পবিত্র রমাজান মাস মুসলিমদের জন্য রহমত মাগফিরাত এবং নাজাতের মাস; যা তাকওয়া অর্জনের মাধ্যম। তাকওয়া অর্জনের জন্য কেবলমাত্র নামাজ ও রোজা আদায় যথেষ্ট নয়। নামায ও রোজার পাশাপাশি আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে সংশোধনের। বাকি ১১মাসে করা সকল প্রকার খারাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমে চেষ্টা করতে হবে তাকওয়া অর্জনের।
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
للصائم فرحتان يفرحهما اذا افطر فرح، واذا لقى ربه فرح بصومه، وفى رواية : اذا لقى الله فجزاه فرح،
রোযাদারের জন্য দুটি আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে, যখন সে আনন্দিত হবে। এক. যখন সে ইফতার করে তখন ইফতারের কারণে আনন্দ পায়। দুই. যখন সে তার রবের সাথে মিলিত হবে তখন তার রোযার কারণে আনন্দিত হবে। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, যখন সে আল্লাহর সাথে মিলিত হবে, আর তিনি তাকে পুরস্কার দিবেন, তখন সে আনন্দিত হবে।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৯০৪, ১৮৯৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৫১ (১৬৩, ১৬৪, ১৬৫); মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৯৪২৯, ৭১৭৪; সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৭৬৬
উপরোক্ত হাদিস দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেলো রমজানের রোজা রাখার উদ্দেশ্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'য়ালার সন্তুষ্ট অর্জনের মাধ্যমে তাকওয়াবান হওয়া। কিন্তু আমাদের বর্তমান মুসলিম সমাজ কি বাস্তবে তাকওয়া অর্জনের পথে এগুচ্ছে? আমরা কি পারছি আমাদের বিগত ১১মাসের খারাপ কাজ থেকে বিরত হয়ে এক মাসের জন্য আল্লাহ মুখি হতে? না, আমরা তো বরং এই একমাসে যতটুকু সম্ভব আল্লাহকে ভুলার চেষ্টায় মত্ত হয়ে আছি।
প্রথম রমজান থেকে শুরু হওয়া বিভিন্ন রকমের কুপ্রথা চর্চার মাধ্যমে শেষ হয় আমাদের রমজান। ইফতারি তাল পাঠানো দিয়ে শুরু হয় আমাদের প্রথম রমজান। আর শেষ হয় ঈদের মার্কেটিং করতে করতে। এই হচ্ছে আমাদের মুসলমানি নমুনা। দয়া করে কেউ আবার ভুল বুঝে এখানে মন্তব্য কইরেন না যে, আমি ধর্মান্ধতার ডাক দিচ্ছি।
সরকারি মন্ত্রীর দাবী অনুযায়ী বাংলাদেশের দারিদ্রতার হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। বেসরকারি দুটি সংস্থার গবেষণা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলে। সানেমের মতে ৪২ শতাংশ এবং সিডিপির মতে ৩৬ শতাংশই দরিদ্র। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। তারা পরবর্তী আর কোন আপডেট দেয়নি।
উপরের হিসেবানুযায়ী আপনি বাংলাদেশকে দারিদ্রমুক্ত বলতে পারবেন না। যেহেতু বাংলাদেশের ৯১% মুসলিম, সেহেতু এই মুসলিমদের বিশাল একটি অংশ্যই দারিদ্রতার ফাঁদে বন্দী। উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে তাদের বোন-কন্যাদের বাড়িতে ইফতার পাঠাতে কোন সমস্যায় পড়তে হয় না। তাদের একটা অংশের কাছে এটা আনন্দের কারণ। আরেকটা অংশ অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় মেনে নিয়েছেন অনায়াসে। কিন্তু এই দুটি অংশের কারণে বাঙালি মুসলিম সমাজের দরিদ্র পরিবারগুলোকে না চাওয়া সত্বেও মেনে নিতে হচ্ছে বিভিন্ন উপরি নির্যাতন। যা একটি বাচ্চার জন্ম উৎসব থেকে নিয়ে খতনানুষ্ঠান, বিয়েশাদি এবং মৃত্যুর পরের কুলখানি পর্যন্ত। এগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে রমজান মাসের ইফতার। যা সম্পূর্ণ হারাম একটি যৌতুক প্রথা।
বিভিন্ন মৌসুমি আবরণে বিরামহীন যৌতুকের ধারাবাহিকতার একটি হচ্ছে এই ইফতারি যৌতুক প্রথা। যা আমাদের মুসলিম সমাজের একটি অংশকে তিলেতিলে শেষ করে দিচ্ছে। এই কুপ্রথার কারণে কত মাতাপিতার জীবন হয়ে যাচ্ছে বিভীষিকাময় তার কোন হিসেব নেই। অনেকে মেয়ে বাঁচিয়ে রাখতে দারস্থ হচ্ছেন সুধি মহাজনদের। নিচ্ছেন লুন ব্যাংক থেকে। সেগুলো আদায় করতে গিয়ে ছাড়তে হচ্ছে নিজেদের ভিটেমাটি। এভাবে ভিটেমাটি হাড়িয়ে পরিবারগুলো হয়ে যান শহরমুখী। শহুরে বিত্তবানেরা পান নতুন চাকর আর গ্রামের ধনীরা হয়ে উঠেন প্রকাণ্ড মহাজন।
অথচ এমন অনেক উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের সদস্য রয়েছেন যারা সত্যিকার অর্থেই চান এসব কুপ্রথা সমাজ থেকে দূর হোক। কুপ্রথা মুক্ত হোক মুসলিম সমাজ। কিন্তু তারাও সমাজের ভয়ে বা বিভিন্ন বাঁধাধরা নিয়মের কারণে এগুচ্ছেন না। বাস্তবিক অর্থে তাদের এই নিরবতাই কিন্তু মুসলিম সমাজের ধ্বংসের কারণ। অথচ তাঁরা নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টায় মুসলিম সমাজকে রক্ষা করতে পারেন। কুপ্রথায় শিকার পরিবারগুলোকে বুঝিয়ে মুক্তি দিতে পারেন এই কুপ্রথা থেকে। প্রত্যেকের চিন্তাভাবনা আলাদা, যেমন আপনার থেকে আমার। কিন্তু যখন সকলেরই উদ্দেশ্য হয় মুক্তি, তখন চিন্তাভাবনার ভিন্নতা হয়ে উঠে মুক্তি পথের পাথেয়। তাই আসুন, আমরা প্রত্যেকেই নিজের অবস্থান থেকে, নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টার মাধ্যমে রুখে দাঁড়াই ইফতারি প্রথার খোলসে চলা যৌতুকের বিরুদ্ধে।
ছবি ও তথ্যাদি বিভিন্ন সাইট থেকে নেওয়া।
কুপ্রথার বিরুদ্ধে আমার পূর্বের লেখা দান নয়, প্রয়োজন অধর্ম রোধন!
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০২৩ বিকাল ৪:৪৮