somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পটা একুশ দিনের নয়

২৬ শে মার্চ, ২০২০ বিকাল ৫:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



না মন ভালো নাই। ২১ দিন গৃহবন্দী মানুষ। না ২১ দিনের জন্যই কিনা, তাও জানে না কেউ। ২১ দিন ২১ মাস হয়ে যাবে নাতো? ভয় আর আতঙ্ক তাই মনের ভিতর বাসা বাঁধছে। সারাদিন ঘরের ভিতর সেঁধিয়ে এইটা কি কোন জীবন হলো? কড়িকাঠ গোনা ছাড়া উপায় নাই। কতক্ষণ আর মোবাইল ঘাঁটা যায়? কাজের ফাঁকে ফাঁকে যে মোবাইলই হাঁফ ছাড়ার উপায় ছিল এই সেদিনও, সেই মোবাইলেই হাঁফ ধরে যাচ্ছে সারাদিন। অধিকাংশ মানুষেরই বই পড়ার বা লেখালেখির অভ্যাস অনুশীলন বা তাগিদ নাই। টিভি চালালেই রোগ আতঙ্ক আর মৃত্যুর পরিসংখ্যান। চোখে অন্ধকার নেমে আসে। ফলে অধিকাংশ মানুষই আজ কর্মহীন। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে। তাকিয়ে ক্যালেণ্ডারের পাতায়। ২১ দিনের কদিন গেল? অলস সময় মনের ভিতর আশঙ্কার চাষ করে চলেছে। হৃদস্পম্দনে একটা হাহাকারের মতোন সুর গুনগুন করছে থেকে থেকে। কে জানে কঘন্টা!

সত্যইই এই এক হয়েছে। জীবনের কোন নিরাপত্তা নাই। সামন্য এক ভাইরাস। যাকে চোখেই দেখা যায় না। তার কি প্রভুত ক্ষমতা! মানুষের কাছে মানুষকেই ভিলেন বানিয়ে তুলেছে। মানুষ দেখলেই সভয়ে তিন হাত পিছিয়ে যেতে হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে করমর্দন আজ অতীত। কেউ কাউকে জড়িয়ে ধরতে পারছে না। কে জানে জড়িয়ে ধরলেই সহমরণ কিনা? না এবার রামমোহনের পিতৃপুরুষও এই সহমরণ ঠেকাতে পারবে না। প্রযুক্তি নির্ভর মানুষ দিনে দিনে অনেকটাই সমাজ বিচ্ছিন্ন। কিন্তু করোনা তাকে একবারে একঘরে করে ছেড়েছে। সমাজের থেকে ব্যক্তি বড়ো। আপনি বাঁচলে বাপের নাম।

আমরা তাই নিজের নিরাপত্তা নিয়েই চিন্তিত। আজ পাশের ফ্ল্যাটের কেউ কোন বিপদে পড়লে আমরা নিজের নিরাপত্তার কথাই আগে ভাববো। সাহায্য করতে গিয়ে শেষে প্রাণ খোয়াতে রাজি নই। ফলে করোনার আঘাতটা যে শুধুই ব্যক্তি মানুষের জীবনের উপর এসে পড়েছে তাই নয়। এই আঘাত আমাদের সমাজ ও সামাজিক পরিকাঠামোর উপরেও এসে পড়েছে। জীবনের ঝুঁকি সবচেয়ে বড়ো ঝুঁকি। মৃত্যুভয় সবচেয়ে বড়ো ভয়। সেই মৃত্যুভয় আজ আমাদের সম্পূর্ণ অসামাজিক করে দিয়েছে। যাঁরা ভাবছেন, তা কেন। মাত্রই তো ২১টা দিন! তারপরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। না মানুষ আর মানুষের সাথে সহজে এক হতে পারবে না। ভাইরাসের আক্রমণ করোনাতেই তো শেষ হয়ে যাবে না। নিত্য নতুন নামে ভাইরাস আঘাত হানতেই থাকবে। আর আমরা সেই আঘাতে মানুষের থেকে পরস্পর আরো দূরে সরে যেতে চাইবো। এই দূরত্বের পরিমণ্ডল আমাদের আগামী জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকবে। অর্থাৎ আগামীতে সকলেই সকলের কাছে অচ্ছুৎ হয়ে উঠবে। করোনায় মৃত্যুর থেকেও এ কম ভয়াবহ নয়। গোটা সমাজটাই যদি প্রতিমুহূর্তে এই ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার করে চলতে চায়, তবে মানুষের সাথে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কেও তার প্রভাব পড়তে বাধ্য।

করোনা হয়তো একদিন পাততাড়ি গোটাবে সারা বিশ্ব থেকেই। কিন্তু যে অভিশাপ সে রেখে যাবে, তার থেকে শাপমোচন ঘটতে সমাজের কয়দিন লাগবে, কেউই সেকথা জানে না আজ। করোনা মানুষের সভ্যতাকে এক বিরাট প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এত লোকলস্কর। বিজ্ঞানের প্রভুত উন্নতি। প্রযুক্তির সীমাহীন সাফল্য। সব কিছু নিয়ে আমাদের যে গর্ব, তা যেন আজ তাসের ঘরের মতোই ভেঙ্গে পড়ছে। আজকে আমাদের চিন্তা করতে হচ্ছে, সমাজে বয়স্ক মানুষের জীবন আর ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যতটা গুরুত্বপূর্ণ কম বয়সীদের জীবন। তাই মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে আজ, কম বয়সীদের চিকিৎসা করাকেই আগে প্রাধান্য দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ চিকিৎসককেও ঠিক করে নিতো হচ্ছে কাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। প্রকৃতি যেন আজ মানুষের কান মুলে দিচ্ছে।

সমাজে বয়স্করা আজ আর ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সমাজে তাঁদের আর নতুন করে দেওয়ার কিছু নাই। তাই সমাজ ঠিক করে নিচ্ছে কার জীবনের অগ্রাধিকার সবচেয়ে বেশি। অথচ আজকের এই সমাজ আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার ভুল ভ্রান্তি সমেত যাবতীয় অর্জন, তার পিছনে আজকে যাঁরা বয়স্ক, তাঁদেরই অবদান সবচেয়ে বেশি। তবুও সময়ের দাবিতে আজ তাঁদের জীবনের মূল্যই সবচেয়ে কম। তাই হাসপাতাল উপচিয়ে করোনা আক্রান্ত রুগীদের ভিতর থেকে সকলের আগে বেছে নিতে হচ্ছে অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের। যাঁদের কাছে সমাজের এখনো অনেক কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। করোনা এসে আমাদের যেন নতুন করে বেআব্রু করে দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের নীতি নৈতিকতার মানদণ্ডকে সভ্যতার খোলস ছাড়িয়ে স্বার্থের পরিমিতিতে প্রতিফলিত করে দিচ্ছে।

না সত্যই মন ভালো নাই। শিয়রে মৃত্যুর সমন দাঁড়িয়ে থাকলে কারই বা মন ভালো থাকে। যেকোন মুহূর্তেই নিভে যেতে পারে জীবন প্রদীপ। গেলে তো গেলই। যে গেল সে গেল। সাথে করে আরও কয়েকজনকে নিয়ে গেল সেটাও অনেক ভয়ের বিষয়। কিন্তু তারপর? তারপর যে পৃথিবীটা রয়ে যাবে, তাকে তো নতুন করে ভাবতে হবে। মুখোমুখি হতে হবে একাধিক প্রশ্নের। প্রকৃতির উপর প্রযুক্তির বড়াই মানুষের জীবনকে যত বেশি করে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন বিচ্যুত করবে, তত বেশি করেই এমন ভাবেই কি তবে প্রকৃতি প্রতিশোধ তুলে নিয়ে যাবে? মানুষের সাফল্যের ভান মানুষকেই কি শেষমেশ দিশাহারা করে দেবে? কি করবে মানুষ? সে কি প্রকৃতির নিয়মের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে নেবে? নাকি আরও বেশি আস্ফালনে স্পর্ধিত বিক্রমে প্রকৃতিকেই বশীভুত করতে ঝাঁপিয়ে পড়বে নতুন উদ্যোমে? কি হবে তার পরিণতি? সে কি আরও ভয়াবহ? সে কি শেষের দিনের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাবে মানুষকেই?

ঘরে বসে বসে, নানাবিধ প্রশ্ন উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। একদিকে মৃত্যুভয়। একদিকে জীবন জীবিকা। একদিকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থের ভরকেন্দ্র। আর একদিকে সমাজিক ভাবে একঘরে হয়ে থাকা। না, মাত্র ২১ দিনেই এই দুর্বিষহ অবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটবে এমন নিশ্চয়তা নাই। করোনা কি তবে আমাদের আরও বেশি করেই ব্যক্তিস্বার্থ কেন্দ্রিক করে তুলে দিয়ে যাবে? যেখানে আপনি বাঁচলে বাপের নাম। যেখানে প্রত্যেকের কাছেই শুধুমাত্র নিজ পরিবারই শেষকথা। করোনা আতঙ্ক আমাদের মনে ভাইরাস ঘটিত যে কোন রোগের বিষয়েই এমন এক আতঙ্কের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে, যাতে পাশের মানুষটির বিপদেও আমরা আগে নিজে নিরাপদে থাকার প্রয়াসেই স্বচেষ্ট হবো। মানুষের সমাজ ও সভ্যতায় এর থেকে বড়ো অভিশাপ আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু কিভাবে বাঁচবে তবে ব্যক্তিস্বার্থ কেন্দ্রিক এমন একঘরে মানুষ? সমাজ বিচ্ছিন্নতার নরকে কোন মানুষের জীবনই কি আর নিরাপদ থাকবে আদৌ?

না সত্যিই নিরাপদ থাকবে না। মানুষের জীবনের মূল নিরাপত্তা মানুষের সমাজ। সমাজ বিচ্ছিন্নতার নরকে মানুষের জীবনের কোনভাবেই নিরাপদ থাকতে পারবে না। ব্যক্তি মানুষ ক্রমশ দুর্বল থেকে দুর্বল হয়ে পড়বে। আর দুর্বল মানুষের ভীড়ে সমাজও হয়ে পড়বে হীনবল। শুধুমাত্র ডাক্তার, পুলিশ আর মিলিটারী দিয়ে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা অসম্ভব। কিন্তু করোনা কিংবা করোনার মতো আরও নতুন নতুন ভাইরাসের ভয় আর আতঙ্ক মানুষকে কি আর কখনো মানুষ হিসাবে সহজ স্বাভাবিক সামাজিক জীবনযাপন করতে দেবে? এই ভয় আতঙ্কের ত্রাস কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনছন্দে ফিরতে হয়তো অনেককাল কেটে যেতে পারে। অন্তত যতদিন না সমস্ত রকমের ভাইরাসের সঠিক ও সহজ প্রতিষেধক আবিষ্কার হচ্ছে। সহজলোভ্য হচ্ছে মানুষের কাছে। ততদিন হয়তো আমাদেরকে সমাজবিচ্ছিন্নতার এক অন্ধকার নরকেই কালাতিপাত করতে হবে। সেসময় ২১ দিনের থেকে অনেক অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী।

২৬শে মার্চ ২০২০

কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০২০ বিকাল ৫:২৯
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×