ইসলামে ইফতার-মাহফিল বা ইফতার-পার্টির কোনো বিধান নাই
সাইয়িদ রফিকুল হক
দেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বলা হচ্ছে যে, সরকার কোনো ইফতার-মাহফিলের আয়োজন করবে না। আর সরকারিভাবে বা দলীয়ভাবে আওয়ামীলীগ এ-বছর রমজান-মাসে কোনোরকম ইফতার-মাহফিলেরও আয়োজন করবে না। এর কোনো অঙ্গসংগঠনও ইফতার-মাহফিলের ব্যবস্থা করবে না। খবরটি নিঃসন্দেহে ভালো। সরকারের এই কাজটি যথোপযুক্ত হয়েছে বলে মনে করি। এ-কে সমর্থন না-করে পারা যায় না। এতে রাষ্ট্রের অযথা খরচ হবে না। অনেক অপচয় কমবে। এতদ্বসংক্রান্ত নানাবিধ খরচও কমবে। ইফতার-মাহফিলের নামে অহেতুক ‘ফ্যাশন-শো’ করার জন্য রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতিও হবে না। তার কারণ, সরকারিভাবে ইফতার-মাহফিলের আয়োজন করা হলে তার অর্থ সরকারি বা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকেই প্রদান করা হয়। আর দলীয়ভাবেও ইফতার-পার্টির আয়োজন করা হলে সেখানেও নানারকম আর্থিক অনিয়ম হয়। লেনদেনের বিরাট ঘাপলা থাকে। দলাদলি হয়। স্বার্থপরদের লাভের অঙ্ক কষতে সুবিধা হয়। গোপনে নেতাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাঁদাবাজিও হয়ে থাকে। পাতিনেতাদের হম্বিতম্বি ও গোপন-চাঁদাবাজি থেকে বাঁচার কোনো পথ থাকে না। এইরকম একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্তে এসব অপকর্ম অন্তত বন্ধ হবে। তাই, পবিত্র রমজানে আসলেই ইফতার-মাহফিলের নাটক জমানোর কোনো প্রয়োজন নাই। এমনকি এটা সবসময়ের জন্য করা উচিত—শুধু এই বছরের জন্য নয়। সংযমের মাস শুরু হলে মানুষ সংযম দেখাবে। আপনমনে ধর্মসাধনা করবে। এতেই ইসলামের গৌরববৃদ্ধি পাবে।
আসলে, ইসলামধর্মে ইফতার-মাহফিলের কোনো বিধিবিধান নাই। আর নাই মানে নাই। কুরআন-হাদিসে বা আমাদের রাসুল সা.-এর জীবনে এসব খুঁজে পাইনি। আর এর কোনো অস্তিত্বই নাই। এটা সাম্প্রতিককালে ইসলামের নামে, ইসলামের দোহাই দিয়ে ইসলামের ভিতরে জোরপূর্বক ঢোকানো হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এটা অপসংস্কৃতি। ধর্মের নামে কারও-কারও দলীয় ধান্দাবাজি কিংবা কোনো-কোনো গোষ্ঠীর কায়েমী স্বার্থ রক্ষার একটা অপকৌশলমাত্র। এর থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। রমজান হলো সংযমের মাস। সবকিছুতে আমাদের সংযম পালন করতে হবে। আমাদের কথাবার্তায়, চালচলনে, হাবভাবে সর্বক্ষেত্রে এই সংযম প্রদর্শন করতে হবে। কিন্তু সেখানে ইফতার-মাহফিলের মতো এক ‘গ্যাঞ্জাম পার্টির’ আয়োজন করলে রমজানের পবিত্রতায় ও সংযমে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। রমজানের ভাবগাম্ভীর্য বিনষ্ট হয়। এটা হুমকির মুখে পড়ে। আর ইসলামের শুরুতে এসব আদিখ্যেতার কোনো প্রচলন ছিল না। তখন মানুষ এখনকার মতো এত রাজনীতি বুঝতো না। এত রাজনীতিও করতো না। আর ধর্ম নিয়ে এতোটা লাফালাফিও করতো না। তাই বলে তখন যে ধর্মীয় সংঘাত ছিল না—তা কিন্তু নয়। তবে তখনকার মানুষ অনেকটাই সহজ-সরল ছিল। এখনকার মতো এত জটিল, কঠিন ও ধড়িবাজ ছিল না। সেইজন্য তখন এইসব লোকদেখানো, স্বার্থসিদ্ধির ও রাজনৈতিক ফায়দা লোটার ইফতার-মাহফিল বা ইফতার-পার্টির প্রচলন হয়নি।
মানুষ তখন সর্বোচ্চ তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতির সঙ্গে ধর্মপালন ও সিয়াম-সাধনা করতো। ধর্মের নামে তখনও মানুষের মধ্যে বাহ্যিক-আড়ম্বরপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক আচারপ্রথা ও অনুষ্ঠানসমূহের উদ্ভব ঘটেনি। আর এখন ধর্মপালনের নামে সর্বক্ষেত্রে আড়ম্বর ও প্রতিযোগিতা মাত্রাতিরিক্ত।
সরকারি এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষও তাদের ইফতার-মাহফিলের কর্মসূচি থেকে সরে এসেছে। আরও কিছু সংস্থাও এই অপসংস্কৃতি ও অপচয়ের ভাণ্ডার বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। আর এতেই কাল হয়েছে! কাটমোল্লারা ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছে। আমাদের দেশের কিছুসংখ্যক স্বঘোষিত ধর্মের চাঁই ভিতরে-বাইরে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। তারা বলছে, মুসলমানদের ইসলামি সংস্কৃতি বন্ধের এটা চক্রান্ত! ইসলামের সংস্কৃতিচর্চাকে কোণঠাসা করার ষড়যন্ত্র! রমজানের সৌন্দর্য হরণের অপচেষ্টা ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, এসব আহাম্মক-আত্মস্বীকৃত ধর্মীয় নেতা তথা ইসলামবাদীরা বলছে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজা হয় জাঁকজমকের সঙ্গে! অথচ, ৯০ভাগ মুসলমানের দেশে ইফতার-মাহফিল হতে পারবে না! এটা কোনো কথা হলো! বুঝতেই পারছেন, এদের স্বার্থটা কোন্ খানে! আসলে, এই মূর্খশ্রেণিটি বুঝতেই পারে না যে, কীসের সঙ্গে কীসের তুলনা! সরস্বতী পূজা সনাতন-ধর্মাবলম্বীদের আনন্দ-অনুষ্ঠান। আর ‘মাহে রমজান’ হলো সংযমের মাস। কৃচ্ছতাসাধনের মাস। এখানে, যাবতীয় অপচয় ও অতিরিক্ত যেকোনোকিছুই নিষিদ্ধ। আর অতিরিক্ত কোনোকিছুই মহান আল্লাহর কাছে অগ্রাহ্য বা অ-অনুমোদিত। মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা. রমজান-মাসে কম খেতে বলেছেন, কম ঘুমাতে বলেছেন, কম কথা বলতে বলেছেন। কিন্তু ইবাদত বেশি করতে বলেছেন। যাতে পরকালে মুক্তি অর্জন করা সম্ভব হয়। আর এরা ইসলামের ভিতরে নিজেদের মনগড়া ইফতার-মাহফিল বা ইফতার-পার্টির মতো নিম্নমানের অপসংস্কৃতিকে ঢুকিয়ে তাকে আবার জায়েজও করতে চাচ্ছে! মদীয় আপত্তি এখানে। এখন অনেক ভণ্ড নিজের নামের আগে শায়খ, মুফতি, আল্লামা, মাওলানা, মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরে কুরআন লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর ইসলাম-সম্পর্কে নিজেদের মনগড়া, আলতুফালতু, আবোলতাবোল, উদ্ভট, আজেবাজে, অশালীন ও লাগামহীন কথাবার্তা বলছে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এদের কঠোর হস্তে দমন করা উচিত।
বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ইফতার-মাহফিল বা ইফতার-পার্টির প্রচলন কবে-কখন থেকে শুরু হয়েছে—তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা না-গেলেও প্রমাণসাপেক্ষে বলা যায় যে, ১৯৭৭-৭৮ সাল থেকে এই ভাইরাস সর্বপ্রথম ছড়াতে থাকে। এরপর ১৯৭৯-৮০ সাল থেকে তা রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হতে থাকে। তৎকালীন সামরিকজান্তা সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য মুখে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বলা আর লোকদেখানো ইসলামের ঘোরতর সমর্থক ও পথিকৃৎ ছিল। তবে এব্যাপারে আসল ইতিহাস হলো—জিয়াউর রহমানের শাসনামলের শেষদিক থেকে (বঙ্গবন্ধু-সরকারের সময় নিষিদ্ধ ঘোষিত) জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান ও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির এইসময় গোপনে নিজেদের কার্যক্রম ধীরে ধীরে শুরু করার লক্ষ্যে ইফতার-মাহফিলের আয়োজন করতে থাকে। তারা এভাবে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। আশির দশকের শুরুতে উক্ত সংগঠনটি ভিতরে-ভিতরে কথিত ইফতার-মাহফিল বা ইফতার-পার্টির নামে নিজেদের সংগঠিত করতে থাকে। তারপর জিয়াউর রহমানের মত্যুর পর আরেক সামরিকজান্তা এরশাদের আমলেও জামায়াত-শিবিরের এই অপতৎপরতা দুর্বার-গতিতে এগিয়ে চলে। এভাবে তারা ইফতার-মাহফিল বা ইফতার-পার্টির নামে নিজেদের রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে শুরু করে দেয়। সেই ইফতার-মাহফিল বা ইফতার-পার্টি এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে! কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ভালো জিনিস খায় খুব কম। আর খারাপটা খায় খুব বেশি।
তবে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের মানুষ অনেক আগে থেকে ‘রোজাদার খাওয়ানোর’ একটা প্রচলন শুরু করেছিল। সাধারণতঃ গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন লোকেরা তাদের বাড়িতে নিজ-নিজ গ্রামের প্রতিটি বাড়ির একজন বা দু’জন করে রোজাদার-মানুষকে দাওয়াত দিয়ে ইফতার করাতো, এবং সেইসঙ্গে ইফতারির পরে তাদের পেটপুরে খাওয়ানোরও ব্যবস্থা রাখতো। এটা মদীয় আলোচনার বাইরে। এটা অনেক ভালো একটা বিষয়। এতে গ্রামের মানুষগুলোর মধ্যে সামাজিক সম্প্রীতি ও বন্ধন সুদৃঢ় হয়। আর এতে কোনো চাঁদাবাজি নাই। রাষ্ট্রের অর্থের অপচয়ও নাই। হাঙ্গামা নাই। রেষারেষি নাই। আর এই নিয়ে কোনোপ্রকার দলাদলিও নাই। সামর্থ্যবান ব্যক্তি বিশেষ তাদের পরলোকগত ময়মুরুব্বির রুহের মাগফিরাতের জন্য গ্রামীণ জনসমাজে এই কার্যক্রম চালু রেখে আজও সামাজিক সম্প্রীতির অটুট বন্ধন ধরে রেখেছেন। এর সঙ্গে শহরের কথিত ও উদ্দেশ্যমূলক ইফতার-মাহফিল বা ইফতার-পার্টির সম্পর্ক নাই।
শহরেও কেউ-কেউ ঘরোয়াভাবে রোজাদারদের দাওয়াত দিয়ে ইফতার করান। এটাও ভালো। এখানে, কোনো স্বার্থ কাজ করে না। হয় তারা ময়মুরুব্বির রুহের মাগফিরাতের জন্য আর নয়তো নিজেদের পারলৌকিক মুক্তির লক্ষ্যে এটা করে থাকেন।
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৫৩