৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩। যুদ্ধপরাধী কাদের মোল্লার যুদ্ধাপরাধ ( খুন-ধর্ষণ-গনহত্যা) নিশ্চিত ভাবে প্রমাণ হবার পরেও আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালে রায় ফাঁসি না হয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড হবার পরে প্রথম ও সবচেয়ে দ্রুত প্রতিবাদ আসে সম্ভবত ফেসবুক থেকেই। অসংখ্য ফেসবুক ব্যবহারী তাদের স্ট্যাটাসে তীব্র ঘৃণা জানায়। এই ঘৃণা ও নিন্দা ফেসবুকেই সীমিত থাকেনা। সেদিন বিকালে চারটায় ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে শাহবাগ চত্বরে সমবেত হন মূলত ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্টরা। কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যেই এই প্রতিবাদ সমাবেশ আর তাদের মধ্যে সীমিত থাকেনা। এই চত্বর হয়ে উঠে সব দল-মতের তরুণদের প্রতিবাদ মঞ্চ। ক্রমে ক্রমে তাতে সংহতি প্রকাশ করে বিভিন্ন দল ও পেশাজীবি সংগঠনরা। সেদিন সারা রাত শাহবাগ চত্বরে অবস্থান নেবার পর পরদিনও চলতে থাকে ট্রাইবুনালের রায় প্রত্যাখান করে ফাঁসির দাবীতে গণঅবস্থান। সেই প্রতিবাদে প্রতিনিয়ত সংহতি প্রকাশের তালিকা যুক্ত হচ্ছে অনেক নাম। উপন্যাসিক মাসুদা ভাট্টি এই গণসমাবেশের নামকরণ করেন নব যুদ্ধ স্কয়ার বা নব যুদ্ধ চত্বর। প্রকৃত অর্থেই এই আন্দোলন যেন তরুন সমাজের কাছে আজকের মুক্তিযুদ্ধ। অন্তত এই প্রতিবাদে উপস্থিত তরুণ তরুণীদের কাছে তো বটেই। অবশ্য উপস্থিত থাকার সুযোগ সত্বেও উপস্থিত থাকছেন না এমন অসংখ্য তরুন- তরুনী যেমন আছে আবার সময়-সুযোগের অভাবে এখানে আসতে না পেরে আফসোস করছে এদের সংখ্যাও অনেক। তারা তাদের সমর্থন জানানো অব্যাহত রাখছে অনলাইনের মাধ্যমে। এবং প্রতিমূহূর্তেই ভিড় সামলাতে হিমশিম খাওয়া তরুণদের মেখে স্পষ্ট বোঝা যায়- যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে একাত্ম হওয়া এইসব মানুষদের অংশগ্রহণ ক্রমশ বাড়ছেই আর বাড়ছেই।
এই নব যুদ্ধের কিছু মূহূর্ত পাওয়া যাবে এই ছবিগুলোতে। ছবিগুলো ৬ ফেব্রুয়ারী সকাল সাড়ে দশটা থেকে দুপুর দেড়টার মধ্যে তোলা।
শাহবাগ চত্বরের অসংখ্য মানুষের উপস্থিতি
তৈরী হয়েছে ফাঁসির মঞ্চ।
সকাল থেকেই বসে আছেন প্রতিবাদী তরুন-তরনীরা।
শিল্পীরা প্রতিবাদলিপি আর চিত্রে রাজপথ রাঙিয়ে দিচ্ছেন।
বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো দেশ বিষয়ক গান, নাচ ও নাটকের মাধ্যমে সমাবেশকে প্রাণচাঞ্চল্য জুগিয়ে যাচ্ছেন।
কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবীতে প্রতিনিয়তই যুক্ত হচ্ছেন বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষ। টেলিভিশনে এই সমাবেশ গুরুত্বসহকারে প্রচারিত হবার কারণে সংগঠিত ভাবে বা অসংগঠিত ভাবে যোগদান চলছেই।
শাহবাগের তরুন সমাজের আন্দোলন তরুন সমাজের মধ্যে সীমিত থাকছে। ছোট শিশুটিকে এই নবমুক্তি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা দিতে নিয়ে আসছেন মা-বাবা।
বেলা বেড়ে যায়। তবুও কমেনা ভীড়। তা যেন আরো বেড়ে চলে।
যেখানে দাবীটি মানুষের প্রাণের সেখানে বাড়তি কিছু করতে হয়না ভীড় সচল রাখবার জন্য। আমি কিছুদিন পূর্বে ধর্ষন বিরোধী অ্যাকটিভিটিজ নিয়ে মানুষের কাগজে কলমে দ্বায়িত্ব পালন করার প্রবণতা নিয়ে হতাশ হয়ে করা একটি মন্তব্যে একজনের ফেসবুক স্ট্যাটাসের রেফারেন্স টেনেছিলাম। সেই স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছিলেন- ভাগ্যিস একাত্তরে ফেসবুক ছিলনা, তাহলে আমরা ফেসবুকের মাধ্যমেই যেন আমরা দেশ স্বাধীন করে ফেলতাম। এখন বুঝতে পারছি আমার রেফারেন্স ও হতাশা অহেতুক ছিল। আজ মনে হচ্ছে সে সময় ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ব্লগ থাকলে পরে আমাদের ৪৭ থেকে ৭১ অবধি অপেক্ষা করতে হতো না দেশ স্বাধীন করার জন্য। নিজের নিরাপত্তা ও প্রাণের মায়া ত্যাগ করে দেশের জন্য রাস্তায় নামতে ভোলেনি বাঙ্গালি। শুধু ঠিক কারণে ঠিক মত ডাকটা দিতে হবে। কারণ অনেক কিছু হারিয়ে ফেললেও দেশের প্রতি ভালবাসাটি বুকের কোথায় যেন স্বযত্নে লালন করে রেখেছি আমরা। এই সাহস- এই ভালবাসা- এই ত্যাগ - এই প্রতিবাদ প্রমাণ করে মূলত তারুন্য সংগঠিত এই সমাবেশ যেন প্রকৃত অর্থেই নব যুদ্ধ।
একটা চরম হিসাবের কথা বলে লেখাটা শেষ করি। হিসাবটা খুব সহজ মারতে হবে নয় মরতে হবে। ওদের ফাঁসি, নয় আমাদের ফাঁসি। এখানে একটা আকুল অনুরোধ, রাজনীতিবিদদের প্রতি। আমাদের দেশে সাধারণত মানুষের প্ল্যাটফর্ম খুব বেশি একটা হয় না। যাও হয়, তা আবার বামপন্থীদের নয়তো ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। একদল একাত্ম হবার মাধ্যমে, হয় মিষ্টি কথায় না হয় ভয় দেখিয়ে আন্দোলনটাকে নিজেদের বানিয়ে গুরুত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করে। অনুরোধ এই জায়গাটাতেই, এবারের আন্দোলনটাকে অন্তত ছেড়ে দিন প্লীজ। রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ এই সব অ্যাকটিভিটিস্টরা টেকনিকাল বুদ্ধির কাছে পারবে না। আপনারা তা জানেনও। তাই এই আন্দোলনটাকে ছেড়ে দিন কারণ এই আন্দোলনের মধ্যে রাজনীতি ঢুকে পড়লে আন্দোলনটি ক্ষমতা হারাবে। ওদের কুবুদ্ধি, অর্থ, অস্ত্র, অভিজ্ঞতা বিরদ্ধে লড়তে চাইলে একমাত্র হাতিয়ার মনের জোর। সেটা নষ্ট করবেন না প্লীজ। আন্দোলনটা আসলেই মারা অথবা মরার আন্দোলন।