রাশিচক্র অনুসারে জন্মছকের তাই না? নিউটন আইনস্টাইন যা করে গেলেন তাতেও তো সেই নিয়তিরই খেলা। তাঁদের চেতনার সাধনার মূল্য তবে তো গৌন। কারণ তাঁরা যে কাজ করে গেছেন সেটা করার জন্যেই তাঁদেরকে প্রোগ্রামিং করে পাঠানো হয়েছিল। অর্থাৎ নিয়তির এই অমোঘ বিধান মানতে গেলে মানুষের সাধনাকেই কিন্তু আমরা অশ্রদ্ধা করে বসবো নিজেদের অজান্তেই। খাটো করে ফেলবো তাঁর আপন সাধনা বলে অর্জিত কৃতিত্বকেই। তুচ্ছ করে ফেলব এইসব মহামানবদের শ্রেষ্ঠত্বকেই। তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব যদি পূর্বনির্দ্দিষ্ট হয়, তবে তাতে তাঁদের কোনই ভুমিকা থাকে না, তাই না? আর সেই সত্যটি একবার বুঝতে পারলেই দেখব নিয়তিবাদ আসলে তাঁদেরকেই অপমান অসম্মান জানিয়ে ফেলছে।

নিয়তিবাদ আবার সেইসব মানুষকেও শ্রদ্ধা করছে, যাঁদেরকে আমরা সামাজিক নিয়মেই অশ্রদ্ধা করি। নিয়তিবাদকে মানতে গেলে হিরোশিমা নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলার জন্যে রুজভেল্ট ট্রুম্যানকে দায়ী করা যায় না, দায়ী করা যায় না ইহুদী নিধনকারী হিটলারকেও। দায়ী করা যায় না সমাজসংসারে ঘুরে বেড়ানো খুনি গুণ্ডা বদমায়েশদেরকেও। কারণ, এই সব অপকর্মগুলি তারা কেউ স্বেচ্ছায় করেন নি, করতে বাধ্য হয়েছেন তাদের নিজ নিজ নিয়তির অমোঘ বিধানে। আর নিয়তির বিধান মানলে এদের শাস্তি বিধান করার নৈতিক অধিকারও থাকে না কারুর। এই সরল সত্যটিও অনুধাবন করা প্রয়োজন আমাদের। নিয়তিবাদীরা বলবেন দুস্কৃতির শাস্তি বিধান করাটাও নিয়তির অমোঘ নিয়মেই সংঘটিত হয়ে থাকে। বলতেই পারেন। যুক্তির ধার দুই দিকেই কাটে। কিন্তু আমি নিয়তিবাদে বিশ্বাস করবো আবার একজনকে মহামানব বলে শ্রদ্ধা করবো আর একজনকে দুস্কৃতি বলে অশ্রদ্ধা করবো এই যে দ্বিচারীতা, হিপোক্রেসি, এর থেকে বড়ো অন্যায় আর কিছু নেই। মরণাপন্ন মানুষকে জীবন দান করা যদি কারুর নিয়তি হয়, তবে সুস্থসবল মানুসের প্রাণ কেড়ে নেওয়াও আর একজনের নিয়তি। একজনকে সাধুবাদ দিয়ে আর একজনকে অশ্রদ্ধা করে তিরস্কার করবো, তার জন্যে শাস্তির বিধান দেবো, এর থেকে বড়ো নৃশংস দ্বিচারীতা মানুষের পক্ষে শোভনও নয় সম্মানজনকও নয়। দুঃখের কথা নিয়তিবাদের প্রচার করতে গিয়ে আমরা তার ইমপ্লিকেশনসগুলি খেয়াল রাখি না। আর রাখি না বলেই আমরা নিয়তিবাদের জমাট অন্ধকারেই হাবুডুবু খেতে থাকি অনবরত।

তাই তখন আমাদের অজ্ঞান মন আমাদেরকে জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত করে আসলেই এক জমাট অন্ধকারে আবদ্ধ করে রাখে। আমরা সেই অন্ধকারে অন্ধের মতোই শান্তি খুঁজতে থাকি। না পেয়েও ভাবি শান্তিতেই আছি। কিন্তু ঘোর যখন কাটে, তখন সান্ত্বনার কোনো খুঁটি থাকে না হাতের কাছে নিশ্চিন্তে একটু ভর দেওয়ার মতো। নিয়তিবাদীরা যতই মুচকি হাসুন সেটাই নিয়তি বলে।

শ্রীশুভ্র।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:৫৮
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×