somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবার শোবার ঘরে

৩০ শে জুন, ২০১৩ সকাল ৯:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দিনের বেলা বাবা অফিস থেকে ফিরে, মধ্যাহ্নভোজন সেরে শেষ দুপুরে একটু ঘুমুতেন। ওই সময়টা ওনার শোবার ঘরে আমাদের যাওয়া ছিলো বারণ। একেবারে কারফিউ জারি থাকতো সেসময়টা।

বাবার দোষটাই দেই কি করে! আমাদের ভাই বোনদের সেই সময়টাতেই যেনো সমস্ত কাজ পড়ে যেতো ওই ঘরে যাবার! আর যতই সন্তর্পণে যেতাম, হাত পা যেনো কথাই শুনতে চাইতো না! কিংবা যেনো অন্য কারো হাত পা নিয়ে ঢুকতাম, যা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকতো না! দরজার পাল্লাটাকে যেখানে নিঃশব্দে খোলার পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে, দেখা গেলো ‘ইয়াও’ করে শব্দ করে উঠলো। ড্রয়ারগুলো যেনো তখনই তাদের মসৃণতা হারিয়ে ফেলতো এবং খুলতে, বন্ধ করতে একটুতেই গান গেয়ে উঠতো! কোনও একট পা হটাত যেন একটু লম্বা হয়ে যেতো আর নিজের অজান্তে আশে পাশের স্যান্ডেল জুতা একটা কিছু পেলে সরসর শব্দ করে পাঠিয়ে দিতো খাটের নীচে।

তারপর যা হবার তাই।‘কে রে ওখানে’ হেঁকে উঠতেন বাবা। যা কারফিউতে গোলাগুলি চলার মত ভীতির সঞ্চার করতো আমাদের মনে।

বাবার শোবার ঘর নিয়ে আরেকটা কারণে আমার মনের অন্তঃস্থলে একটা সুতীব্র আকর্ষণ ছিল। সেটা সৃষ্টি হয়েছিলো অপেক্ষাকৃত কম বয়সে সেই ঘরে থাকার অধিকার হারিয়ে ফেলায়। আমার ১৮ মাস বয়সে ছোট ভাইটি যোগ দিলো আমাদের পরিবারে। এর আগে বিছানায় অবস্থান ছিল বড় ভাইয়ের, মা-বাবার আর আমার। পাঁচজনের স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় বড় ভাইকে সরিয়ে দেয়া হল পাশের রুমে। তার একা থাকাটা ভালো দেখায়না বিধায় কপাল পুড়লো আমারও। একটা অব্যক্ত কষ্ট রয়ে গেলো মনে।

হটাত একদিন বাবা মা’র ছুটাছুটিতে বুঝলাম, আমার নাকি জবরদস্ত জ্বর হয়েছে। সেই সূত্রে ঠাঁই হোল বাবার শোবার ঘরে। সে কি আদর, বাবার এবং মা’র। ভেবেছিলাম এভাবেই কেটে যাবে দিন। একদিন ঘুম ভেঙ্গে দেখি বড় ভাইয়ের সাথে শুয়ে। শুনলাম ভাল হয়ে গেছি। সেই থেকে জ্বর হওয়া আমার জন্য ছিলো একটা অতীব আকর্ষণীয় ব্যাপার।

রাগী বাবা থাকলে একটা বড়ো ফায়দা অর্জন হয়। ধরাকে সরা জ্ঞান করার আস্থা প্রাপ্তি ঘটে। বাবার আশ্রয়ে নিজেদেরকে খুব নিরাপদ বোধ করতাম আমরা সবসময়য়। একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভাবতেই পারিনি বাবা আমাদের কোন ক্ষতি বরদাশত করবেন। সেই জন্য নিঃশঙ্কায় কেটে গেছে দিন। অথচ ভাবলে এখনও গা শিওরে উঠে, কিভাবে মরতে মরতে কয়েকবার বেঁচে গেছি আমরা, নিশ্চিত পিতৃহীন হবার সম্ভাবনা থেকে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে ফিরে পেয়েছি আমাদের বাবাকে।

বয়স বাড়তে থাকলো আমাদের আর অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগলাম, আমাদের কারফিউদাতা বাবা কিভাবে আমাদের বন্ধু হয়ে যেতে লাগলেন। বয়ঃসন্ধিকালে দোকানে নিয়ে কিনে দিলেন আন্ডারওয়ার, লুকিয়ে ভ্রাতৃত্রয়কে তাস খেলতে দেখে একদিন ড্রয়িংরুমে ডেকে নিজে খেলায় যোগ দিলেন আর মা’কে বললেন সবাইকে চা পরিবেশন করতে। সেই দিন থেকে তাস খেলা আমাদের ঘরে আর নিষিদ্ধ রইলো না আর আমরাও বিনিময়ে জীবনে এই খেলার অপব্যবহার করার কথা ভাবতেই পারিনি।

অতঃপর LPR এ গেলেন বাবা। সদা প্রাণচঞ্চল বাবা রাতারাতি যেন বুড়ো হয়ে গেলেন। জানতাম বাবার হাই ব্লাড প্রেশার রয়েছে। কিন্তু কোনোদিন তাঁকে শঙ্কিত দেখিনি। কোনদিন শয্যাশায়ী থাকেননি। দেখিনি আমাদেরকে শঙ্কায় ফেলতে। সেই বাবা অবসরে যেতে না যেতেই স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেন। আমাদেরকে কোন প্রস্তুতির সুযোগ না নিয়ে ছেড়ে গেলেন এই দুনিয়া।

তিন দেশ থেকে পড়িমরি ছুটে এলাম মানসিকভাবে বিধ্বস্ত আমরা তিন ভাই। বারডেমের হিমঘর থেকে গ্রহণ করলাম বাবার মরদেহ। পায়ের দিকে ধরার সৌভাগ্য হোল আমার। মনে মনে বললাম, বাবা মাফ করে দিও, তোমার সামনে থাকতে পারিনি। হয়তো ছেলেদের সামনে দেখলে নিজের দায়িত্বের কথা স্মরণ করে আরো কিছু দিন বেঁচে থাকার আগ্রহবোধ করতে।

তোমার কাছে মাফ নেয়া হলোনা বাবা, ছোট থাকতে তোমার ড্রয়ার থেকে সিকি এবং আধূলিগুলো আমিই সরাতাম বাবা, যাতে আমার মাটির ব্যাংকটা, অন্য সবার আগে ভরে ওঠে। তুমি নিশ্চয়ই সব বুঝতে বাবা ব্যাংকটা অতো তাড়াতাড়ি ভারী হয়ে যেতে দেখে কিন্তু আমাকে বুঝতে দাওনি তা। হ্যাঁ বাবা, খাবার ঘরের মিটসেফটা ধরে আমি ঝুলে পড়েছিলাম বলেই ওটা পড়ে গিয়েছিলো আর সংসারের সব কাঁচের জিনিস চুরমার হয়ে গিয়েছিলো। মারবে ভয়ে সেদিন সত্য কথাটা বলতে পারিনি বাবা আর তুমিও কিচ্ছু বলনি আমাকে। মা’কে বলতে শুনেছি মিটসেফটা যে আমার গায়ের উপর পড়েনি সেজন্যে তুমি খুব সন্তুষ্ট ছিলে এবং কৃতজ্ঞতার নামাজও পড়েছিলে। কিন্তু আমার যে সত্য কথাটা বলা হলোনা বাবা!

গ্রামের বাড়িতে আমাদের পারিবারিক গোরস্থানে বাবাকে সমাহিত করার ব্যবস্থা হলো। আমার এক জেঠাতো ভাই, কোরানে হাফেজ, মসজিদে ইমামতি করেন, বললাম ভাই, ওনাকে কবরে নামানোর কাজটায় আপনি নেতৃত্ব দিবেন কিন্তু। মনে মনে ভাবলাম কাজটা ভালভাবে সম্পন্ন হবে তাহলে। উনি বোধহয় দায়িত্ব থেকে রেহাই চাইলেন শরীর ভালো না থাকার কারণে।

আমার গায়ে তখন যেন জ্বর। ঠিক যেন বাবার ঘরে শোবার সুযোগ প্রাপ্তির জ্বর। একলাফে নেমে গেলাম খোঁড়া কবরের গভীরে। ভাইয়েরাও নেমে এলো সাথে সাথে। যত্নের সাথে বাবাকে নামিয়ে শুইয়ে দিলাম তাঁর নতুন ঘরে। কি শান্তি! বাবার ঘরে একসঙ্গে আমরা ভ্রাতৃত্রয়। বাবা শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছেন। উচ্চ রক্তচাপ তাঁকে আর ছুঁতে পারছে না একটুও। উপর থেকে তাড়া আসছে ফিরে যাবার। মন চাইছে আরেকটু থাকি, অনেকক্ষণ থাকি। মনে মনে বাবাকে বললাম, বাবা তোমার ঘরে এসেছি আমরা, তোমার ঘুমের ব্যাঘাত করছি, একটু কষে বকে দাওনা বাবা!
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৪


শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×