somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কুরআন-হাদীছের আলোকে শবে বরাত - পর্ব ০৯

০৬ ই জুন, ২০১২ দুপুর ২:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

بسم الله الرحمن الرحيم

হাদীছের আলোকে শবে বরাত - ১

১।

শবে বরাত সম্পর্কে বর্তমানের কিছু স্থূল দৃষ্টিসম্পন্ন লোকের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে যে, শবে বরাত সম্পর্কীয় যেসব হাদীছ পাওয়া যায়, সেগুলো মওজু তথা মনগড়া ও জাল হাদীছ। এ ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে তারা শবে বরাতের ফজীলতকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বসে। এমনকি এ রাতে জাগরণ থেকে ইবাদত-বন্দেগী, যিকির, তেলাওয়াতসহ সকল নফল ইবাদত করাকে বিদআত মনে করে।

২।

শবে বরাত সম্পর্কে হাদীছের কিতাবসমূহ গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে কিংবা হাদীছ শাস্ত্রে সম্যক ধারণা থাকলে একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, তাদের এ ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি অমূলক ও ভ্রান্ত এবং হাদীছ শাস্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞতাপ্রসূত। এমনকি তাদের এ ভ্রান্ত ধারণা শরীয়তের বিধানবলী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সাহাবা ও তাবেয়ীন আইম্মায়ে মুজতাহেদীনসহ সকল সলফে সালেহীন এবং তাদের থেকে পরম্পরা সূত্রে প্রাপ্ত আমলের সাথে অসংগতি ও বিরোধপূর্ণ।

৩।

মূলতঃ সাহাবায়ে কেরামের এক জলীলুল ক্বদর দল থেকে বিভিন্নসূত্রে শবে বরাতের ফজীলত সম্পর্কীয় বহু বর্ণনা হাদীছ গ্রন্থসমূহে বিদ্যমান। যেসব বর্ণনার সূত্রগুলো কিছু সহীহ আর কিছু হাসান তথা সহীহের অন্তর্ভুক্ত আর কিছু জঈফ যা পরস্পর পরস্পরকে শক্তিশালী করে আমলের যোগ্য করে তোলে। যদিও স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যেকটি বর্ণনাকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করা যায় না, কিন্তু বেশ কিছু বর্ণনা ছ্বিকাহ রাবী তথা নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী থেকে বর্ণিত এবং তার অনুকূলে আরো রেওয়ায়েত বা হাদীছ বিদ্যমান থাকায় নিঃসন্দেহে তা সহীহ এর মানে উন্নীত হয়। এই কারণেই শরীয়তে শবে বরাতের ফজীলত ভিত্তিহীন বলার কোন অবকাশ নেই।

হাদীছ শাস্ত্রের কিছু নীতিমালাঃ

উপরোক্ত বিষয়গুলো বোধগম্য হওয়ার জন্য প্রথমে হাদীছ শাস্ত্রের কিছু নীতিমালা পেশ করা হচ্ছে।


হাসান হাদীছঃ

ক)

শবে বরাতের ব্যাপারে ( حسن ) ‘ হাসান ’ স্তরের এমন কিছু হাদীছ তো অবশ্যই পাওয়া যায় যেসব হাদীছের সহযোগিতায় ও সমর্থনে অন্যান্য আরও হাদীছও বিদ্যমান। আর হাদীছশাস্ত্রের মূলনীতি মতে ‘ হাসান ’ স্তরের হাদীছের সমর্থনে ও সহযোগিতায় অন্য আরো রেওয়ায়েতে তথা বর্ণনা পাওয়া গেলে সেই হাদীছ হাসান স্তর থেকে উন্নীত হয়ে সহীহ স্তরের মর্যাদা লাভ করে।

খ)

যেমন এ প্রসঙ্গে হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী বলেনঃ

“ হাসান সনদ দ্বারা বর্ণিত হাদীছ হয় একটি হবে অথবা তার সমর্থনে অন্য হাদীছও থাকবে। যদি মর্যাদার দিক থেকে উভয়টি সমান হয় কিংবা তার চেয়ে উচ্চস্তরের হয়, তাহলে বর্ণিত উভয় হাদীছ একে অপরের সমর্থনে সহীহ এর স্তরে পৌছে যায়। ”

মুরসাল হাদীছঃ

১।

মুরসাল হাদীস হল সেসব রেওয়ায়েত যেখানে একজন তাবেঈ সরাসরি রসূলের (সঃ) কোন কর্ম বা উক্তির বর্ণনা দেন, অর্থাৎ কোন সাহাবা থেকে তিনি শুনেছেন তিনি তা উল্লেখ করেন নি।

২।

শবেবরাত সম্পর্কে কোন কোন হাদীছ মুরসাল ( مرسل ) পাওয়া যায়। আর হানাফী মাযহাবসহ বহু ইমামগনের মতে মুরসাল হাদীছ সহীহ এবং শরীয়তের দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য। এখানে আমরা সংক্ষেপে মুরসাল হাদীস দলীল হওয়ার পক্ষে ইমামগণের মতামত উল্লেখ করব।

৩।

ইমাম মালিক এবং মালিকি মাযহাবের সকল প্রসিদ্ধ ফকীহগণের মত হল, নির্ভরযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির মুরসাল হাদীস শরীয়তের দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য এবং এর উপর আমল করা যাবে।

( তাজরীদ আল তামহীদ লিমা ফি আল মুয়াত্তা মিনাল আসানিদ, ইউসুফ বিন আব্দুল্লাহ ইবনে আবদুল বার, কায়রো, ১৩৫০, ১:২ )

তাদের কেউ কেউ আবার মুরসাল হাদীসকে মুসনাদ হাদীসের চেয়ে উত্তমও বলেছেন।

৪।

ইমাম আবু হানিফাও ইমাম মালিকের মতই মুরসাল হাদীসকে সহীহের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, চাই এর সমর্থনে অন্য কোন সহীহ হাদীস থাকুক বা না থাকুক।

( ইমাম সুয়ুতী )

৫।

ইমাম শাফিঈ মুরসাল হাদীস গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য তাঁর কিতাব " আল রিসালাহ " তে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং কিছু শর্ত দিয়েছেন। সেগুলো হলঃ

ক) এর সমর্থনে অন্য সনদে মুসনাদ হাদীস থাকতে হবে অথবা মুরসাল হাদীসের বক্তব্যের সাথে অধিকাংশ স্কলারদের মতের মিল থাকতে হবে।

খ) আর যে রাবী মুরসাল হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাকে উত্তম তাবেঈ হতে হবে।


( আল রিসালাহ, ইমাম শাফী, আহমদ শাখির এর সংস্করণ, কায়রো, ১৩৫৮/১৯৪০, পৃঃ৪৬১-৪৭০ )

৬।

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহঃ) মুরসাল হাদীস গ্রহণ করেছেন যদি তার বিপরীতে কোন কিছুই পাওয়া না যায় এবং তিনি কিয়াসের চেয়ে মুরসাল হাদীসকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।

( ইলাম আল মুয়াক্কিন, ইবনুল কায়্যিম, দ্বিতীয় সংস্করণ, দারুল ফিকর, বায়রুত, ১৩৯৭/১৯৭৭, ১:৩১ )

৭।

এজন্যই আল্লামা ইমাম নববী (রহঃ) বলেনঃ

“ মুরসাল হাদীছকে ইমাম মালেক (রহঃ) ও ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) সহীহ – এর শ্রেণীভুক্ত করেছেন। ”

( তাকরীবু লিন নববীঃ খ-১, পৃ-১৯৮ )

৮।

এ ব্যাপারে আল্লামা সাইফুদ্দীন আল আমেদী (রহঃ) বলেনঃ

“ মুরসাল হাদীছ এর গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে ইমামগণ মতবিরোধ করেছেন। ইমাম আবু হানিফা (রহঃ), ইমাম মালিক (রহঃ) ও ইমাম আহমদ (রহঃ) এর প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী উক্ত হাদীছ শরীয়তের দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য।”

( আল আহকাম ফি উসূলিল আহকামঃ খ-২, পৃ-১৭৭ )

৯।

আবু দাউদ (রহঃ) এর মতেও মুরসাল হাদীস গ্রহণযোগ্য, শর্ত হল, ঐ বিষয়ে কোন মুসনাদ হাদীস পাওয়া যাবে না, আর যদি যাই তাহলে তা মুরসাল হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না।

( সুরুত আল আইম্মাহ আল খামসাহ, আল হাজিমি, আল কাউসারী সংস্করণ, কায়রো, পৃ - ৪৫ )

১০।

খতীব আল বাগদাদী (রহঃ)ও মুরসাল হাদীসকে গ্রহণযোগ্য বলেছেন যদি তা উত্তম তাবেঈ থেকে বর্ণিত হয় অথবা তার সমর্থনে মুসনাদ হাদীস পাওয়া যায়।

( আল কিফায়া ফি ইলম আল রিওয়ায়াহ, খতীব বাগদাদী, হায়দারাবাদ, ১৩৫৭, পৃ - ৩৮৭ )

১১।

ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ)ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী থেকে ইরসাল করা হলে সেই মুরসাল হাদীসকে গ্রহণযোগ্য বলেছেন।

( মিনহাজ আল সুন্নাহ আন নববীয়াহ ফী নকদ কালাম আল শিয়া ওয়াল ক্বাদারিয়াহ, ইবনে তাইমিয়্যা, মাকতাবাহ আল আমিরীয়াহ, বুলাক, ১৩২২, ৪:১১৭ )

উপরোক্ত বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহঃ) মুরসাল হাদীসকে গ্রহণযোগ্য ও সহীহ বলে রায় দিয়েছেন। আর ইমাম শাফিঈ গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য কিছু শর্ত দিয়েছেন। উল্লেখ্য, শবে বরাতের মুরসাল হাদীস গুলো শর্তগুলো পূরণ করে।

যঈফ বা দুর্বল হাদীসঃ

১।

যে হাদীছের রাবী হাসান হাদীছের রাবীর গুণ সম্পন্ন নন তাকে যঈফ হাদীস বলা হয়। হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কোন কথাই যঈফ নয় বরং রাবীর দুর্বলতার কারণে হাদীছকে যঈফ বলা হয়।

২।

শবে বরাতের ফযীলত বিষয়ে কিছু জ’ঈফ তথা দুর্বল হাদীছও রয়েছে।

৩।

হাদীছ শাস্ত্রের নীতিমালা মতে য’ঈফ ( ضعيف ) হাদীছ যদি বিভিন্ন সূত্রে (সনদে) বর্ণিত হয়ে তখন ওই হাদীছটি একাধিক সূত্রে বর্ণনা করার কারণে সমষ্টিগতভাবে হাসান ( حسن ) এর স্তরে পৌঁছে যায়। আর তখন সর্ব সম্মতিক্রমে ওই হাদীছটি শরীয়তের দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য এবং সকলের আমলযোগ্য হাদীছ হিসেবে বিবেচিত হয়।

৪।

আল্লামা যফর আহমদ উছমানী (রহঃ) নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহ থেকে চয়ন করে সংক্ষিপ্ত আকারে উক্ত কথাটি এভাবে তুলে ধরেনঃ

“ যঈফ হাদীছের বর্ণনারীতি যদি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয় এমনকি এক সূত্রেও যদি বর্ণিত হয় পরিণামে তা হাসান স্তরে উপনীত হয় এবং তার দ্বারা দলীলও পেশ করা যায়। ”

( ক্বাওয়ায়িদ ফী উলূমিল হাদীছ )

ফাযাইলের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীসঃ

১।

উপরন্তু হাদীছ বিশারদগণের মতে য’ঈফ তথা দুর্বল হাদীছ অত্যধিক দুর্বল না হলে ফাযাইলে আ’মাল এর ক্ষেত্রে তার উপর আ’মল করা যায়, এর ভিত্তিতে সওয়াবও পাওয়া যায় এবং উলামা মুহাদ্দিসদের এই বিষয়ে ইজমা আছে। বড় বড় ইমাম এবং মুহাদ্দিসীনরা তাদের বিভিন্ন কিতাবে এই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। অথচ শবে বরাত সম্পর্কীয় সকল হাদীছ য’ঈফ নয়।

২। ইমাম বুখারী (রহঃ)

আমীরুল মুহাদ্দিসীন ইমাম বুখারী (রহঃ) হাদীসের উস্তাদ ছিলেন এবং স্পষ্টভাবেই সহীহ ও দুর্বল হাদীসের মধ্যে পার্থক্য জানতেন। কিন্তু তবুও তিনি তার একটি ফাযাইলের কিতাবে দুর্বল হাদীস বর্ণনা করেছেন। তার বিখ্যাত কিতাব " আল আদাব আল মুফরাদ ", এ কিতাবে প্রচুর যঈফ হাদীস রয়েছে, কিন্তু এটি জানার পরও কিতাবটি যুগ যুগ ধরে উম্মতরা পড়ে আসছে এবং অনুসরণ করে আসছে, কারণ এই কিতাবটিতে ফাযাইলের বর্ণনা আছে। এমনকি এই কিতাবের কিছু অধ্যায়ে কোন সহীহ রেওয়ায়েতও নেই।

আল্লামা শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ আদাব আল মুফরাদ এর সনদের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করছেন তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ " ফাযলুল্লাহ আস সামাদ " এ।

৩। ইমাম নববী (রহঃ)

ইমাম নববী (মৃঃ ৬৭৬ হিঃ) তার আল আযকারে যঈফ হাদীসের উপর আমল করার বিভিন্ন দিক আলোচনা করতে গিয়ে বলেনঃ

কিছু কিছু ক্ষেত্রে (শর্তসাপেক্ষে) যঈফ হাদীসের উপর আমল করা যায়।

৪। মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ)

বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফক্বিহ হযরত মোল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,

"সকলেই একমত যে যঈফ হাদীছ ফজিলত হাসিল করার জন্য আমল করা জায়েজ আছে।"

(আল মওজুআতুল কবীর, ১০৮ পৃষ্ঠা)

৫। ইমাম ইবনে হুমাম (রহঃ)

এ প্রসঙ্গে হযরত ইমাম ইবনে হুমাম রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,

" যঈফ হাদীছ যা মওজু নয় তা ফজিলতের আমল সমূহে গ্রহণযোগ্য"

(ফতহুল ক্বাদীর)

৬। ইমাম মুসলিম (রহঃ)

ইমাম আহমদ এবং সালাফের অন্যান্যদের মতের মত ইমাম মুসলিমও দুর্বল হাদীসকে প্রত্যাখান করেন নি।

( নববী, শরহে সহীহ মুসলিম (ভূমিকা); ইবনুল কায়্যিম, ইলাম আল মুওয়াক্কিন (১/৩১); ); সাখাবী, আল ক্বওল আল বাদী (পৃ-৪৭৪), ইবনে রজব, শরহে ইলাল আল তিরমিযী (১/৭৫-৭৬)

৭। ইমাম ইবনে আরাবী (রহঃ)

ইমাম ইবনে আরাবী ফাযাইলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করেছেন।

( ইবনে আল আরাবী, আরিদাত আল আহওয়াযী (১০/২০৫); ফাতহুল বারী (১০/৬০৬) যা মুহাম্মদ আওয়ামা আল কওল আল বাদী (পৃ - ৪৭২) এ উল্লেখ করেন)

৮। ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মঈন (রহঃ) ( ইমাম বুখারীর উস্তাদ)

তিনিও ফাযাইলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণযোগ্য ও আমলযোগ্য বলে মত প্রকাশ করেছেন।

( তাবীয়ুনাল আসার; ফাতহুল মাগহীত )

৯। ইমাম আবু শামা মাকদীসী (রহঃ)

তিনি ফাযাইলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণ করেছেন এবং এটি মুহাদ্দিসীনদের সিদ্ধান্ত বলেও মত প্রকাশ করেছেন।

( তাওযীয়ুন নাদার)

১০। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ)

ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ) তাঁর কিতাব " আল কায়দা আল জলীলা ফিত তাওয়াসসালি ওয়াল ওয়াসিলা ", মুহাক্কিক ড রাবিয়া বিন হাদী উমাইর আল মুযখালী, প্রফেসর, ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়, মদীনা মুনাওয়ারাহ, এর ৮ম অধ্যায়ে যঈফ হাদীস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং অধিকাংশ উলামা কেরামের মতামত উল্লেখ করেছেন এবং সাথে নিজের মতও প্রদান করেছেন।

ইবনে তাইমিয়্যা ৪৭৮ অনুচ্ছেদ (প্যারা) এ উল্লেখ করেনঃ

কোন আমল শরীয়তের দলীল দ্বারা প্রমাণিত থাকলে, এবং ফাযাইলের ক্ষেত্রে (এরকম আমলের) হাদীস বর্ণিত হলে একে মিথ্যা বলা যাবে না, এটা সম্ভব যে ফাযাইলটা সত্য, এবং কোন ইমামই দুর্বল হাদীস দ্বারা ফাযায়েলটিকে ওয়াজিব বা মুস্তাহাব বলেন নি, এবং যারা বলেছেন তারা ইজমার বিরুদ্ধে।

এখান থেকে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই যে, ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ)ও ফাযাইলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীসের পক্ষে মত প্রদান করেছেন।

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যার কিতাব "আল কালিমুত তায়ীব" এ প্রচুর দুর্বল হাদীস রয়েছে যা পরবর্তীতে আলবানী "সহীহ আল কালিমুত তায়ীব" এবং "যঈফ আল কালিমুত তায়ীব" এ দুই ভাগে ভাগ করেন।

১১। ইমাম শাওকানী (রহঃ)

তাঁর মতে ফাযাইলের ক্ষেত্রে অনেক গুলো দুর্বল হাদীস এক করলে তা শক্তিশালী হয় এবং তার উপর আমল করা যায়।

( নায়লুল আওতার (৩/৬০))

তার বিখ্যাত কিতাব " তুহফাতুয যাকিরীন " এ প্রচুর পরিমাণে যঈফ হাদীস পাওয়া যায়।

১৪। ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহঃ) (মৃঃ ১৮১ হিঃ)

তাঁর মতে ফাযাইলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস বর্ণনা করা যায়।

(সুয়ুতীর তাদরীব আল রাবী)


১৫। এ প্রসঙ্গে আল্লামা যফর আহমদ ওছমানী’র রচিত গ্রন্থ “ ক্বাওয়ায়িদ ফী উলূমিল হাদীছ ” এর ভাষ্য নিম্নরূপঃ

“ দুররে মুখতার এ রয়েছে যে, ফাযাইলে আমা’ল এর ক্ষেত্রে য’ঈফ হাদীছ এর উপর আমল করা যাবে। ব্যাখ্যাকার ইবনুল আবেদীন বলেনঃ যে ফজীলত আমলের মাধ্যমে অর্জিত হয়, সেই ফজীলত লাভের উদ্দেশ্যে (য’ঈফ হাদীছ এর উপর আ’মল করা যাবে)। ”

( ক্বাওয়ায়িদ ফী উলূমিল হাদীছঃ পৃ - ৯২)

শবে বরাতের হাদীস এবং সাহাবীঃ

তাছাড়া শবে বরাতের সাথে সংশ্লিষ্ট হাদীছসমূহের বর্ণনাকারিদের মধ্যে অনেক বড় বড় (এক ডজনের মত ) সাহাবাও রয়েছেন। যাদের কয়েকজনের পবিত্র নাম নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ

ক) হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রঃ)
খ) হযরত আলী (রঃ)
গ) হযরত আয়শা (রঃ)
ঘ) হযরত আবু হুরায়রা (রঃ)
ঙ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আ’মর (রঃ)
চ) হযরত আবু মুসা আশআরী (রঃ)
ছ) হযরত আউফ ইবনু মালিক (রঃ)
জ) হযরত মুআয ইবনু জাবাল (রঃ)
ঝ) হযরত আবু ছালাবাহ আল খুসানী (রঃ)
ঞ) কাছীর ইবনে মুররা আল হাজরমী (রঃ)


সার কথাঃ

এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের কোন কথাই দুর্বল নয়। মুহাদ্দিসীনে কিরাম হাদীসের ক্ষেত্রে সহীহ, হাসান, যঈফ ইত্যাদি যে পরিভাষা ব্যবহার করেন তা সনদ তথা বর্ণনাকারীগণের ধারাবাহিকতা ও গুণাগুণ বিবেচনায়। উসূলে হাদীসের কিতাবে আছে- তিন কারণে হাদীস যঈফ হয়ে থাকে।

১. বর্ণনাকারী ন্যায়পরায়ণতা, স্মরণশক্তি ও সংরক্ষণ ক্ষমতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমালোচিত হলে।
২. বর্ণনাকারী অপরিচিত হলে। কারণ এতে জানা যায় না তিনি নির্ভরযোগ্য কি না?
৩. বর্ণনাধারা (সনদ) মুত্তাসিল বা সংযুক্ত না হলে। কারণ এতে জানা যায় না যে, মধ্যখান হতে যে বর্ণনাকারীর নাম বাদ পড়েছে তিনি বিশ্বস্ত কি না?

মুহাদ্দিসীনে কিরাম হাদীস সংগ্রহ ও সংরক্ষণে বর্ণনাকারীদের সার্বিক গুণাবলীর চুল-চেরা বিশ্লেষণ করেন এবং সাথে সাথে সনদের সবলতা ও দুর্বলতার দিকটাও তুলে ধরেন। সবলতা ও দুর্বলতা নির্ণয়ে সব মুহাদ্দিসীনের নীতি আবার এক নয়। ইমাম বুখারী (রহঃ) হাদীস গ্রহণে যেরূপ কঠোর শর্তারোপ করেছেন অন্যরা তা করেন নি। তাইতো দেখা যায় ইমাম মুসলিম (রহঃ)-এর বিবেচনায় যে সব হাদীস সহীহ, ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর বিবেচনায় তার কোন কোনটি সহীহ নয়। স্বয়ং ইমাম মুসলিম (রহঃ) বলেন, যে সব হাদীস মুহাদ্দিসীনে কিরামের নিকট সহীহ ও নির্দোষ হিসেবে স্বীকৃত কিন্তু আমাদের আলোচিত ব্যক্তি (ইমাম বুখারী রহঃ)-এর নিকট যঈফ (দুবল) হিসেবে চিহ্নিত- যদি আমরা এগুলোর পরিপূর্ণ সংখ্যা হিসেব করার চেষ্টা করি তাহলে নিশ্চয়ই আমরা অসমর্থ হয়ে পড়বো এবং সবগুলোর আলোচনা করাটাও আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না (মুকাদ্দমায়ে সহীহ মুসলিম)।

যাই হোক, মুহাদ্দিসীনে কিরাম তাদের অনুসৃত নীতির ভিত্তিতে হাদীস বর্ণনার সাথে সাথে সবল হাদীসকে সবল এবং দুর্বল হাদীসকে দুর্বল বলে দিয়েছেন। কিন্তু তারা এ কথা বলেন নি যে, দুর্বল হাদীস (যঈফ) কোন ক্ষেত্রেই গ্রহণীয় নয়। মূলত দুর্বল হাদীস আমলের ক্ষেত্রে গ্রহণীয় বলেই উলামা, মুহাদ্দিসীন ও মুফাসসিরীনে কিরাম তাদের স্ব স্ব কিতাবে ফযীলত ও আমলের বর্ণনায় এ ধরণের হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকেন নি। শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত যে সকল হাদীসের সনদ দুর্বল এসব হাদীসতো সহীহ হাদীসের পাশাপাশি বিভিন্ন কিতাবে স্থান পেয়েছে। এর দ্বারা শবে বরাতের সবিশেষ ফযীলত ও আমলের গুরত্বের দিকটাই প্রমাণিত হয়।

উসূলে হাদীস সম্পর্কে যাদের ভাল ধারণা আছে, তার অবগত আছেন যে, হাদীসের দুর্বলতার মাত্রা সব সময় একই হয় না, কি কারণে হাদীসটি দুর্বল তার উপর হাদীসের দুর্বলতার মাত্রা এক এক ক্ষেত্রে এক এক রকম হয়ে থাকে। যেমন কোন রাবীর স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার কারণে একটি হাদীস দুর্বল, আর কোন রাবী মিথ্যুক এবং হাদীস জালকারী বলে সুপরিচিত, এজন্য একটি হাদীস দুর্বল - এই দুই ক্ষেত্রে দুর্বলতার মাত্রা কখনোই এক নয়। হাদীস শাস্ত্রের নীতিমালা অনুযায়ী, যদি কোন ফাজাইলের ব্যাপারে অনেকগুলো হাদীস বা রেওয়ায়েত পাওয়া যায়, এবং যদি তাদের মধ্যে অধিকাংশ রেওয়ায়েত দুর্বলও (কম মাত্রায়) থাকে, তবুও সবগুলো রেওয়ায়েতকে একত্রে করে সেই ফজীলত বা ফাজাইলকে গ্রহণ করা যাবে।

সুতরাং যারা শবে বরাতের হাদীস সংক্রান্ত কিছু দলিলকে যঈফ হাদীছ বলে শবে বরাত পালন করা বিদায়াত বলে তাদের এধরনের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভূল।

শেষ কথাঃ

যেসব আহলে হাদীস বা সালাফী ভাইরা শবে বরাতের ফযীলতকে অস্বীকার করতে চান, তাদের জ্ঞাতার্থে বলছিঃ

১। শবে বরাত সম্পর্কিত অনেক হাসান হাদীছ পাওয়া যায় যেগুলো উসূলে হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী একে অপরকে শক্তশালী করে সহীহ এর পর্যায়ে চলে যায়।

২। শবে বরাত সম্পর্কিত অনেক দুর্বল হাদীছ পাওয়া যায় যেগুলো বিভিন্ন সনদে বর্ণিত থাকায় উসূলে হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী একে অপরকে শক্তশালী করে হাসান এর পর্যায়ে চলে যায়।

৩। তদুপরি মুহাদ্দিসে কেরামের ইজমা আছে যে, ফাজাইলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীসের উপর আমল করা যায়।

আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন উপরের তিনটি নীতিমালার কোনটিকে আপনারা অস্বীকার করছেন যে, যার ফলে আপনাদের কাছে শবে বরাতকে বিদয়াত মনে হয় এবং এর ফাযায়েলকে রীতিমত অস্বীকার করে চলেছেন?

পরবর্তী পর্ব থেকে আমরা শবে বরাত সম্পর্কিত হাদীসগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করব এবং সর্বমোট ১২ টি হাদীস উল্লেখ করে উসূলে হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী হাদীসগুলো সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনদের মতামত অর্থাৎ কোনটি সহীহ, কোনটি হাসান, আর কোনটি দুর্বল তা উল্লেখ করব ইনশাল্লাহ।

যেসব লোক দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে মিথ্যাচারের আশ্রয় নিচ্ছেন দিনের পর দিন, তাদের উদ্দেশ্যে পবিত্র কোরআনে কারীমের একটি আয়াত পেশ করে আজ শেষ করব।

لَعْنَةَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ

মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর অভিশম্পাত। {সূরা আলে ইমরান-৬১}

( চলবে ইনশাল্লাহ )

( পররর্তী পর্বঃ হাদীছের আলোকে শবে বরাত - ২)

৮ম পর্বঃ
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×