somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা

১০ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা এতদিন রূপকথাতেই বন্দী ছিল। জার্মানির ছোট্ট শহর হ্যামিলিনির লোককথায় বন্দী থাকা সেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাকেই যেন সম্প্রতি দেখা গেল কলকাতায়। তিনি এলেন। এক হাতে হারমোনিয়াম। আর এক বুক ভালবাসায় গলা ছেড়ে গানের তালে তালে গানের সুরে সুরে টেনে নিলেন বাংলার একঝাঁক সুর পাগলদের। তিনি মহীতোষ তালুকদার তাপস। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা গান পাগল বাঙালির হৃদয়জুড়েই যাঁর তালুক। চন্দ্রবিন্দুর সেই গানের কলি, ‘গান ভালবেসে গান’কেই যেন জগৎ ও জীবনে সার্থক করে তোলার তপস্যাকে শিরোধার্য করে নিয়েছেন তিনি। সেই তাপসকে ঘিরেই কলকাতার এবং কলকাতার আশেপাশের সুরপাগল এক ঝাঁক মানুষ সমবেত হয়েছিলেন সুরবন্ধনে। এবং সেই সুরবন্ধন ব্যানারেই তাঁরা মহীতোষ তালুকদার তাপসের পৌরহিত্যে শহর এবং শহরতলি গানে গানে সুরে সুরে মাতিয়ে রাখলেন প্রায় এক পক্ষ কাল। মহীতোষ ফিরে গিয়েছেন তাঁর বাসস্থানে। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে। আমেরিকায়। আর সাথে নিয়ে গিয়েছেন বাংলার শত শত গান পাগলদের হৃদয়ের ভালবাসার একান্ত নির্যাসকে।

শতকন্ঠে বাংলা গানের কাণ্ডারী এই গান পাগল মানুষটিকে যাঁরা একবার কাছে পেয়েছেন। একমাত্র তাঁরাই বলতে পারবেন। ‘কি জাদু তাঁর প্রাণের টানে’। জাদু তো একটা আছেই। নয়তো হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালার সুরে মোহিত হয়ে হারিয়ে যাওয়া শতশত শিশুর মতোই তাপসের তপস্যার ছোঁয়ায় শত শত গান পাগল মানুষ সবরকম ভেদাভেদ ভুলে কি করে হারিয়ে গেলেন বাংলা গানের ভিতরে? তাঁরা তো এই আমাদের শতটুকরো সমাজেরই এক একজন। ধর্ম বর্ণ জাতপাত মতবাদ এবং স্বার্থের এক একটি অনতিক্রম্য গণ্ডীতে আবদ্ধ। শত ভঙ্গ বাংলার বাঙালি! কিন্তু সেই শত টুকরো বাঙালিকেও, পরস্পর বিচ্ছিন্ন বাঙালিকেও তিনি তাঁর গানে গানে তালে তালে মেলালেন সুরে সুরে এক অমোঘ সুরবন্ধনে। না, আর পাঁচজন পেশাদার সঙ্গীত শিল্পীর মতো মঞ্চে উঠে গান শোনান না তাপস। তিনি নিজেকে ছাপিয়ে শত শত গান পাগলদেরকে সমানে তুলে নিয়ে আসেন। তিনি শতকণ্ঠে গান গাইয়ে ছাড়েন। সেখানেই তাঁর অনন্য স্বাক্ষর। আর সেই আশাতেই সুদূর মার্কিন দেশ থেকে কলকাতায় চলে এসেছিলেন এই গানের মাঝি। মনের ভিতরে এক বুক ইচ্ছে নিয়ে। শহর কলকাতা আর শহরতলি মাতিয়ে তাঁর শতকন্ঠের নাও ভাসিয়ে দেবেন। শুধু হালটুকু ধরা থাকবে তাঁর হাতে।

তিনি এলেন, দেখলেন। গান গাওয়ালেন। আর জয় করে নিলেন শত শত গান পাগল মানুষের হৃদয়। আমাদের এই রাজনীতি পরিকীর্ণ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ব্যক্তিস্বার্থ এবং গোষ্ঠীস্বার্থের যে ঘুণ ধরে বসে রয়েছে। যেখানে হাতে হাতে হাত মেলানো আর পায়ে পায়ে এগিয়ে চলার মানবিক পরিসরগুলি ক্রমেই সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হয়ে উঠেছে। সেখানে এই এক গান তাপস সবকিছু ছাপিয়ে সুরবন্ধনে মিলিয়ে নিলেন পরিচিত অপরিচিত শত শত মানুষের আবেগ ভালবাসা আর আনন্দকে। একজন মানুষ যখন এইরকম একটা প্রায় অলৌকিক কাজ হাসতে হাসতে গাইতে গাইতে নাচতে নাচতে করে ফেলতে পারেন। তখন সত্যিই বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে হয় বইকি সেই মানুষটির দিকে। এমন অফুরান প্রাণ প্রাচুর্য আর অমলিন আনন্দের ভাণ্ডার যে মানুষটি। স্বভাবতই তাঁকে দেখলেও যেন সাত জন্মের পুণ্য সঞ্চয় হয়ে যায়। ঈশ্বরদর্শন কি এর থেকেও বেশি কিছু? না, মনে হয়।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি’। কবি তো গানের ভিতর দিয়েই ভুবন দেখতে চেয়েছিলেন। মহীতোষও নিশ্চয়ই তাই চান। চেয়েছেন। সেই গানের ভিতর দিয়েই মহীতোষ এই বাংলাকেও দেখেন। আর দেখেন বাঙালিকে। বাংলা গানের তরীতে। তাঁর সেই দেখারই যেন সাক্ষী থাকলো এবারে কলকাতা, এবং শহরতলী। এই বাংলার মানুষ। আর তাতেই তাঁকে বুকে জড়িয়ে নিল কলকাতা। এবং শহরতলী। রবীন্দ্রনাথ গানের ভিতর দিয়ে ভুবন দেখার ছলে আসলে ভুবনেশ্বরকে চিনতে এবং জানতে এগিয়েছিলেন। আর মহীতোষ তালুকদার তাপস? তিনি বাংলা গানের ভিতর দিয়ে এই বাংলাকে, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা টুকরো টুকরো বাংলাকে দেখেন। আর চিনে নিতে চান বাঙালিকে, বাঙালির সত্তার অন্তরে যে মানব রয়েছে। সেই মানুষকেই। সেই মানুষকেই যেন তিনি গানে গানে তালে তালে সুরে সুরে সুবন্ধনে মিলিয়ে দিয়ে যেতে চান। মহীতোষ সেই তপস্যাকেই তাঁর চিন্তায় ভাবনায়, কাজে কর্মে সার্থক করে করে এগিয়ে চলেছেন। এগিয়ে চলেছেন মানুষে মানুষে মিলনের সেই বাঁশি বাজিয়ে। যে বাঁশির অমোঘ টান এড়িয়ে থাকাই দায়। বাংলা গানই মহীতোষের সেই বাঁশি।

সেই বাঁশি বাজাতেই মহীতোষ এবারে ঘুরে গেলেন কলকাতা। কর্মসুত্রে যিনি একটি শহরের মেয়রের অফিসের হিসাবরক্ষক। কিন্তু পেশায় যে হিসেবই তিনি রক্ষা করুন না কেন। মানুষে মানুষে সুরে সুরে বেঁধে বেঁধে চলার আবহমান কালের যে মানবিক হিসেব। মহীতোষ সেই হিসাবের যে সার্থক রক্ষাকর্তা। ইতিপূর্বেই তার সাক্ষী ছিল নিউইর্কের টাইম স্ক্যয়ার। সেখানে বাংলা নববর্ষে শতকন্ঠে বাংলা গানের ইতিহাস রচনা করে ইতিমধ্যেই তিনি প্রায় কিংবদন্তী। ভবিষ্যতে বাংলা গানের যে ইতিহাস রচিত হবে। তাতে তিনি ইতিমধ্যেই নিজস্ব একটি জায়গা করে নিয়েছেন। অথচ, সব সময় মাটিতে নিজের পা’কে ধরে রাখা এই নিরহংকারী মানুষটি সবসময়েই বলে থাকেন, ‘আমি কিন্তু গানের মানুষ নইরে ভাই’। “আমি গান ভালবাসা মানুষ”। এমনকি নিজেকে তিনি শিল্পী বলেও পরিচয় দিতে রাজি নন। এবং তিনি কখনোই একক গান গানও না। তিনি সমবেত গান গাওয়ানোর কাণ্ডারী। গান পাগল এক গানওয়ালা। গান যাঁর কাছে শুধুমাত্র ভালবাসাই নয়। সেই ভালবাসাকে মানুষে মানুষে ছড়িয়ে দেওয়াই যাঁর ব্রত। তাঁর সেই ব্রত উদযাপনের উৎসবে আজ সামিল হাজার হাজার বাঙালি। হাজার হাজার কন্ঠে বাংলা গানের আরাধনা।

না মহীতোষকে আমি চোখে দেখিনি। তাঁর সাথে ব্যক্তিগত আলাপ পরিচয়ও হয়নি। তাঁর কোন অনুষ্ঠানেও যাওয়া হয়নি আমার। কিন্তু এটা একবিংশ শতক। মুঠোয় মুঠোয় গোটা বিশ্ব। সেই সূত্রেই মানুষটির কর্মকাণ্ডের সাথে পরিচয়। এমন একটা মানুষ, যাঁর নিজের কথায়। তাঁদের কোন সংগঠন নেই। নেই কোন কমিটি। নেই কোন ফাণ্ডিং। শুধু আছে গানের প্রতি ভালবাসা। আর আছে নিরন্তর পাগলামি। সুরে সুরে তালে তালে হৃদয়ে হৃদয়ে মানুষে মানুষে। সেই পাগলামো দিয়েই মহীতোষ বাঙালির প্রাণে প্রাণে এক নবজোয়ার নিয়ে এসেছেন যেন। যে বাংলা ও বাঙালির ভবিষ্যত নিয়ে আমরা যাঁরা নিয়ত শঙ্কিত থাকি। মহীতোষ, সেই আমাদের মতো শঙ্কিত চিত্তের মানুষদের কাছে এক মরূদ্যান। প্রতিনিয়ত বাংলা ও বাঙালির ক্ষয় দেখতে দেখতে হতোদ্যম চিত্তে এক আধজন মহীতোষের মতো মানুষের সন্ধান পেলে, মনে হয় ‘প্রাণ আছে, এখনো প্রাণ আছে’। মহীতোষ যেন এক সঞ্জীবনী মন্ত্র নিয়ে শতটুকরো বাংলার ক্রমবিচ্ছিন্ন বাঙালিকে একসূত্রে বেঁধে ফেলার তপস্যায় মগ্ন। বাংলা গানই সেই অমোঘ পথ। যে পথে, পায়ে পায়ে চলতে চলতে বাঙালি পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে পারবে সমানের দিকে। আলোর অভিমুখে। যে গানটি মহীতোষের অনেক অনুষ্ঠানেই সমবেত কন্ঠে শোনা যায়, ‘মানুষ হ, মানুষ হ, এবার তোরা মানুষ হ’। মনে হয় মহীতোষ জাতি হিসাবে বাঙালির মূল অসুখটা সঠিক ভাবে ধরতে পেরেছেন। আর পেরেছেন বলেই, নিরাময়ের আয়ুধটিকে বার বার স্মরণ করিয়ে দিতে চান আমাদেরকে। আমরা যেন নিরাময়ের পথ থেকে বিচ্যুত না হয়ে পড়ি। সেই দিকেই এই গানতাপসের অতন্দ্র প্রহরা। আমাদের সৌভাগ্য আমরা আমাদের মধ্যে এমন একজন নিরহংকারী তাপসকে পেয়ে গিয়েছি। আর সৌভাগ্যক্রমে হাজার হাজার বাঙালির হৃদয় আজ সেই তাপসের সুরে সুর মিলিয়ে নিতে চাইছে। মহীতোষের কথা দিয়েই শেষ করা যাক বরং। ভালোবাসার জয় হোক। বন্ধুত্বের জয় হোক। জয় হোক মানুষের। জয় হোক মানবিকতার। আমাদের জীবন কাটুক মাতৃবন্দনায়, জীবন কাটুক দেশবন্দনায়। জীবন সুন্দর, আনন্দম।

©শ্রীশুভ্র ১৭ই ফেব্রুয়ারি ২০২৪


সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:০৩
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অল্প পুঁজিতে অত্যন্ত লাভজনক একটি ব্যবসার সন্ধান, যে কেউ চাইলে শুরু করতে পারে

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৫



কেউ একজন জানতে চেয়েছেন ১০/১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে কিভাবে মাসে ১/২ লাখ টাকা ইনকাম করা যায়? বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করে দেখলাম বাংলাদেশে ১০/১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজনীতির পন্ডিত, ব্লগার তানভীর জুমারের পোষ্টটি পড়েন, জল্লাদ আসিফ মাহমুদ কি কি জানে!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৪৯



সামুর রাজনীতির ডোডো পন্ডিত, ব্লগার তানভীর ১ খানা পোষ্ট প্রসব করেছেন; পোষ্টে বলছেন, ইউনুস ও পাকিসতানীদের জল্লাদ আসিফ মাহমুদ ধরণা করছে, "সেনাবাহিনী ও ব্যুরোক্রেটরা বিএনপি'কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নীল নকশার অন্ধকার রাত

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:১৬


কায়রোর রাস্তায় তখন শীতের হিম হাওয়া বইছিল। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। দুইটা বড় সংবাদপত্র অফিস: আল-আহরাম এবং আল-মাসরি আল-ইয়াউম—হঠাৎ করেই আগুনে জ্বলে উঠলো। কিন্তু এই আগুন কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩২

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে[

স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, মব-রাজনীতি ও এক ভয়ংকর নীরবতার ইতিহাস
চরম স্বৈরশাসন বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রেও সাধারণত সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার সাহস কেউ করে না। কারণ ক্ষমতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×