somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

সাইয়িদ রফিকুল হক
আমি মানুষ। আমি ত্বরীকতপন্থী-মুসলমান। আমি মানুষ বলে আমার ভুলত্রুটি হতেই পারে। বইপড়তে আমার ভালো লাগে। সাহিত্য ভালোবাসি। লেখালেখি আমার খুব শখের বিষয়। বাংলাদেশরাষ্ট্র ও গণমানুষের জন্য আমি লেখনিশক্তিধারণ করেছি।

খুব ভয়ের গল্প: বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে (চতুর্থ পর্ব)

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



খুব ভয়ের গল্প:
ধারাবাহিক উপন্যাস:
বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে
(চতুর্থ পর্ব)

সাইয়িদ রফিকুল হক

প্রথম পর্বের লিংক: Click This Link
দ্বিতীয় পর্বের লিংক: Click This Link
তৃতীয় পর্বের লিংক: Click This Link
[বি.দ্র. যাদের নার্ভ খুব দুর্বল তারা দয়া করে এই লেখাটি পড়বেন না। এটি কোনো-একজনের জীবনে ঘটে যাওয়া অন্যরকম ঘটনা]

পানিটুকু পান করার পর থেকে শায়লা যেন এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। তবুও অর্ণব ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “আপুনি, তুমি একটু একা থাকতে পারবে তো? আবার ভয় পেয়ো না যেন। পাশের রুম থেকে আমি মামণিকে এখনই ডেকে আনছি।”
শায়লা হাততুলে ও-কে থামাবার চেষ্টা করে—কিন্তু অর্ণব কিছুতেই থামলো না। সে প্রায় দৌড়ের বেগে ছুটলো। তারপর সে মায়ের রুমের কাছে এসে দেখে—তাদের দরজাটা ভেজানো রয়েছে—সে সামান্য একটু ধাক্কা দিয়ে দরজাটার খানিকটা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে মায়ের বিছানার পাশে দাঁড়ায়। তার বাবা শুয়ে আছে মায়ের পাশে। তার ঘুম যেন না ভাঙে সেইজন্য সে মশারির ভিতরে তার ডানহাতটা প্রবেশ করিয়ে মায়ের ডানপায়ের বুড়ো আঙ্গুল ধরে ধীরে ধীরে একটু নাড়াচাড়া করতে থাকে—যেন মায়ের ঘুম ভাঙে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার মায়ের ঘুম ভাঙলো।
এবার তিনি ধচমচ করে জেগে উঠে—বিছানায় বসে বললেন, “কী হয়েছে, বাবা, কী হয়েছে? এতো রাতে তুই এ-ঘরে?”—তার চোখেমুখে দারুণ একটা ভয়ের ভাব ফুটে উঠলো। তিনি যে খুব ঘাবড়ে গেছেন—তা সহজেই অনুমেয়।
অর্ণব তাড়াতাড়ি তার মাকে অভয় দিয়ে আস্তে-আস্তে বলে, “না, তেমনকিছু নয়, মা। তবে তুমি একটু তাড়াতাড়ি আপুনির রুমে আসো তো। একটু বিশেষ দরকার আছে।”
ওর মা এই কথাটা শোনামাত্র খুব দ্রুত বিছানা থেকে নেমে—পারলে একলাফে অর্ণবের অনুগামী হন। তিনি যে এইমুহূর্তে সাংঘাতিকভাবে বিচলিত—তা তার হাবভাব দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
রাশিদা বানু ছেলের পিছন-পিছন শায়লার রুমে এসে দেখলেন, শায়লা কিছুটা চোখ বুজে শুয়ে রয়েছে। আর তার রুমে লাইট জ্বলছে! এতো রাতে তার যে ঘুম ভেঙেছে কী জন্য—তা বুঝতে তার কোনো অসুবিধা হলো না। তবুও অর্ণব সবটা তার মাকে প্রায় একনিঃশ্বাসে খুলে বললো।
রাশিদা বানু সব শুনে বললেন, “আমি জানি, বাবা। এসব এই বাড়িটাতে আছে। কিন্তু তোরা ভয় পাবি বলে এতোদিন তোদের কাছে আমি এসব বলিনি। ভেবেছিলাম, বাড়িটা হুজুর ডেকে যখন বন্ধ করেছি—তখন এমনিতেই এসব ঠিক হয়ে যাবে। এখন দেখছি—তা আর হলো না। আজ যখন সব ঘটনা তোদের কাছে প্রকাশিত হয়েছে—এসব এখন আর গোপন রেখে লাভ কী? কাল সকালে সব ঘটনা তোদের খুলে বলবো আমি।”
অর্ণব বললো, “আমরাও অনেককিছু জানি, মা।”
তিনি বললেন, “সে তো দেখছি, বাবা। এখন সবই জানাজানি হয়ে যাবে।”
মিনিটখানেক পরে তিনি অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “যা তো বাবা, তোর বাবাকে একবার ডেকে আন? তার এসব জানা খুব দরকার।”
এটা শুনে শায়লা তার মাকে প্রবলভাবে বাধা দিয়ে বলে, “না, মা। তার আর দরকার হবে না। তুমি বাবাকে এখন ঘুমাতে দাও তো। পরে নাহয় বলবে।”
অর্ণব অবশ্য বললো, “হ্যাঁ মা, বাবাকে আমি এখনই ডেকে আনছি। আপুনির কথা এখন আমি শুনবো না। এসব আসলেই বাবার জানা খুব জরুরি।”
তবুও শায়লা মাকে বলতে লাগলো, “থাক না, মা। এতো রাতে বাবাকে ডাকার কোনো দরকার নাই। বাবা একটু ঘুমাচ্ছে—তাকে আর কষ্ট দিয়ে লাভ কী? তাছাড়া, রাত শেষ হতে তো আর বেশি বাকি নাই। তুমিও রুমে গিয়ে ঘুমাও গে। এখন আমি একলাই থাকতে পারবো।”
রাশিদা বানু বললেন, “তা হচ্ছে না, মা। আমি তোর পাশে থাকবো।”—বলে তিনি শায়লার পাশে শুয়ে পড়লেন। আর অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই আবার নিজের রুমে একা থাকতে ভয় পাবি নাতো? ভয় পেলে এখানে চলে আয়, বাবা।”
অর্ণব একটু হেসে বলে, “না, মা। আমার এতো ভয় নাই। তুমি আপুনির কাছেই থাকো।”—বলে সে নিজের রুমে চলে গেল। মিনিটখানেক পরেই অর্ণব একটা বালিশ ও বিছানার চাদর নিয়ে শায়লার রুমে এসে ঢুকলো। ও-কে এভাবে শায়লার রুমে ঢুকতে দেখে ওর মা বললেন, “কী ব্যাপার? ভয় লাগছে বুঝি? আমি তো আগেই বলেছিলাম—এতোবড় একটা ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর তোর একা থাকার দরকার নাই।”
অর্ণব বললো, “হ্যাঁ মা, আমিও তোমাদের সঙ্গে এখানে থাকবো।”
মা বললেন, “আমি তো তা-ই বলছিলাম রে। তুই তো আগে শুনলি না!”
তারপর তিনি আবার বললেন, “তুই এবার নিচে বিছানাটা করে নে তো। আর কোনো কথা বলিস না। এখন যে রাতটুকু আছে—তাতে ঘুমিয়ে নে। নইলে, সকালে তোর খারাপ লাগবে।”
অর্ণব আর-কোনো কথা না বলে নিচে বিছানাটা করে নিলো।
তারপর সে কতক্ষণ পরে বলে, “মা, তোমাদের রুমের ডিমলাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে আসি? আত্মাটা যদি আবার বাবার ওখানে ঘোরাফেরা করতে যায়!”
ওর মা একটু ভেবেচিন্তে বললেন, “তা করতে পারিস। তোর বাবা তো আমাদের মতোন এতোকিছু জানেন না। যা, তুই তা-ই করে আয়।”
অর্ণব বাবার রুমে এসে দেখলো, তার বাবা লাইট জ্বালিয়ে কী যেন খুঁজছেন!
সে পিছনদিক থেকে হঠাৎ বলে উঠলো, “বাবা, কী খুঁজছো তুমি?”
হঠাৎ ওর কথা শুনে মোসাদ্দেকসাহেব ভয় না পেলেও আচমকা কারও শব্দ শুনে একটু থতমত খেয়ে কাঁপাগলায় বললেন, “একটু আগে রুমের মধ্যে হঠাৎ একটা খস-খস খচ-খচ শব্দ হলো যেন! ভাবলাম, চোরটোর ঢুকলো কিনা—তাই, খাটের নিচটা একটু দেখছিলাম। আর দেখলাম—বাইরে কিছু আছে কিনা—বারান্দার দরজাটাও এজন্য খুলে দেখছি।”
তারপর তিনি একটু অবাক হয়ে বললেন, “কিন্তু তুই এতো রাতে! ঘুমাসনি এখনও? আর তোর মা কোথায় রে?”
অর্ণব বললো, “মা আপুনির রুমে।”
তারপরও তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন না। আসলে, তার চোখে এখনও ঘুমের ভাব রয়েছে।
মোসাদ্দেকসাহেব রুমের তল্লাসিশেষে বললেন, “যাই, এবার ছাদটা একবার দেখে আসি।”
অর্ণব তাকে বাধা দিয়ে তাড়াতাড়ি বললো, “ওসব কিছু না, বাবা। বাড়িতে কোনো চোর-ডাকাত আসেনি। তুমি এবার ঘুমাও তো। কতরকমের আওয়াজ হতে পারে। আর তোমার রুমের লাইটটা জ্বালিয়ে রাখো তো। মা বলেছেন।”
সে আবারও বললো, “মা, আপুনির রুমে শুয়েছেন। তুমি এবার ঘুমাও।”
মোসাদ্দেকসাহেব তবুও কিছুক্ষণ মশারির বাইরে বসে থাকেন।
তা দেখে অর্ণব বলে, “তুমি আবার ভয় পাচ্ছো না তো, বাবা?”
মোসাদ্দেকসাহেব এতো রাতে এবার একটু হেসে ফেললেন, আর বললেন, “যা দুষ্টু, ভাগ। আমি কোন্ বাপের ছেলে তা কি জানিস না? আজ সন্ধ্যায় না তোদের আমার বাপের কথা বললাম! আর তুই কিনা এখন আমাকে এসেছিস ভয় দেখাতে!”—বলে তিনি লাইটটা বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন।
কিন্তু অর্ণব ডিমলাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে বললো, “বাবা, এটা থাক। আর বন্ধ করবে না কিন্তু।”
মোসাদ্দেকসাহেব আর-কিছু বললেন না। তিনি তার একমাত্র ছেলের এই আদেশটা মেনে নিয়ে বাকি রাতটুকু ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই যেন তার ঘুম আসছিল না! তবুও তিনি দুচোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন।

অর্ণব বাবার কাছ থেকে ফিরে এলে—তার মা বললেন, “এবার তুই একটু ঘুমা তো।”
সে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে। কিন্তু তার ঘুম আসছে না।
ফজরের আজান হতে এখনও কিছুটা সময় বাকি রয়েছে। এইসময়টুকু সে ঘুমের চেষ্টা করতে থাকে। কাল অবশ্য ছুটির দিন—শুক্রবার। তাদের স্কুল বন্ধ। দেরিতে ঘুম থেকে উঠলেও কোনো সমস্যা নাই। তবুও সে সময়মতো ঘুম থেকে জেগে ওঠার জন্য এখন ঘুমাতে চেষ্টা করলো।

অর্ণব ঘুমিয়ে পড়েছিল—না জেগে ছিল—তা সে বলতে পারবে না। হয়তো তার একটুখানি তন্দ্রাভাব এসেছিল। এমন সময় সে খটখট একটা আওয়াজ শুনে কানখাড়া করে কিছুটা সচকিত হয়ে উঠলো। সে চোখমেলে তাকিয়ে দেখলো—ঘরের বাতিটা এখন নেভানো! তার মা ও বোন খাটে শুয়ে আরামে ঘুমাচ্ছে।

শব্দটা আসছে তার রুমের দিক থেকে। সে কাউকে কিছু না বলে খুব সাহসের সঙ্গে পা টিপেটিপে শব্দটাকে লক্ষ্য করে এগুতে থাকে। নিজের রুমের সামনে এসে সে দেখলো—এখানেও লাইট নেভানো! অথচ, এই রুমের লাইট কিছুক্ষণ আগেও জ্বালানো ছিল! তার চোখেমুখের ঘোর বিস্ময়ের ভাবটা কাটতে-না-কাটতেই সে আরও বেশি বিস্মিত হলো—যখন দেখলো—রান্নাঘরে লাইট জ্বালানো! তার মনে হলো—সেখানে কেউ-একজন কী যেন করছে! সে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না—কিন্তু একজন মানুষের উপস্থিতি বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। সে ভাবলো, হয়তো তাদের গৃহসাথী মালেকা হবে! কিন্তু এতো রাতে সে রান্নাঘরে কী করছে! সে রান্নাঘর থেকে বেশ খানিকটা দূরে—ড্রইংরুমের একমাথায় একটা বড়সড় পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে এখনও কাউকে না দেখলেও কারও চলাফেরা বেশ বুঝতে পারছে। রান্নাঘরের পানির ট্যাপ খুলে কেউ যেন কাজও করছে! হাঁড়ি-পাতিলগুলো নাড়াচাড়ার শব্দও স্পষ্ট! তার কৌতূহল বেড়ে গেলেও—সে আর সামনে এগুতে সাহস পেল না। তার একবার মনে হলো—সে মাকে ডেকে নিয়ে আসবে—কিন্তু তার আগেই সে দেখলো—একটা অপূর্ব সুন্দরী মহিলা ঘোমটা দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ড্রইংরুম পেরিয়ে তাদের বাসার মেইন গেইটের ভিতর দিয়ে কীভাবে যেন বাইরে চলে গেল! মহিলাটিকে সে স্পষ্টভাবে দেখতে পায়নি।
সে পাথরের মতো নিশ্চল ও নিশ্চুপ হয়ে সেখানেই কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর কিছুটা সম্বিৎ ফিরে পেয়ে টলতে-টলতে কোনোরকমে সোফাটার একপাশে গিয়ে বসলো।

অর্ণব সেখানেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার মা সকালে তাকে ডেকে তুললেন। শায়লা এসে বসলো তার পাশে। আর বললো, “ভাই, তুই এখানে এলি কী করে! তুই না আমাদের কাছে শুয়ে ছিলি? হঠাৎ এখানে এসে ঘুমিয়ে ছিলি কেন?”
অর্ণব হেসে বলে, “তাইতো ছিলাম, আপুনি। আমি ছিলাম তোমার রুমে। কিন্তু গতরাতে হঠাৎ একটা খটখট আওয়াজ শুনে এখানে এসেছিলাম। তারপর কে যেন আমার দুচোখে রাজ্যের ঘুম নামিয়ে দিয়েছিল যে—আমি আর তোমাদের কাছে ফিরে যেতে পারিনি। এখানে, কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!”
শায়লা খুব অবাক হয়ে বলে, “সত্যি! আবার কিছু দেখে ছিলি নাকি?”
অর্ণব হেসে বললো, “একেবারে সত্যি বলছি। গতরাতে আমি আরেকজনকে দেখেছি!”
এমন সময় রাশিদা বানু এসে বসলেন ওদের কাছে।
তারপর সে গতরাতের শেষঘটনাটা মাকে ও বোনকে খুলে বললো।
সব শুনে ওর মা গম্ভীর হয়ে বললেন, “এই মহিলাটাকে আমিও একদিন দেখেছিলাম! তবে এর পুরা চেহারাটা কিংবা মুখমণ্ডলটা কখনো দেখা যায় না! সবসময় কেমন যেন লম্বা-মতোন একটা ঘোমটা দেওয়া থাকে তার মুখ ও মাথা ঢেকে!”
শায়লা বললো, “এ-কে আমি তো কখনো দেখিনি!”
মা বললেন, “না দেখাই তো ভালো রে, মা!”
অর্ণব বলে, “তাইতো, মামণি ঠিকই বলেছেন। এ-কে দেখলে গা-টা কেমন যেন শিরশির আর ছমছম করতে থাকে! কী নীরব একটা ছায়ামূর্তির মতো দেখতে সে! কিন্তু মানুষের রূপেই তাকে দেখেছি! আর তার হাত-পা-গায়ের রঙ এতো সুন্দর যে—চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে!”
শায়লা বলে, “ওটাকে তোর খুব পছন্দ হয়েছে বুঝি?”
রাশিদা বানু একথা শুনে মেয়েকে মিষ্টি করে ধমকে বলেন, “চুপ কর তো। ও তো ঠিকই বলেছে। এই মহিলা দেখতে এতো সুন্দর! আমিও তার সবিকছু দেখেছি—কিন্তু শুধু মুখমণ্ডলটি দেখতে পাইনি।”
অর্ণব বললো, “মামণি, তুমি এ-কে কয়বার দেখেছো?”
রাশিদা বানু কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বললেন, “কমপক্ষে তিন-চারবার হবে রে।”

এমন সময় ওদের বাবা মোসাদ্দেকসাহেব ড্রইংরুমে প্রবেশ করে বললেন, “তোমাদের এতো হৈচৈ আর এতো শোরগোল কীসের? আর কীসের এতো গল্প জমিয়েছো এখানে?”
রাশিদা বানু একটু মুখটিপে হেসে বলেন, “শোনো, আমাদের এই বাড়িটাতে আমরা ছাড়াও আরও অনেক অতিথি আছে! তাদের নিয়ে এতো কথা হচ্ছে।”
মোসাদ্দেকসাহেব হঠাৎ এরকম একটা কথার কোনো আগামাথা বুঝতে না পেরে বললেন, “বুঝলাম না! ঠিক কী বলতে চাচ্ছো তুমি!”
রাশিদা বানু আবার কিছু গুছিয়ে বলার আগেই শায়লা হেসে বলে, “বাবা, আমাদের এই বাড়িটাতে কেউ-একজন আছে। মানে, আমরা ছাড়াও অন্য কেউ!”
মোসাদ্দেকসাহেব একথা শুনে মেয়ের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ।
তার এই হাবভাব দেখে শায়লা আবার বলে, “বাবা, তুমি তো খুব বোকালোক! এখনও বোঝোনি! আমাদের এই স্বপ্নের বাড়িটাতে কারও-কারও আত্মা আছে। আর সেটা দিনে-রাতে কখনো-কখনো ঘোরাফেরা করে! আত্মাটা আমাদের চোখের সামনেও পড়েছে অনেকবার! এই বাড়িটাতে ওঠার পর আমি, মা আর অর্ণব—তিনজনই তা দেখেছি।”
মোসাদ্দেকসাহেব এবার একটু নড়েচড়ে বসলেন আর বললেন, “এতোক্ষণে বুঝেছি। আর হ্যাঁ, এখন আমার মনে পড়ছে—গতরাতে একটা খটখট শব্দে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যায়! আমি জেগে দেখি, তোদের মা বিছানায় নাই। ভাবলাম, হয়তো সে ওয়াশরুমে গেছে। এইসময় আমি তার কথা না ভেবে বিছানাছেড়ে উঠে পড়লাম। আর খুব দ্রুত খাটের নিচ থেকে শুরু করে বারান্দার দরজা খুলে দেখলাম—কোথাও চোরটোর ঢুকেছে কিনা! এমন সময় অর্ণব এলো। ওর মুখে শুনলাম, রাশিদা, শায়লার রুমে। এতে আমি আর-কিছু না ভেবে লাইট বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়লাম। অর্ণব আমার রুমে ডিমলাইটটা জ্বালিয়ে রাখলো। এবার বুঝলাম, আমি যাতে ভয় না পাই—সেজন্য অর্ণব গতরাতে এটা করেছিল! আর এখন আমার মনে হচ্ছে—রুমের ভিতরের খটখট শব্দটা কোনো ভুল ছিল না—আর আমি কোনো ভুল শুনিনি। এটা খুবই স্পষ্ট আর বেশ জোরালো ছিল।”
কথা শেষ করে মোসাদ্দেকসাহেব আবার বলতে থাকেন, “এতো শখ করে তোমাদের জন্য বাড়িটা কিনলাম! শেষে এই ছিল আমাদের কপালে!”
স্বামীর হতাশায় আশার আলো জ্বেলে দিতে রাশিদা বানু বললেন, “তুমি এখনই এতো হতাশ হচ্ছো কেন? একটা বিষয় কিন্তু পজিটিভ আছে—আত্মাটা এখনও আমাদের কারও-কোনো ক্ষতি করেনি। শুধু তার উপস্থিতি আমরা টের পাচ্ছি! আর সে যেন এই বাড়ির সদস্য—এইভাবে সে চলাফেরা করছে। চেষ্টা করলে এরও একটা বিহিত আমরা করতে পারবো।”
মোসাদ্দেকসাহেব ভেবেচিন্তে বললেন, “তাইলে তো একটা হুজুর ডাকতে হয়!”
কথাটা শোনামাত্র রাশিদা বানু তাতে বাধা দিয়ে বললেন, “তাতে কোনো লাভ হবে না। এর আগে আমি গোপনে তোমাদের কাউকে না জানিয়ে একটা হুজুর ডেকেছিলাম। আসলে, এরা কিছু জানে না। এরা কোনোকিছু না বুঝে—শুধু বলে জ্বীনের উৎপাত! সব টাকা খাওয়ার ধান্দা।”
মোসাদ্দেকসাহেব খুব চিন্তিতমুখে বললেন, “তাইলে কাকে ডাকা যায়?”
সবাই যখন ভাবনাচিন্তায় ব্যস্ত—তখন অর্ণব বললো, “বাবা, তোমার গুরুজীকে ডাকলে কেমন হয়। তুমিইতো বলেছিলে—তিনি একজন আধ্যাত্মিক মানুষ আর আত্মাবিষয়ক গবেষক।”
কথাটা শুনে মোসাদ্দেকসাহেব প্রায় লাফিয়ে উঠে বললেন, “শাবাশ বাবা, শাবাশ, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। এইব্যাপারে গ্রান্ডমাস্টার হলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় গুরুজী—অধ্যাপক লিটু মিয়া। নাশতা শেষ করে তাঁকে ফোন করবো—দেখি তিনি কবে আসতে চান।”
শায়লা মনভার করে বলে, “বাবা, কবে না—তাঁকে আজকালের মধ্যেই একবার আসতে বলো।”

রাশিদা বানু বললেন, “নাশতার টেবিলে চলো সবাই। খেতে-খেতে বাকি কথা হবে।”
ওরা একসঙ্গে উঠে পড়লো।
ওদের নাশতার মাঝামাঝি অবস্থায় দরজায় কলিংবেল বাজলো।
অর্ণব উঠতে যাচ্ছিলো। রাশিদা বানু তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই গেলেন গেইট খুলতে। লুকিং গ্লাসে আগে দেখে নিলেন। তারপর হাসিমুখে দরজা খুললেন।
তার বড়বোনের ছেলে সাদমান এসেছে। তাকে দেখে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন রাশিদা বানু। তারপর তাকে বসতে দিলেন নাশতার টেবিলে।
সাদমান একগাল হেসে—কেমন আছেন খালুজান?—বলে মোসাদ্দেকসাহেবের দিকে তাকালেন। এরপর সে শায়লার দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি কেমন আছো?”
শায়লা কিছু বললো না। শুধু ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো।
অর্ণব বলে, “সবাই ভালো আছে। এবার আপনি কেমন আছেন—তা-ই বলেন।”
সে হেসে বলে, “আমি ভালোই আছি। তবে এখনও মনের মতো একটা চাকরি পাচ্ছি না বলে কিছুটা হতাশ। আসলে, আমাদের এই দেশে ভালোকিছু করার মতো...।”
এবার মোসাদ্দেকসাহেব কিছুটা ধমকের সুরে তাকে আগেভাগে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “থামো তো, বাবা, তোমাদের এইসব নোংরা কথা শুনলে আমাদের পিত্তি জ্বলে যায়। তোমরা তো দেশের শিক্ষিত যুবক! তবুও তোমাদের কারও কোনো স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটলেই এই দেশটাকে গালমন্দ করো! তোমাদের লজ্জা করে না? কত রক্তের বিনিময়ে আমরা এই দেশটাকে পেয়েছি। আসলে, তুমি নিজেও তো বড়সড় অকৃতজ্ঞ। এই দেশে বসে তুমি—আর তোমার মতো একটা সাধারণ ছেলে পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা-বেতনের চাকরি করছো—তবুও তোমাদের মধ্যে কোনো কৃতজ্ঞতার একটু বালাই নাই! এই দেশ তোমাদের আর কত দিবে? তুমি বা তোমরা দেশকে কী দিয়েছো? কিছু মনে কোরো না, বাবা, একাত্তরে আমি মুক্তিযুদ্ধ করতে পারি নাই ঠিকই—কিন্তু আমার বড় সকল চাচাতো, মামাতো, খালাতো ভাই তখন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আমাদের আপন দুই চাচাতো ও এক খালাতো ভাই একাত্তরে শহীদও হয়েছেন। আমরা জানি, তাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের আজকের এই দেশ। আর এই দেশকে—তোমরা একটা ছুতানাতায় কিংবা দেশের ভিতরে কিছু-একটা হলেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে থাকো! তোমাদের স্পর্ধা কত! মনে রাখবে: বহু রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই দেশ। আসলে, দেশের কি দোষ—আমরা কি এখনও ভালো হতে পেরেছি?”
দিনের শুরুতেই একেবারে ক্লিন বোল্ড হয়ে সাদমান এখন আমতা-আমতা করতে থাকে।
মোসাদ্দেকসাহেব এবার তাকে নাশতার আমন্ত্রণ জানালেন। ‘একটু আগে খেয়ে এসেছি’ বলে—সে একটু নিমরাজীভাব দেখায়। কিন্তু মোসাদ্দেকসাহেব আবার তাকে স্নেহের সুরে বলেন, “আরে, খাও তো। তোমাদের তো এখন খাওয়ারই বয়স। এই বয়সে রুটি-পরোটা গুনে খাবে না। যত পারো খেয়ে যাও। পরে বয়স হলে একটু হিসাব করে খেয়ো।”
সে হাসিমুখে এবার নাশতা খেতে শুরু করে। মোসাদ্দেকসাহেবের স্নেহের কাছে সে পরাজিত হলো।
রাশিদা বানু বললেন, “আব্বু, তোমার খালুজানের সামনে কখনো দেশের বিরুদ্ধে কিছু বলবে না। তাইলে তিনি রেগে যান। তার রাগটা অমূলক নয়—আমরা ভালো হলে দেশটাও ভালো হবে। আর এসব বাদ দিয়ে এখন অন্যকথা বলো।”
হঠাৎ অর্ণব প্রায় লাফিয়ে উঠে বলে, “ভাইয়া, সস্তা-রাজনীতির কথা বাদ দিয়ে আত্মার কথা বলেন তো। আত্মাবিষয়ে কিছু জানেন কিনা? জানলে, আমাকে এখনই বলেন।”
সাদমান বলে, “হঠাৎ আত্মার কথা কেন?”
অর্ণব বলে, “দরকার আছে, ভাইয়া। জানলে কিছু বলেন।”
সাদমান বলে, “নাহ, আত্মাটাত্মায় আমার এতো বিশ্বাস নাই। মরার পরে আত্মাটাত্মা বলে আর-কিছু থাকে না। এসব মানুষের উদ্ভট চিন্তা।”
তার কথা শুনে অর্ণব একেবারে হতাশ হলো।
আর একথা শুনে মোসাদ্দেকসাহেব এবার রাগাণ্বিত না হয়ে হেসে বললেন, “বাবা, তুমি একজন ইঞ্জিনিয়ার! কতকিছুর নকশা-ডিজাইন বোঝো—কিন্তু মানবদেহের নকশা কেন বোঝো না?”
সাদমান তবুও বলে, “আসলে, খালুজান, আমি এসবে বিশ্বাস করি না। মরার পরে সব শেষ। আর মরার পরে আত্মা আসবে কোত্থেকে?”
অর্ণব বলে, “আমাদের বাবা তো বলেন—আত্মা অমর—আত্মা কখনো মরে না। আমাদের বাবার একজন নামকরা গুরুজী রয়েছেন। তিনি বাবাকে এসব বলেছেন। তাঁর কথাগুলো আমরা বাবার মুখে শুনি। আমিও কিছু-কিছু বইয়ে আত্মার অমরত্বের কথা পড়েছি। আর আপনি কোনো প্রমাণ ছাড়াই এখন বলছেন—মরার পরে সব শেষ! আত্মাও শেষ! এটা কীভাবে সম্ভব? আপনার কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনি কি পৃথিবীর ধর্মগ্রন্থগুলোর চেয়েও বড়?”
অর্ণবের অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তার সামনে পড়ে সাদমান কেমন যেন একটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। সে এবিষয়ে আপাততঃ আর-কিছু বলার সাহস পেল না।
মোসাদ্দেকসাহেব ছেলের পারফরম্যান্সে যারপরনাই সন্তুষ্ট।
খাওয়ার একফাঁকে সাদমান বলে, “আজকাল অনেকে বলে—সে নাকি আত্মাটাত্মা দেখেছে—আমার এসব বিশ্বাস হয় না। আত্মা থাকলে তো দেখবে!”
ওর কথায় মোসাদ্দেকসাহেব এবার জোরে হেসে ফেললেন। আর বললেন, “বাবা, তুমি কখনো শক্তিশালী কোনো-একটা আত্মার কবলে পড়লে বুঝবে—আত্মা কাকে বলে—আর উহা কত প্রকার ও কী-কী? আর তখন তুমি, আত্মার সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, চরিত্র, মাহাত্ম্য ইত্যাদি বর্ণনা করতে থাকবে। এরকম আমি অনেক দেখেছি। আর সবখানে গায়ের জোর খাটে না, বাবা।”
সাদমান ইতোমধ্যে দুই-তিনটা পরোটা সাবাড় করে ফেলেছে। সে আরেকটা পরোটা ধরে নিজের যুক্তিতে স্থির থাকার জন্য তবুও বলতে লাগলো, “খালুজান, আপনিই বলুন—এই বিজ্ঞানের যুগে ভূতপ্রেত বা আত্মাটাত্মা বলে কিছু আছে? এগুলো তো গ্রাম্যলোকদের কুসংস্কার। আমি এসবের মধ্যে নাই। আমার কাছে এইব্যাপারগুলোকে একদম হাস্যকর ও খুব খেলো বলে মনে হয়।”
শায়লা এবার মুখ খুললো—“তাইলে, মানুষ যে নিজের চোখে অনেককিছু দেখে—আপনার কাছে তার কোনো মূল্য নাই? সবটাই বুঝি অজ্ঞতা?”
সাদমান বলে, “মূল্য থাকতো—যদি এর পিছনে কোনো-একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকতো। কিন্তু এইসব ঘটনার তো কোনো প্রমাণ নাই। পারলে, তুমি আমাকে একটা আত্মা দেখাও তো।”
শায়লা বলে, “ঠিক আছে, আপনি একটু ধৈর্য ধরুন। আর আজ আমাদের বাসায় থাকবেন কিন্তু। রাতে আপনাকে আত্মা দেখাবো।”
সাদমান এবার হো-হো করে হেসে ওঠে। আর বিদ্রুপের সুরে বলে, “কেন? কেন? হঠাৎ এসব বলছো কেন? তোমাদের বাসায় কোনো আত্মাটাত্মা আবার বাসাভাড়া নিয়েছে নাকি?”—কথাটা শেষ করেও সে হাসতে থাকে।
শায়লা বলে, “না, এখনও বাসাভাড়া নেয়নি। তবে আজ রাতে নিতে পারে। আর আপনি যখন এসে পড়েছেন—তখন ওরা আপনার সঙ্গে কথাও বলতে পারে। আমরা তো এসবকে একটু ভয়টয় পাই। তাই, ওদের সঙ্গে কথা বলা হয়নি।”—এরপর সে সবার দিকে চেয়ে হাসতে লাগলো।
অর্ণব বললো, “ঠিক আছে, ভাইয়া। আপনি আজ রাতে আমাদের বাসায় অবশ্যই থাকবেন। তারপর রাতে আপনাকে আপুনির ঘরে থাকতে দেওয়া হবে।”—সেও একটু হাসলো।
সাদমান বলে, “আহা, এ আর এমন কী ব্যাপার! আমি আজ কেন—কয়েকদিন এখানে থাকতে এসেছি। বেড়াতে এসেছি, ভাই। তোমাদের এতোবড় বাড়ির ছাদে একটু ঘোরাফেরা করবো। আরামে থাকবো কয়েকদিন।”
সে বলে, “অবশ্যই ভাইয়া আপনি থাকবেন। এতে আমরাও খুশি। কিন্তু আপনি আজ রাতে থাকবেন আপুনির রুমে।”
সাদমান বলে, “ঠিক আছে, তা-ই হবে।”
মোসাদ্দেকসাহেব শুধু হেসে বললেন, “থাকো, বাবা। কিন্তু শেষে আবার ভয়ে কাউকে-কিছু না বলে পালিয়ে যেয়ো না।”
স্বামীর কথা শুনে রাশিদা বানু মুখটিপে হাসেন। শেষে তিনিও বললেন, “সব ব্যাপারে এতো সাহস দেখাতে নাই, আব্বু। পৃথিবীতে এমন অনেককিছু ঘটে—যার কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মানুষ দিতে পারে না। এগুলো আমিও বইয়ে পড়েছি। আমাদের অর্ণব কতরকম বইপত্র কেনে। মাঝে-মাঝে এর থেকে দুই-চারখান তো আমিও পড়ি। তুমি এসব বিষয়ের বই পড়োনি?”
সাদমান বলে, “না, খালামণি। এসব আমার বিশ্বাস হয় না বলে—তেমন-একটা পড়াও হয় না। আর সাহিত্য-দর্শনের বেশিরভাগ বই আমি পড়ি না। আমার ভালো লাগে বিজ্ঞান।”
নাশতাশেষে মোসাদ্দেকসাহেব উঠে পড়লেন। তারপর তিনি ভিতর-রুমে ঢুকলেন। আর ফিরেও এলেন খানিকটা পরে। এসে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের জন্য একটা সুখবর আছে। আগামীকাল দুপুরের দিকে আমাদের গুরুজী এখানে আসতে রাজী হয়েছেন। তিনি সরাসরি কলেজের ক্লাসশেষে আমাদের বাসায় হাজির হবেন। আমি খুব সংক্ষেপে আমাদের বাড়িতে এযাবৎ ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর কিছুটা তাকে বলেছি—তিনি এবিষয়ে এখন থেকেই ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন।”
কথাটা শোনার পর শায়লা আর অর্ণব ভীষণ খুশিতে একেবারে হাততালি দিয়ে ফেললো। এমনকি রাশিদা বানু পর্যন্ত খুশি হলেন। তার মুখ দেখে তা বোঝা গেল।

মোসাদ্দেকসাহেব ড্রইংরুমে বসে টিভি ছেড়ে তা মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন। তবুও মাঝে-মাঝে অর্ণবের সঙ্গে সাদমানের আত্মাবিষয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা ও আলোচনা তার কানে আসলো। তার গুরুজীকে নিয়েও সাদমান অনেক প্রশ্ন করছে। তবে এই বিষয়ে তার কোনো বেআদবি এখনও প্রকাশ পায়নি। এজন্য তিনি মনে মনে স্বস্তিভাব অনুভব করলেন। আর ভাবলেন—এইসব ছেলে কবে একটু বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে? এরা শুধুই সার্টিফিকেটধারী সাধারণ শিক্ষিত মাত্র। জ্ঞানের ছিটেফোঁটাও এদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় না। এরা কথায়-কথায় আজ শুধু তর্ক করতে শিখেছে! আর দম্ভভরে ভাবছে—তর্ক করতে পারলেই বুঝি খুব বুদ্ধিমান হওয়া যায়!

সাদমান নাশতা শেষ করে রাশিদা বানুর দিকে তাকিয়ে বলে, “খালামণি, তুমিও কি ওই আত্মাটা দেখেছো?”
রাশিদা বানু কোনোরকম ভনিতা না করে সোজাসাপটা বললেন, “হ্যাঁ, আব্বু, আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি। আর তোমার বোনতো দেখেছে আরও বেশি। আর আত্মাটা সবসময় শায়লার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে।”
এইরকম একটা সিরিয়াস কথা শুনেও সাদমান খুব শব্দ করে হেসে উঠলো। তার মনে হলো—জগতে এরচেয়ে হাসির আর কোনোকিছু নাই। তাই, সে কিছুক্ষণ একাকী মনভরে হাসলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে—কেউ ওর হাসিতে শরীক হলো না। সবাই বরঞ্চ আরও গম্ভীর হয়ে ডাইনিং টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লো।
শায়লা গিয়ে বসলো তার বাবার পাশে। আর অর্ণব নিজের রুমে ঢুকলো।
রাশিদা বানু খুব কাজের লোক। তিনি কোনো কাজ মুহূর্তের জন্য ফেলে রাখেন না। তাই, মালেকাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি দুপুরের আহার প্রস্তুত করার কাজে লেগে পড়লেন। তিনি ঘড়ি দেখলেন—আজ সকালের নাশতা শেষ করতে তাদের সাড়ে দশটা বেজে গেছে! তারউপরে আজ জুম্মার দিন। একটু আগেভাগে সবকিছু প্রস্তুত করতে হবে। জুম্মার দিন মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে এসে—দুপুরের খাবার খাওয়াটা মোসাদ্দেকসাহেবের দীর্ঘদিনের একটা অভ্যাস। এসব ভেবেই রাশিদা বানু নিজের কাজে মত্ত হয়ে গেলেন।
আর মালেকা মেয়েটিও খুব কাজের হওয়ায় তাদের এতোবড় বাড়িটা এখন দেখেশুনে-গুছিয়ে রাখতে তেমন-কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তারা দুজন মনের আনন্দে কাজ করে।
সাদমান কিছুক্ষণ টিভি দেখার পর উসখুস করতে থাকে। সে খুব গল্পবাজ ছেলে। কথা না বলে সে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। আবার তার খালুজানের সামনে বেশি কথা বলাও যায় না। উপায়অন্তর না দেখে সে শায়লাকে ছাদে যাওয়ার ইশারা করতে থাকে।
শায়লা তার ইশারা বুঝেও চুপ করে থাকে। শেষে তার বাবা বললেন, “যা-না, মা। ওর সঙ্গে ছাদটা একবার ঘুরে আয়। মনটাও ভালো লাগবে।”
বাবার কথায় নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও শায়লা উঠে পড়লো।
ছাদে গিয়েই সাদমান কথার জালে শায়লাকে পাকড়াও করার চেষ্টা করে বলে, “তুমি একটা আধুনিক শিক্ষিত মেয়ে হয়েও এসব আত্মাটাত্মায় এতো বিশ্বাস করো? আমার ভাবতে অবাক লাগছে!”
শায়লা একটু ঝাঁঝের সঙ্গে বলে, “আপনি এসব দেখেননি বলেই এতো বাহাদুরি দেখাচ্ছেন। যদি একবার দেখতেন, তবে...।” আসল কথাটা বলতে গিয়ে সে কিছু-একটা লুকিয়ে তাকে অন্যভাবে বললো, “তবে আপনার চেহারাটা বদলে যেত। এতো বাহাদুরি আপনার থাকতো না।”
সাদমান বলে, “কালও আমার অফিসছুটি আছে। আর প্রয়োজনে ছুটি নিয়ে আরও কয়েকদিন এখানে থাকবো। তবুও তোমাদের আত্মাবন্ধুকে দেখে যাবো। আর আজ রাতে বিশেষভাবে দেখবো—তোমাদের আত্মাবাবাজীর কত সাহস! আমি এইরকম একটা কেস আজ কিছুতেই হাতছাড়া করবো না।”
শায়লা বলে, “দেখলে খুব খুশি হবো। আমরাও আপনার সাহস দেখতে চাচ্ছি।”
হঠাৎ অর্ণব এসে পড়ায় সাদমান যেন কিছুটা দমে যায়। তবুও সে খুশি-খুশি-ভাব দেখিয়ে বলতে লাগলো, “এসো, হে আত্মাবিষয়ক আলোচক। তোমার কাছ থেকে কিছু জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনি।”
অর্ণবও কম যায় না। সে মুচকি হেসে বলে, “আপনি বিজ্ঞানীমানুষ। আপনার কাছে পৃথিবীটা একেবারে সহজপাঠ মনে হয়। তাই, আপনার কথা শুনতেই আমি এখন ছাদে এসে দাঁড়িয়েছি। হে আমাদের মহান বিজ্ঞানী, আমাকে কিছু জ্ঞানদান করুন!”
অর্ণবের অভিনয় দেখে শায়লা হেসে খুন।
সাদমান দমবার পাত্র নয়। সে মুখে জোর করে হাসি এনে বলে, “ইঞ্জিনিয়ার যখন হয়েছি—তখন আমাদের বিজ্ঞানীও বলা যায়। কিন্তু তুমি কবে থেকে এভাবে একজন আত্মাবিষয়ক রেডিমেট দার্শনিক হয়ে উঠলে? তা কি বলা যায়, ভায়া?”
অর্ণব বলে, “কবে থেকে আবার! এই তো বই পড়তে-পড়তে।”
সাদমান বিদ্রুপ করে বলে, “তোমাকে এখন থেকে আত্মাবিজ্ঞানী বলে ডাকবো নাকি?”
অর্ণব এবার একটু গম্ভীর হয়ে ধীরস্থিরভাবে বলতে লাগলো, “না-না, এতোবড় খেতাবের অধিকারী আমি এখনও হতে পারিনি। কিন্তু আগামীকাল দুপুরে যিনি আমাদের বাড়িতে আসছেন—তিনি হলেন প্রকৃত আত্মাবিজ্ঞানী। পারলে তার সঙ্গে কাল একটু কথা বলবেন।”
সাদমান খুব জোরের সঙ্গে বললো, “অবশ্যই কথা বলবো। আর দেখবে, কাল তাকে আমি এমন সব প্রশ্ন করবো যে—তিনি তার জবাব দিতে না পেরে বাড়ি ছেড়ে পালাবেন।”
অর্ণবও ফোঁড়ন কেটে বলে, “আচ্ছা দেখা যাবে—কে, কাকে দেখে—কখন বাড়ি ছেড়ে পালায়!”

দুপুরে খাবার-টেবিলে সাদমান ইচ্ছে করে আত্মার প্রসঙ্গটা উঠালো। সে ইনিয়েবিনিয়ে বলতে লাগলো, “মানুষ আধুনিক না হলে সমাজপরিবর্তন হবে না। আমাদের রাষ্ট্রও বেশিদূর যেতে পারবে না। এখন মানুষ বিজ্ঞানচর্চা বাদ দিয়ে কেন যে আত্মাটাত্মা নিয়ে পড়ে আছে!”
ওরা সবাই খাচ্ছিলো। কেউ তেমনকিছু বললো না। এজন্য সে কিছুটা হতাশ হলো।
সে আবার খোঁচামেরে বলে, “কেউ কোনোদিন জীবিত আত্মাই দেখেনি! আর মরার পরে নাকি আত্মাটাত্মা বাড়িতে-বাড়িতে ঘোরাফেরা করে! আজকাল কী যে শুনছি এসব!”
মোসাদ্দেকসাহেব হাসিমুখে বলতে লাগলেন, “ঠিকই শুনছো, বাবা। সবাই তো তোমার মতো বিজ্ঞানী নয় যে—আত্মার জগৎ ছেড়ে চাঁদে কিংবা মঙ্গলে গিয়ে বাস করবে। সেখানে তো এখনও আত্মার সন্ধান পাওয়া যায়নি। তুমি চেষ্টা করলে মঙ্গলগ্রহে চলে যেতে পারো—তাইলে, আত্মার মতো জটিল বিষয় নিয়ে তোমাকে এতো জটিলতায় পড়তে হবে না।”
এবার শায়লা ও অর্ণব একসঙ্গে শব্দ করে হেসে উঠলো।
দিনের মধ্যভাগে আরেকবার বোল্ডআউট হয়ে সাদমান মনের দুঃখে ভাত খেতে লাগলো। আর সে হয়তো এখন মনে মনে রাতের অপেক্ষা করছে। কোনোমতে আজকের এই রাতটা পার করতে পারলে সে সবাইকে আচ্ছামতো জব্দ করতে পারবে। আর তখন সে সুউচ্চকণ্ঠে বলতে পারবে—আসলে, আত্মা বলতে কিছু নাই।
সাদমান আত্মায় বিশ্বাস না করলেও তার ধর্মবিশ্বাস আছে। এজন্য সে আজ তার খালুজান ও অর্ণবের সঙ্গে মসজিদে গিয়ে জুম্মার নামাজ পড়ে এসেছে।

রাশিদা বানু তার বোনের এই ছেলেটিকে খুব পছন্দ করেন। স্নেহও করেন অত্যধিক। এজন্য তিনি সবসময় তাকে ‘আব্বু’ বলে সম্বোধন করে থাকেন। কিন্তু আজ তার বোকামি দেখে তিনি নিজেও লজ্জিত হলেন। তবে তিনি মুখফুটে আর-কিছু বললেন না। এটাকে ওদের ভাইবোনের রসিকতার মধ্যেই রেখে দিলেন।

রাতের খাবার খেয়ে সাদমান কারও কোনো কথা না শুনে শায়লার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো। সে অর্ণবের কাছ থেকে একটা ডিটেকটিভ বইও চেয়ে নিলো। যাতে, সারারাত সে না ঘুমিয়ে আত্মার দর্শনলাভ করতে পারে। বিছানায় শুয়ে সে মাঝে-মাঝে একা-একা হাসছিল।
তার হাসির শব্দ শুনে তার খালামণি রাশিদা বানু ছুটে এলেন। তিনি তার হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করতেই সে বলতে লাগলো, “খালামণি, তোমাদের আত্মা তো আসছে না। রাত তো সাড়ে দশটা বেজে গেল। নাকি আমার ভয়ে সে আজ এই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে!”—আবার তার হাসির ফোয়ারা ছুটতে লাগলো।
রাশিদা বানু এবার খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, “বাবা, তুমি জিদের বশে হয়তো এই কাজটি করছো। কিন্তু ব্যাপারটা অনেক ভয়ের। তাই, আমি বলি কি—তুমি অন্য একটা রুমে গিয়ে ঘুমাও। আমাদের এতোবড় বাড়িটাতে এখনও কত রুম খালি পড়ে রয়েছে। তুমি অন্য রুমে গিয়ে ঘুমাও, আব্বু।”
সাদমান একথা শুনে হাসতে-হাসতে বললো, “খালামণি, তুমি যাও তো বিছানায় গিয়ে ঘুমাও। আর খালুজানকে একটু পাহারা দাও গে। আমি ঠিক আছি। আমার জন্য কোনো চিন্তা করতে হবে না। আমি তো ভালো আছি। আর ভালোই থাকবো। তুমি যাও।”
অগত্যা খুব মনখারাপ করে—ভীষণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও রুম থেকে বেরিয়ে এলেন রাশিদা বানু।

মাকে খুব মনখারাপ করে রুমে ঢুকতে দেখে শায়লা বললো, “কী হলো মা? সে কি আমার রুমটা ছাড়বে না?”
রাশিদা বানু এবার আরও মনখারাপ করে বললেন, “না। ছাড়বে না। ওর জন্য আমার খুব ভয় করছে রে। যদি একটাকিছু হয়ে যায় রে!”
মোসাদ্দেকসাহেব বললেন, “আমি কি একবার যাবো? কাছে গিয়ে ও-কে বুঝিয়ে বলি।”
রাশিদা বানু বললেন, “না। তার দরকার নাই। সে আমার কথাই শুনলো না। ও এখন খুব জেদি হয়ে ওখানে বসে আছে। হয়তো তোমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টাও করতে পারে। থাক, তারচে না যাওয়াই ভালো। কিন্তু কী যে করি!”
শায়লা বললো, “তাইলে মামণি, তাকে থাকতে দাও। আর ভয় পেলেও সে মরবে না। তার নার্ভ শক্ত আছে। তাছাড়া, সে তো খুব সাহসীমানুষ। আমাদের এতো চিন্তা করে লাভ কী?”
মোসাদ্দেকসাহেবও তা-ই বললেন—“তাকে থাকতে দাও।”
শায়লা বহু বছর পরে আজ বাবা-মার সঙ্গে ঘুমাবে। সে মায়ের পাশে শুয়েছে। এখানে, প্রচুর জায়গা আছে। আর তাদের এই খাটটাও অনেকবড়। ওর মনে আছে—ছোটবেলায় ওরা সবাই এই একখাটে একসঙ্গে ঘুমাতো।

বিছানায় শুয়েও রাশিদা বানু মনখারাপ করছিল সাদমানের জন্য।
মায়ের এই মনখারাপের ভাব দেখে শায়লা হঠাৎ বিছানায় উঠে বসলো। তারপর সে মায়ের দিকে মায়াভরাচোখে তাকিয়ে বললো, “মা, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে?”
ওর মা সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, “কী? কী রে?”
শায়লা কোনোরকম ভনিতা না-করে বলে, “মা, তুমি এখনই বড়খালাকে ফোন দাও। তিনি তার ছেলেকে বুঝিয়েশুনিয়ে অন্যরুমে পাঠিয়ে দিবেন।”
কথাটা শোনামাত্র রাশিদা বানু যারপরনাই খুশি হয়ে তখনই বড়বোনকে ফোন করলো। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতে বেশি সময় লাগলো না। তারপর তিনি বড়বোনকে খুব সংক্ষেপে তাদের বাড়ির ঘটনাটা বলে ফেললেন।
আর সব শুনে তার বড়বোন বললেন, “তুই এতো চিন্তা করিস না, বোন। বিষয়টা আমি দেখছি।”
এবার রাশিদা বানু যেন একটু শান্তিতে ও নিরাপদে ঘুমাতে পারবে।
ওরা সামান্য একটু পরেই শায়লার রুমে ফোন রিসিভ হতে শুনলো।
তারপর ওরা গল্প করতে-করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লো।

রাত বারোটার পরে সাদমান দেখলো—আত্মা বাহির হওয়ার কোনো আলামত নাই। সে হাতের বইখানা বন্ধ করে একটু কাত হয়ে শুয়ে মোবাইল-ফোনটা চালু করে ফেসবুক খুলে বসলো। যেকারও টাইম-পাস করার এই এক যন্ত্র!
এরই মধ্যে অর্ণব পাশের রুম থেকে এসে সাদমানকে দুই-তিনবার দেখে গেছে।

রাত তখন আনুমানিক তিনটা হবে। হঠাৎ একটা বিজাতীয় ‘ফ্যাস-ফ্যাস’ শব্দ শুনে সাদমানের ঘুম ভেঙে গেল! এইসময় তার মনে পড়লো—সে মোবাইলে ফেসবুক দেখছিল। কিন্তু কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে! সে কানপেতে আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলো—এটা কোনো বিড়ালের ‘ফ্যাচ-ফ্যাচ’ শব্দ। এরপর কিছুটা ভয়ের সঙ্গে সে বিছানার ওপর বসে আরও ভালোভাবে তা বুঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু সে আর-কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই বিড়ালটা এমন জোরে বিকটভাবে ‘ফ্যাচ-ফ্যাচ’ শব্দ করে উঠলো—তাতে একনিমিষে সাদমানের গায়ের সমস্ত রক্ত যেন হিম হয়ে এলো। তারপর বিড়ালটা তার মাথার দিকের জানালাটার কাচ ঘষে-ঘষে অতিবিকটভাবে সমস্ত এলাকা কাঁপিয়ে, দাপিয়ে ও মাতিয়ে একনাগাড়ে ফ্যাচ-ফ্যাচ, খ্যাচ-খ্যাচ, ফ্যাচ-ফ্যাচ শব্দ করতে লাগলো! আর একমুহূর্তের মধ্যে বিড়ালটা যেন জানালার কয়েকটি কাচও ভেঙে ফেললো! তারপর আরও কয়েকটি ভাঙলো। এভাবে সে যেন জানালার সব কাচ ভাঙছে! ঘরের ভিতরে একটা পানিভর্তি কাচের বড়সড় জগ ছিল—মুহূর্তের মধ্যে সেটা ভেঙে চুরমার হওয়ার শব্দও সে শুনতে লাগলো! এমনকি তার মাথার দিকের বন্ধ জানালাটা হঠাৎ যেন একটা প্রচণ্ড দমকা বাতাসে খুলে গেল! সে এবার বিছানাছেড়ে একলাফে মেঝেতে পড়ে আবার কোনোরকমে একটু উঠে দাঁড়িয়ে তার খালামণির রুমের দিকে দৌড় দিলো। তখনও তার পিছনে বিড়ালের সেই ভয়ংকর ‘ফ্যাচ-ফ্যাচ’ শব্দ হচ্ছিলো!
সে কোনো ভদ্রতার বালাই না রেখে দৌড়ের বেগে সোজা খালামণির রুমের ভিতরে ঢুকে পড়লো। তার শরীর খুব কাঁপছিল। তবুও সে মনের জোরে এই পর্যন্ত আসতে পেরেছে।
এরপর সে কোনোরকমে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, “খালামণি! খালামণি! খালামণি!”
আর তখনই প্রায় একসঙ্গে ঘুম ভেঙে গেল—মোসাদ্দেকসাহেব ও শায়লার। তারা ধচমচ করে জেগে উঠতেই—প্রায় তাদের সঙ্গে জেগে উঠলেন রাশিদা বানু। মুহূর্তের মধ্যে তিনি ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলেন। রুমের ভিতরে আগে থেকে ডিমলাইটটা জ্বালানো ছিল—তবুও তিনি এই বয়সেও প্রায় একলাফে খাট থেকে নেমে—প্রথমে লাইটটা জ্বালালেন। তারপর তিনি চোখমেলে দেখলেন—তাদের বেডরুমের মেঝেতে বিরাট একটা ভয়ার্ত ও একেবারে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার অতিআদরের আব্বু! আর সে এইমাত্র প্রস্রাব করে তাদের অত্যাধুনিক টাইলসের মেঝেটা একেবারে ভাসিয়ে ফেললো!
ওর ভয়ের মাত্রা দেখে খাটের ওপর বসা মোসাদ্দেকসাহেব ও শায়লা ঘাবড়ে গিয়ে যেন কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে!
রাশিদা বানু স্নেহের আতিশয্যে সাদমানকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর তাকে ধরে পরম মমতায় শুইয়ে দিলেন বিছানার একপাশে।
মোসাদ্দেকসাহেব দ্রুত খাট থেকে নেমে তার চোখেমুখে পানির ছিটা দিতে লাগলেন। আর একটা গেলাসে করে তাকে খানিকটা পানিও পান করালেন।
তিনি একফাঁকে শায়লার দিকে চেয়ে খুব আস্তে করে বললেন, “দেখেছিস মা—ছেলেটি কী ভয় পেয়েছে! আমাদের চোখের সামনে সে ভয়ে রুমের মধ্যে একেবারে প্রস্রাব করে ফেললো! একেই বলে ভয়! আর এই ভয় জিনিসটা নিয়ে এতো বাহাদুরি করতে নাই।”
শায়লাও কাজে নেমে পড়লো। সে দ্রুত বাসার প্রায় সব লাইট জ্বেলে দিলো। আর অর্ণবকে ডেকে আনলো তার রুম থেকে।
শায়লার রুমটাতে এখন আর কোনো উৎপাত নাই। সেখানে কারও উপস্থিতিও আর প্রকাশ পাচ্ছে না। তবুও সকালের আগে কেউ আর ওই রুমটাতে যাওয়ার সাহস পেল না। আর মোসাদ্দেকসাহেবই সেখানে যেতে দিলেন না কাউকে।

সাদমান পুরাপুরি অজ্ঞান হয়ে যায়নি। তবে সে খুব ভয় পেয়েছে। সেটা বুঝা গেছে—তার শারীরিক লক্ষণসমূহ দেখে। তার এই ভয়ের ধকলটা মারাত্মক!
মোসাদ্দেকসাহেব তাকে বারবার পানিপান করাতে লাগলেন। ভয় পেলে বেশি-বেশি পানিপান করতে হয়। তিনি নিজেই রান্নাঘরে প্রবেশ করে গ্যাসের চুলা জ্বেলে—ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে তা গরম করতে লাগলেন। পরে তিনি এই কাজটা শায়লা ও অর্ণবের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজে ফিরে এলেন তার বেডরুমে। ততক্ষণে মালেকাও জেগে উঠেছে। পুরা বাড়িটাতে যেন একটা হুলুস্থূল পড়ে গেছে!
সাদমানকে ধরাধরি করে বাথরুমে নিয়ে গেলেন রাশিদা বানু আর মোসাদ্দেকসাহেব।
মোসাদ্দেকসাহেব ভাষণ দেওয়ার মতো ভঙ্গি করে জোরে-জোরে বললেন, “আমাদের গুরুজী বলেছেন, কেউ কোনো কারণে কখনো ভয়টয় পেলে সঙ্গে-সঙ্গে ভয়পাওয়া মানুষটিকে প্রচুরপরিমাণে ঠাণ্ডা পানিপান করাবে, তারপর তাকে গোসল করাবে—আর সবশেষে তাকে এক গেলাস গরম দুধ খেতে দিবে। এতে তার শরীরে ক্ষতির আর-কোনো আশংকা থাকবে না।”
সাদমান বাথরুমে অনেক সময় নিয়ে গোসল করলো। তারপর সে বাইরে এলে—তার হাতে এক গেলাস গরম দুধ ধরিয়ে দিলো শায়লা। আর সে একবারও হাসেনি তার বিপদ দেখে।
গরম দুধটুকু খেয়ে কিছুটা সুস্থবোধ করতে লাগলো সাদমান।
মোসাদ্দেকসাহেব ওর হাবভাব দেখে বললেন, “যাক, বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। মহান আল্লাহর শোকর। শোকর আলহামদুলিল্লাহ। ছেলেটির বড়ধরনের কোনো আপদবিপদ হয়নি। খুব অল্পেই এ যাত্রা রক্ষা পেয়েছে সে। আর সে এবার দ্রুত সুস্থও হয়ে যাবে।”

মালেকা অল্পসময়ের মধ্যে মোসাদ্দেকসাহেবের বেডরুমের মেঝে পরিষ্কার করে ফেললো। প্রস্রাবের গন্ধটা দূর করার জন্য সে চারপাশে ছিটিয়ে দিলো স্যাভলন। তারপর যে চাদরটার ওপর সাদমানকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল—সেটাও সে দ্রুত ধুয়ে দিলো। তারপর বিছানায় পেতে দিলো নতুন একটা চাদর।

সাদমানের অবস্থা এখন অনেকটা ভালো। আর এই অবস্থায় মোসাদ্দেকসাহেব সবাইকে ডেকে নিয়ে তার বিশাল ড্রইংরুমে বসলেন। এখানে, তিনসেট আরামদায়ক সোফা রাখা আছে। তাই, সবাই বেশ ভালোভাবে আর আরামে ছড়িয়েছিটিয়ে বসতে পারলো। তিনি সবাইকে বাকি রাতটুকু এখানে ঘুমাতে বললেন।


(চলবে)


সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
রচনাকাল: ২৫/১১/২০১৯

সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:১৬
৯টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×