আমার চাকুরী জীবনের দশটি বছরই শিক্ষকতার মধ্যে কেটেছে, এখনও কাটছে। প্রথম সাড়ে তিন বছর আমি একটি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে চাকুরী করি। মাত্র ১৯ বছর বয়সে বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এ কথা যে শুনেছে সেই নানান নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা করেছে, যা তাদের কথা বার্তায় ফুটে উঠেছে। তবে সকলের সব সমালোচনার সঠিক জবাব দিয়ে বীরের বেশে নতুন চাকুরী নিয়ে ঐ চাকুরী ছেড়ে চলে আসি। এখনও ঐ বিদ্যালয়ের অনেকে আমার খুব প্রসংশা করে। একটি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে চাকুরী করা সত্ত্বেও নীতিহীন কোন কাজকর্ম আমার মাঝে দেখে না্ই। কোন ছাত্রীর সাথে একটু বেশি ভাব বিনিময় তা কখনও কেউ দেখেনি। আমি এতটা্ই কঠোর মনোভাব এর ছিলাম যে আমাকে খুব ভয় পেত।
আমার বয়স কম ছিল বলে ছাত্রীদের প্রা্ইভেট পড়ানোর ব্যাপারে আমার তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। কেননা যদি কেউ কোন মিথ্যা রটনা রটিয়ে দেয়। আমি ৮ম শ্রেণীর গণিত বিষয়ের ক্লাশ নিতাম। প্রধান শিক্ষক আমাকে ডেকে বললেন মেয়েরা পড়তে চায়, তুমি যদি না পড়াও তবে অনেক ছাত্রী খারাপ ফলাফল করবে। তুমি ওদেরকে পড়াও, স্কুলেই ছুটির পরে পড়াও। কোন অসুবিধা হবে না, আমরাতো আছি।মেয়েরা আমার কাছে পড়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলো। সবদিক চিন্তা করে প্রধান শিক্ষকের অনুরোধে আমি বিদ্যালয়েই পড়ানো শুরু করলাম। পড়ানোর কয়েকদিনের মধ্যে দেখলাম একটি মেয়ে পড়ার সময় তার আবদারটা একটু বেশি করতো। এই যেমন আমার খাতায় সব অংক করতে হবে, অন্য কারো খাতায় করতে পারবেন না। এর মধ্যে একদিন ঐ মেয়েটি তার যেই খাতাটি আমাকে অংক করার জন্য দিয়েছে, তার মধ্যে লেখা আমি তোমাকে ভালবাসি। লেখাটি আমার দৃষ্টিগোচর হয়। এবং আমাকে ভাবনায় ফেলে দেয়। পরের দিন ঐ মেয়েটি আমাকে বলে স্যার আমাকে বাসায় গিয়ে পড়াবেন। আমি বললাম কেন তুমিতো ব্যাচে পড়তেছো। সে বলল না আপনি আমাকে বাসায় পড়াবেন যত টাকা চান আমি দিব। আমি বললাম আমার সময় না্ই। তখন সে আমাকে বলল রাত দশটার সময় হলেও আমার কোন অসুবিধা না্ই। কথাগুলো শুনার পর আমার চিন্তা ভাবনা আরও বেড়ে গেল। কোন বিপদ আমার জন্য অপেক্ষা করতেছে? আমাকে এখনই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অনেক ভেবে চিন্তে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি আর ঐ মেয়েকে পড়াবো না। বাসায়ও না, ব্যাচেও না। পরের দিন সে যখন আমার কাছে পড়তে এসেছে আমি তাকে ডেকে বললাম যে তুমি আগামী দিন থেকে আর আমার কাছে পড়তে আসবে না। ও আর আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করে ঠিক পরের দিন থেকে আর আমার কাছে পড়তে আসেনি। কাজটা আমি কতটুকু ঠিক করেছি তা আমি জানি না।
এস.এস.সি পরীক্ষার পূর্বে পরীক্ষার্থীদের রাতের বেলায় পড়াশুনার তদারকি করার জন্য বিদ্যালয় থেকে সব শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া হল। প্রতি দু্ইজন করে শিক্ষককে এলাকা ভিত্তিক কয়েকজন করে শিক্ষার্থীর দায়িত্ব দেওয়া হল। শীতের রাতে আমরা শিক্ষার্থীদের তদারকির জন্য এ বাড়ি ঐ বাড়ি ঘুরেছি। দূরে কোথায়ও যদি কোন দিন যেতে না পেরেছি তবে রাত দশটার পর মোবাইল ফোনে কল করে জানার চেষ্টা করেছি যে শিক্ষার্থী জাগ্রত আছে কিনা, পড়াশুনা করছে কিনা? এক শিক্ষার্থীর মোবাইল ফোনে দুই তিন দিন কথা বলার পর একদিন তার এক ভাবী আমার বাসায় এসে উপস্থিত। আমার সাথে কিছু কথা বলবেন। ঊনি যে সব কথা বললেন শুনে আমি পুরো বোকা হয়ে গেলাম। তিনি আমাকে বললেন যে আমার সাথে ঐ শিক্ষার্থীর সম্পক হল টাকার। আমি তাকে প্রাইভেট পড়া্ই, তার বিনিময়ে সে আমাকে টাকা দেয়। আর কোন খোজ খবর আমার জানার বা নেওয়ার দরকার নেই। আমি যেন আর তার ফোনে কখনও ফোন না করি। আমি শুনে পুরো হতবাক হয়ে গেলাম। উল্লেখ্য তখন ঐ শিক্ষার্থী আমার কাছে ব্যাচে প্রাইভেট পড়তো। আর ফোন করে যে শুধু ওর একা খবর নিতাম তা কিন্তু নয়। আমার দায়িত্বে যারা ছিল এবং যাদের তখন মোবাইল ফোন ছিল তাদেরই খবর নিতাম।
যাক ঐ ভাবীর কথা গুলো শুনে মনে হল আমরা শিক্ষকেরা কত খারাপ, সামান্য কয়টা টাকার বিনিময়ে জ্ঞান বিক্রি করি। আমাদের জ্ঞানকে এ্ই সমাজ শুধু টাকার অংকেই মূল্যায়ন করে। আমাদের কোন সম্মান, মূল্যবোধ এ জাতির কাছে নেই। যদি থাকতো তবে আজ শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের হাতে মার খেত না।আমিতো তার ফোনে কল করে কোন অন্য ধরনের কথা বলিনি। কেবলমাত্র লেখা পড়ার খবর নিয়েছি একজন দায়িত্ব প্রাপ্ত শিক্ষক হিসেবে।ঐ দিনই ঐ মেয়ের নম্বর মুছে দেই।
সামনে ছিল এস.এস.সি পরীক্ষা। সেই কথা বিবেচনা করে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এদের পড়ানো শেষ করে আর কোন দিন প্রাইভেট পড়াবো না। সেদিন থেকে আর কোন শিক্ষার্থীকে প্রা্ইভেট পড়াই নাই। কারো কোন সমস্যা থাকলে বাসায় আসতে চাইলে বলি, ক্লাস টাইমে কিংবা প্রতিষ্ঠানে যতক্ষণ থাকি সে সময়ের মধ্যে সমস্যার সমাধান করে নিতে।তবে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে যখন পড়াই আন্তরিকতার সাথেই পড়াই। আমার শুভাকাঙ্খী হাজার হাজার শিক্ষাথী এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে চাকুরী করে। অনেকেরই ফোন পাই, আমার খোজ খবর রাখে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তখন সত্যি খুবই আনন্দ পাই।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




