তখনও আমাদের ধারাপাতের ক্লাস শেষ হয়নি। আমরা চাচাতো-ফুফাতো ভাইবোনগুলো একই সাথে একই ক্লাসে পড়তাম। পাঁচ থেকে ছ'জন ছিলাম আমরা। সমবয়সী হওয়ায় কাকারা আমাদেরকে একই ক্লাসে ভর্তি করে দিয়েছিলেন যে এমন না। বরং দু'একজন ছিলেন এমন, যারা অকৃতকার্য হয়ে আমাদের সঙ্গ নিয়েছিলেন। আমাদের অধিকাংশের কাছে এই ধারাপাতের ক্লাস ছিল সবচেয়ে কঠিন।
আমাদের কোন ক্লাস রুম ছিল না। বাহিরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে স্যার আমাদের ক্লাস নিতেন। পেট-সমান দেওয়ালের উপর আমরা বই রেখে দাঁড়াতাম। সেটা ছিল আমাদের ছেকন্দো ক্লাসের কথা। স্যারের মনমুগ্ধকর ক্লাস নেওয়ার পদ্ধতি আমাদেরকে আকৃষ্ট করত। ছুটি নেওয়ার প্রয়োজন পড়লে অথবা ক্লাস ফাঁকি দিতে চাইলে আমরা স্যারের ক্লাস শেষেই যা করার করতাম। স্যারকে আমরা খুব বেশি ভালবাসতাম। আমাদের মধ্যে ফুফাতো ভাই রিয়াজ ছিল সবচেয়ে চালাক। ধারাপাতের ক্লাস আসলে তাকে ক্লাসে পাওয়া যেত না। যারা ধারাপাত স্যারের পড়া শিখে আসত না তারা রিয়াজ এর মত ক্লাস ফাঁকি দিত। অথবা প্রস্রাবের বিরতিকালে লুকিয়ে চলে যেত বাড়িতে। আমি তখন ইংরেজিতে কাঁচা ছিলাম। আমার মা ইংরেজি কম জানতেন, তাই ইংরেজি ক্লাস শুরুর পূর্বেই আমি চলে যেতাম নিকটে থাকা বন্ধুদের বাড়ি৷ একেকদিন একেকজনের বাড়ি। সেই বন্ধুদের মধ্যে হাবিব নামের বন্ধুটি ছিল সবচেয়ে কাছের। (পরবর্তীতে আধুনিক হয়ে তার নাম জনি রেখেছে।) তার সাথে তাদের পুরাতন বাড়িতে ঘুরতে যেতাম। এমনিতেই। কোন প্রয়োজন ছাড়াই আমরা ঘুরে-বেড়াতাম গ্রামের সকল চিপা-চাপা। ওদের বাঁশ বাগানে বকের বাসা খোঁজতাম। জমিতে ওদের কাজের লোকদের জন্য খাবার নিয়ে যেতাম। জমিতে গিয়ে যখন আকষ্মিক ওর বাবাকে সেখানে দেখতাম তখন দু'কেআর (আমাদের অঞ্চলে ৩১ শতককে এক কেআর বলে) জমির দূরত্বে খাবারের পাত্র রেখে চলে আসতাম; ওর বাবার ভয়ে পাশে যেতাম না। তখন হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যাথা হয়ে যেতো। তবু আমরা মনের সুখে ঘুরে বেড়াতাম। "ধান শুকায় নাড়াত, মানুষ শুকায় হাঁটাত"। হয়ত সেকারণেই পরবর্তীতে আমি তেমন মোটা হতে পারিনি। এই বিষয়ে আমার কোন আফসোস না থাকলেও আমার বোনদের খুব আফসোস ছিল। এই আফসোসটা আমার খালাতো বোনদেরকেও গ্রাস করতো। আর এইসব ঘুরেবেড়ানোর জন্য নির্ধারিত টাইম ছিল ইংরেজি স্যারের ক্লাস। ইংরেজি স্যারকে তখন আমরা ঘৃণা করতাম। উনি ছাত্রদের বেত্রাঘাত করতেন বলে। ধারাপাত স্যারও ক্লাসে বেত নিয়ে আসতেন, তবে ইংরেজি স্যারের মত এমন দয়ামায়াহীন ছিলেন না। আমি সেই বিদ্যালয়ে আট বছর পড়ালেখা করি। আমার দেখা অনেক শিক্ষার্থীর পড়ালেখা ছাড়ার মূল কারণ স্যারের এই মারপিট। এলাকার প্রভাবশালী পরিবারের ঘর জামাই হওয়া ও প্রেন্সিপালের ভাল রেজাল্টের উচ্চাকাঙ্খা এই মারপিট চালু থাকার মূল কারণ।
পরবর্তীতে ধারাপাতের ক্লাসগুলো শেষ হওয়ার পূর্বেই ভালোবাসার এই স্যারকে আমাদের কাকারা আমাদের বাড়ীতে লজিং-এ নিয়ে আসেন। আর এতে করে ধারাপাতের ক্লাসগুলোর শেষ হলেও আমাদের শৈশব জীবন থেকে ধারাপাতের আর বিদায় হয়নি। একেবারে কৈশরের মধ্যভাগ পর্যন্ত স্যারকে আমরা সাথে পাই। ছয় পরিবার নিয়ে গঠিত আমাদের সৈয়দ বাড়িতে মহল্লার একটি পাঞ্জেগানা মসজিদ আছে। আমাদের ধারাপাত স্যার সেই মসজিদের ইমাম ছিলেন। 'সুন্দরপুর পাঞ্জেগানা মসজিদ' নামের সাথে মিলিয়ে বাস্তবে আমরা সুন্দর মনের একজন ইমাম পেয়েছিলাম। যিনি একই সাথে ছিলেন আমাদের ধারাপাত স্যার, ইমাম, অভিভাবক ও পথপ্রদর্শক। ব্যক্তিগতভাবে আমি আমি হয়ে উঠার পেছনে যে মানুষগুলোর আপ্রাণ চেষ্টা কাজ করেছে (ধারাপাত স্যার) জনাব সাইফুল ইসলাম সাহেব তাদের মধ্যে একজন।
আজ এতো বছর পর হঠাৎ করে স্যারের কথা খুব মনে পড়ছে। স্যারের সাথে যোগাযোগের কোন সুযোগ নেই। তাই মনের কষ্ট দূর করতে এই ব্লগ লেখা। প্রিয় ধারাপাত স্যার, যেখানেই থাকুন পরিবার সহ ভালো থাকুন ও সুস্থ থাকুন এই কামনা করি। মানুষ গড়ার এমন সব কারিগরদের প্রতি অনেক অনেক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও শুভকামনা থাকলো।
১১:১৮
২৮/০১/২২
অভাদা, অ্যালেজান্দ্রিয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০২২ বিকাল ৫:৩৭