somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রায়-নন্দিনী : সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী

০৩ রা অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


৬ষ্ঠ পর্ব...........
প্রথম দিবসেই এক হরিণ শিকার করিয়া তাহার গোশত কাবাব করিয়া অরুণাবতী সহ পরমানন্দে উদরপূর্তি করিলেন।
অরুণাবতী মাহতাব খাঁর নিকট ইসলামের পবিত্র কলেমা পড়িয়া মুসলমান ধর্মে দীতি হইল। অপাততঃ আত্মরক্ষার জন্য উভয়েই সেই নিবিড় বনে বাস করিতে লাগিলেন।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
হেমদার ষড়যন্ত্র

মহরম নিকটবর্তী। আর সাতদিন মাত্র অবশিষ্ট। বরদাকান্তের জ্যেষ্ঠপুত্র হেমদাকান্ত কাশী হইতে বাটি ফিরিয়াছে। তাহার এক পিসী বৃদ্ধ বয়সে কাশীবাসী হইয়াছিলেন। পিসী হেমদাকে পুত্রবৎ লালন-পালন করিয়াছিলেন। পিসীর সন্তানাদি কিছুই ছিল না। হেমদাই তাঁহার সরুস্ব। পিসীর যথেষ্ট টাকাকড়ি ছিল। সুতরাং হেমদাকান্ত বাল্যকাল হইতেই পিসী ক্ষীরদার আদরে বিলাসে উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিয়াছিল। ছোটবেলা হইতেই তাহার কোনও আব্দার বা আকাঙক্ষা একদিনের জন্যও অপূর্ণ থাকিত না। হেমদা তাহার পিসী ক্ষীরদার নিকটেই প্রায় থাকিত। কাশীতে গঙ্গাতটে একটি দ্বিতল বাড়ীতে হেমদা তাহার পিসী ও স্ত্রীর সহিত বাস করিত। পিসীর নগদ প্রায় ২৫ হাজার টাকা ছিল। সে কালের এই পঁচিশ হাজার আজকালকার লাখেরও উপর। পিসী সমস্ত টাকাই লগ্নী কারবারে লাগাইয়াছিল। তাহা হইতে যে আয় হইত তাহাতেই পিসী, হেমদা ও হেমদা-পত্নী কমলার স্বচ্ছন্দে খরচপত্র পোষাইত। টাকা হেমদার হস্তেই খাটিত। পিসী দিবারাত্রি তপ জপ আহ্নিক উপবাস করিয়া এবং নানা প্রকার দেবলীলা ও উৎসব দেখিয়া সময় কাটাইতেন। ক্ষীরদা-সুন্দরী সম্ভ্রান্ত হিন্দু-ঘরের আদর্শ নিষ্ঠাবতী প্রবীণা মহিলার ন্যায় ছিলেন। জীবন-সন্ধার আঁধার যতই ঘনাইয়া আসিতে লাগিল, ক্ষীরদাও ততই অন্তিমের সম্বলের জন্য অধীর ও আকুল প্রাণে ধর্মকর্মেই অধিকতর লিপ্ত হইতে লাগিলেন। সংসারের সরুস্বই হেমদা ও তাহার স্ত্রীর হাতে ছাড়িয়া দিলেন। হেমদা কয়েক বৎসরের মধ্যেই টাকা খাটাইয়া পঞ্চাশ হাজার টাকার লোক হইয়া দাঁড়াইল। সে আর কয়েক বৎসরের মধ্যেই যে কাশীর মধ্যে একজন প্রথম শ্রেণীর শ্রেষ্ঠী বা ধনীতে গণ্য হইবে, ইহা সকলেই আলোচনা করিত। কিন্তু এই সময় হইতেই তাহার চরিত্র ভীষণরূপে কলুষিত হইয়া উঠিল। পূরু হইতেই তাহার লাম্পট্য দোষ ছিল। এক্ষণে এই লাম্পট্যের সঙ্গে মদ্যপান, দ্যূতক্রীড়া এবং পরদারগমন অভ্যস্ত হইয়া উঠিল। অগ্নিশিখা বায়ু সংযোগে আরও প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। কাশী ভারতে সত্য সত্যই এক অদভুত স্থান। উহার অসংখ্য রুদ্র ও বৃহৎ মন্দির, অসংখ্য সুন্দর ও কুৎসিত দেবীর প্রাতঃসন্ধ্যা আরতি-অর্চনায় ধর্মপিপাসু হিন্দু নরনারীর প্রাণে যেমন ভক্তি ও নিষ্ঠার ভাব উদ্রেক করে, অন্যদিকে নানা দিগ্ধেশাগত অসংখ্য প্রকারের চোর, জালিয়াত, বিশেষতঃ লম্পট নরনারীর অবিরাম বীভৎস লীলায় পবিত্রাত্মা মানবমাত্রকেই ব্যথিত করে। জগতে যে সমস্ত জঘন্য লোকের অন্যত্র মাথা লুকাইবার স্থান নেই, কাশীতে তাহারা পরমানন্দে বাস করে। বহু সংখ্যক রাজ-রাজড়ার অন্নসত্র উন্মুক্ত থাকায় এই সমস্ত পাপাত্মাদিগের উদরান্নের জন্যও বড় ভাবিতে হয় না। কাশীতে প্রকৃত চরিত্রবান ভালো লোকের সংখ্যা মুষ্টিমেয়। চরিত্রহীন লম্পট ও জুয়াচোরদের সংখ্যাধিক্যে এই অল্প সংখ্যক প্রকৃত নিষ্ঠাবান চরিত্রশালী লোকের অস্তিত্বে অনেক সময়েই সন্দেহের সঞ্চার করে।
সে যাহা হইক, হেমদা কাশীর ব্যভিচার-দুষ্ট বায়ুতে এবং কুসংসর্গ প্রভাবে অল্পকালের মধ্যেই একজন প্রথম শ্রেণীর গুন্ডার মধ্যে পরিগণিত হইল। তাহার শরীরে বেশ শক্তি ছিল, সে শক্তি এক্ষণে নানা প্রকার পাশবিক এবং পৈশাচিক কার্য সাধনে দিন দিন দুর্দম ও অসংযত হইয়া উঠিল। গায়ের শক্তি, হৃদয়ের সাহস, টাকার বল, সহচরদিগের নিত্য উৎসাহ এবং পাপ-বিলাসের উদ্ভট-চিন্তা তাহাকে একটা সাক্ষাৎ শয়তানে পরিণত করিল। অনবরত কাম-পূজায় তাহার ধর্মকর্ম-জ্ঞান লোপ পাইল। মদের নেশা তাহাকে আরও গভীর পঙ্কে নিক্ষেপ করিল। শেষে মদ্য-সেবা এবং কাম-পূজাই তাহার জীবনের একমাত্র কর্তব্য হইয়া উঠিল। অবশেষে বামাচারী তান্ত্রিক-সমপ্রদায়ের এক কাপালিক সন্ন্যাসীর হস্তে সে তন্ত্রে মন্ত্রে দীৰিত হইয়া পাপে দ্বিধাশূন্য ও নির্ভীক হইয়া পড়িল।
হেমদা বামাচারী-সমপ্রদায়ে দীৰিত হইবার কিছু পরেই সাদুল্লাপুরে প্রায় দুই বৎসর পরে বাড়ী ফিরিল। আত্মীয়-স্বজন সকলেই তাহার আগমনে পরমানন্দিত হইল। সে কাশী হইতে বাড়ী ফিরিবার সময়ে নানা প্রকার সুন্দর সুন্দর অলঙ্কার, ছেলেদের খেলনা, বানারসী শাড়ী, চাদর, পাথরের নানাপ্রকার দ্রব্য ও মূর্তি, জরীর কাঁচুলী সকলকে উপহার দিবার জন্য আনিয়াছিল। হেমদা বাড়ীতে আসিয়াই দেখিতে পাইল যে, উদ্ভিন্ন-যৌবনা প্রদীপ্তকান্তি স্বর্ণময়ী তাহাদের বাড়ী আলোকিত করিয়া বিরাজ করিতেছে। স্বর্ণময়ীকে দেখিয়া সে চমৎকৃত, মুগ্ধ এবং লুব্ধ হইয়া গেল। সে কাশীতে নানাদেশীয় অনেক সুন্দরী দেখিয়াছে এবং নিজে অনেক সুন্দরীর সরুনাশও করিয়াছে, কিন্তু তাহার মনে হইল স্বর্ণময়ীর ন্যায় কোন সুন্দরী কদাপি নেত্রপথবর্তী হয় নাই। স্বর্ণময়ী যে এরূপ রসবতী, লীলাবতী, রূপবতী এবং লোভনীয় মোহনীয় সুন্দরীতে পরিণত হইয়াছে, তাহা দেখিয়া তাহার প্রাণ যেন অপার্থিব আনন্দে পূর্ণ এবং মগ্ন হইয়া গেল। কাশী ত্যাগ করিতে তাহার যে কষ্ট হইয়াছিল, এক্ষণে তদপেক্ষা শতগুণ আনন্দ তাহার প্রাণে সমুদিত হইল। সে নিজকে পরম সৌভাগ্যশালী বলিয়া মনে করিল। পিশাচের হৃদয় পৈশাচিক ঘৃণিত বাসনায় চঞ্চল হইয়া উঠিল। সে সর্বোৎকৃষ্ট শাড়ী, চাদর, চুড়ি, পুতুল ও পাথরের একপ্রস্থ বসন স্বর্ণময়ীকে উপহার দিল। সরল-প্রাণা বিমল-চিত্ত স্বর্ণ ভ্রাতার উপহার বলিয়া প্রাণের সহিত গ্রহণ করিল। কিন্তু দুই তিন দিনের মধ্যেই হেমদার কুৎসিত হাবভাবে, সকাম পিপাসু দৃষ্টিতে স্বর্ণ একটু সঙ্কুচিতা এবং লজ্জিতা হইল। হেমদার প্রতি তাহার একটু ঘৃণারও উদ্রেক হইল। পাপিষ্ঠ হেমদা নানা ছলে স্বর্ণময়ীর গৃহে প্রবেশ করিয়া নানারূপে তাহার মনোহরণের চেষ্টা করিলেও স্বর্ণময়ী অচল অটল রহিল।
হেমদা যতই তাহাকে ধর্মভ্রষ্ট করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল, স্বর্ণময়ী ততই তাহাকে ঘৃণার চক্ষে দেখিতে লাগিল। হেমদার চেষ্টা যতই বিফল হইলে লাগিল, ততই তাহার হৃদয়ের পাপ-লিপ্সা বলবতী হইতে লাগিল। তাহার আগ্রহ ও যত্ন বাড়িয়াই চলিল। মেঘ-বিহারিণী চঞ্চলা সৌদামিনী যেমন ময়ূরকে বিমুগ্ধ এবং উন্মত্ত করে, বৈদ্যুতিক শুভ্র আলোকে যেমন শলভকে আত্মহারা ও আকৃষ্ট করে, বংশীধ্বনির মধুরতা যেমন মৃগকে জ্ঞানশূন্য করে, রায়-নন্দিনীর ভরা যৌবনের উচ্ছ্বসিত রূপতরঙ্গও তেমনি পাপাত্মা হেমদাকান্তকে উন্মত্ত ও অশান্ত করিয়া তুলিল।
হেমদা কাশী হইতে আসিবার সময় তাহার দীক্ষাগুরু অভিরাম স্বামীও সঙ্গে আসিয়াছিল। অভিরাম স্বামী সন্ন্যাসীর মত গৈরিকবাস পরিধান এবং সরুদা কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা ধারণ করিত। বাহুতে ও গলায় রুদ্রাক্ষমালা, শিরে দীর্ঘকেশ, কিন্তু জটাবদ্ধ নহে। এতদ্ব্যতীত তাহার সন্ন্যাসের বাহ্যিক বা আভ্যন্তরিক কোনও লক্ষণ ছিল না। সে সরুদাই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং মস্তকে প্রচুর তৈল মর্দন করিত। তাহার শরীর মাংসল, মসৃণ, স্থূল এবং পেশীবহুল। সে অসুরের মত ভোজন করিত। সকালে তাহার জন্য দুই সের লুচি, এক সের মোহনভোগ ও অন্যান্য ফলমূল বরাদ্দ ছিল। দ্বিপ্রহরে অর্ধ সের চাউলের ভাত, এক পোয়া ঘৃত, এক সের পরিমিত মাছ এবং দুই সের মাংস এবং অন্যান্য মিষ্টান্ন প্রায় দুই সের, সরুশুদ্ধ ছয় সের ভোজ্যজাত তাহার উদর-গহ্বরে স্থান পাইত। অপরাহ্নে দেড় সের ঘন ক্ষীর তাহার জলখাবার সেবায় লাগিত। রাত্রে রুটি ও মাংসে প্রায় পাঁচ সেরে তাহার রুন্নিবৃত্তি হইত। তাহার ভোজন, আচরণ ও ব্যবহারে সন্ন্যাসের নামগন্ধও ছিল না। মদ্য সরুদাই চলিত। তাহার চেহারা ও নয়নের কূটিলতা তীব্রভাবে লক্ষ্য করিলে সে যে একটি প্রচ্ছন্ন শয়তান তাহা তীক্ষ্ণবুদ্ধি লোকে বুঝিতে পারিত। কিন্তু তাহার গৈরিক বাস, দীর্ঘকেশভার এবং রক্ত-চন্দরের ফোঁটা হিন্দু-সমাজে তাহাকে সম্ভ্রমের সহিত সন্ন্যাসীর আসন প্রদান করিয়াছিল। তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর নামে অনেকে ‘ইতঃ নষ্ট ততঃ ভ্রষ্টের’ দল, শিষ্য ও চেলারূপে স্বামীজীর পাদ-সেবায় লাগিয়া গেল। স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে কবচ লইবারও ধুম পড়িয়া গেল। বশীকরণ, উচাটন, মারণ প্রভৃতির মন্ত্র-প্রণালী ও ছিটেফোঁটা কত লোকে শিখিতে লাগিল। শিষ্যদিগের আধ্যাত্মিক উন্নতির মধ্যে ধান্যেশ্বরীর সেবা খুব চলিল। সেকালের ইসলামীয় শাসনে মদ্য কোথায়ও ক্রয় করিতে পাওয়া যাইত না। এখনকার মত ব্রান্ডি, শাম্পেন, শেরী, ক্লোরেট প্রভৃতি বোতলবাহিনীর অস্তিত্ব ছিল না। কোনও মুসলমান মদ্যপান করিলে কাজী সাহেব তাহাকে কষাঘাতে পিঠ ফাটাইয়া দিতেন। হিন্দুর মধ্যে কেহ মদ খাইয়া মাতলামী করিলেও কষাঘাতে পিঠ ফাটিয়া যাইত। কাজেই বড় শহরেও মদের দুর্গন্ধ, মাতালের পৈশাচিক লীলা কদাপি অনুভূত ও দৃষট হইত না। হিন্দুদের মধ্যে বাড়ীতে অতি নিভৃতে ধান্যেশ্বরী নামক দেশী মদ প্রস্থত করিয়া কেহ কেহ সেবন করিত। ইসলামীয় সভ্যতার অনুকরণে হিন্দু সমাজেও মদ্যপান ও শূকর-মাংস ভক্ষণ অত্যন্ত গর্হিত এবং ঘৃণিত বলিয়া বিবেচিত হইত। [হিন্দুশাস্ত্রে শূকর মাংস ও মদ্য পবিত্র ও ভক্ষ্য বলিয়া নির্দিষ্ট। কিন্তু মুসলমানেরা শূকর মাংসভোজী ও মদ্যপায়ীকে নিতান্ত ঘৃণা করিতেন বলিয়া মুসলমান রাজত্বে উচ্চশ্রেণীর হিন্দুরা উহা পরিত্যাগ করেন।]
স্বামীজির আগমনে আর কিছু উপকার হউক আর না হউক, অনেক হিন্দু যুবকই বাড়ীতেই বকযন্ত্রে মদ চোঁয়াইতে লাগিল। স্বামীজি হেমদাকান্তের বিশেষ অনুরোধে পড়িয়াই সাদুল্লাপুরে আসিয়াছিল। দুইদিন থাকিবার কথা, কিন্তু আজ পাঁচদিন অতীত হইতে চলিল, তথাপি স্বামীজির মুখে যাইবার কথাটি নাই। ইহার কারণ আর কিছুই নহে, কেবল রায়-নন্দিনী। হায় যুবতীর সৌন্দর্য! তুমি এ জগতে কতই না অনর্থ ঘটাইয়াছ! তুমি স্বর্গের অমূল্য সম্পদ হইলেও কামুক ও পিশাচের দল তোমাকে কামোন্মত্ততার তীব্র সুরা মধ্যেই গণ্য করিয়াছে। তুমি একদিকে যেমন পূর্ণিমার জ্যোৎস্না-বিধৌত রমণীয় কুসুমোদ্যান সৃষ্টি করিতেছ, অন্যদিকে তেমনি পূতিগন্ধপুরিত অতি বীভৎস শ্মশানেরও সৃষ্টি করিতেছ। কেহ কেহ তোমার ধ্যান করিয়া ফেরেশ্তা প্রকৃতি লাভ করিতেছে বটে, কিন্তু অনেকেই নরকের কামকীটে পরিণত হইতেছে।
পেটুক বালক রসগোল্লা দেখিলে তাহার মুখে যেমন লালা ঝরে, গর্ভিণী তেঁতুল দেখিলে তাহার জিহ্বায় যেমন জল আইসে, তীব্র তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি বরফ দেখিলে যেমন তল্লাভে অধীর হইয়া উঠে, বহুমূল্য মণি দেখিলে তস্কর যেমন আকুল হইয়া পড়ে, আমাদের অভিরাম স্বামী মহাশয়ও তেমনি নবযুবতী অতুল রূপবতী নির্মল রসবতী নির্মল রসবতী শ্রমতী রায়-নন্দিনীকে দেখিয়া একেবারে ভিজিয়া গলিয়া গেলেন। পাষন্ডের পাপলিপ্সা যেন ফেনাইয়া ফুলিয়া উঠিল। শিষ্য এবং গুরু উভয়ে যুগপৎ রায়-নন্দিনীর জন্য দিবস-যামিনী চিন্তা করিতে লাগিল। হেমদার কুমতলব স্বর্ণ বেশ বুঝিতে পারিয়াছিল, কিন্তু অভিরাম স্বামীর ‘মনের বাসনা’ স্বর্ণ দূরে থাকুক, হেমদাও বুঝিতে পারে নাই। বলা বাহুল্য, শিষ্য অপেক্ষা গুরু চিরদিনই পাকা থাকে। সুতরাং এখানেই বা তাহার ব্যতিক্রম হইবে কেন?
হেমদা কয়েক দিনেই বুঝিতে পারিল যে, স্বর্ণকে দূষিত করা সহজ নহে। স্বর্ণ প্রথম প্রথম পূর্বের ন্যায় ভাই-বোন ভাবে তাহার পাশে বসিত, কিন্তু পরে আর তাহার পাশে বসা দূরে থাকুক, তাহার সম্মুখেও বাহির হইত না। এমনকি, তাহাকে দাদা বলিয়া সম্বোধন করাও পরিত্যাগ করিল। স্বর্ণ এক্ষণে মহরর্মের দিন গণিতে লাগিল। কারণ মহররমের পরের দিবসই তাহাকে পিত্রালয়ে লইবার জন্য লোক আসিবে।
যত শীঘ্র হেমদার কলুষদৃষ্ট ও ঘৃণিত সঙ্কল্প-দুষ্ট বাটি হইতে নির্গত হইতে পারে ততই মঙ্গল! কয়েক দিবসের মধ্যেই স্বর্ণ যেন বড়ই স্ফূর্তিহীনতা বোধ করিতে লাগিল। ঈসা খাঁর পত্র পাইয়া স্বর্ণ অনেকটা প্রফুল্ল ও আনন্দিত হইয়াছিল। কিন্তু পাপাত্মা হেমদাকান্তের ঘৃণিত ব্যবহারে বড়ই অসুখ বোধ করিতে লাগিল। একবার তাহার মামীর কাছে হেমদার ঘৃণিত সংকল্প ও পাপ-প্রস্তাবের কথা বলিয়া দিবার জন্য ইচ্ছা করিত; কিন্তু তাহাতে বিপরীত ফল ফলিতে পারে এবং তাহার নামেও হেমদা মিথ্যা কুৎসা আরোপ করিয়া বিষম কলঙ্ক সৃষ্টি করিতে পারে, এই আশঙ্কায় তাহা হইতে নিবৃত্ত হইল। ভাবিল, আর তিনটা দিন কাটিয়া গেলেই রক্ষা পাই। হেমদাও স্বর্ণময়ীর পিত্রালয়ে যাইবার দিন আসন্ন দেখিয়া অস্থির হইয়া উঠিল। সে এবং তাহার গুরুদেব যত প্রকার তন্ত্রমন্ত্র এবং ছিটেফোঁটা জানিত, তাহার কোনটিই বাকী রাখিল না। গুরুদেব অভিরাম স্বামী হেমদার প্রতি গভীর সহানুভূতি দেখাইতে লাগিল। অভিরাম স্বামী নিজে স্বর্ণময়ীর যৌবনে মুগ্ধচিত্ত না হইলে এরূপ ভয়ানক এবং নিতান্ত জঘন্য কার্যের সংকল্প হয়ত লোক-লজ্জার জন্যও অনুমোদন করিত না। কিন্তু সে জানিত যে, হেমদার ভাগ্যে শিকা ছিঁড়িলে সে নিজেও দুগ্ধভান্ডে লেহন করিবার সুবিধা পাইবে।
দিন চলিয়া যাইতেছে- স্বর্ণময়ী হস্তচ্যুত হইতে চলিল দেখিয়া গুরুদেবও বিশেষ চিন্তিত হইল। অবশেষে তন্ত্রের বিশেষ একটি বশীকরণ মন্ত্র সারা দিবারাত্রি জাগিয়া লক্ষবার জপ করতঃ একটি পান শক্তিপূত করিল। এই পান স্বর্ণকে স্বহস্তে সেবন করাইতে পারিলেই হেমদাকান্তের বাসনা পূর্ণ হইবে বলিয়া স্বামীজি দৃঢ়তার সহিত মত প্রকাশ করিলেন, পানের রস গলাধঃকরণ মাত্রই স্বর্ণময়ী হেমদার বশীভূত হইবে।
পাপাত্মা হেমদাকান্ত এই পান লইয়া পরম আহলাদিত হইল। এক্ষণে এই পান স্বর্ণকে কিরূপে খাওয়াইবে তাহাই হেমদার চিন্তার বিষয়ীভূত হইল। সন্ন্যাসী যখন পান দিল, তখন সন্ধ্যা। স্বর্ণ তখন অন্যান্য বহু স্ত্রীলোকের মধ্যে বসিয়া গল্প করিতেছিল, সুতরাং তাহাকে পান দিবার জন্য দুরুত্তের মনে সাহস হইল না।
অতঃপর কিছু রাত্রি হইলে হেমদা সকলের অসাক্ষাতে স্বর্ণময়ীর গৃহে নিঃশব্দে প্রবেশ করিয়া পালঙ্কের আড়ালে বসিয়া রহিল। স্বর্ণময়ী আহারান্তে গৃহে আসিয়া দ্বার বন্ধ করতঃ শয়ন করিবার পরে পাপাত্মা মৃদুমন্দ হাস্যে স্বর্ণের নিকটে উপস্থিত হইল। স্বর্ণ সহসা তাহাকে গৃহ মধ্যে দর্শন করিয়া- পথিমধ্যে দংশনোদ্যত ফণী দর্শনে পথিকের ন্যায় বিচলিতা হইয়া চীৎকার করিবার উপক্রম করিল। পাপাত্মা তদ্দর্শনে অতীব বিনীতভাবে দুই হস্ত জোড় করিয়া বলিল, ‘স্বর্ণ! আমি কোন মন্দ অভিপ্রায়ে আসি নাই। তুমি যাতে চিরকাল সুস্থ থাক, সেই জন্য সন্ন্যাসী-ঠাকুর এই মন্ত্রপূত-পান দিয়েছেন; এটা তোমাকে খেতে হবে।’
স্বর্ণ: তুমি এখানই গৃহ থেকে নির্গত হও, নতুবা বিপদ ঘটবে, ও পান সন্ন্যাসীকে খেতে বল। আমি ও পান কিছুতেই খাব না।
স্বর্ণের দৃঢ়তা দেখিয়া হেমদা দুই হস্তে স্বর্ণের পা জড়াইয়া ধরিয়া তাহাকে পান খাইবার জন্য অনুরোধ করিতে লাগিল। স্বর্ণ তাহার এই বিসদৃশ ব্যবহারে নিতান্ত কুপিত হইয়া সজোরে তাহার বক্ষে পদাঘাত পূরুক দ্বার খুলিয়া তাহার ছোট মামীর গৃহের দিকে চলিয়া গেল। সহসা স্বর্ণের সবল পদাঘাতে পাপিষ্ঠ কামান্ধ হেমদাকান্ত একেবারে ঘরের মেঝেতে চিৎ হইয়া পড়িল। বুকে পদাঘাত এবং মস্তকে পাকা মেঝের শক্ত আঘাত পাইল। কিন্তু এ আঘাত অপেক্ষা তাহার মানসিক আঘাত সর্বাপেক্ষা অসহ্য হইয়া উঠিল। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিল, যেরূপেই হউক স্বর্ণের সরুনাশ সাধন করিবেই।
হেমদা নিতান্ত দুঃখিত রুব্ধ ও উত্তেজিতভাবে সমস্তই গুরুদেবের নিকট নিবেদন করিল। অতঃপর পরামর্শ হইল যে, মহররমের দিবস স্বর্ণকে নৌকাপথে হরণ করিয়া একেবারে কাশী লইয়া যাইতে হইবে।

নবম পরিচ্ছেদ
কাননাবাসে


প্রধান সেনাপতি মাহতাব খাঁ যশোর হইতে প্রস্থানের কিঞ্চিৎ পরেই প্রতাপাদিত্য তাঁহাকে ধরিয়া আনিবার জন্য কালিদাস ঢালীকে আদেশ করিলেন। ঢালী মহাশয় অনুসন্ধান করিয়া কোথাও খাঁ সাহেবকে পাইলেন না। পরে নদীতটে যাইয়া শুনিলেন যে, খাঁ সাহেব নৌকা করিয়া বামনী নদী উজাইয়া গিয়াছেন। কালিদাস যাইয়া রাজাকে সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদন করিলেন। ঘটনা শুনিয়া প্রতাপাদিত্যের রোষানল শীতল হইয়া গেল। মনে একটু অনুশোচনার উদ্রেক হইল। মাহতাব খাঁই প্রতাপের দৰিণ হস্ত। মাহতাবের বাহুবল এবং রণ-কৌশলেই প্রতাপের যা কিছু প্রভাব ও দম্ভ। মগ ও পর্তুগীজেরা কতবার মাহতাব খাঁর দুর্দম বিক্রমে রণক্ষেত্রে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিয়াছে। প্রতাপ ভাবিলেন, মাহতাব খাঁ শত্র্বপক্ষে যোগদান করিয়া তাঁহার ঘোরতর অনিষ্ট সাধন করিতে পারেন। তিনি যদি কেদার রায় বা রামচন্দ্র রায়ের অথবা ভুলুয়ার ফজল গাজীর সেনাপতিত্ব গ্রহণ করেন, তাহা হইলে প্রতাপের পক্ষে বিষম সঙ্কট। এক্ষণে হয় তাঁহাকে ফিরাইয়া আনা, না হয় নিহত করাই মঙ্গলজনক বলিয়া বোধ হইল। প্রতাপ তখনি কালিদাসকে এক শত বন্দুকধারী সৈন্যসহ একখানি দ্র্বতগামী তরী লইয়া মাহতাব খাঁকে ধরিয়া আনিবার জন্য আদেশ করিলেন। কালিদাস কালবিলম্ব না করিয়া শত সৈন্য সমভিব্যবহারে শীঘ্র তরণীতে আরোহণ করিলেন। পঞ্চাশ দাঁড়ে প্রকা- ছিপের আকৃতি নৌকা কল্ কল্ করিয়া বামনীর ঊর্মিলস্রোতে বিদারণ করতঃ মাহতাব খাঁর উদ্দেশ্যে ছুটিয়া চলিল।
মাহতাব খাঁর নৌকা ছয় দাঁড়ের হইলেও রুদ্র বলিয়া বেশ ছুটিয়া চলিয়াছিল। তাঁহার বিশ্বাস ছিল যে, সারারাত্রি নৌকা বাহিতে পারিলে, প্রাতঃকালে কিঞ্চিৎ বেলা উদয়েই প্রতাপাদিত্যের এলাকা ছাড়াইতে পারিবেন। প্রতাপাদিত্যের এলাকা ছাড়াইতে পারিলেই তিনি নিরাপদ। মাল্লারা দাঁড় ফেলিতে যাহাতে কিছুমাত্র শৈথিল্য না করে, সেজন্য তিনি অর্ধরাত্রি পর্যন্ত জাগিয়া রহিলেন। মাল্লারা প্রাণপণে নৌকা বাহিতে লাগিল। মাঝি খাঁ সাহেবকে জাগিয়া থাকিতে দেখিয়া তাঁহাকে শয়ন করিবার জন্য সনিরুন্ধ অনুরোধ করিতে লাগিল এবং নৌকা যে প্রভাতেই সলিমাবাদের সীমা অতিক্রম করিয়া ঈসা খাঁর এলাকায় পৌঁছাইতে পারিবে, এ বিষয়ে খুব বড় মুখে বড়াই করিতে লাগিল।
মাহতাব খাঁ মাঝির ব্যগ্রতা এবং মাল্লাদিগের প্রতি দ্র্বত নিক্ষেপে পুনঃ পুনঃ সাবধানতা দর্শনে নিশ্চিন্ত হইয়া শয্যায় দেহ পাতিলেন এবং অল্পক্ষণেই নিদ্রাভিভূত ইহয়া পড়িলেন। মাহতাব খাঁ নিদ্রিত হইয়া পড়িলে মাঝি ও মাল্লারা একস্থানে নৌকা লাগাইয়া সকলেই পলায়ন করিল। তাহাদের পলায়ন করিবার কারণ যে প্রতাপাদিত্যের কঠোর দ-ভীতি, তাহা বোধ হয় পাঠক বুঝিতে পারিতেছেন। খাঁ সাহেব যখন যশোরে নৌকায় আরোহণ করেন, তিনি যে যশোর হইতে পলায়ন করিতেছেন তখন মাঝিরা তাহা বুঝিতে পারে নাই। তিনি সলিমাবাদের বিশেষ কোন গোপনীয় রাজকার্যে যাইতেছেন বলিয়াই তাহারা বুঝিয়াছিল; কিন্তু মনোহরপুর হইতে নৌকা ছাড়িলে অরুণাবতী যখন পলায়নমান-বেশে নৌকায় উঠিল তখন তাহারা বুঝিল যে, সেনাপতি প্রতাপাদিত্যের কন্যাকে কুলের বাহির করিয়া লইয়া পলায়ন করিতেছেন। তাহারা নিজেদের পরিণাম ভাবিয়া উদ্বিগ্ন হইল; তাহাদেরই নৌকায় মাহতাব খাঁ পলায়ন করিয়াছে, প্রতাপ ইহা সহজেই জানিতে পারিবেন। জানিতে পারিলে তাহাদিগকে যে জান, বাচ্চা বুনিয়াদসহ জ্বলন্ত আগুনে পুড়াইয়া মারিবেন, ইহা স্মরণ করিয়া শিহরিয়া উঠিল। তাহাদের গায়ে ঘর্ম ছুটিল। অন্যদিকে সেনাপতির ভয়ে নৌকা বাহনেও অস্বীকৃত হইবার সাহস ছিল না। ঘটনা যতদূর গড়াইয়াছে তাহাতেই তাহাদের প্রাণরক্ষা হইবে কি না সন্দেহের বিষয়। তবে নিজেদের অজ্ঞতা জানাইয়া সেনাপতির রাজকন্যা হরণের সংবাদ রাজাকে অর্পণপূরুক আপনাদের নির্দোষত্ব জ্ঞাপন করিতে পারিলে হয়ত প্রতাপাদিত্য তাহাদিগকে ক্ষমা করিতে পারেন, এই বিশ্বাসে তাহারা পলায়ন করিল। সেনাপতি সাহেব নিজের ব্যস্ততা এবং নিজের বিপচ্ছিন্ততার মধ্যে মাঝিদের বিপদের কথা একবারও ভাবিবার অবসর পান নাই। তিনি যেরূপ উদার ও মহদন্তঃকরণের লোক ছিলেন, তাহাতে মাঝিরা নিজেদের বিপদের কথা খুলিয়া বলিলে, তাহাদিগকে নিজের সহস্র বিপদের মধ্যেও বিদায় করিয়া দিতেন।
যাহা হউক, মাঝিরা পলায়ন করিবার প্রায় একপ্রহর পরে মাহতাব খাঁর নিদ্রা ভাঙ্গিল। তিনি দাঁড়ের শব্দ না শুনিয়া নৌকার ভিতর হইতে বাহির হইলেন। বাহির হইয়া দেখিলেন, মাঝি-মাল্লার কোন নিদর্শন নাই। নৌকা একগাছি রজ্জু দ্বারা একটি গাছের মূলে বাঁধা রহিয়াছে। প্রকৃত রহস্য বুঝিতে তাঁহার বিলম্ব হইল না। তৎক্ষণাৎ তিনি অরুণাবতীকে জাগাইয়া সমস্ত বৃত্তান্ত বুঝাইয়া বলিলেন। মাঝিদের পলায়নে প্রতাপ-দুহিতা নিতান্ত উদ্বিগ্ন ও অধীর হইয়া পড়িল। পাছে বা পশ্চাদ্ধাবিত রাজ-অনুচরদের হস্তে ধৃত হওয়ায় উচ্ছ্বসিত, জীবনের উদ্দাম সুখ ও প্রেমের কল্পনা মরীচিকায় পরিণত হয়! তাহার হৃদয়-তরণীর ধ্র্ববনক্ষত্র, তাহার তৃষ্ণার্ত জীবনের সুশীতল অমৃত-প্রশ্রবণ, তাহার জীবনাকাশের চিত্তবিনোদন লোচনরঞ্জন অপূরু জলধনু পরে বা বিপদগ্রস্ত হয়, এবম্বিধ চিন্তায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িল। মাহতাব খাঁ মুহূর্তে চিত্ত স্থির করিয়া অরুণাবতীকে করুণাময় আল্লাহ তায়ালার উপর নির্ভর করিতে বলিয়া শেষে বলিলেন, ‘প্রিয়তমে! এ বিপদে তুমি যদি কোনরূপ নৌকার হালটি ধরে রাখতে পার, তা হলে আমি একাই দাঁড় ফেলে নিয়ে যেতে পারি। এছাড়া আর কোন উপায় নাই। তুমি যখন হতভাগ্যের জীবন-সঙ্গিনী হয়েছ, তখন দুঃখ ভোগ করা ছাড়া উপায় কি?’
মাহতাব খাঁ এমন গভীর অনুরাগ এবং শুভ্র সহানুভূতির সহিত কথাটি বলিলেন যে, প্রতাপ-বালার কর্ণে তাহা অমৃতবর্ষণ করিল। নৌকায় আরোহণ করা পর্যন্ত মাঝিদের জন্য লজ্জায় পরস্পর কোন কথাবার্তা বলিতে পারে নাই। এক্ষণে লোক-সঙ্কোচ দূর হওয়ায় এবং বিপদ সমাগমে উভয়ের হৃদয়, চরু ও জিহ্বা মুক্তাবস্থায় সুরভিত প্রেমের অমিয় দৃষ্টি ও মধুর ভাষা উদ্গীর্ণ করিতে লাগিল। হাতুড়ির আঘাত যেমন দুইখ- উত্তপ্ত ধাতুকে পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্মিলিত করিয়া দেয়, বিপদও তেমনি দুইটি অনুরাগোষ্ণ হৃদয়কে একেবারেই মিলাইয়া দেয়। অগ্ন্যুত্তাপে অল্পপরিমিত দুগ্ধ যেমন বৃহৎ পাত্রকে পূর্ণ করিয়া ফুলিয়া উঠে, বিপদের আঁচেও তেমনি হৃদয়ের কোণে যে প্রেম, যে সহানুভূতি নীরবে আলস্যশয্যায় পড়িয়া ঘুমাইতেছে তাহাও জোরেশোরে দশগুণ উচ্ছ্বসিত হইয়া হৃদয়ের কুল ভাসাইয়া অপর হৃদয়কে ভাসাইয়া ফেলে। তখন দুই মিশিয়া এক হয়।
অরুণাবতী বাল্যকাল হইতেই নৌকা-ক্রীড়ারত ছিল বলিয়া হাল ধরিতে অভ্যস্তা ছিল। এক্ষণে বিপদকালে প্রতাপ-কুমারী হাল ধরিয়া বসিল, আর খাঁ সাহেব বীর-বাহুর বিপুল বলে দুই হস্তে দাঁড় ফেলিতে লাগিলেন। নৌকা নদীর খর-প্রবাহ কাটিয়া কল্ কল্ করিয়া ছুটিয়া চলিল। ছয় দাঁড়ে নৌকা যেরূপ দ্রুত চলিয়াছিল, মাহতাব খাঁর দুই দাঁড়েও নৌকা প্রায় সেইরূপ ছুটিল। মাহতাব খাঁ তালে তালে দাঁড় ফেলিতেছেন, আর সুন্দরী অরুণাবতী সাবধান-হস্তে পরস্পরের হাসিতে উভয়ের হৃদয়ে যে কোটি নক্ষত্রের স্নিদ্ধ আলোক মরকত-দ্যুতির ন্যায় জ্বলিতেছে-ঐ নীলাকাশের তারাগুলি যদি যে প্রেমামৃতমাখা দিব্য দীপ্তি দর্শন করিত, তাহা নক্ষত্রখচিত জলদ-বিমুক্ত অনন্ত নভোমণ্ডল, নিন্মে শ্যামলা ধরণী বক্ষে রজত-প্রবাহ বামনী নদী কোটি তারকার প্রতিবিম্ব হৃদয়ে ধারণ করতঃ উদ্দাম গতিতে কল্ কল্ ছল্ ছল্ করিয়া ফুটন্ত যৌবনা প্রেমোন্মাদিনী রসবতী যুবতীর ন্যায় সাগরসঙ্গমে ছুটিয়াছে; আর তাহার বক্ষে নবীন প্রেমিক-প্রেমিকা দাঁড় ফেলিয়া হাল ধরিয়া অনন্ত আনন্দ ও অপার আশায় হৃদয় পূর্ণ করিয়া নৌকা বাহিয়া চলিয়াছে। মরি! মরি!! কি ভুবনমোহন চিত্তবিনোদন লোচনরঞ্জন দৃশ্য! যে বিপদ এমন অবস্থায় সংঘটন করে, তাহা সম্পদ অপেক্ষাও প্রার্থনীয় নহে কি?
নৌকা ছুটিয়াছে। আকাশে তারকা দলও ছুটিয়া চলিয়াছে। বামনী ছুটিতেছে, বাতাস ছুটিতেছে। এ জগতে ছুটিতেছে না কে? জগৎ পর্যন্ত, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড পর্যন্ত ছুটিয়া চলিয়াছে। অনন্তকাল হইতে ছুটিতেছে, অনন্তকাল ছুটিবে। এ ছোটার কিছু শেষ নাই, সীমা নাই। রজনী পূর্ব গোলার্ধ ত্যাগ করিয়া পশ্চিম গোলার্ধে ছুটিল-ঊষার শুভ্র আলোক-রেখা ছুটিয়া আসিয়া অম্বর-অঙ্গ-বিলম্বিত শ্বেত পতাকার ন্যায় ফুটিয়া উঠিল। নদীব ঈষৎ আলোকিত হইল। শীতল-সলিল-শীকর-সিক্ত-মৃদু-সমীরণ নায়ক-নায়িকার বাবরী দোলাইয়া কুন্তল উড়াইয়া প্রতি মুণ্ডর্তে ছুটিয়া চলিল। মাহতাব খাঁর ঈষৎ স্বর্ণতা-মণ্ডিত শুভ্র-রজত-ফলকবৎ ললাটদেশে গুরুশ্রমে বিন্দু বিন্দু ঘর্ম ফুটিয়াছে। মাহতাব খাঁ দাঁড় তুলিয়া সম্মুখের দিকে স্থির ও দূরগার্মিনী দৃষ্টিতে চাহিলেন-দেখিলেন, দূরে-অতিদূরে একখানি প্রকাণ্ড নৌকায় কয়েকটি বাতি জ্বলিতেছে! হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল-আবার দেখিলেন,-পকেট হইতে দূরবীণ বাহির করিয়া দেখিলেন। যাহা দেখিলেন, তাহাতে বুঝিলেন বিপদ আসন্ন। অরুণাবতীও দেখিল, কেবল আলোক ছুটিয়া আসিতে দেখা যাইতেছে। অরুণাবতী ব্যাঘ্রসন্দর্শনভীতা মৃগীর ন্যায় কাঁপিয়া উঠিল!
মাহতাব খাঁ প্রকৃত বুদ্ধিমান বীরপুরুষের মত মুহুর্ত মধ্যে চিত্ত ও কর্তব্য স্থির করিয়া ফেলিলেন। অরুণাকে বলিলেন, “অরুণে! ব্যাকুল হইও না, আল্লাহ আছেন। আমাদের নৌকায় বাতি নাই, সুতরাং ওরা আমাদিগকে দেখতে পায় নাই। চল, নদীর তীরবর্তী জঙ্গলে আশ্রয় লওয়া যাক। নৌকা বেয়ে ওদের হস্ত অতিক্রম করা অসম্ভব। মুসলমান কখনও শত্রু দেখে আত্মগোপন করে না, কিন্তু আজ আত্মগোপন না করলে অমূল্য কোহিনূর তোমাকে রক্ষা করতে পারব না। নৃপকিরীট-শীর্ষ-শোভী কোহিনূর কক্ষনও কুক্কুরের গলায় অর্পণ করব না। অরুণা! তুমি আর বিলম্ব করো না, সমস্ত দ্রব্য গুছিয়ে পেটিকা-বদ্ধ কর। আমি এখন নৌকা তীরে লাগাচ্ছি।
অতি অল্প সময়েই মধ্যেই নৌকা তীরে লাগিল। মাহতাব খাঁ দ্রুত নামিয়া রজ্জু দ্বারা একটি বৃক্ষমূলে নৌকা বাঁধিলেন। তৎপর দুইজনে সমস্ত জিনিসপত্র নামাইয়া জঙ্গলের মধ্যে জমা করিলেন। সমস্ত দ্রব্য কথায় পুঞ্জীকৃত করিয়া নৌকার ছই ও পাটাতনের তক্তা-সকল গভীর জঙ্গলে রাখিয়া নৌকা ডুবাইয়া দিলেন। বামনীর উভয় পার্শ্বে সেই স্থানে বহুদূরব্যাপী অরণ্য। নিকটে কোথাও লোকালয় নাই। জঙ্গলে নানা জাতীয় বৃক্ষ। জঙ্গল এমন নিবিড় এবং বিশাল ছিল যে, তখন এখানে দলে দলে মৃগ বিচরণ এবং ব্যাঘ্র গর্জন করিত। পূর্বে শিকার উপলক্ষে দুই তিনবার মাহতাব খাঁ এ-জঙ্গলে পদার্পণ করিয়াছিলেন, তাই তিনি এ কাননের বিষয় অবগত ছিলেন। খাঁ সাহেব জিনিসপত্র একস্থানে রাখিয়া একস্থানে একটু দূরে বৃক্ষের নিবিড় অন্ধকারের মধ্যে আত্মগোপন করিয়া অরুণাকে লইয়া বসিলেন। হিংস্র শ্বাপদভীতির জন্য তিনি তাহার ‘খুনরেজ’ (রক্তপিপাসু) নামক তরবারি কোমর হইতে মুক্ত করিয়া হস্তে ধারণ করিলেন। জঙ্গলের ফাঁকের ভিতর দিয়া দূরবীণ ধরিয়া মাহতাব খাঁ শত্রুতরী পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। ক্রমে ঊষার আলোক আরও স্ফুটতর হইয়া উঠিল। অর্ধ ঘন্টার মধ্যে প্রতাপাদিত্যের প্রকাণ্ড নৌকা দাঁড়ের আঘাতে নদী বক্ষে ঊর্মি তুলিয়া এবং শব্দে উভয় তটের কানন-হৃদয়ে প্রতিধ্বনি জাগাইয়া মাহতাব খাঁ ও অরুণাবতীর আশ্রয়দাত্রী বনভূমি পশ্চাতে ফেলিয়া সলিমাবাদের দিকে ছুটিয়া চলিল। মাহতাব খাঁ অজু করিয়া ভক্তিপ্লুতচিত্তে বামনীর তটস্থ শ্যাম দুর্বাদলের কৃতজ্ঞতার অশ্রুবারি বর্ষণ করিলেন। অনন্তর মঙ্গলময় আল্লাহতালার পদারবিন্দে তরুণ অরুণিমা-জালে আকাশ-মেদিনী বামনীর চঞ্চল হৃদয় এবং কাননের বর্ষাবারি-বিধ্যেত সরস-শ্যামল-মসৃণ তরুবল্লীর পত্রে স্বর্ণ-চূর্ণজাল ছড়াইয়া অপূর্ব শোভা ফুটাইলে মাহতাব খাঁ অরুণাবতীর কর ধারণ করতঃ আশ্রয়ের উপযুক্ত স্থান অনুসন্ধানে কিঞ্চিৎ ভিতরে প্রবেশ করিলেন। অরণ্য-শাল, তমাল, সুন্দরী, ঝাউ, অশ্বত্থ, কদম্ব, বেত, কেতকী, হরীতকী, আমলকী, আম্র, খর্ৎুর, পনস প্রভৃতি জাতীয় অসংখ্য ক্ষুদ্র ও বৃহৎ বৃক্ষে পরিপূর্ণ। কোথায়ও নানাজাতীয় গুল্ম ও তৃণ বাড়িয়া ভূমি আচ্ছন্ন এবং অসম্য করিয়া ফেলিয়াছে। কোথায়ও বা মনুষ্য-হস্তকৃত সযত্ন-রচিত উদ্যান অপেক্ষাও বনভূমি মনোহর। রাশি রাশি কেতকী ও কদম্ব ফুল ফুটিয়া প্রভাত সমীরে গন্ধ ঢালিয়া সমস্ত বনভূমি আমোদিত করিয়া তুলিয়াছে। ঘুঘু, ফিঙ্গা, দোয়েল, শ্যামা, বন্য, কুক্কুট, বুলবুল, টিয়া প্রভূতি অসংখ্য বিহঙ্গ বিবিধ স্বরে মধুর কুজনে প্রভাত-কানন চঞ্চল ও মুখরিত করিয়া তুলিয়াছে। বন-প্রকৃতির সরস শ্যামল নির্মল নগ্ন শোভা দেখিয়া অরুণার নব প্রেমাকুল চিত্ত যেন প্রেমের আভায় আনন্দে ফুটিয়া উঠিল।
উভয়ে কিয়দ্দুর অগ্রসর হইয়া এক নির্মল-সলিলা সরসী দেখিতে পাইলেন। ক্ষুদ্র সরসীর চারিপার্শ্বে মখমল-বিনিন্দিত কোমল ও শ্যামল শম্পরাজি। তাহার মধ্যে বর্ষাঋতুজ নানাবিধ বিচিত্র বর্ণের তৃণৎজাতীয় পুস্প ফুটিয়া শ্যামল ভূমি অপূর্ব সুষমায় সাজাইয়াছে। সরোবরের জলে অসংখ্য মৎস্য ক্রীড়া কুর্দন করিতেছে। মাঝে মাঝে শাপলা ও কুমুদ ফুটিয়া মৃদু হিল্লোলে দুলিয়া দুলিয়া নাচিতেছে। জল এত পরিস্কার যে, নীচের প্রত্যেকটি বালুকা কণা দেখা যাইতেছে। রক্ত-রেখা-অঙ্কিত সমুজ্জ্বল শফরীর ঝাঁক রূপের ছাঁয় সরসীগর্ভ আলোকিত করিয়া ভ্রমণ করিতেছে। আকাশের নানাবর্ণ রঞ্জিত অম্বুদমালা আকাশসহ সরসীর তলে শোভা পাইতেছে। কি বিচিত্র দৃশ্য! কি মনোমোহিনী শোভা! দেখিয়া দেখিয়া প্রতাপ-তনয়া একেবারে মুগ্ধ-লুব্ধ এবং বিস্মিত হইয়া পড়িল। অরুণা অরণ্যভূমির উজ্জ্বল শ্যামল-বিনোদ কোমল শোভা আর কখনও দর্শন করে নাই। সুতরাং তাহার প্রেমাকুল তরুণ চিত্ত যে বনভূমির শান্তি সম্পদে, বিচিত্র সৌন্দর্যে এবং নির্জন প্রেমের সরস পুলকে মাতিয়া উঠিবে, তাহা ত অত্যন্ত স্বাভাবিক। তাহার এত আনন্দ হইল যে, ইচ্ছা হইতেছিল সে একবার পুস্পখচিত গালিচা-বিনিন্দী কোমল ঘাসের উপর চঞ্চলা হরিণী বা প্রেমোন্মাদিনী শিখিনীর ন্যায় নৃত্য করে। মাহতাব খাঁও অরণ্য প্রকৃতির স্নিগ্ধ শোভা এবং মোহন দৃশ্যে মুগ্ধ হইয়া গেলেন। ক্ষণেকের জন্য তাঁহার চিত্তা নগরের বণ্ড লোক সহবাস পূর্ণ অশান্তি ও কোলাহলময় জীবনের প্রতি ধিক্কার দিল। অলক্ষিতে তাঁহার প্রেমমদিরাকুল চিত্তের মর্ম হইতে প্রভাত-কানন মুখরিত করিয়া মধুর কণ্ঠে ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত ধ্বনিত উঠিলঃ
“দর ফসলে বাহার আগার তনে হুর শিরস্তী পুর ময়ে কদাহ্ বমন দেহদ বরলবে কীসত, গরচে বর্হর্ কসে সখুন্ বাশদ জীশ্ত। সগ্ বে বমন্ আরজাঁকে বরম্ নামে বেহেশত”
মাহতাব খাঁ সুললিত স্বরে সেই নির্জন কাননে সুধাকণ্ঠ বিহঙ্গাবলীর মধুর কুজনে মধু বর্ষণ করিয়া কয়েকবার ‘রুবাইয়াত’টি গাহিলেন। অরুণাবতী ফার্সী জানিত না, কৌতূহলাক্রান্ত চিত্তে মাহতাব খাঁকে জিজ্ঞাসা করিল,-“কি গাইছেন? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
মাহতাবঃ কি গাইব! তোমারই গান গাইছি।
অরুণাঃ আমার গান কেমন? গজলটা ভেঙ্গেই বলুন না!
“আচ্ছা তবে শোন,” এই বলিয়া-প্রস্ফুটিত শুভ্র রজনীগন্ধা মারুত হিল্লোলে যেমন করিয়া ফুটন্ত যৌবনা গোলাপ-সুন্দরীর রক্তব স্পর্শ করে, মাহতাব খাঁও তেমনিভাবে প্রণয়-সোহাগে চম্পক অঙ্গুলে অরুণাবতীর গোলাপী কপোল টিপিয়া বলিলেন, “কবি বলিতেছেন যে, আনন্দময় বসন্তকাল পুস্পিত নিকুঞ্জ কাননে যদি কোন অস্পরীবৎ সুন্দরী অর্থাৎ অরুণাবতী কোমল করপল্লবে এক পাত্র মদিরা আমার অধরে ধারণ করে, তাহা হইলে কুকুর আমা অপেক্ষা শতগুণে শ্রেষ্ঠ, যদি আর কখনও বেহেশত কামনা করি।”
অরুণা রুবাইয়াতের ব্যাখ্যা শুনিয়া ঈষৎ সলজ্জ কটাক্ষ হানিয়া স্মিত হাসিয়া বলিল, “বটে! কবি ত খুব রসিক।”
মাহতাবঃ আর আমি বুঝি অরসিক?
অরুণাঃ কে বলল?
মাহতাবঃ ভাবে!
অরুণাঃ কি প্রকারে?
মাহতাবঃ তবে মদিরাপাত্র কোথায়?
অরুণাঃ সে যে বসন্তকালে।
মাহতাবঃ এ বর্ষাকাল হলেও এ কাননে এখনও বসন্ত বিরাজমান।
অরুণাঃ আচ্ছা, বসন্তই যেন হ’লে; কিন্ত এখানে মদিরা কোথায়? আর তুমি মুসলমান, মদ্য যে তোমার জন্য হারাম।
মাহতাবঃ কবি যে মদ্যের কথা বলেছেন, তা’ হারাম নহে।
অরুণাঃ সে আবার কোন মদ্য?
“সে এই মদ্য” এই বলিয়া মাহতাব খাঁ যুবতীকে ভুজপাশে জড়াইয়া অধরে অধর স্থাপন করিলেন। অধল-রসামৃত পানে উভযের পুলকিত শিহরিত এবং বিমোহিত হইলেন। অরুণাবতী দেখিল সমস্ত পৃথিবী যেন সুধারসে বিপ্লাবিত। সহসা একটা বুলবুল উড়িয়া আসিয়া অরুণাবতী সেই বিহঙ্গের দৃষ্টিতে লজ্জিত হইয়া আনত চুতে চুম্বনাকৃষ্ট মুখ সরাইয়া লইল। যুবতী-হৃদয় যৌবনতরঙ্গে যেমন প্রেমাকুল, লজ্জায় তেমনি সদা অবগুণ্ঠিত।
মাহতাব খাঁ সরোবরের অদূরে গোলাকারে ঘণ সন্নিবিষ্ট তালবৃ পূর্ণ এশটি উচ্চস্থান দেখিতে পাইলেন। তাল গাছগুলির ফাঁকে বেতের লতা এমন ঘন ভাবে জন্মিয়াছে যে, বাহির হইতে মধ্যস্থানের নির্মল তৃণাচ্ছাদিত স্থানটুকু সহসা দেখা যায় না। অরুণাবতীও সেইস্থানে কানন-বাসের কুটীর নির্মাণের জন্য পছন্দ করিল। একদিকের কিঞ্চিৎ বেত কাটিয়া দ্বার প্রস্তুত করা হইল। অতঃপর ছোট ছোট দেবদারু ও সুন্দরী গাছ কাটিয়া মঞ্চ প্রস্তুতপূর্বক নৌকার ছই এবং গোলপাতার সাহায্যে দুইটি রমণীয় কুটীর প্রস্তুত করা হইল। কাঁচা বেত চিবিয়া তদ্বারা বন্ধনীর কার্য শেষ করা হইল।
প্রতাপাদিত্যের নৌকা বামনী নদী হইতে ফিরিয়া না গেলে অরুণাকে লইয়া সেই ভীষণ জঙ্গল অতিক্রম করতঃ অন্যত্র যাওয়া মাহতাব খাঁর পক্ষে নিতান্ত অসুবিধা ছিল। কয়েক ক্রোশ পশ্চিমে আর একটি নদী আছে। সেখানে সহসা নৌকা পাওয়ার সম্ভাবনা নাই। এদিকে নৌকা ব্যতীত কোন নিরাপদ স্থানে যাইবার সুবিধা নাই। কারণ তখন সুন্দরবনের এই অঞ্চল অসংখ্য নদী-প্রবাহে বিভক্ত ও বিধৌত ছিল। হেমন্তকাল হইতে বৈশাকের শেষ পর্যন্ত এই সমস্ত অরণ্যে লোকের খুব চলাচল হইত। নল, বেত এবং নানাজাতীয় কাষ্ঠ আহরণের জন্য বহু লোকের সমাগম হইত। কিন্তু বৃষ্টিপাত আরম্ভ ও বর্ষা সূচনা হইলেই এই সমস্ত অরণ্য জনমানব-শূন্য হইয়া পড়িত। মাহতাব খাঁ একাকী হইলে, এই বনভূমি অতিক্রম করিয়া প্রতাপের রাজ্যের বাহিরে চলিয়া যাইতেন, কিন্তু অরুণাবতীর বিপদ ও ক্লেশ ভাবিয়া সেই কাননেই আবাস কুটীর রচনা করিলেন। বিশেষতঃ অরুণাবতী এবং মাহতাব খাঁর প্রেম-উচ্ছ্বসিত হৃদয়, কিছুদিন এই রমণীয় কাননাবাসে বাস করিবার জন্যও ব্যাকুল হইয়াছিল। নৌকায় রন্ধন করিবার পাতাদি সমস্তই ছিল। প্রায় দুই মণ অত্যুৎকৃষ্ট চাউল, কিছু ডাল, ঘৃত, লবণ ও অন্যান্য মশলা যাহা ছিল, তাহাতে দুইজনের দুই মাস চলিবার উপায় ছিল। বনে হরিণ, নানাজাতীয় খাদ্য পক্ষী এবং সরোবরে মৎস্যের অভাব ছিল না। মাহতাব খাঁ প্রথম দিবসেই এক হরিণ শিকার করিয়া তাহার গোশত কাবাব করিয়া অরুণাবতী সহ পরমানন্দে উদরপূর্তি করিলেন।
অরুণাবতী মাহতাব খাঁর নিকট ইসলামের পবিত্র কলেমা পড়িয়া মুসলমান ধর্মে দীতি হইল। অপাততঃ আত্মরক্ষার জন্য উভয়েই সেই নিবিড় বনে বাস করিতে লাগিলেন।
[sb]দশম পরিচ্ছেদ
মহরম উৎসব
১৭ই আষাঢ় মহরম উৎসব। সেকালের মহরম উৎসব এক বিরাট ব্যাপার, সমারোহকা- এবং চিত্ত-উন্মাদক বিষয় ছিল। মহররমের সে অসাধারণ আড়ম্বর, সে জাঁক-জমক, সে ক্রীড়া-কৌশল, সে লাঠি ও তলোয়ার খেলা, সে বাদ্যোদ্যম এবং যাবতীয় নর-নারীর মাতোয়ারা ভাবের উচ্ছ্বাস, সে বিরাট মিছিল, সে মর্সিয়া পাঠ, সে শোক প্রকাশ, সে দান খয়রাৎ, মহররমের দশদিন ব্যাপী সে সাত্ত্বিক ভাব, বর্তমানে কল্পনা ও অনুমানের বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সেকালের হিন্দু-মুসলমান, ধনী-দরিদ্র, আলেম-জাহেল, সকলেই মহরম উৎসবে যোগদান করিতেন। তখন বাঙ্গালা দেশে অদূরদর্শী কাটমোল্লার আবির্ভাব ছিল না; সুতরাং মহরম উৎসব তখন বেদাত বলিয়া অভিহিত হইত না। মহররমের দশ দিবস কেবল মুসলমান নহে, হিন্দুরা পর্যন্ত পরম পবিত্রভাবে যাপন করিতেন। মহররমের দশ দিবস চোর চুরি করিত না, ডাকাত ডাকাতি করিত না, লম্পট লাম্পট্য ত্যাগ করিত। ধনী ধনভান্ডার মুক্ত করিয়া গরীবের দুঃখ বিমোচন করিত। ক্ষুধার্ত অন্ন পাইত, তৃষ্ণার্ত সুমিষ্ট সরবৎ পাইত, বস্ত্রহীন বস্ত্র পাইত, প্রত্যেক লোক প্রত্যেকের নিকট সাদর সম্ভাষণ, আদর আপ্যায়ন এবং প্রেমপূর্ণ ব্যবহার পাইত। ‘আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সমস্ত কার্য ফেলিয়া মহরম উৎসবে যোগদান করিতেন। বীরপুরুষ অস্ত্রচালনায় নৈপুণ্য লাভ করিয়া বীরত্ব অর্জন করিবার, কারু ও শিল্পীগণ মহররমের তাজিয়া সংগঠনে আপনাদের সূক্ষ্ম কারুকার্যের সৌন্দর্য দেখাইবার জন্য মস্তিষ্ক পরিচালনা করিবার, বালক-বালিকাগণ ‘কাসেদ’ সাজিয়া আনন্দ উপভোগ করিবার, ধনী দান-খয়রাতে বদান্যতা লাভ করিবার, দেশবাসী গ্রামবাসী পরস্পরের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া বন্ধুত্ব লাভ করিবার, দলপতিগণ বিভিন্ন দলের পরিচালনা করিয়া নেতৃত্ব অর্জন করিবার এবং সর্বোপরি সকলেই এই দশ দিন নির্মল আনন্দ, বিপুল উৎসাহ, সামরিক উত্তেজনা, শত্র্ব-সংহারে উদ্দীপনা এবং মিত্রের প্রতি হিতৈষণা পোষণ করিবার সুবিধা পাইত।’ মহররমের দশ দিন সমারোহের দিন- উৎসাহের দিন এবং পুণ্যের দিন ছিল। সমগ্র দেশ বাদ্যোদ্যমে মুখরিত- শানাইয়ের করুণ-গীতিতে প্রাণ দ্রবীভূত, খেলোয়াড় এবং বীরপুরুষদিগের অস্ত্র সঞ্চালনে, হুঙ্কারে এবং সদর্প অভিযানে চতুর্দিক উৎসাহ আনন্দে পরিপূর্ণ-মেদিন কম্পিত-দিঙ্ম-ল চমকিত হইত! মিছিলের বিপুল আড়ম্বরে, তাজিয়া ও দুলদুলের বিচিত্র সজ্জায়, কারুকার্যে, পতাকার উড্ডয়নে,
অশ্বারোহীদিগের অশ্ব সঞ্চালনে কি চমৎকার দৃশ্যই না প্রতিভাত হইত! মর্সিয়ার করুণ তানে প্রাণের পর্দায় পর্দায় কি করুণ রসেরই না সঞ্চার করিত। মহররমের দশ দিনে ইসলামের কি অতুল প্রভাবই প্রকাশ পাইত! মহাত্মা ইমাম হোসেনের অপূর্ণ আত্মোৎসর্গ ও অদম্য স্বাধীনতা-স্পৃহার উন্মাদনা গগনে পবনে পবনে নব জীবনের স্ফূর্তি ও উল্লাস ছড়াইত। রোগী রোগশয্যা হইতে উঠিয়া বসিত, ভীরু সাহস পাইত, হতাশ ব্যক্তিও আশায় মাতিয়া উঠিত। উৎপীড়িত আত্মরক্ষার ভাবে অনুপ্রাণিত হইত, বীরের হৃদয় শৌর্যে পূর্ণ হইত। মহররমের দশ দিন দিগ্বিজয়ী বিরাট বিশাল মুসলমানজাতির জ্বলন্ত ও জীবন্ত প্রভাব প্রকাশ পাইত। মুসলমান এই দশ দিন বাহুতে শক্তি, মস্তিষ্কে তেজঃ, হৃদয়ে উৎসাহ এবং মনে আনন্দ লাভ করিতেন। সমগ্র পৃথিবীতে মহররমের ন্যায় এমন শিক্ষাপ্রদ, এমন নির্দোষ, এমন উৎসাহজনক পরু আর নাই। অধম আমরা, মূর্খ আমরা, অদূরদর্শী আমরা, তাই মহরম-পরু দেশ হইতে উঠিয়া গেল। জীবন্ত ও বীরজাতির উৎসব কাপুরুষ, অলস, লৰ্যহীনদিগের নিকট আদৃত হইবে কেন? বীর-কূল-সূর্য অদম্যতেজা হজরত ইমাম হোসেনের অতুলনীয় আত্মোৎসর্গ ও স্বাধীনতাস্পৃহার জ্বলন্ত ও প্রাণপ্রদ অভিনয়, প্রাণহীন নীচচেতা স্বার্থান্ধদিগের ভালো লাগিবে কেন? পেচকের কাছে সূর্য, কাপুরুষের কাছে বীরত্ব, বধিরের কাছে সঙ্গীত, অলসের উৎসাহ কবে সমাদর লাভ করে? যখন বাঙ্গালায় মুসলমান ছিল, সে মুসলমানের প্রাণ ছিল-বুদ্ধি ছিল- জ্ঞান ছিল- তেজঃ ছিল- বীর্য ছিল; তখন মহরম উৎসবও ছিল। যাহা হউক, উৎসবের কথা বলিতেছিলাম, তাহাই বলি।মহরমের ১০ তারিখ- বাঙ্গালার পল্লীপ্রান্তর শহর বাজার কম্পিত করিয়া মুহুর্মুহুঃ ইমাম হোসেনের জয়ধ্বনি উচ্চারিত হইতেছে। দ্বিপ্রহরের সঙ্গে সঙ্গেই সাদুল্লাপুর হইতে এক ক্রোশ পশ্চিমে কল্পিত কারবালার বিশাল মাঠে চতুর্দিক হইতে বিচিত্র পর্বিছদধারী সহস্র সহস্র লোক সমাগত হইতে লাগিল। নানাবর্ণের বিচিত্র সাজ-সজ্জায় শোভিত মনোহর কারুকার্য ভূষিত ক্ষুদ্র ও বৃহৎ তাবুত, অসংখ্য পতাকা, সমুজ্জ্বল আসা-সোটা, ভাস্বর বর্শা, তরবারি, খঞ্জর, গদা, তীর, ধনু, সড়কি, রায়বাঁশ, নানা শ্রেণীর লাঠি, খড়গ, ছুরি, বানুটি প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্রে, স্বর্ণ-সজ্জা শোভিত দুল্দুল্, সহস্র সহস্র অশ্বারোহী ও শত শত হস্তিশোভিত মিছিলের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ দল চতুর্দিক হইতে শ্রেণীবদ্ধ সুশৃঙ্খল অবস্থায় কারবালার ময়দানের দিকে ধাবিত হইল। অসংখ্য বাদ্য নিনাদে জলস্থল কম্পিত এবং দিঙ্ম-ল মুখরিত হইয়া উঠিল। পিপীলিকাশ্রেণীর ন্যায় জনশ্রেণী জল ও স্থল আচ্ছন্ন করিয়া নানা পথে নৌকায় কারবালার ময়দানে ধাবিত হইল। জন-কোলাহল সাগর-কল্লোলবৎ প্রতীয়মান হইতে লাগিল। পঁচাত্তরটি ক্ষুদ্র ও বৃহৎ মিছিলের দল শতাধিক তাবুতসহ বিভিন্ন গ্রাম হইতে বিভিন্ন পথে আসিয়া কারবালার ময়দানের বিভিন্ন প্রবেশপথ-মুখে অপেক্ষা করিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে ঈসা খাঁ মস্নদ-ই আলীর মহররমের বিপুল মিছিল আড়ম্বর, প্রতাপ ও অসাধারণ জাঁকজমকের সহিত কারবালার নিকটবর্তী হইল। ঈসা খাঁর রৌপ্য-নির্মিত স্বর্ণ ও অসংখ্য মণি-মাণিক্য-খচিত সুচারু ছত্র, অসংখ্য কিঙ্কিণীজাল সমলঙ্কৃত পতাকা, দর্পণ এবং কৃত্রিম লতাপুষ্প এবং নানা বিচিত্র কারুকার্য-শোভিত ত্রিশ হস্ত পরিমিত উচ্চ, বিশাল ও মনোহর তাবুত মিছিলের অগ্রভাগে একশত ভারবাহীর স্কন্ধে বাহিত হইল। ঈসা খাঁর তাবুত দেখিবামাত্রই সেই বিপুল জনতা সমুদ্র-গর্জনে “হায়! হোসেন! হায়! হোসেন!” রবে স্থাবর জঙ্গম চরাচর জগৎ যেন কম্পিত করিয়া তুলিল। মধ্যাহ্ন ভাস্করের প্রখর কিরণে তাজিয়ার শোভা শতগুণে ঝলসিয়া উঠিল। তাজিয়ার পশ্চাতে দুই সহস্র অশ্বারোহী উর্দী পরিয়া বামহস্তে রক্তবর্ণ বিচিত্র পতাকা বিধূনন এবং দক্ষিণ করে উলঙ্গ কৃপাণ আস্ফালন করিয়া গমন করিল। তাহার পশ্চাতে পাঁচশত সুসজ্জিত স্বর্ণ-আস্তরণ-বিমন্ডিত হস্তী তালে তালে সমতা রক্ষা করিয়া পৃষ্ঠে ভীষণ ভাস্বর বর্শাধারী দুই দুই জন বীরপুরুষকে বহন করতঃ উপস্থিত হইল। তৎপশ্চাৎ দুইশত বাদ্যকর ঢাক, ঢোল, ভেরী, শানাই, পটহ, ডঙ্কা, তুরী, জগঝম্প, দফ, শিঙ্গা প্রভৃতি নানাবিধ বাদ্যে ভূতল খতল কম্পিত করিয়া কারবালায় উপস্থিত হইল। তাহার পশ্চাতে শত শত খেলোয়াড় লাঠি, তরবারি, বানুটি, সড়কির নানা প্রকার ক্রীড়া-কৌশল দেখাইতে দেখাইতে ভীমতেজে অগ্রসর হইল। তৎপর নানাজাতীয় পতাকা ও ঝান্ডা পুনরায় দেখা দিল। তৎপর কৃষ্ণবর্ণ অশ্বপৃষ্ঠে কৃষ্ণসজ্জায় শোভিত তেজঃপুঞ্জমূর্তি মহাবীর ঈসা খাঁ শত অশ্বারোহী-বেষ্টিত হইয়া অগ্রসর হইলেন। তৎপশ্চাতে শুভ্র পর্বিছদ-সমাবৃত দক্ষিণ হস্তে শ্বেত এবং বাম হস্তে কৃষ্ণ চামর-শোভিত সহস্র যুবক পদব্রজে বিলাপ এবং ব্যঞ্জন করিতে করিতে আগমন করিল। তৎপর বিপুল জনতা গৈরিক-প্রবাহের ন্যায় চতুর্দিক হইতে কারবালায় প্রবেশ করিল। ঈসা খাঁর তাবুত কারবালায় প্রবেশ করিলে, অন্যান্যা মিছিলের দল নানা পথে উল্লাস ও আনন্দে হঙ্কার করিয়া কারবালায় প্রবেশ করিল। সম্ভ্রান্ত মুসলমান-কুলমহিলাগণ তাজ্ঞামে চড়িয়া সূক্ষ্ম যবনিকায় আবৃত হইয়া উৎসবক্ষেত্রের এক পার্শ্বে উপস্থিত হইলেন। অসংখ্য হিন্দু মহিলা লাল, নীল, সবুজ, বাসন্তী প্রভৃতি বর্ণের শাড়ী পরিয়া সিঁথিতে সিন্দুর মাখিয়া, নানাবিধ স্বর্ণ ও রৌপ্যালঙ্কারে বিভূষিত হইয়া, গুজরী মল, নূপুরের রুণু রুণু ঝুমু ঝুমু এবং ঝন্ ঝন্ কৃণ্ কৃণ্ শব্দে পল্লী ও প্রান্তরবক্ষে আনন্দনিক্কণ জাগাইয়া, রূপের ছটায় পথ আলোকিত করিয়া, কথার ঘটায় হাসির লহর তুলিয়া চঞ্চল শফরীর ন্যায় স্ত্রীলোকদিগের নির্দিষ্ট স্থানে জমায়েত হইল। মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে সহস্র সহস্র তরণী নানাবর্ণের নিশান উড়াইয়া দাঁড়ের আঘাতে জল কাটিয়া বাইচ দিতে লাগিল। অসংখ্য বালক-বালিকা এবং যুবক-যুবতীর উৎফুলৱ মুখকমলের আনন্দ-জ্যোতিঃতে মাথাভাঙ্গার জল-প্রবাহ আলোকিত এবং চঞ্চল হইয়া উঠিল। নদীর পারেই ঘোড়দৌড়ের বাঁধা রাস্তা; তাহাতে শত শত ঘোড়া প্রতিযোগিতা করিয়া ধাবিত হইতে লাগিল। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মহররমের শির্নী স্বরূপ নানা শ্রেণীর মিষ্টান্ন পাইয়া আনন্দ করিতে লাগিল। খেলোয়াড়গণ শত শত দলে বিভক্ত হইয়া নানাপ্রকার ব্যায়াম, অস্ত্র-চালনা এবং ক্রীড়া-কৌশল প্রদর্শন করিতে লাগিল। বিশাল ময়দানে এক মহা সামরিক চিত্তোন্মাদকর দৃশ্য! অগণিত নরনারী সেই মহা উত্তেজনাকর ক্রীড়া-কৌশল দেখিয়া মুগ্ধ ও লুব্ধ হইতেছে। মুহুর্মুহুঃ সেই বিশাল জনতা “ইমাম হোসে কি-ফতেহ” বলিয়া গগন-ভুবন কম্পিত করিতেছে। শত শত বালক তাম্বুর চূড়ার ন্যায় লম্বা টুপী মাথায় পরিয়া ছুটাছুটি করিতেছে। থাকিয়া থাকিয়া “হায়! হোসেন! হায়! হোসেন!” রবে প্রকৃতির বক্ষে শোকের দীর্ঘ লহরী তুলিতেছে। ধনাঢ্য নরনারীগণ তাবুত লক্ষ করিয়া পুষ্প, লাজ, পয়সা ও কড়ি বর্ষণ করিতেছে। দরিদ্রেরা পয়সা ও কড়ি আগ্রহের সহিত কুড়াইয়া লইতেছে। কেহ কেহ রাশি রাশি বাতাসা বর্ষণ করিতেছে। বালকের দল সেই বাতাসার লোভে হুড়া-হুড়ি, পাড়াপাড়ি করিতেছে। বিশাল ময়দানের চতুর্দিকে তাবুত লইয়া মিছিলসমূহ শ্রেণীবদ্ধভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। গায়কগণ স্থানে স্থানে দল বাঁধিয়া করুণকণ্ঠে উচ্চৈঃস্বরে কারবালার দুঃখ-দুর্দশার কাহিনী সঙ্গীতালাপে প্রকাশ করিতেছে। ধন্য ইমাম হোসেন! তুমি ধন্য! তোমার ন্যায় প্রাতঃস্মরণীয় এবং চিরজীবিত আর কে? ধন্য তোমার স্বার্থত্যাগ! ধন্য তোমার আত্মত্যাগ!! ধন্য তোমার স্বাধীনতা-প্রিয়তা! শত ধন্য তোমার অদমনীয় সাহস ও শৌর্য! তোমার ন্যায় বীর আর কে? তোমার ন্যায় স্মরণীয়ই বা আর কে? প্রজাতন্ত্র-প্রথা রক্ষা করিবার জন্য, ধর্ম ও ন্যায়ের মর্যাদা রক্ষা করিবার জন্য তোমার ন্যায় আর কে আত্মত্যাগ করিয়াছে? “মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন” এ প্রতিজ্ঞা তোমার দ্বারা পূর্ণ হইয়াছে। পুণ্যভূমি আরবের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, ইসলামের পবিত্রতম প্রজাতন্ত্র-প্রথা রক্ষা করিবার জন্য মৃত্যুর করাল গ্রাস এবং নির্যাতন ও অত্যাচারের ভীষণ নিষ্ঠুর যন্ত্রণাও তোমাকে বিচলিত করিতে পারে নাই। তুমি সবংশে ধ্বংস হইলে, তথাপি অন্যায়ের প্রভুত্বের নিকট মস্তক নত করিলে না। আজ অত্যাচারী এজিদের স্থান এবং তোমার স্থানের মধ্যে কি বিশাল ব্যবধান। তুমি আজ জগতের যাবতীয় নর-নারীর কণ্ঠে কীর্তিত, হৃদয়ে পূজিত। তুমি কারবালায় পরাজিত এবং নিহত হইয়াও আজ বিজয়ী এবং অমর।
মহরম উৎসব খুব জোরে চলিতে লাগিল। ক্রমে দিনমণি পশ্চম-গগনপ্রান্তে দ্র্বত নামিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে দিবসের শেষ-রশ্মি বৃক্ষের অগ্রভাগে উত্থিত হইল। সন্ধ্যা সমাগমে দুই একটি তারকা নীলাকাশে ফুটিতে লাগিল। আর দেখিতে দেখিতে অমনি জলস্থল সহসা প্রদীপ্ত করিয়া সহস্র সহস্র মশাল কারবালা ক্ষেত্রে জ্বলিয়া উঠিল। নানা বর্ণের মাহতাব, তুবড়ী এবং হাওয়াই জ্বলিয়া জ্বলিয়া কারবালার হত্যাকান্ডের দারুণ রোষানল উদ্গীর্ণ করিতে লাগিল। সহস্র সহস্র বোমের আওয়াজে আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িতে লাগিল। কি অপূরু দৃশ্য! প্রান্তরময় মনুষ্য! প্রান্তরময় অনল-ক্রীড়া! নদীগর্ভে অনল-ক্রীড়া! আকাশে অনল-ক্রীড়া! জলেস্থলে-অন্তরীক্ষে সরুত্র বিপুল উৎসাহ। বিপুল আনন্দ!! বিপুল কোলাহল!! বিপুল স্ফূর্তি!!!
সাদুল্লাপুর মিত্রদের বাড়ী হইতেও বিপুল সমারোহে তাজিয়ার মিছিল বাহির হইয়া কারবালায় আসিয়াছিল। পাঠকগণ! অধুনা ইহা পাঠ করিয়া বিস্মিত হইবেন। কিন্তু যে-সময়ের কথা বর্ণিত হইতেছে, তখনকার ঘটনা ইহাই ছিল। বাদশার জাতি মুসলমানের সকল কার্যেই হিন্দুর শ্রদ্ধা এবং সহানুভূতি ছিল। মুসলমানের মসজিদ এবং পীরের দরগা দেখিলে সকল হিন্দুই মাথা নোয়াইত, মুসলমানের ঈদ পর্বেও হিন্দুরা মুসলমানদিগকে পান, আতর এবং মিষ্টান্ন উপহার দিত। মুসলমানের পোষাক পরিয়া হিন্দু তখন আত্মাভিমান বোধ করিত। মহরম পরু-ত হিন্দুরা প্রাণের সহিত বরণ করিয়া লইয়াছিল। আজিও বাংলার বাহিরে বিহার এবং হিন্দুস্তানের হিন্দুরা মহরম পর্বে মুসলমানের ন্যায়ই মাতিয়া উঠে। অনেক রাজ-রাজরাদের বাড়ীতে দস্তরমত তাবুত উঠে এবং মিছিল বাহির হয়। আজিও হিন্দুস্তানে মহরম পর্বে হিন্দু-মুসলমানে গভীর একপ্রাণতা পরিলক্ষিত হয়।
সাদুল্লাপুর মিত্রদের বাড়ী হইতে স্থলপথে মিছিল আসিয়াছিল। আর জলপথে দুইখানি সুসজ্জিত পিনীসে বাড়ীর গিন্নি ও বধূরা, অন্যখানিতে স্বর্ণময়ী, মালতী এবং অন্যান্য বালক-বালিকা। মাল্লারা নৌকা বাইচ দিতেছিল। বরকন্দাজেরা দাড়ি-গোঁফে তা দিয়া ঢাল-তলওয়ার লইয়া পাহারা দিতেছিল। হেমদাকান্ত এবং অন্যান্য যুবকেরা অশ্বারোহণে আসিয়াছিল।
কাপালিক ঠাকুর রক্তবর্ণ চেলি পরিয়া কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা কাটিয়া স্বর্ণময়ীদের নৌকায় চড়িয়া মহররমের উৎস দেখিতেছিল। নদীগর্ভে একস্থানে ঈসা খাঁ কয়েকখানি রণতরী নৌযুদ্ধের অভিনয় করিতেছিল। স্বর্ণময়ী সেই অভিনয়ই সাভিনিবেশে পর্যবেক্ষণ করিতেছিল।
ঈসা খাঁ যে স্বর্ণময়ীর সহিত মহরম উৎসবের দিন দেখা করিতে চাহিয়াছিলৈন, হেমদাকান্ত তাহা বিলক্ষণ অবগত ছিল। কারণ ইহা গোপনীয় বিষয় ছিল না। দুর্মতি হেমদাকান্ত এক্ষণে এই ছলে স্বর্ণকে হরণ করিবার জন্য একটা কৌশল বিস্তার করিল। হেমদা নৌকার পাহারাওয়ালা বরকন্দাজদিগকে সহসা ডাকিয়া কয়েকটি ঘোড়া রক্ষা করিবার ভার তাহাদিগকে দিয়া, “আমি আসছি, তোমরা অপেক্ষা কর” বলিয়া সঙ্গের কয়েকটি কাশী-নিবাসী আগন্তুক বন্ধু লইয়া স্বর্ণের নৌকায় আসিয়া উপস্থিত হইল এবং অত্যন্ত ব্যবস্তা সহকারে মালতীকে সম্বোধণ করিয়া বলিল, “মালতী! তুই এবং অন্যান্য সকলে নেমে অন্য নৌকায় উঠ্, এ নৌকা তাজিয়া-ঘাটে নিয়ে যেতে হবে। তথায় নবাব সাহেব স্বর্ণকে দেখবার জন্য অপেক্ষা করছেন।” হেমদাকে বাটির ছেলেমেয়েরা অত্যন্ত ভয় করিত। সুতরাং হেমদা বলিবা মাত্রই তাহারা অন্য নৌকায় তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িল। অভিরাম স্বামী নৌকা হইতে নামিয়া ডাঙ্গায় উঠিল। মাঝি-মাল্লারা পিনীস তাড়াতাড়ি বাহিয়া তাজিয়াঘাটা পানে ছুটিল। হেমদার সঙ্গের ভদ্রবেশধারী কতিপয় ব্যক্তি নৌকায় উঠিয়া পড়িল। ‘ইহারা ঈসা খাঁর লোক, স্বর্ণকে লইতে আসিয়াছে,’ মাঝি-মাল্লারা ইহাই মনে করিল।
হেমদা এবং স্বামীজী দুইজন, জনতার মধ্যে মিশিয়া নানাস্থানে ক্রীড়া-কৌতুক এবং আতসবাজী দেখিতে লাগিল। অনেক বিলম্বে তাহারা বরকন্দাজদিগের নিকট উপস্থিত হইল। উপস্থিত হইয়াই তাড়াতাড়ি বলিল, “যাও, যাও, তোমলোগ জলদি তাজিয়া-ঘাটামে কিস্তীকে হেফাজত মে যাও! ওঁহা নবাব সাহেবকা সাথে মোলাকাত করনেকে লিয়ে রাজকুঙারী তশ্রিফ লে গেয়ি হায়। জল্দি ওঁহা যানা।” বরকন্দাজেরা “হুজুর”, বলিয়া তাজিয়া-ঘাটের দিকে দৌড়াইল।
অভিরাম স্বামী পূর্বেই মাঝি এবং মাল্লাদিগকে একটি এমন ঔষধ পানের সহিত মিশাইয়া খাইতে দিয়াছিলেন যে, তাহারা তাজিয়া-ঘাটায় নৌকা লইয়া একটু বিশ্রাম করিতেই বেহুশ এবং সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িল। তখন সেই ছদ্মবেশী গুন্ডার দল পাল তুলিয়া মাথাভাঙ্গা নদীর পশ্চিমগামী একটা ক্ষুদ্র শাখার দিকে নৌকা চালাইল। নৌকা ভরা-পালে উড়িয়া চলিল।


চলবে.।.।.।.।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৫:২৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×