আজ সেই ২৫ই মার্চের কালো রাত। ১৯৭১ সালের এই রাতে পাকিস্তানি কুকুরেরা অপারেশন সার্চলাইটের নামে যে গনহত্যা শুরু করেছিল তা এখনো পর্যন্ত বিশ্বের কাছে চরমভাবে নিন্দিত হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে। এই রাতের নির্মম ঘটনার পর অনেকেই দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে নিজ পরিবার পরিজন ছেড়ে ভারতের ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোতে চলে যান । সেইসব বীরদের মধ্যে একজন হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম (৬৭)। ভারতের আসাম রাজ্যের বিভিন্ন ক্যাম্পে ট্রেনিং শেষে চট্টগ্রাম সীমান্ত এলাকায় গেরিলা হামলার দায়িত্ব পালন করেছিলেন তারা কয়েকজন।
মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলামের জন্ম কুমিল্লায়। তার পিতার নাম মহররম আলী। কুমিল্লায় জন্ম হলেও মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে সপরিবারে চলে এসেছিলেন সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার শরিফগঞ্জ ইউনিয়নস্থ ইসলামপুর গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বে ইপিআরএ যোগ দিয়েছিলেন সিরাজুল ইসলাম ।
১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম দিকে ইস্ট ব্যাঙ্গল রেজিমেন্ট (ইপিআর), চট্টগ্রাম বান্দরবানে পাহাড়িদের পুণর্বাসনের কাজ করছিলেন তারা। বয়স তখন ২১/২২ বছর। ২৬ মার্চ ঢাকাসহ সারাদেশে পাকিস্তানী মিলিটারি বাহিনী ধ্বংসলীলা চালানোর পর শেষ রাতের দিকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে হায়েনাদের উপর প্রথম হামলা করেছিলেন তারা।
এরপর সশস্ত্র অবস্থায় যোগদান করেন মুক্তিযুদ্ধে এবং ট্রেনিং গ্রহন করেন ভারতের শিলচরের লিচুবাগান এলাকায়। প্রায় ১৫ দিনের ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরে অংশগ্রহন করেন সম্মুখ যুদ্ধে। এখনো তার স্মৃতিপটে ভাসে যুদ্ধজীবনের উল্লেখ্যযোগ্য অপারেশনগুলোর মধ্যে থাকা পাঠিয়া (রঙ্গুনিয়া ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল) হামলা, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে হামলার কথা।
যুদ্ধের স্মৃতি মনে করতে গিয়ে আজো কেঁদে উঠে সিরাজুল ইসলামের অন্তর। প্রাণের বন্ধু ফজলুর রহমানের কথা আজো তার মনে পড়ে। রাতে আঁধারে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে হামলার সময় তার এই প্রিয় বন্ধুটি শাহাদাত বরণ করেছিলেন।
বিজয়ের পর দেশে ফিরে আসেন। ফিরে আসেন ইসলামপুরে মা-বাবার কোলে। বাড়ি ফিরে দেখেন তার বাবা মৃত্যুবরণ করেছেন। স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও জন্মদাতাকে দেখতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাকে।
যুদ্ধের সময় দেশে থেকে দেশের মাটির সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে আজ অনেকেই কোটিপতি কিন্তু এসকল বীর মুক্তিযোদ্ধা তার বিপরীত জীবন কাটাচ্ছেন হাজারো কষ্টে। যাদের কারণের আমরা দেশটাই পেয়েছি তারা আজ একেবারে নিঃস্ব। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দিচ্ছেন। দুঃস্থদের দিচ্ছেন ঘরবাড়িও। কিন্তু সিরাজুল ইসলামের না জুটছে ভাতা, না জুটছে বাড়ি। নিজের জান বাজি রেখে স্বাধীন করা দেশে এখনো তিনি পরাশ্রিত।
বয়স ৬৭ হলেও অসুস্থ শরীরের কারনে সিরাজুল ইসলামকে অশিতিপর বৃদ্ধ বলেই মনে হয়। ৬ সন্তানের জনক দুঃখভারাক্রান্ত কন্ঠে বললেন, আজো আমি ঘরবাড়িহীন একজন মানুষ। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি জীবন বাজি রেখে। কিন্তু নিজের জীবন যুদ্ধ চালাতে আজ আর পারছিনা।
একসয় তার মাছের ব্যবসা ছিল। এখন তাও নেই। সরকারী ভাতা পাচ্ছেন তবে অসুস্থতার কারণে তা মোটেও সন্তোষজনক নয়। সিংহভাগ টাকাই চলে যায় ওষুধ জোগাড় করতে।
হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে পুরো নয় মাস যুদ্ধের ময়দানে থাকতে পারা এই গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা আক্ষেপ করে বলেন, "সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জমি দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি করে দিবেন বলে আশ্বাস দিলেন। আমরাও নতুন আশায় বুক বাঁধলাম। দুইবছর আগে তালিকায় নাম দেওয়া হলেও আজো তা পাইনি। কবে পাবো তাও জানি না।"
প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনেকেই নিজেদের আশা পূরণের জন্য হাত বাড়িয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজে থেকে এসকল মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের দুঃখ কষ্টের বন্ধু হতে চেয়েছেন। এমন সহযোগিতামূলক মনোভাবের কারণেই প্রধানমন্ত্রীকে দেশের মানুষ ভালবাসে।
এমনই ভালবাসা থেকে সৃষ্ট আশা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম বলেনঃ "আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার একটাই চাওয়া, মৃত্যুর আগে আমার ছেলে মেয়েদের জন্য যেনো মাথাগোঁজার জায়গা হয়েছে বলে দেখে যেতে পারি।"
সহযোগিতায়ঃ আঞ্চলিক এক সাংবাদিক ভাই।
স্বাধীনতা দিবস, ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৯ সকাল ১১:৪০