'ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমদের কিছু প্রশ্নের উত্তর' শিরোনামে একটি ধারাবাহিক পোষ্ট প্রকাশ করছিলাম। প্রতি পোষ্টে একটি করে উত্তর দেয়া হচ্ছিল। গত সপ্তাহে ৩ টি প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছিল:
১. ইসলামে পুরুষদের বহুবিবাহের অনুমতি দেয়া হয়েছে কেন?
২. নারীদের বহুবিবাহের অনুমতি দেয়া হয়নি কেন?
৩. নারীদের বোরখার আড়ালে রেখে অবমাননা করা হয় কেন?
প্রচুর মন্তব্যের মধ্যে প্রশংসার সাথে সাথে কিছু সন্দেহ ও স্ববিরোধী প্রশ্ন ছিল। অনেক প্রশ্নের ব্যাপারে আমার পূর্ব ধারনা ছিল না। এজন্য সেই প্রশ্নগুলো সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করে দেখেছি। বেশিরভাগ প্রশ্ন করেছেন:
নিরুদ্দেশ নিহারীকা
আরিফুর রহমান
নাস্তিকের ধর্মকথা...
সকলকে ধন্যবাদ। প্রশ্নকারীদের সবগুলো প্রশ্নের বিশ্লেষণ শেষ হয়নি। যতদূর হয়েছে তাতে দেখা যায়, বেশিরভাগ প্রশ্নই যথার্থ ও যুক্তিসঙ্গত। প্রশ্নের আরও গভীরে যাবার জন্য এবং উত্তরগুলো পাবার উদ্দেশ্যে পড়াশোনা করছি। সন্দেহগুলোর সন্তোষজনক উত্তর না দিয়ে মূল পোষ্টের বাকী উত্তরগুলো প্রকাশ করা সঙ্গত নয় বলে বিবেচনা করছি। এবং এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য জানতে চাইছি।
ব্যক্তিগত পড়াশোনার অগ্রগতি কতদূর কি হল, সেটা আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করব। যখনই কোন উল্লেখযোগ্য বিষয় পাব, সেটিকে সবার সামনে নিয়ে আসতে চেষ্টা করব। এমনকি যদি তা ইসলামের বিপক্ষে যায় তবুও।
আমি একরোখা ব্যক্তি নই। বিজ্ঞানের ছাত্র, যুক্তিবাদী এবং একত্ববাদে বিশ্বাসী। আমি মনে করি, ইসলাম সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনবিধান। কিন্তু তাই বলে অযৌক্তিকভাবে ইসলামের পক্ষে সাফাই দেব না। আমাদের দেশে এমনকি সারা বিশ্বে বহু মৌলবি আছেন যারা ইসলামের নামে বিভিন্ন ফতোয়া দেন। বিজ্ঞানের প্রমাণিত সত্যের সাথে বৈপরীত্য সৃষ্টি করলে আমার কাছে সেই ফতোয়ার কানাকড়ি মূল্য নেই। আইনস্টাইন বলিছিলেন,
'বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম শুধুই অন্ধবিশ্বাস আর ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান অসহায়, পঙ্গু'
যদি ইসলাম বিরোধী কোন বক্তব্য পাই এবং তা যথাযত যুক্তিসঙ্গত হয় তবে সেটি প্রকাশে দ্বিধা করব কেন?
অনুসন্ধান করতে গিয়ে আলী সিনা নামক এক ব্যক্তির পরিচয় পেয়েছি। যতদূর পড়েছি মনে হয়েছে, তিনি ইসলাম তো বটেই এমনকি অন্য সকল ধর্মের বিরোধী। তবে এখন পর্যন্ত এমন প্রমাণ পাইনি যে, তিনি নাস্তিক। তার অনেকগুলো আর্টিকেল পেয়েছি এবং পড়ছি। গুরুত্বপূর্ণ কোন পেলে সেটি জানাব ইনশাআল্লাহ।
আলী সিনার সাথে আয়াতুল্লাহ মোনতাজেরি (সম্ভবত ইরানের ধর্মীয় নেতা)-র একটি বির্তক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্পূর্ণ বির্তক আমি পড়তে পারিনি। তবে যতদূর পড়েছি তাতে মনে হয়েছে আলী সিনার অবস্থান সুদৃঢ়। আলী সিনা ইসলামবিরোধী বেশকিছু প্রমাণপত্র উপস্থাপন করেছেন, যেগুলো সত্য। যার বিপরীতে আয়াতুল্লাহ মোনতাজেরির বক্তব্য খুবই দুর্বল।
এই ধরনের বির্তক আসলেই সঙ্গত। যুক্তি দিয়ে যদি ইসলামের দুর্বলতা প্রমাণ করতে পারেন তবে নতি স্বীকার করব না কেন?
এই সঙ্গত বির্তকের বাইরে আমি আলী সিনার বিছু বিচ্ছিন্ন ও অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য পেয়েছি।
তিনি তার Lukewarm Muslims (2008-06-14) নামক আর্টিকেলে লিখেছেন,
মুসলমানরা যুদ্ধপ্রিয়। কোরআন উস্কানিমূলক এবং যুদ্ধসর্বস্ব গ্রন্থ।
এরপর তিনি ইসলামের যুদ্ধপ্রিয়তা নিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন এবং ইসলামকে খাটো করে দেখানোর প্রয়াস পেয়েছেন।
যেহেতু তিনি ইসলামবিরোধী ব্যক্তিত্ব সেহেতু স্বাভাবতই তার কাছ থেকে ইসলামের গুণগান প্রত্যাশা করা যায় না। তিনি ইসলামের বিপক্ষেই বলবেন, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু কথা হল, তিনি তার বক্তব্যের প্রমাণস্বরূপ যে দলিল দিয়েছেন সেগুলোর গ্রহনযোগ্যতা সম্পর্কে।
তিনি উল্লেখ করেছেন, সুরা বাকারার ১৯১ নং আয়াত:
তাদের যেখানেই পাও, হত্যা কর।
এখানে তাদের বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হল কোরআনে শুধুই যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে। এবং তার বক্তব্য যথার্থই সত্য। সুরা বাকারার ১৯১ নং আয়াতে এটাই বলা আছে। তবে এর মাধ্যমে কোরআনের যুদ্ধসর্বস্বতা প্রমাণিত হয় না।
সুরা বাকার ১৯১-১৯৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে:
তাদের যেখানেই পাও, হত্যা কর। দাঙ্গা হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ। মসজিদুল হারামের নিকটা তাদের সাথে লড়াই কোরো না। (২:১৯১)
আর যদি তারা বিরত থাকে তবে আল্লাহ অত্যন্ত দয়ালু। (২:১৯২)
অন্যায়ের অবসান না হওয়া পর্যন্ত লড়াই কর। যদি তারা নিবৃত হয় তবে কারও প্রতি কোন জবরদস্তি নেই। (২:১৯৩)
যদি আলী সিনা সুরা বাকারার ১৯১ আয়াতের সম্পূর্ণটুকু দলিল হিসেবে দিতেন তাহলেই তার বক্তব্য মিথ্যা হয়ে যায়। তিনি কৌশলে ১৯১ নং আয়াতের আংশিক উপস্থাপন করেছেন। ১৯১ নং আয়াতে হত্যার কঠোরতা প্রকাশ পেয়েছে, ১৯২ নং আয়াতে আল্লাহ অত্যন্ত দয়ালু বলে সেই কঠোরতাকে বাতিল করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তারা যদি যুদ্ধের বদলে শান্তি চায় তবে তাদের হত্যা করা নিষিদ্ধ।
আলী সিনা দলিল হিসেবে সুরা বাকারার ১৯১ নং আয়াত দিয়েছেন তার মানে নি:সন্দেহে তিনি ১৯২ ও ১৯৩ নং আয়াতও পড়েছেন। কাজেই শুধু ১৯১ নং আয়াতের আংশিক তুলে দিয়ে তিনি যদি বলেন, কোরআন যুদ্ধসর্বস্ব তবে এটা স্পষ্ট প্রতারণা।
আয়াতুল্লাহ মোনতাজেরির সাথে তিনি যে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন আমি সেগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করি। সেই যুক্তিগুলো আয়াতুল্লাহ মোনতাজেরির পক্ষে খন্ডানো সম্ভব হয়নি। এই ধরনের যুক্তি দেখিয়ে তিনি ইসলামের বিপক্ষে কোন কথা বললে আমি বিনা বাক্যে সেটি মেনে নেব। কিন্তু আয়াতের খন্ডিত অংশ তুলে এধরনের প্রতারণার মানে কি?
যদি ইসলামে কোন অসামঞ্জস্যতা পান তবে সেটিকে নিয়ে কথা বলুন। খন্ডিত আয়াতের ধুয়া তুলে ইসলামকে খাটো করে দেখানোর অর্থ কি?
একই আর্টিকেলে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন,
সমস্ত জীবের মধ্যে অস্বীকারীরা নিকৃষ্ট। (৮:৫৫)
এখানে অস্বীকারকারী বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে? সাধারনত, অস্বীকারকারী = অমুসলিম। তার মানে দাড়াল, যারা ইসলাম গ্রহণ করেনি তারা সমস্ত জীবদের মধ্যে নিকৃষ্ট। বিশ্বভ্রাতৃত্বের ইসলামে সকল মানুষ একে অন্যের ভাই, তা সে মুসলিম হোক বা না হোক। অথচ কোরআনের এই বক্তব্য অনুযায়ী, মুসলমানরা তাদের অমুসলিম ভাইদের সমস্ত জীবদের মধ্যে নিকৃষ্ট মনে করে।
সুরা আনফালের ৫৫ ও ৫৬ আয়াত দেখা যাক:
সমস্ত জীবের মধ্যে অস্বীকারকারীরা নিকৃষ্ট। যারা সর্বদা চুক্তি ভঙ্গ করে। (৮:৫৫-৫৬)
যারা সর্বদা চুক্তি ভঙ্গ করে তাদের অস্বীকারকারী বলা হয়েছে, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে। মানে, মুসলমান হয়েও যদি সর্বদা চুক্তি ভঙ্গ করা হয় তবে সে অস্বীকারকারী। এখানে, অস্বীকারকারী not equals to অমুসলিম।
সর্বদা চুক্তি ভঙ্গ করলে মুসলমানও অস্বীকারকারী হতে পারে।
চুক্তিভঙ্গকারী নয়, সর্বদা চুক্তিভঙ্গকারীদের নিকৃষ্ট জীব বলা হয়েছে। এখানে ঢালাওভাবে অমুসলিমদের প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ অবান্তর।
আলী সিনা আরও উল্লেখ করেছেন,
মুশরিকরা অপবিত্র। তারা যেন মসজিদুল হারামের নিকট না আসে। (৯:২৮)
যারা আল্লাহর সাথে নিজেদের বা অন্য বস্তুর তুলনা করে তারা মুশরিক। শিরক সবচেয়ে বড় অপরাধ। এই গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করেন না। কাজেই, মুশরিকরা অপবিত্র।
মসজিদুল হারাম মুসলানদের জন্য অন্যতম পবিত্র স্থান। মসজিদুল হারামে সকল ধরনের রক্তপাত, যাবতীয় অন্যায় নিষিদ্ধ। তাই মসজিদুল হারামে মুশরিকদের প্রবেশাধিকারে বাধা দেয়া হয়েছে, হত্যা করার কথা বলা হয়নি। সুরা আত-তওবার এই আয়াতে যুদ্ধ সম্পর্কিত কোন বক্তব্যই নেই, কোজেই কোরআনের যুদ্ধসর্বস্বতা প্রমাণে এই আয়াতের উদ্ধৃতি কেন দেয়া হয়েছে তা আমার বোধগম্য নয়।
আয়াতুল্লাহ মোনতাজেরির সাথে বিতর্কে আলী সিনার যুক্তিগুলোকে আমি সম্মান জানাই। প্রচুর পড়াশোনার মাধ্যমেই তিনি এই যুক্তি অর্জন করেছেন। কিন্তু তাই বলে, অযাচিত এইসব দলিল উপস্থাপন করে নিজ বক্তব্যের সপক্ষে বলার কোন মানে হয় না। এতে করে তার আর্টিকেলটির উদ্দেশ্য নিয়েই সন্দেহ জাগে।
তিনি যদি ইসলামের দুর্বলতা বা অসামঞ্জস্যতার প্রমাণ উপস্থাপন করেন তো তাকে স্বাগতম জানই কিন্তু গোড়ামী করে জোরপূর্বক ইসলামের খাটো করে দেখানোর এই প্রচেষ্টা নিন্দনীয়।
উল্লেখ্য, 'ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিদের কিছু প্রশ্নের উত্তর' এর মূল গ্রন্থ:
'Answers to the Non-Muslims' Common questions about Islam.' by: Dr. Zakir Abdul Karim Naik.
আর আয়াতুল্লাহ মোনতাজেরির সাথে আলী সিনার সেই বিতর্কের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আমি পরবর্তীকালে প্রকাশ করব। সেই বিতর্কে ইসলামের অনেক দূর্বল বিষয় প্রকাশ পাবে যা মুসলমানদের জন্য অস্বস্তিকর হলেও সত্য। আমি যখন লেখা প্রকাশ করব তখন যদি ব্লগে না থাকেন তবে
http://www.somewhereinblog.net/blog/tausiq লিংকে গেলে আমার সবগুলো লেখা পাবেন। ধন্যবাদ।
তৌসিক আহম্মেদ। ছাত্র।