সবাই যখন চা বাগান নিয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলে তখন আমি চুপ করে শুনি আর মুখ টা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়ে হাসি। না তাচ্ছিল্য করে নয়, হাসিটা আসে কষ্ট থেকে, বিষাদ থেকে, আর ফিরে যেতে না পারা সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়াতে। মানুষ শুধু সুখে আর দুঃখেই হাসেনা, বিষন্নতা, অতৃপ্তি অথবা অক্ষমতা থেকেও মাঝে মাঝে হাসে, নিজেকে উপহাস করেই হয়তো।
আমার শৈশব বাবার কর্মসূত্রে কেটেছে শ্রীমঙ্গলের পাশের একটি চা বাগানে, যেখানে নগর জ়ীবনের কিছুই ছিলোনা। সন্ধ্যা বেলাতেই গভীর রাত নামতো, শেয়াঁলের আনাগোনা ছিলো বাসার ঊঠোনে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে তক্ষকের ডাক পিলে চমকে দিতো প্রায়ই, বাসার ঠিক পিছনেই নিজের আবাসস্থল বানিয়ে বসা ৭/৮ হাত লম্বা দাঁড়াস সাপটাও প্রতিমুহুর্তে মনে করিয়ে দিতো আমাদের অসহায়ত্ব। প্রকৃতির কাছে উন্মুক্ত থাকার ক্ষোভে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।
যখন বর্ষা নামতো, তখন বছরের ছয়টি মাসই বিচ্ছিন্ন থাকতে হত পুরোটা পৃথিবী থেকে, শহরের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিলো কাঁধে ঝোলা নিয়ে ডাকঘর থেকে চিঠি নিতে আসা ডাক হরকরা। আমরা আসলে তখন খুব একটা পার্থক্য করতেও শিখিনি, শুধু যখন মাঝে মাঝে শহরে আসতাম, হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতাম আর অনুভব করতাম নাগরিক জীবনের চাকচিক্য।
স্কুল নামক শব্দটির সাথে পরিচয় ছিলোনা ৯ বছর বয়স পর্যন্ত। বাবা যখন মূর্খ হয়ে যাবার আশংকায় মা সহ আমাদের কে শ্রীমঙ্গলে পাঠালেন, তখন খুশিতে উদাম নেচে উঠেছিলাম আমরা আর হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। স্কুলের পরিবেশের সাথে পুরোপুরি অপরিচিত আমি যখন পঞ্চম শ্রেনীতে প্রথম ক্লাশ করতে গেলাম, তখন অভিজ্ঞ আর আকারে বড় সমবয়সীদের হুমকি আর নিত্যনতুন শয়তানির কলাকৌশলে প্রায়ই কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরতাম। তবে বয়সের তুলনায় অপরিপক্ক আমাকে খুব বেশিদিন জ্বালাতন সহ্য করতে হয়নি শুধু ছিচকাদুনে খেঁতাব টি নেয়া ছাড়া। তারপর ওখান থেকেই মাধ্যমিক।
শ্রীমঙ্গল সরকারী কলেজ
উচ্চমাধ্যমিকে বড় ভাই আর বোনের প্রত্যাশার চেয়ে খারাপ ফলাফলের খেসারত দিতে হয় আমাকে স্থানীয় সরকারী কলেজে ভর্তি হয়ে। সরকারী কলেজে পড়ার সবগুলো সুযোগ সুবিধাই (!) নিয়েছিলাম, মানে ক্লাশ না করা, চুটিয়ে আড্ডা দেয়া, নির্বোধের মত অল্পবয়সেই প্রেমে পড়া... আরো কত কি। তবে ভাই-বোনের ফলাফলে ক্ষুব্দ মা কখনোই হাতের মুঠো আলগা করে দেননি। মনে আছে একদিন বাসায় ফিরতে রাত হয়েছিলো একটু, দরজায় কড়া নাড়তেই মা’র আওয়াজ “কয়টা বাজে” আমি বললাম “দশটা বাজতে এখনো দশ মিনিট বাকী” মা’র উত্তর “তাহলে দশটা মিনিট যাওয়ার পরেই ঘরে আসো।“ কনকনে শীতের রাতে ওই দশ মিনিট ঠিকই আমাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাটাতে হয়েছিলো।
উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি ততদিনে বাবাও একই বাগানে তার ২৫ বছরের চাকরী জীবনের অবসান ঘটিয়ে ফিরেন আর আমরা দুই ভাই ছাড়া আমাদের পুরো পরিবারটির আবাস পরিবর্তন করে অগ্রসর হয় আরেকটু বেশি নাগরিক সুবিধার আশায় সিলেটের দিকে। তারপর যখন শেষ সূতোটিও ছিড়ে যায়, তখন থেকেই আর যাওয়া হয়না খুব একটা। মাঝখানে একবার বিলেত ফেরত বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়ে ৮-৯ ঘন্টা থেকেই চলে এসেছিলাম।
গত কছুদিন থেকেই মনটা টানছিলো খুব, যাবো যাবো করেও যাওয়া হচ্ছিলো না। গত সপ্তাহে আর খুব বেশি চিন্তা না করে উঠে পড়ি বাসে। বাস থেকে নেমেই মনে হলো ফিরে এলাম আবারও জীবনের কাছে। ওইদিন রাতেই বন্ধুদের সাথে একচোট আড্ডা।
পরদিন সকালে উঠেই আমার জন্মস্থান, এখন আমূল পালটে যাওয়া সেই চা বাগানটির দিকে ছুটি। পরিচিত বলতে বুড়িয়ে যাওয়া ডাক্তার মামা আর স্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যাওয়া কিছু চা শ্রমিক। ফেরার পথে গাড়ী থামিয়ে যখন একটি টিলার পাশে নামি, শৈশবের সেই সাপটিই হয়তো আবারো উদয় হয়। হতচকিৎ আমাকে কিছু না করেই যখন আপন মনেই পিছন দিকে চলে গেলো, তখন মনে হলো এইতো আমার হারিয়ে যাওয়া শৈশবের খেলার সঙ্গী।
ফিরে এসে ৩ বন্ধু মিলে বিকালে যাই কলেজে, যেখানে আমরা দুইটা বছর কাটিয়েছি একসাথে আড্ডা দিয়ে। স্মৃতি বহন করা প্রতিটা ক্লাশরুমের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা ফিরে যাই অতীতে আর মনে করি কোন স্যারকে কিভাবে বিব্রত করেছিলাম কোন কাজটি করে। হাসতে হাসতেই সন্ধ্যা নামে আর আমরাও চুপ করে যাই, ভারাক্রান্ত হই, আর আমরা আবারও ফিরে আসার তাগিদ অনুভব করি।
সন্ধার পর শহরের রাস্তায় হাটতে হাটতে চেহারা বদলে যাওয়া অনেকের সাথেই দেখা। বর্তমানে অল্প পরিচিত এইসব লোকজন সবার সাথেই জড়িয়ে আছে অনেক কথা আর স্মৃতি। জড়িয়ে নিতে চায় আবারো, আমি চাইনা কারন আমাকে যে ভোঁড়ের বাসে চেপেই ফিরতে হবে আর যাপন করতে হবে রোবটিক জীবন।
ফেরার পথে বাসে উঠে যখন চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে আসে, তখন আবারো চোখের ডাক্তারের কাছে যাবার তাগিদ অনুভব করলো চা বাগান ফুড়ে ক্রমশঃ নগরের দিকে অগ্রসর হওয়া আমার মন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




