somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উপন্যাসঃ নীলাম্বরী (পর্ব-১)

০৫ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ৮:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দুপুর আড়াইটা বাজে। মাথার উপর সূর্য তার মহীমা বেশ ভালোভাবেই ছড়াচ্ছে। যেন মনে হচ্ছে সূর্যদেবকে কেউ তার সক্ষমতা কটাক্ষ করেছে বা তার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সুর্যদেব যে সেই কটাক্ষের প্রতিবাদ যে যথার্থভাবেই করছে তা বোঝা যায় ঘড়িতে টেম্পারেচার স্কেলের ঘরে সংখ্যাটা দেখে। ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গ্রীষ্মের এমন দুপুরে যার পশ্চাদদেশে কোনোমতে একটা নেংটি জুটে যায়, সেও মাথার উপর ছাতা রাখার বিলাসিতা করতে কুন্ঠাবোধ করে না। অথচ দিয়াবাড়ি মুনস্টোন মডেল কলেজের ৭০ গজের বিরাট মাঠখানাতে দৌড়ে বেড়াচ্ছে ফুয়াদ। “হোহ্, হোহ্, হোহ্, হোহ্…………… এক, হোহ্, হোহ্, হোহ্, হোহ্…………… দুই,, হোহ্, হোহ্, হোহ্, হোহ্…………… তিন” এভাবে মাঠের প্রতিটা রাউন্ডের হিসাব মনে মনে টুকে রাখে ফুয়াদ। স্পোর্টস টিচার আসাদুল স্যার কড়া ভাষায় আদেশ দিয়েছিলেন, “একশো রাউন্ড এন্ড নো মার্সি, ডু নট ট্রাই ফর চিটিং।“ শাস্তি ঘোষনার পর চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন আসাদুল সাহেব। একশো রাউন্ড কি বেশি হয়ে গেলো না? না! পরমুহুর্তেই তিনি মন থেকে দ্বিধা ঝেড়ে ফেললেন। ঠিকই আছে। আজকালকার ছেলেরা বড় ফাজিল। শাস্তি সম্পুর্ন না করেই বলবে যে শেষ। আসাদুল সাহেবের ধারনা অন্তত এইরকম। ফুয়াদকে শাস্তি দিয়ে আসাদুল সাহেব যাচ্ছিলেন প্রিন্সিপালের রুমে। হয়তো এই জেদটাই ফুয়াদের এই অতিরিক্ত শাস্তির মূখ্য কারণ। কারণ, মানুষ যখন এমন একটা পরিস্থিতিতে পরে, যেটা তার একদম পছন্দ নয়, তখন সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে এবং তার মনে এমন একটা ভাব আসে যে “চান্দু আমি একা কেন ভোগ করবো? তুমিও একটু ভোগ করো।“ নিজে বিপদে পরলে বিপদমুক্ত মানুষকে ঈর্ষা যেটাকে বলে আর কি। তবে; ফুয়াদ কিন্তু পুরোপুরি বিপদমুক্ত নয়। টিফিনের সময় ঘুসি মেরে স্থানীয় এক এম পির ছেলের চোয়াল ভেঙে দিয়েছে। আসদুল সাহেব জানেন ফুয়াদের দুর্বল জায়গা নিয়ে না ঘাটালে সে প্রচুর নিরীহ। আর সেটা ঘাটালে সে কোনও শ্বাপদসংকুল বনের জীব অপেক্ষা হিংস্র। কিন্তু ওই যে প্রিন্সিপালের কাছে জবাবদিহি করতে হবে, এই চিন্তায় কোনও কিছু না ভেবেই একশো রাউন্ড বলে ফেলেছেন।

মুনস্টোন কলেজের প্রিন্সিপাল বাসীরুল্লাহ হাবীব অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। ঢাকার একটা নামকরা কলেজের গভর্নিং বডিতে ছিলেন। অন্যান্য মেম্বারদের সাথে বনিবনা না হওয়ায় ঝগড়া করে কর্নেল হাবীব আলাদা হয়ে যান এবং যাওয়ার সময় বলে যান, “আমি এরকম দশটা কলেজ দাড় করাতে পারি। ব্যাস, তারপর দোষ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। বর্তমানে কর্নেল হাবীবের মুনস্টোন কলেজ একটা ব্র্যান্ড এবং এখানে যারা পড়ালেখা করে তার সবাই মুন্সটোনের মতোই অমূল্য এবং দুর্লভ হয়। যদিও এই দাবিটা কর্নেল হাবীব সাহেবের একতরফা যেটা তিনি বিভিন্ন সেমিনারে বক্তৃতা প্রদানের সময় করে থাকেন। নিন্দুকদের দাবি ইহার সম্পুর্ন বিপরীত। অভিভাবকদের মতামত অবশ্য মিশ্র। তাদের মতে কলেজ যেরকমই হোক না কেন অথবা শিক্ষা বানিজ্য যতই চলুক না কেন, এই কলেজে ভর্তি করিয়ে ছেলেমেয়েদের পিছনে যেই টাকা ঢালা হয়, সেটা সম্পুর্ন রূপে কাজে দেয়।

প্রিন্সিপালের অফিস ঘরের সামনে এসে দরজাটা হালকা করে টান দিয়ে ভিতরে তাকালেন আসাদুল সাহেব। দেখতে পেলেন কর্নেল হাবীবের টেবিলের সামনে এক লোক বসা। টেবিলে রকমারি নাস্তা আর চা। কর্নেল হাবীবের পাশে তার ব্যাক্তিগত সহকারী মতিন যথারীতি দাঁড়ানো। কর্নেল হাবীব টেলিফোনের রিসিভারটা কানের কাছে ধরে বসে আছে। “জ্বী স্যার, জ্বী ,জ্বী। আমি ব্যাপারটা পার্সোনালি হ্যান্ডেল করছি। জ্বী, দেখবো স্যার। জ্বী, স্লামালেকুম স্যার।“ টেলিফোনের রিসিভারটা রেখে অফিসরুমের দরজার সামনে দন্ডায়মান আসাদুল সাহেবের দিকে তাকালেন এবং বললেন, “কি ব্যাপার?”
- স্যার আসবো?
- তা যখন দেখছেন ফোনে কথা বলছি, তখন দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থেকে ওরকম আদিখ্যেতা না করলেই পারতেন। অথবা আদিখ্যেতা করতে চাইলে বাইরে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতেন। যখন ঢুকেই পরেছেন, শুধু শুধু আদিখ্যতার মানে হয় না।
- সরি স্যার।
- ভিতরে আসুন।
- জ্বী স্যার।

কর্নেল হাবীবের টেবিলের সামনে বসা লোকটি চায়ের কাপ হাতে বলে উঠলো, “হুম্মম্মম! এটা কোনও কথা? অতটুকু ছেলেকে কেউ এভাবে ঘুসি মারে? একটু না হয় খারাপ কথা বলেছে, তাই বলে এভাবে মারতে হবে? আহারে, বেচারা ছেলেটা আমার!” লোকটির বিলাপ দেখে কর্নেল হাবীব এর পিওন মুখে একটা অস্ফুট উক্তি করে বলে, “সত্যিই অতটুকু ছেলে, ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।“
এবার কর্নেল হাবীব বললেন, “আহা! ব্যাপারটা আমি দেখছি তো!” তারপর পিওনের দিকে ফিরে বললেন, “মতীন, ফুয়াদকে ডেকে নিয়ে এসো।“ তারপর আসাদুল সাহেবের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, “আচ্ছা, ফুয়াদ কি বিজনেস টাইফুন মামুন আর অভিনেত্রী রীমার ছেলেটা না? ছয় বছর আগে যাদের ডিভোর্স হয়েছে।“
- জ্বী স্যার।
- আই সি। ওর বাবা আমার বন্ধুপ্রতীম মানুষ। ওর মার সাথেও আমার ভালো সম্পর্ক আছে। দুজনই আমাকে ফোন দিয়েই ছেলের খবরাখবর জানতে চায়। আমি তো ব্যাস্ত মানুষ বলে দেই হ্যাঁ ভালই। গতকালও তো ওর মা ফোন দিয়েছিলেন। এক্টু আগে ওর বাবা উপর মহলে ফোন করে ছেলের বিষয়টা দেখার জন্য বললেন। ওর ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কিছু বিষয় জেনে দেওয়ার দরকার। আপনি তো ওদের স্পোর্টস টিচার এবং হোস্টেল সুপারও। তা কি অবস্থা ছেলের?
- স্যার, পড়ালেখায় ভালো, খেলাধুলাতেও ভালো। ডিসিপ্লিন মেনে চলে। একেবারে পাংচুয়াল। ফ্রী ট্রাইমে ক্রাইম ফিকশন পড়ে লুকিয়ে। আমি টের পেয়েও কিছু বলি না। লেখাপড়াতে ভালো, পাঙ্গচুয়াল একারনে ছাড় দেই। কিন্তু সমস্যা ওই যে বাবা মার ডিভোর্স নিয়ে কিছু বললেই ক্ষেপে উঠে।
- হুম। ব্রোকেন ফেমিলির ছেলেরা হচ্ছে ঘুমন্ত বাঘ। আঁতে ঘা না দিলে ভালো, আর দিলেই……… শেষ।
এদিকে কর্নেল হাবীবের সামনে বসা স্থানীয় এমপি ফুয়াদের মা বাবার ডিভোর্সের কথা শুনে ফুয়াদকে এমন বিশেষণে বিশেষিত করলেন, যেটাকে শুদ্ধ ভাষায় জারজ কিংবা বেজন্মা ডাকা হয়।
হঠাৎ অফিসরুমের দরজা খুলে গেলো এবং অফিসরুমে খালিগা এক যুবকের আবির্ভাব ঘটলো। অফিসরুমের প্রত্যেক ব্যাক্তিই কয়েক মুহুর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো। এরপর হাঁপাতে হাঁপাতে অফিসরুমে মতীনের প্রবেশ। রুমে প্রবেশ করেই মতীন বলে, “স্যার আমি কইছিলাম গায়ে একটা শার্ট দিয়া তারপর আপনার রুমে যাইতে, সে তোয়াক্কাই করলো না। দৌড়াইয়া গেলো গা।“ কর্নেল হাবীব ফুয়াদের দিকে ফিরে বললেন, “এসব কি ফুয়াদ? তুমি খালি গায়ে কেন?”
- স্যার, আসাদুল স্যার মাঠে একশো রাউন্ড দিতে বললেন। তাই শার্ট খুলে দৌড়াচ্ছি। নাহলে ইউনিফর্ম নষ্ট হয়ে যায়।
কর্নেল হাবীব এবার আসাদুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “হুম, আজকাল আমাকে জিজ্ঞেস না করেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। বাহ! ভালোই তো স্মার্ট হয়েছেন। তা এক কাজ করুন, আমার চেয়ারে বসে আপনিই চালান না গোটা কলেজটাকে। উত্তরে আসাদুল সাহেব কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে পুনরায় ফুয়াদের দিকে ফিরে বললেন, “হ্যাঁ, তাহলে বলো, শরীফকে ওভাবে মেরেছো কেন?”
- স্যার আমি মাঠে বসে টিফিন খাচ্ছিলাম। শরীফ কয়েকজন চ্যালাচামুন্ডা নিয়ে আমার সামনে আসে। লাথি মেরে আমার টিফিন ফেলে দেয়। তারপরও চুপ থাকি। আমাকে ইচ্ছেমতো চড় মারতে থাকে। আমি কিছুই বলি নি। আমাকে বিরক্ত করার কোনও চেষ্টাই সে বাকি রাখে নি। তারপর আর কি? হঠাৎ সে বলে, “শালা বেজন্মা জারজ একটা।“ তারপর আমি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলি। আর আপনারা কিছুটা ভুল ইনফরমেশন পেয়েছেন। আমি ওকে একটা ঘুসি দেই নি। গুনে গুনে চারটা ঘুসি দিয়েছি চোয়াল বরাবর। সাথে আরও কিছু ছিলো। কদিন আগে আপনি মাঠের পশ্চিম দিকের গাছটা কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। গাছ কাটার পর কাঠগুলো মাঠের একসাইডে জড়ো করে রাখা ছিলো। সেখান থেকে একটা চোলাকাঠ নিয়ে প্রাণের আঁশ মিটিয়ে ওকে পিটিয়েছি।

কর্নেল হাবীব এবার তার টেবিলে বিদ্যমান একাধিক ফোনগুলো থেকে একটির রিসিভার তুলে নিলেন। তারপর বললেন, “আসিফ, টিসি এর প্রিন্ট আউটটা রেডি? নিয়ে আমার রুমে এসো কুইক।“ আসাদুল সাহেব বললেন, “স্যার, বিষয়টা বোধ হয় লঘুপাপে গুরুদন্ড হয়ে যাচ্ছে।“ কর্নেল হাবীব জবাব দিলেন, “আরে থামুন তো! আপনার থেকে আমার নীতি শিখতে হবে না কি?” এমন সময় কলেজের কম্পিউটার অপারেটর আসিফ অফিসরুমে এসে একটা কাগজ রেখে দিয়ে চলে যায়। তারপর কর্নেল হাবীব পকেট থেকে কলম বের করে সেটাতে সাইন করলেন।

অফিসরুমে অবস্থানরত ব্যাক্তিদের মুখের ভাব লক্ষনীয়। প্রত্যেকের মুখে ভাবের এক এক রকম বৈচিত্র্যতা। আসাদুল সাহেবের মুখে প্রিয় ছাত্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আতঙ্ক, পিওন মতীন হাওলাদার এর মুখ নির্বিকার। ফুয়াদের মুখ ভাবলেশহীন, আর এম পি আব্দুর রব এর চেহারায় একটা লুকায়িত পৈশাচিক হাসি আর কর্নেল হাবীবের মুখের ভাব দেখলে মনে হবে যেন এক রহস্যময় লুকায়িত হাসিময় মুখ।
এরপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে কর্নেল হাবীব কাগজটি টেবিলের অপর পাশে বসা এম পি আব্দুর রফের দিকে এগিয়ে দিলেন। তার মুখের লুকায়িত রহস্যময় হাসিটি দৃশ্যমান হয়ে উঠলো। এম পি রফ বিস্ফারিত চোখে জিজ্ঞেস করলেন, “এর মানে কি?”
- ইওর সান ইজ রাসটিকেটেড।
- মানে কি? আমার ছেলের আহত হওয়ার বিচার না করে তাকেই রাস্টিকেট করছেন!
- শুনুন রফ সাহেব, উস্কানিটা আপনার ছেলেরই ছিলো। আর তাছাড়া, যে ছেলের সমস্যা সমাধানের জন্য তার বাপের সমস্ত কাজ ফেলে কলেজের টাকায় কিনা চা নাশতা গিলে তারপর প্রিন্সিপালের কাছে সমস্যার কথা বলতে হয়, সে ছেলে মুনস্টোনের কলঙ্ক। আর যে ছেলে নিজের প্রতিবাদ নিজে করতে শিখে, সে ডেফেনেটলি মুন্সটোনের গর্ব।
- কাজটা ঠিক করলেন না, আপনি আমাকে চেনেন না।
- আপনি কর্নেল হাবীবের চেনাজানা সম্পর্কে জানেন না। আর আপনি একজন এমপি হয়েই বা কি করবেন? মুনস্টোন একটা বেসরকারি কলেজ, সো বেশি কিছু করার ক্ষমতা যে আপনার নেই, সেটা আমি বেশ ভালোমতনই বুঝি। আর শিক্ষামন্ত্রী দুইমাস আগে আপনার অফিসে এসে আপনাকে একটা চড় মেরে গিয়েছিলেন, সে বিষয়ে আমি অজ্ঞাত নই। অতএব, আপনার ক্ষমতার দৌর আমার জানা আছে। আর হ্যাঁ, আপনারা বাপ বেটা দুজনে মিলে নিজেদের মুখের ভাষাটা ঠিক করুন। নচেৎ এবার যে কলেজে যাবেন, সেখান থেকেও তাড়িয়ে দিবে।

রাগে ফোঁসতে ফোঁসতে রফ সাহেব বেরিয়ে গেলেন। এবার কর্নেল হাবীব ফুয়াদের দিকে ফিরে বললেন, “তোমার বাবা ফোন করেছিলেন। হয়তো কোনও ভাবে তোমার ব্যাপারটা জেনেছেন। উপর মহলে পর্যন্ত ফোন দিয়েছিলেন। আমাকে বলা হয়েছিলো তোমার বিষয়টা দেখতে। তবে তার মানে এই না যে আমি সুপারিশের ভিত্তিতে তোমার পক্ষে জাস্টিস করেছি। কর্নেল হাবীব পক্ষপাতিত্ব করে চলার মত মানুষ না। আমি প্রকৃতপক্ষে যে দোষী, তাকেই শাস্তি দিয়েছি। তবে; তোমাকেও বলি। তুমি ধীরে ধীরে একজন ইন্ট্রোভার্ট হয়ে যাচ্ছো। অতিস্বত্ত্বর একটা সিদ্ধান্ত নাও। এভাবে চলতে পারে না। আইনত তোমার কাস্টডি তোমার মায়ের কাছে। চাইলে বাবার কাছেও থাকতে পারো। সেক্ষেত্রে হয়তো সৎ মায়ের সাথে মানিয়ে নিতে ঝামেলা হবে একটু। তোমার মায়ের কাছেও থাকতে পারো। যাই করো, একটা সিদ্ধান্ত নাও। হোস্টেলে তো ছয় বছর কাটালে। সারাবছর এভাবে পরিবার থেকে আলাদা হয়ে থাকা যায় না। এটাকে কোনও সুশৃঙ্খল লাইফ বলে না। তুমি তো বেশ পাংচুয়াল, সুশৃঙ্খল জীবনের তাৎপর্য তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না আশা রাখি। তাই তোমাকে বলবো, একটা সিদ্ধান্ত এবার নাও। তোমার ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলার জন্য সরি, কিন্তু তোমার জীবন এভাবে গোল্লায় যাক, সেটা দেখে চুপ করে থাকা যায় না।
- নো স্যার, ইটস ওকে। আই উইল থিংক এবাউট ইট স্যার।

কর্নেল হাবীবের সাথে একমত হলেও ওটা বাধ্য হয়ে হওয়া। এ ব্যাপারে কোনও কথা ভাবতে চায় না ফুয়াদ। ভাবতে গেলেই ছয় বছর আগের কথা মনে পরে। তখন সে ক্লাস সিক্স এ পড়ে। হঠাৎ একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে দেখে বাসায় একাধিক লোকজন। সবাই তার মা ও বাবার নিকটাত্মীয়। তাদের পারস্পরিক গুঞ্জন থেকেই ফুয়াদ বুঝতে পারে তার বাবা ও মা আলাদা হচ্ছে। তখনই ডিভোর্স নামের শব্দটার সাথে পরিচিতি ঘটে ফুয়াদের। সে কিছু কিছু বুঝতে পারে তার বাবা মা এর ভবিষ্যৎ পরিনতির ব্যাপারে। কিন্তু তারপরও কিছু একটা বোঝে না। সেই সময় ছোট ফুয়াদ আরও পিছনে চলে যায়। চোখের সামনে একটা ঝাপসা ঝাপসা দৃশ্য ভেসে আসে। তার বাবা রাত বারোটার সময় মাতাল হয়ে ঘরে এসে তার মাকে ক্রমাগত মারছে। তার মা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর কাঁদছে। ফুয়াদের বয়স সেসময় ছয় কি আট বছর। তখন ফুয়াদের পায়ের নীচের মাটি শক্ত ছিলো না। ফুয়াদের বাবা ঘরের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি এবং ব্যাবসার ক্রমাগত লোকসানে মাতাল হচ্ছিলেন দিনকে দিন। এরপর ফুয়াদের বাবার ব্যাবসা দাঁড়ায়, ফুয়াদের ম্যায়েরও পায়ের নীচের মাটি শক্ত। ফুয়াদের মাকে একজন বিখ্যাত নাট্য পরিচালক বেশ কিছুদিন ধরেই একটা রোল অফার করে আসছিলেন। শুরুতে ভাবতে সময় নিয়েছিলেন রীমা চৌধুরি। পরে যখন দেখলেন পায়ের নীচের মাটি শক্ত না হলে আর হচ্ছে না, তখন তিনি কোনও চিন্তা ভাবনা না করেই রোলটা করলেন। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয় নি। ধীরে ধীরে নিজেকে একজন খ্যাতনামা অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। ফুয়াদের বাবাও একজন নামকড়া ব্যাবসায়ী হয়ে গেলেন। কিন্তু তারপরও তাদের দুরত্ব ক্রমশই বাড়তে লাগলো। অবশেষে দুইজন আলাদা হয়ে গেলেন। ফুয়াদ যখনই ভাবতে যায় মায়ের সাথে থাকবে কি বাবার সাথে, তখনই তার দুনিয়া ওলট পালট হয়ে যায়। আর কিছুই ভাবতে পারে না সে। শরীর খারাপ হয়ে আসে।

প্রতি সন্ধ্যাতেই একুজন বুয়া এসে হোস্টেলের যাবতীয় কাজ করে দিয়ে যায়। আজ বুয়া তার নাতিনকে নিয়ে এসেছে। নাতিনটি বেশ শান্ত। কোনও রকম দুষ্টুমি করছে না। খালি একটু পর পর বুয়াকে ডাকছে, “নানু, নানু! কতক্ষন?” ফুয়াদ নিজের বযাগ থেকে একটা বিস্কুট আর একটা চকোলেট বের করে মেয়েটিকে দেয়। মেয়েটি সসংকোচে সেগুলো হাতে নিয়ে রেখে দিয়েছে। কখনও সেই বিস্কুট এর প্যাকেট আর চকোলেটের প্যাকেটটা নিয়ে খেলছে। সেই সাথে নানুকে ডেকেও চলেছে। নানুও আশ্বাস দেয় বারবার, “এই তো নানু, শেষ।“ সে আশ্বাস শুনতে অনেকটা কতিপয় শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতাদের নির্বাচনকালীন আশ্বাস এর মতো। মেয়েটির খেলা দেখতে ভালোই লাগে ফুয়াদের। ফুয়াদ মা বাবার একমাত্র সন্তান। তার ভাইবোনের শখ ছিলো খুব। বুয়ার নাতিনকে দেখে ভাবতে থাকে তার কোনও ছোট বোন থাকলে হয়তো ওর সমানই হতো বা ওর চেয়ে কিছুটা বড় হতো হয়তো। কিন্তু ভাগ্যকে আর কে বদলাতে পারে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুয়াকে ডাকে ফুয়াদ, “খালা, খালা……”
- জে ভাইয়া,
- আজকে ঘর মোছা লাগবো না, যাও গা।
- স্যারে রাগ করবো, বেশিক্ষণ লাগবো না, মুইছা দিয়াই যাই।
- এতো কিছু তোমার ভাবা লাগবো না, তোমার স্যারের ব্যাপারটা আমি বোঝুম।
- আইচ্ছা।
- তোমার নাতিনটা কি তোমার মেয়ের ঘরের না পোলার ঘরের?
- পোলার ঘরের।
- কার মতন হইছে?
- হের আব্বুর মতো।
ফুয়াদ পঞ্চাশটা টাকা বের করে বলে, “তোমার নাতিনরে দিলাম, মজা খাইবো।“ বুয়া নিঃসংকোচে টাকাটা রাখে। অভাবের জঠর জ্বালায় সংকোচ পুরে ছাই হয়ে গেছে।

যাওয়ার সময় নাতিনকে কোলে নিতে গেলে নাতিন বলে, “ধরবা না, আগে হাত হাত মোছো।“ বুয়াকে আদেশ মান্য করতে হলো। তাই দেখে ফুয়াদের মুখে একটা হাসির ঝিলিক কেটে গেলো।

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০২১ সকাল ৭:১৭
৬টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×