somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জয় গুরু ( চন্দন )

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পড়তে ভালো লাগলো তাই শেয়ার করলাম
অরিত্রর মন খারাপ। রিনির জন্য। ওকে কিছুতেই মোবাইলে ধরতে পারছে না। সকালের দিকে বিজ়ি টোন পেয়েছিল। হয়তো ফেসবুকে চ্যাট করছিল। কিন্তু বিকেলের পর থেকে অন্তত দশবার ফোন করেছে। এমন কী পরের দিনও। ওদিক থেকে ‘নো রিপ্লাই’। এমনই আকাট, কোথায় থাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। এগুলো তো কমন সেন্স! প্রথম দু’-একদিনের আলাপের সূত্রপাত তো এইভাবেই হয়। কোথায় থাকিস? কী পড়িস? কী পছন্দ করিস, ইত্যাদি। এসব কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। ওর রূপে-গুণে পুরো ফিদা অয়ন। অথচ গতপরশু সন্ধেবেলায় কতক্ষণ কাটিয়েছে। কথা হয়েছে। মোহরকুঞ্জ তখন জমজমাট ছিল।

আলোর ঝরনা দেখতে খুব ভাল লাগে রিনির। বছরদুয়েক আগে দাদা-বউদির কাছে গিয়েছিল বেড়াতে। ওরা স্টেট্সে অ্যারিজ়োনাতে থাকে। সেখান থেকে লাস ভেগাসে বেলাজিও হোটেলের সামনে আলোর ঝরনা দেখেছিল। সে আরও বিশাল, সুন্দর। ফোয়ারার জলে আরও ভেরিয়েশন। মিউজ়িকের সঙ্গে ঝরনাধারায় জলপরিরা যেন নূপুর পরে ডান্স করছিল। সেই কারণে মোহরকুঞ্জের আলোকঝরনা ওর মন টানে। তার পিছনে সাদা ভিক্টোরিয়া ঠায় দাঁড়িয়ে।

আর অরিত্রর মন টানে খেলতে। রিনির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে ইলিবিলি খেলা। রিনির শরীরের খাঁজে-খাঁজে অজন্তা ইলোরার ভাস্কর্য। রিনি সেটা বোঝে বলেই সেই খেলায় অরিত্রকে অ্যালাউ করে। তবে একটা লক্ষ্মণ রেখাও টানা থাকে।
একটু ফাঁকা জায়গায় বেঞ্চে ওরা পাশাপাশি বসেছিল। জায়গাটা ছায়া-অন্ধকারে ঢাকা। ঠিক দু’জনেরই পছন্দমতো জায়গা। বিশেষ কেউ দেখার নেই। ডিস্টার্ব করারও নেই। অরিত্র নেটে বল নিয়ে ড্রিবল করছিল। পায়ে নয় হাতে। গোল করার জন্য উসখুসে-হাত ফাঁক-ফোকর খুঁজছিল। সব খেলার একটা নিয়ম থাকে। এ খেলার কোনও বাঁধা-ধরা নিয়ম নেই। যে যেরকম খেলতে পারে।

রিনি মিছিমিছি রাগ দেখিয়ে বলেছিল, “তা বলে এই পাবলিক প্লেসে বসে? তুই কিন্তু লিমিট ক্রস করছিস। জানিস, এইসব চত্বরে ড্যাডের কত স্পাই ছাড়া আছে? খবর পেলে হাত ভেঙে দেবে।”
অরিত্র তখন রিনির শরীরের ঘ্রাণে বুঁদ। ঠোঁট দু’টো ওর ঘাড়ে গুঁজে টুকুস করে চুমু খায়। বলেছিল, “নিকুচি করেছে তোর ড্যাডের। এ হাত হচ্ছে গিয়ে মারাদোনার ভগবানের হাত। ধরতে পারলে তো। একেবারে নিখুঁত প্লেসিং।”
মুখে বললেও অরিত্রর বুকের মধ্যে ধুকপুকুনি শুরু হয়েছিল। ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে থাকে। গতকাল দু’জনের মোহরকুঞ্জের সাক্ষাত্‌কারটা ছিল পাঁচবারের। সম্ভবত দ্বিতীয় সাক্ষাতে এই মোহরকুঞ্জেই দু’জনে পাশাপাশি বসেছিল। তখন অতটা ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বিঘতখানেক ফাঁক ছিল মাঝে। রিনি সাইড ব্যাগ থেকে একটা ডিজিটাল ক্যামেরা বার করে বলেছিল, “দেখ, আমার ছবিটা দারুণ না?”
বেশ বিজ্ঞাপনের মেয়েদের মতো হাসিখুশি রিনি। টোল পড়াতে আরও সুন্দর লাগছিল।
অয়ন বলেছিল, “তোরটা তো জাস্ট ফাটাফাটি। কিন্তু তোর সঙ্গে গব্বর-গুঁফো লোকটা কে রে?”
“মারব থাপ্পড়। ওটা আমার ড্যাডি। কত ম্যানলি ফিগার। কোথায় আছে জানিস?”
“কোথায় আবার, নিশ্চয়ই মাংসের দোকানে মাংস কাটে।”
“একদম ফালতু বকবি না!” রিনি তর্জনী তুলে বলেছিল।
“বলব না তো কী, বল? কসাইয়ের মতো এমন তাগড়াই গোঁফ কেউ রাখে?”
রিনি রাগে বিড়বিড় করতে থাকে। ড্যাডি ওকে ভীষণ ভালবাসে। ও নিজেও ‘ড্যাডি’ বলতে অজ্ঞান। সেই ড্যাডি সম্বন্ধে উল্টোপাল্টা কথা? চুড়িমার্কা কানের দুল দুলতে থাকে।
“বাবা লালবাজারে পোস্টিং। অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অফ পুলিশ, জানিস?”
শুনেই তো অরিত্র বোমকে গেল। খেয়েছে রে! জুটবি তো জোট, শেষকালে পুলিশ কত্তার মেয়ে! শালা, বাপের চেহারাটাও টিপিক্যাল খচ্চরের মতো। ছবিতে বেশ লম্বা মনে হল। ফরসা রং। ভরাট লালচে মাল-খাওয়া গাল। জোড়া ভুরু। তীক্ষ্ম বাজপাখির মতো চাউনি।
যদিও অরিত্রর চেহারাটা একেবারে ফেকলুর মতো ফ্যালনা নয়। বরঞ্চ একটু ‘পাগলু’ কাটিং। ছ’ফুটের কাছাকাছি হাইট। চেহারায় সিক্স-প্যাক না থাকতে পারে, তবে একেবারে পঁ্যাক-খাওয়া নয়। তামাটে রং। চোখ-মুখ শার্প। লম্বাটে মুখ কিছুটা গ্রিক পুরুষদের মতো। সুট-টাই পরা অরিত্রকে দেখলে হলিউডি হিরো মনে হয়। না হলে প্রথম দর্শনেই রিনির মতো মেয়ে প্রেমে ফিদা হয়? বাপের দিক থেকে একেবারেই কমজোরি, যেটুকু ছিলেন তাও বা রইলেন কোথায়? সাদামাটা চাকরি করতেন। ইউনিয়নের লিডার ছিলেন। সারাজীবন দৌঁড়ঝাপ, রিটায়ার করার পর যে একটু সুখ ভোগ করবেন, তাও কপালে জুটল না। অতিরিক্ত সিগারেট টেনে হার্ট-লাংসের বারোটা বাজিয়ে দুম করে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। এখন ওদের সংসার মানে অরিত্রর বিধবা মা আর অরিত্র।

সুতরাং অরিত্রবাবু, একটু ভাবো। ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিয়ো না। এদিক-ওদিক করলেই ফাটকে। রিনির জাঁদরেল বাপের সঙ্গে পাঙ্গা নিতে হলে হাফসাইজের মন্ত্রী বা ফুল সাইজের এমএলএ-এমপির ব্যাটা হতে হবে। যে কিনা অক্লেশে বলতে পারবে, “এ হাত মুঝে দে দে গব্বর।” তোমার বাপ নেই। তার আবার হাফ, ফুল সাইজ। অর্থাত্‌ সেদিক থেকে তুমি বিগ জ়িরো।
এদিকে অরিত্রর জ়িরোতে মন ভরে না। কে-ই বা চায় এমন খেলায় জ়িরো স্কোর করতে? ও থামতে চায় না, ওর ডানহাতটা রিনির কাঁধ টপকে টপের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়েছে। বিভাজিকার ফাঁক দিয়ে সুডৌল বুকে, স্তনে আঙুল চালায়। ললিপপ রিনি তখন গলে-গলে পড়ছিল। বলছিল, “অ্যাই, বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছিস। হাতটা সরা না। আমার অস্বস্তি হচ্ছে।”
অরিত্র আধো-আদুরে গলায় বলেছিলয, “আমার গুরু বলেছেন, পেয়ার করতে হলে সেক্স আসবেই। আর দ্যাখ, পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া… এসব লাখ-লাখ উদাহরণ দিতে পারি, বুঝেছিস।”
“অসভ্যতাই তো শিখেছিস। হাত সরা বলছি। না হলে খুব খারাপ হয়ে যাবে…” আবার কপট রাগ। রিনির রূপ-লাবণ্য-সৌন্দর্যে সত্যিই নেশা আছে। অরিত্র তখন পাগল। ভাবে বড়লোকের বাপ-ন্যাওটা আদুরে মেয়ে, এই যা। হতেই পারে। কিন্তু…
‘কিন্তু’তেই ফুলস্টপ পড়ে গেল। অরিত্র হাত সরিয়ে ভাল ছেলের মতো বসে রইল। ব্যাটা বাপ জানতে পেরে প্রেম রুখে দিলে? জানতে না পারাটাই অস্বাভাবিক। প্রথমত পুলিশের মেজকত্তা, তার ওপর মেয়ে ভাবে ‘ড্যাডি হো তো অ্যায়সা।’ বন্ধুর মতো ড্যাডি। অতএব বলা যেতেই পারে। জানো তো বাবা, ছেলেটা দেখতে দারুণ। নন্দনে সিনেমা দেখতে গিয়ে আলাপ… ইত্যাদি। কথা শেষ করতে দেবেন তো? যা কসাই-কসাই চেহারা। জীবনে কোনওদিন প্রেম-ট্রেম করেছে বলে মনে হয় না। রস-কষ আছে বলেও মনে হয় না। পিকিউলার মিক্সড ক্যারেকটার। চোর-বাটপাড় ঠ্যাঙাতে-ঠ্যাঙাতে ঠ্যাঙাড়ে হয়ে গিয়েছে। তারপরেই ফাটকে পুরে অরিত্রকে রাম-ক্যালানি। যে-কোনও একটা ইভটিজ়িং-মিজ়িং কেস দিলেই হল। রিনি রুখে দাঁড়াতে পারবে তো? হয়তো পারল। বলল, আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না ড্যাডি। তুমি কি চাও আমি সুইসাইড করি… ইত্যাদি। কিন্তু ও কি অরিত্রর বিধবা শান্ত নিরীহ মাকে মেনে নেবে? কষ্ট দেবে না তো! মা-টা যে বড় ভাল। মা-ই তো সব। কত কষ্ট করেছেন অরিত্রর জন্য। এটাও তো ঠিক, সব বড়লোকের মেয়েরা মেজাজি রাগি হয় না। শেষকালে সুচিত্রা-সৌমিত্রর সাতপাকে বাঁধা হয়ে যাবে না তো! অন্তিমে ছাড়াছাড়ি। ওইটুকু সময়ের মধ্যে সাত-পাঁচ অনেক কিছু ভাবে। শেষে কনক্লুশন, দেখাই যাক। লড়কে লেঙ্গে রিনিস্তান।
এরপরে অরিত্র-রিনির প্রেম তরতরিয়ে এগোয়। মোবাইল যুগ প্রেমকে ত্বরান্বিত করল। ফোন, এসএমএস-এর বন্যা ছুটল। ফোনে ফ্লাইং কিস ফ্লাই করে এবং নির্দিষ্ট জায়গায় ঝুপ করে বসে পড়ে। দার্জিলিং-কমলার কোয়ার মতো অরিত্র চুমু চোষে। পঞ্চমবার মোহরকুঞ্জে। রিনি বলেই দিয়েছে এই মোহরের ঝরনা মাঠেই প্রেম করব, অন্যত্র নয়।
অরিত্র বলেছিল, “দেখ, রান্নার হাত চেঞ্জ করলে যেমন সুস্বাদু লাগে, তেমন প্রেমের প্লেস চেঞ্জ করলে প্রেমও গভীর হয়। ধর, তুই-আমি গঙ্গাবক্ষে নৌকায় দুলছি।”
“মাথা খারাপ! জলে আমার ভীষণ ভয়। চলবে না।”
অগত্যা মোহরেই …
রিনির গায়ে এক অদ্ভুত ভালবাসার গন্ধ। কাঁচা মাংসের বা আঁশটে নয়। প্রেমে পবিত্রতা, সততা থাকলে বোধ হয় ভালবাসার গন্ধ এরকমই হয়।
রিনির মুখে কলকল কথা ঝরছে, “এই, তোর ল্যাপটপ নেই?”
অরিত্র একটু বোকা বনে গেল। ল্যাপটপ আজকাল প্রেমের ফার্স্ট প্রায়োরিটি।
“না রে নেই। তবে এবারে ভাবছি নিয়ে নেব।”
“হোয়াট? তবে ফেসবুক-টুক সব ভোগে? ওহ শিট!”
“দাঁড়া, ক’টা দিন ওয়েট কর। সব করব। পুরনো বাড়িটা রং-টং করে একটু রিমডেলিং করি। তারপর ল্যাপটপ, এসি সব করব।”
“সে কী রে! তোদের বাড়িতে এসি নেই! তা হলে তো খুব কষ্ট হবে রে! আচ্ছা গরমকালে কী করিস তবে?”
“না রে, সেরকম কোনও অসুবিধে হয় না। পুরনো বাপ-ঠাকুদ্দার আমলের বাড়ি। বড়-বড় জানলা দরজা। দোতলায় দখিনের জানলা খুলে দিলে বেশ হু-হু করে বাতাস ঢোকে।”
“বুঝলাম। কিন্তু যখন বাতাস থাকে না, ঘরের পরদা কাঁপে না?”
“তখন, বিশ্বাস কর, কিচ্ছু অসুবিধে হয় না। চারদিকে অনেক গাছপালা আছে। বাতাস না থাকলেও ঠান্ডা-ঠান্ডা ভাব থাকে। কত পাখি আসে জানিস? একদিন চল না। মা দেখে খুব খুশি হবে।”
“আর কে কে আছে বাড়িতে?”
“বিধবা মা আর আমি।”
“হুম… মামের পক্ষে প্লাস পয়েন্ট। মা বলে বড় সংসার একদমই চলবে না, এক ছেলে হবে ব্যস। নো ননদ, নো ঝক্কি ঝামেলা। কিন্তু…” বলে কিছুটা সময় নেয় রিনি। দুম করে জিজ্ঞেস করে, “এই তুই করিসটা কী রে? বেশ তো টাই-ফাই বেঁধে, হাতে হাল ফ্যাশনের ব্যাগ নিয়ে দেখা করতে আসিস।”
“ভিজ়িট সেরে ফিরি। সবে তো এম আর…” কথা শেষ করতে দেয় না রিনি।
“বলিস কী রে! এই বয়সেই এম আর সি পি? রিয়েলি ফ্যানটাস্টিক! জানিস তো ড্যাডের আবার পছন্দ ডক্টর। হি শুড হ্যাভ আ ফরেন ডিগ্রি। মা বলে ওসব ডাক্তার-ফাক্তার চলবে না। হেভি রিস্ক আজকাল। কেউ মানে না, বোঝে না, কথায় কথায় মারধোর। তারপর জীবনে প্রাইভেসি বলে কিছু থাকে না। যখন তখন কল। তার চেয়ে আইটি ইঞ্জিনিয়ার ভাল। গোছা গোছা মাইনে, ফরেন টুর…” অরিত্র হাঁ। যাহ্ শালা, মালটা ফসকে যাবে! ও মরিয়া, “আর, তোর কী পছন্দ?”
“আমার কিছুটা স্যান্ডউইচ অবস্থা বলতে পারিস। তবে ওসবে আমি ভুলছি না। ফার্স্ট ক্রাইটেরিয়া শুড বি হ্যান্ডু। অ্যান্ড দেন রিয়েলি আ গুড পার্সন। বউকে ভালবাসবে, সময় দেবে। এবারে সঙ্গে যদি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হয়, দ্যাট উড বি আ বোনাস পয়েন্ট। হা হা । বুঝলি হ্যান্ডু। তুই তো একেবারে ফিট। মেড ফর ইচ আদার।”
“সত্যি বলছিস রিনি?”
“গড প্রমিস।”
“তবে আমি কিন্তু ওই বোনাস পয়েন্টের মধ্যে নেই। বাকি সব খাপে খাপ পঞ্চুর বাপ। মানে পারফেক্ট ম্যাচিং।”
“বোনাস পয়েন্টের দিকে নেই মানে?”
“মানে এম আর। সিম্পলি মেডিকাল রিপ্রেজ়েন্টটেটিভ। আমার পিছনে কোনও সি পি টি পি নেই। এবারে বল।”
রিনি মুখ ভ্যাটকায়, বলে “এ বাবা, শেষে মেডিকাল রিপ্রেজ়েন্টটেটিভ। কেসটা একটু ডিফিকাল্ট হয়ে যাবে রে!”
“এই যে বললি ওগুলো সব বোনাস। বোনাস ছাড়াও তো জীবন চলে রে!”
“সমস্যা ড্যাডকে নিয়ে রে… কোথায় এমআরসিপি আর কোথায় এমআর… ড্যাডকে কী বলব বল তো দেখি।”
তারপরও কিন্তু রিনি অরিত্রর গায়ে ঢলে পড়েছিল। কাঁধে মাথা রেখে রঙিন জলের নাচ দেখেছিল। গান শুনেছিল, কত কথা বলেছিল।
“রাগ করে না হ্যান্ডু সোনা। তোকে আমি ভালবেসে ফেলেছি রে…” মুচুস-মুচুস করে চুমু দিয়েছিল, “দ্যাখ না ড্যাডটাকে ঠিক ফিট করে ফেলব।”

¶ ২ ¶

কোথায় কী ফিট! অরিত্র এখন আনফিট। সেই রিনির সঙ্গে ষষ্ঠবার আর দেখা হল না অরিত্রর। অথচ পঞ্চম সাক্ষাতের পরের দিন দুপুরের দিকে প্রথম ফোন করেছিল। চেনা রিং টোন, ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও…’ বেজেছিল। কিন্তু ওই একবারই। ও ধরেনি। পরে যতবার ফোন করেছে অরিত্র, ততবার নো রিপ্লাই। ব্যস্ত থাকলে নো রিপ্লাই একবার হতে পারে। তা বলে বারবার। কেন ফোন ধরছ না রিনি? অরিত্রর অভিমান হল, দুঃখ হল। তবে কি রিনির সমস্তটাই নাটক ছিল! সুন্দর ছেলে দেখে ক’দিনের মোহে পড়েছিল। তার পরে পাঁচবারের সাক্ষাতেই বুঝে গেছে একে বাড়িতে কিছুতেই মেনে নেবে না। অতএব অলবিদা। পরের দিনও যখন ফোন করে পেল না তখন অরিত্র ঠিকই করে নিল, ঠিক আছে। তুমি তোমার মতো থাকো।
কিন্তু বললেই কি সব ভোলা যায়? একবার যদি মুখোমুখি হওয়া যেত। কিন্তু মুশকিল হল ওর নাম রিনি আর বাবা লালবাজারের পুলিশ কত্তা ছাড়া অরিত্র কোনও খবর জানে না। কোথায় থাকে? ভাল নাম কী? বাবার নামটাই বা কী? বলেছিল সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। কিন্তু কোথায় কোন কলেজ? কিছুই জানা হয়নি। আসলে ওকে দেখেই অরিত্র সব ভুলে যেত। তখন শুধু কথা আর ইলিবিলি খেলা।
ভাবনা পিছু ছাড়ে না অরিত্রকে। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে ও বোকার মতো ড্যাডকে সব সত্যি বলে দিয়েছে কিছুটা ওভার কনফিডেন্স নিয়ে! ড্যাড ধরে ফেলেছে। সিনেমার বড়লোক বাপেদের মতো মেয়েকে আটকে রেখেছে! অরিত্রর গোমড়া থমথমে ছায়ামাখা মুখ দেখে মা বুঝতে পারেন ছেলের মনের ব্যথার কথা। সব শুনেটুনে মা বলেন, “ওসব ভুলে যা। কম বয়সে এসব হয়ে থাকে। মানুষ ভুলেও যায়।”
অরিত্র বলে, “আসলে মা, আমার চিন্তা রিনিটাকে নিয়ে। ওর বাবা যা কসাই। ঠিক মেয়ের উপর টর্চার করছে। আর ও তো বাপেরই মেয়ে। একরোখা, জেদি। আমি সরে যাব, ঠিক কথা। কিন্তু ও আবার কিছু করে বসবে না তো?”
মা বলেন, “পুরুষ হয়েছিস। ওর বাবাকে খঁুজে বের করে সব খুলে বল। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। মেয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবেন না। উলটে বোঝাবেন।”
ঠিকই তো, অরিত্র তা হতে দিতে পারে না। বরং ওর ড্যাডকে লালবাজারে খঁুজে বের করে নিজের দোষ স্বীকার করা অনেক ভাল। খেয়েছে! যদি পেটায়। পেটাক গে যাক! যাওয়া তো যাক।

¶ ৩ ¶

খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার মতো অবস্থা। অতবড় বিল্ডিং-এ হাজার-একটা অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ কমিশনার। অরিত্র নামটাও জানে না। খুঁজে বের করবে কী করে? তবে ওই কসাই-মার্কা চেহারা একজনেরই আছে। আর ওই ঝোলা গোঁফ। গেটেই সাদা পোশাকের ক. পু. লেখা পুলিশকেই চেহারার বর্ণনা দিয়ে আবিষ্কার করল ভদ্রলোকের নাম কপোতাক্ষ রুদ্র। কোথায় বসেন তাও জেনে নিল। খাতায় এন্ট্রি-ফেন্ট্রি করে এবং রুদ্রস্যারের ভার্বাল পারমিশন পেয়ে তবেই দেখা করার ছাড়পত্র পেল। আফটার অল টাই-বাঁধা ঝকঝকে পোশাকে অরিত্রকেও তো কেউকেটাই দেখায়।
আর কেউকেটা! ওই শেয়াল লেজের গোঁফে ধ্যাবড়া-মতন মুখটা চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠতে লাগল। দরকার নেই হিরো সেজে। কেটে পড়াই ভাল। কিন্তু দেখতে-দেখতে ঘরটা এসে গেল। রুদ্রস্যার একাই ছিলেন। টুলে বসা হাবিলদারও ছেড়ে দিল। অরিত্রর আর পালানো হল না। বেশ বড়সড় ঘর। রুদ্রসাহেব বসে। সামনে বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিল। অনেকগুলো ফোন। জানলায় শৌখিন পর্দা। এসির দাপটে ঘর ঠান্ডা। ঠান্ডা মেরে আছেন দেওয়ালে গাঁধী, নেতাজি, ইন্দিরা।
অরিত্রও প্রায় ঠাণ্ডা। কী বলবে? আপনার মেয়েকে রিনিকে ভালবাসি?
ভাবনায় ছেদ পড়লয় গমগমে গলা, “হুম! আমার কাছে কেন? কী ব্যাপার?”
“আমি, ইয়ে… মানে, অরিত্র। রিনির ইয়ে, মানে বন্ধু।”
দু’-দুটো ‘ইয়ে’ শুনে উনি নড়েচড়ে বসলেন, “আমাকে চিনলে কী করে?”
“না স্যার, রিনির সঙ্গে আপনার ছবিটা দেখছি। তখনই বলেছিলাম, কী সুন্দর মেদহীন বুদ্ধিদীপ্ত, ম্যানলি ফিগার….”
একটু গদগদ রুদ্রসাহেব, “বাড়িটা কোথায়? কোন থানার আন্ডারে?”
“আজ্ঞে স্যার, ঠাকুরপুকুর থানা। স্যার, আমাকে গারদে পুরুন, আপত্তি নেই। দোষটা আমার। বামন হয়ে চাঁদে হাত দিয়েছিলাম। ওর কোনও দোষ নেই। বড় ভাল মেয়ে স্যার। ওকে শাস্তি দেবেন না। কথা দিচ্ছি, ওর জীবন থেকে সরে যাব।”
“হুম! প্রেম উথলে উঠছে মনে হচ্ছে।” স্বগতোক্তি করেন কপোতাক্ষ রুদ্র।
“মানে…”
“চোপ! তুমিই তা হলে সেই কালপ্রিট! জানো, তোমাকে আমি কী করতে পারি? কতরকম চার্জে ফেলতে পারি?”
অরিত্র ঠান্ডাতেও ঘামতে থাকে। টাইয়ের নটের ওপর কণ্ঠিটা নাড়াতে থাকে, “তা পারেন স্যার। তবুও বলছি…”
“বাড়িতে বিধবা মা আর তুমি?”
“হঁ্যা স্যার। মাকে এর মধ্যে জড়াবেন না। মা খুব সাদাসিধে মানুষ।”
“গুড! তা, মা এত সাদাসিধে, ব্যাটা এত খচ্চর কেন?” পুলিশের নিজস্ব ভাষা প্রয়োগ হচ্ছে। অরিত্র মাথা নিচু করে বসে থাকে।
“বাড়িটা নিজের তো?”
“হঁ্যা স্যার, পৈতৃক বাড়ি।”
“গুড! বাড়িটা রিমডেলিং করছ?”
“হ্যাঁ স্যার, করব।”
“আই অ্যাপ্রিশিয়েট ইওর গুড জেসচার। …মেয়েটাকে ফাঁসিয়ে এখন কেটে পড়ার ধান্দা করছ? রাস্কেল, ফোন করোনি কেন?”
“স্যার, করেছিলাম। সুইচ্ড অফ। ভাবলাম ও সম্পর্ক রাখতে চায় না।”
“ফোনটা চুরি গেলে সুইচ্ড অফ করে দেয় জানো না?”
“চুরি হয়েছে? বিশ্বাস করুন, জানি না!”
“চোপ! কাওয়ার্ড কোথাকার! আমিই ওকে পুরনো নাম্বার সিমকার্ড চেঞ্জ করতে বলেছি। পুলিশের লোক আমরা। অনেক সাবধানে থাকতে হয়, বোঝো না! ওই পুরনো নাম্বার নিয়ে কোথায় কোন বিপদে পড়ে, তার ঠিক আছে?”
উনি বলতেই থাকেন, “আমার মেয়েটার ক’দিনে কী হাল করে ছেড়েছ, জান? আমার মেয়েকে কষ্ট দেবে আর তোমাকে আমি ছেড়ে দেব ভেবেছ?”
অরিত্রকে অবাক করে দিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, “নতুন নাম্বারটা নোট করে নাও। এক্ষুনি ফোন করবে।”
অরিত্র মোবাইলে নাম্বারটা দ্রুত সেভ করে নিল।
“যাও!”
অরিত্র এখন গেটের বাইরে। জয় গুরু!
কিন্তু কপালে ভাঁজ। এমআরসিপি কেসটা কি রিনি জানিয়েছে? কে জানে! ও পরে দেখা যাবে!
মোবাইলে বোতাম টিপতে শুরু করল অরিত্র, “হ্যালো… রিনি?”

ছবি : ওঙ্কার

সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:৫২
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×