somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মা ও মেয়ে(শেষ পর্ব)

২৯ শে মে, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মা-মেয়ের সম্পর্কে সমস্যাঃ

মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন মুদ্রার এপিঠ ওপিঠের ছাপ দু’রকম হলেও তা একই মুদ্রার অংশ। তেমনি মানুষের মনেও “লাভ এন্ড হেট” এই দুই প্রবৃত্তির পিঠেপিঠি অবস্থান। একটি যেখানে তীব্র, সেখানে অন্যটি আসতেই পারে। মা-মেয়ের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম হয়না। মায়ের প্রতি নির্ভরতা দিয়ে শুরু হয় মেয়ের শিশুবেলা। তাই মায়ের প্রতি তীব্র ভালবাসাও মেয়ের মনে থাকেই, তারই সাথে থাকে আনুগত্য। টিন-এজে পৌঁছানোর সময় থেকেই এই আনুগত্যে কখনো কখনো চিড় ধরতে থাকে। এর নানা কারন থাকে। কখনও দেখা যায়, মায়ের চেয়ে বাবার প্রতি মেয়ের আনুগত্য ও ভালবাসা মাঝের কয়েক বছরে ধীরে ধীরে বেড়ে গেছে। বাবাকেই সে মনে করছে নিজের “হিরো’। তখন বাবা-মায়ের মাঝে কোন মতবিরোধ হলে চোখ-কান বুজে সে বাবাকেই সমর্থন করে। এতে মায়ের মনে অভিমান, ক্ষোভ জমতে থাকে। তারই বহিঃপ্রকাশ হতে থাকে, মেয়ের সাথে কলহ বিবাদের মধ্য দিয়ে। মেয়ে যত বয়ঃসন্ধির দিকে এগুতে থাকে, ততই তার ভিতরে স্বাধীনচেতা ভাবটি ফুটে ওঠে। মায়েরা সেটাকে সুনজরে দেখেননা। মনে করেন, মেয়ে অবাধ্য, স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছে। তার মনের গতী বা চিন্তা-ভাবনার দিক পরিবর্তনটি খেয়াল না করেই তখন মায়েরা কড়া শাসন করতে চেষ্টা করেন। তখনই মায়ের সাথে মানসিক সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। মেয়ের প্রতিবাদের প্রকাশ হয় তখন অবাধ্যতা। মায়ের মনে হয়, মেয়ে ইচ্ছে করেই মাকে অগ্রাহ্য করছে। স্কুল পেরিয়ে সদ্য কলেজে পা রাখা মেয়ের জীবনযাত্রার ছক বদলাতে থাকে। তখন অনেকটা সময় কেটে যায় বাইরে, বধু-বান্ধবের সংখ্যা বেড়ে যায়, বাড়ির বাইরে সে খুঁজে পায় এক নতুন জগত। আর এ নতুন জগতে মেয়ে নিজেকে অনেকটাই হারিয়ে ফেলে। এ সময়েই মায়েদের শুরু হয় ক্ষোভ, বঞ্চনার বোধ। এতো আদর, স্নেহে বড় করে তোলা মেয়ে মাকে এমন করে ভুলে যাচ্ছে? অন্য সব কিছুর তুলনায় মা যেনো কোন গুরুত্বই পাচ্ছেনা। মনে হতে থাকে মেয়ে নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেছে।
এই সব ক্ষেত্রেই শুরু হয় মা-মেয়ের ভুল বোঝাবুঝি। ভালবাসা ভরা পাত্রটিতে আস্তে আস্তে মিশে যায় পরস্পরের ঘৃনা। “লাভ” এর সাথে মেশে “হেট”। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি না বুঝে মা-মেয়ের সম্পর্কে বেড়ে চলে দুরত্ব। তখনই মায়ের মন মেয়েকে হারিয়ে ফেলার আশংকায় হাহাকার করে ওঠে। এই “লাভ-হেট” রিলেশন কখনো এক তরফা হয়না। নতুন প্রজন্মের ধ্যানধারনা, দৃষ্টিকোন যে অন্য রকম এটা অনেক সময় মা বোঝেননা। আবার অন্য দিকে, মায়ের সাথে যতই ভুল বোঝাবুঝি হোক না কেনো, মা কখনো শত্রু হতে পারেন না—এটাও অনেক ক্ষেত্রে মেয়ে বুঝে উঠতে পারেন না। ফলে দু’পক্ষেই জমে উঠতে থাকে ক্ষোভ, অভিমান, আর বিদ্বেষ। চিরাচরিত স্নেহ-মমতার বদলে মায়ের কাছ থেকে কেবলই শাসন, তর্জন, আর অভিযোগ পেতে পেতে মেয়ে তার মা সম্পর্কে সব ভালবাসা, আবেগ হারাতে থাকে। এটাই হয়ে দাঁড়ায় মা-মেয়ের সম্পর্কের সবচেয়ে বড় ক্রাইসিস পয়েন্ট। মনে রাখতে হবে, স্নেহ যেহেতু নিম্নগামী, তাই সমাধানের উদ্যোগ মাকেই প্রথম নিতে হবে। রাগ, বিদ্বেষ, অভিমান কোনটাই জমিয়ে রাখা ঠিক নয়। শুরুতেই সংঘাতের কারন গুলি বের করে নির্মুল করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন এই নতুন সময়, বয়সকে বোঝার চেষ্টা করা, সেই সাথে নিজের মেয়েটিকেও। মনে রাখতে হবে, আমার সন্তান হলেও সে সম্পুর্ন একটি আলাদা সত্ত্বা তাকে আমার বুদ্ধি দিতে পারি, কিন্তু বোধ নয়।
প্রয়োজনে নিজের পুরোনো ধ্যান-ধারনা ও বিচারভঙ্গি কিছুটা বদলানো, খোলামেলা আলোচনা, মেয়ের অভিভাবকের চাইতে অনেক বেশী বন্ধু হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে। একঘেয়ে বস্তা বস্তা উপদেশ আর অনুশাসন নয়, বদলে সহযোগিতা ও সমর্থনের মধ্যে দিয়ে মেয়ের বিশ্বাস ও বন্ধুত্ব অর্জন করতে হবে। দেখবেন, বকে ধমকে যে কথা শোনাতে পারেননি, তার চেয়ে অনেক বেশী কথা শুনবে মেয়ে বন্ধুত্বের খাতিরে।
অনিশ্চয়তা বোধ, মেয়েকে হারানোর চিন্তা, মেয়েকে বেশী আকড়ে ধরার প্রবনতা বাদ দিতে হবে। বন্ধুদের সাথে বাইরে গেলে বার-বার তাকে ফোন করা, স্কুল, কলেজের টিচারদের কাছে ফোন করে তার পড়াশোনার খোঁজ করা, মোবাইলে কথা বললে বার-বার তার ঘরে যাওয়া, মেয়ের খাতা-পত্র, ডাইরি চেক করা, এসবই আমরা করে থাকি মায়ের ভালবাসা আর সতর্কতার কারনে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যেন আমাদের এই ভালবাসা মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়। মেয়েকে বুঝতে দিন, আপনি ওকে কতটুকু বিশ্বাষ করেন, আর সেই বিশ্বাষের মর্যাদা রাখাটা তার দায়িত্ব, কর্তব্য। সম্পর্ক তখনই বাঁচে, যখন সম্পর্কের মাঝে “ব্রিদিং স্পেস” থাকে। যতদিন আচঁলে আড়াল করে রাখা দরকার, তার বেশী আগলে বা আঁকড়ে রাখবেন না। ওকে ডানা মেলে উড়তে দিন ওর স্বাধীন আকাশে। তবেই মা-মেয়ের সম্পর্ক গাঢ় হবে। আকাশে উড়ে ক্লান্ত হলে সে ঠিকই ফিরে আসবে মায়ের কোলে। নাহলে মায়ের অতি –পজিসিভনেস মা-মেয়ের মধুর সম্পর্ক আলগা করে দেবে।

মা-মেয়ের সম্পর্কের কি করা উচিত আর কি নয়।

কি করবেনঃ

মেয়েকে বোঝার চেষ্টা করুন। সবসময় এটা করো, ওটা করোনা না বলে তার সমস্যা জানতে চেষ্টা করুন।
মায়ের প্রতি অতিরিক্ত ভালবাসা মানেই কিন্তু বাবাকে অবজ্ঞা করা নয়। এ বিষয়ে নজর রাখুন। পরস্পরের উপর অভিমান করলে, তা দূর করার চেষ্টা করতে হবে দুজনকেই।
নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব বজায় রাখুন। সেটাই অনেক সংকট কাটিয়ে দেয়।
দিনের মধ্যে কিছুটা সময় এক সাথে কাটান, নিজেদের গল্পগুলো শেয়ার করুন। মাঝে মধ্যে সারপ্রাইজ গিফট দিন। রাগারাগি না করে ভালবেসে, বুঝিয়ে আপনার বক্তব্য বলুন। সম্পর্কের মাঝে একটু স্পেস দিন। যে সব মেয়ে একটু ইন্ট্রোভাট হয়, তাদের মায়েদের বাড়তি দায়িত্ব হল, মেয়ের মনের কথা, তার চিন্তাপদ্ধতি ইত্যাদি ভালো করে বোঝা, এবং সেই মতো বোঝানো। একে অপরের সাপোর্ট সিস্টেম হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুন।

কি করবেন নাঃ

অযথা পরস্পরকে সন্দেহ করবেন না।
জোর করে আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করবেন না।
ক্রমাগত অভিযোগ করবেন না। এতে আপনারও খারাপ লাগবে, আর সন্তানও কষ্ট পাবে।
কোন সমস্যা হলে মেয়ের থেকে লুকোবেন না। মনে রাখবেন মা-মেয়ের মত ভাল বন্ধু আর হয়না।
মেয়ে উদ্যত ব্যবহার করলে তাকে প্রথমেই শাসন করবেন না। সহমর্মিতা দেখান। সময় দিন। নিজের স্নেহ, ধৈর্য ও বিচক্ষনতা দিয়ে ওকে শোধরাবার চেষ্টা করুন।
সব কথা নির্বিচারে মেনে নেবেন না। যুক্তি, বুদ্ধি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করুন।
একটা বয়সে সব মেয়েই প্রেমে পড়ে। তা নিয়ে অকারন হুলুস্থুল বাধাবার দরকার নেই। মেয়ের বিশ্বাস অর্জন করুন। তারপর তার কাছ থেকেই পুরোটা জেনে তাকে গাইড করুন।
>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>
বিখ্যাত দার্শনিক কবি কাহলিল জিব্রান সন্তান সম্পর্কে খুব সুন্দর করে বলেছেন। “শিশুদের মতো হতে চেষ্টা করতে পারো, কিন্তু ওদেরকে বানাতে চেওনা তোমাদের মতো। কারন জীবন কখনো পেছনে হাটেনা, গতকল্যের জন্য অপেক্ষা করেনা”।

মা ও মেয়ে (১ম পর্ব)
মা ও মেয়ে (২য় পর্ব)

সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৩৮
৩৭টি মন্তব্য ৩৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বসতে না পারার কষ্টটা সমালোচনার কোন বিষয়বস্তু নয়

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৬

গতকালের একটি ভাইরাল খবর হচ্ছে কয়েক মিনিটের জন্য বিসিএস পরীক্ষা দেয়া হলো না ২০ প্রার্থীর !! অনেক প্রার্থীর কান্নাকাটির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।এ বিষয়ে পিএসসি চেয়ারম্যান এর নিয়ামানুবর্তিতার জ্ঞান বিতরনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×