সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চতুর্দিকে অন্ধকারের রাজত্ব শুরু হবে। এই গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। প্রথম বিদ্যুৎ জ্বলে উঠার পর প্রায় এক হাজার বছর গত হয়ে গিয়েছে। অথচ কোনা পাথর গ্রামটিতে সভ্যতার অগ্রগতির প্রাথমিক অর্জনটিও যায়নি। অতিকায় বটগাছের নিচে বসে এমনটিই ভাবছিল তানজিল। সে এবার এসএসসি পাশ করে শহরের কলেজে ভর্তি হয়েছে। এখন কলেজ ছুটি তাই গ্রামে এসেছে বাড়ীতে আসার পর বাবা-মা এত বেশি আদর যতœ শুরু করে যে সে তাতে হাঁফিয়ে উঠে। একা একা বটগাছের গোড়ায় বসে থাকতে তার ভালই লাগছিল। ভাবতে ভাবতে কখন গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে তা সে মোটেই খেয়াল করেনি। বিশাল বটগাছের ছোট একটি বট উপর থেকে তার মাথায় পড়ে। সাথে সাথে তানজিল ভীষণ চমকে উঠে। এই বট গাছটি নিয়ে গ্রামে অনেক ভূতের গল্প প্রচলিত আছে। সন্ধ্যা বা রাতে কেউ এখান দিয়ে একাকী যায় না। তানজিল একটু ঘাবড়ে গেল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বট গাছটিকে কেন্দ্র করে কিছু নতুন রহস্য ও ভীতি তৈরী হয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাতের বেলায় একা বা দলবদ্ধভাবে কেউ এখানে আসে না। প্রয়োজন থাকলে অন্যপথ ঘুরে যায়। প্রায় মাস খানেক আগে প্রথম গ্রামের মাতব্বর সিরাজ খান এখান দিয়ে যাওয়ার সময় উধাও হয়ে যায়। আরেকদিন একদল ডাকাত লুট করে পালানোর সময় সবাইকে বটগাছ খেয়ে ফেলে। ডাকাতদের পিছনে ছুটে আসছিল আবদুল জব্বার চৌকিদার। দূর থেকে তিনি দেখেন সবকটি ডাকাত গাছের ভেতর ঢুকে যায়। এর পরদিন রূপাকান্দা থানার ওসি রফিক সাহেব ফোর্স নিয়ে এসেছিলেন তদন্ত করতে। গাছের ঘটনা শুনে সেখানে যান তিনি। সময় তখন সন্ধ্যা ৭টা। সবাইকে রেখে শুধু রফিক সাহেবকে গাছ ভেতরে টেনে নিয়ে যায়। এ ঘটনার পর থেকে রাতে তো নয়ই দিনের বেলায়ও সাধারণত কেউ বট গাছটির ধারে কাছে যায় না। তানজিল এসব কিছুই জানে না। তার বাবা-মা তাকে সাবধান করতে ভুলে গিয়েছিল। ঘটনা জানলে কোন ভাবেই সে এদিকে আসত না। অন্ধকারের মধ্যেও ছোট বট ফলটি দেখা যাচ্ছে। তানজিল বট ফলটি হাতে নিল। আচমকা নিজেকে ওজনহীন মনে করল। ভয়ে বট ফলটি ফেলে দিল। আবার নিজেকে স্বাভাবিক মনে হল। একদিকে ভয় অন্যদিকে রহস্যের হাতছানি ও কৌতুহল। শেষ পর্যন্ত কৌতুহলের জয় হল। কিছুটা সাহস জমা করে বট ফলটি আবার হাতে নিল। প্রায় সাথে সাথে তানজিল নিজেকে ওজনহীন অনুভব করল। নিজেকে যথেষ্ট সাহসী মনে হচ্ছে। অজানা আত্মবিশ্বাস ভর করল মনে। মনে হল ইচ্ছা করলে এক লাফে গাছের উপরে উঠে যেতে পারবে। বাস্তবে হলোও তাই। ছোট্ট একটি লাফ দিতেই পৌঁছে গেল বট গাছের মাথায়। উত্তেজনায় তার বুক দ্রুত উঠানামা করছে। সে জানতো না বট গাছের উপর আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছে তার জন্য। বট গাছের উপরে খুবই সুদৃশ্য একটি দরজা দেখা গেল। এখানে কিভাবে এত সুন্দর একটি দরজা এল, এটি দাঁড়িয়ে আছেই বা কিভাবে এসব ভাবার আগেই তানজিল দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল গাছের ডালপালার উপর দিয়ে শূন্যে বাতাসে হাঁটতে তার কোনই অসুবিধা হচ্ছে না। দরজার হাতলে হাত দেয়ার প্রয়োজন হলো না। দরজা খুলে গেল। মনে হলো অদৃশ্য কোন চুম্বক তাকে টেনে ভিতরে নিয়ে গেল। ভেতরটা একটা লিফটের মত তবে ডিম্বাকৃতির। দরজা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেল। তানজিলের ওজন অস্বাভাবিক ভাবে বাড়তে থাকল। তাকে নিয়ে পুরো কামরাটি ঘুরতে থাকল। তার মনে হল ওজন মনে হয় কয়েক হাজার কেজি হয়ে গেছে। হাঁড়গুলো ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হলো। সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল।
যখন জ্ঞান ফিরল নিজেকে একটি জঙ্গলের ভেতর আবিষ্কার করল। সূর্য মেঘের আড়ালে থাকলে যেমনটি হয়, তেমন আলো বিরাজ করছে। উপরের দিকে মুখ, চিৎ হয়ে পড়ে আছে তানজিল। খুব ভালো করে দেখে একটি গাছও সে চিনতে পারলো না। আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু শূন্যতা অনুভব করল। কতক্ষণ অজ্ঞান ছিল তার ধারণা নেই। প্রচ- ক্ষুধায় নাড়ি-ভুঁড়ি জ্বলছে। পান্তা ভাত, শুকনো মরিচ আর কড়া করে ভাজা ডিম সকালের নাস্তা হিসেবে খুবই প্রিয় তার কাছে। তানজিল ভাবছে পান্তা ভাত খাওয়ার কথা। তার চিন্তার চেয়েও অধিক গতিতে কোথা হতে যেন এক প্লেট ফ্রেশ পান্তাভাত, সাথে শুকনা মরিচ আর ভাজা ডিম এসে হাজির। স্তম্ভিত তানজিল উঠে বসলো। প্রচ- ক্ষুধার্ত সে। ভাবনা চিন্তা পরে করা যাবে। আগে খাওয়া দরকার। হাত ধোয়া প্রয়োজন। ভাবতে দেরি যা। একটি গাছ হতে পানি ঝরতে লাগল। তানজিল দ্রুত উঠে হাত ধুয়ে নিল। সাথে সাথে পানি বন্ধ হয়ে গেল। ভাত খেতে গিয়ে তানজিল অনুভব করল কেউ একজন তাক নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে। ভাত খাওয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে তানজিল ছোট একটা ঘণ্টার ধ্বনি শুনতে পেল। শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টা করল। অনেকটা রোলারের মত একটি ভারী যান তার দিকে ধেয়ে আসছে। বড় বড় গাছগুলোর যেটাই সামনে পড়ছে পিষে ফেলছে। তানজিল উঠে বিপরীত দিকে দৌঁড় দিল। তবে তার চেয়ে দ্রুত গতিতে রোলারটি তাকে অনুসরণ করছে। গতি বেশি হলেও ডানে বায়ে টার্ন করতে গিয়ে একটু স্লো হয়ে যাচ্ছে সেটি। তানজিল ডানে বায়ে এঁকে বেঁকে টার্ন নিয়ে এলোমেলো অবস্থা তৈরী করে। গ্রামে গোল্লাছুট আর বউছি খেলার সময় দৌঁড়ে তার সাথে কেউ পারতো না। স্কুলে দৌঁড় প্রতিযোগিতায় সে সব সময় ফার্স্ট হত। সে অভিজ্ঞতা এখন কাজে লাগল। যানটিকে মোটামুটি বিভ্রান্ত করে ফাঁক দিয়ে দৌঁড়ে এসে রোলারের উপরে উঠে গেল। রোলারটি নিশ্চয়ই দূর থেকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে। রোলার উল্টে যাওয়া শুরু করল। উল্টে গেলে সে রোলারে চাপা পড়ে পিষ্ট হয়ে যাবে। তৎক্ষণাৎ ভাবতে লাগল এ রোলারটি কন্ট্রোলের রিমোট যদি পেতাম। অদ্ভুত ব্যাপার হল সাথে সাথে হাতের কাছে রিমোট কন্ট্রোল পেল। রিমোট দিয়ে রোলারটি অফ করে নেমে আসল। তাকিয়ে দেখে রোলারটির আকৃতি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। সেখান থেকে কিছু শব্দ আসছে। একটু পর পরিষ্কার ভিডিও চিত্র ভেসে উঠল। একটি হাসপাতালের ওয়ার্ড। দেখেই বুঝা যায় খুবই উন্নত মানের। বিভিন্ন বেডে রুগী শুয়ে আছে অনেক। ডাক্তারের এপ্রণ পরা একজন মানুষ কথা বলছেন। শুন তানজিল। ওয়েলকাম টু ফোর ডাইমেনশনাল ওয়ার্ল্ড ‘প্রতিকার’ গুড লাক। তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। ইয়ংম্যান তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আচমকা তানজিলের মুখ থেকে বের হল-আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না। স্ক্রীনে ভদ্রলোক পায়চারী শুরু করল। আমি ড. আফিফ সিদ্দিকী। তোমার পিতামহ সেলিম আমার বাল্য বন্ধু। সেলিম তেমন একটি পড়ালেখা করতে পারেনি। তবে সে ছিল অসাধারণ মেধাবী। আমার বিপদের সময় সে বুদ্ধি পরামর্শ দিতো। টাকার অভাবে যখন আমার উচ্চ-শিক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় তখন সে ধান-বিক্রি করে আমাকে টাকা দেয়। আমি তোমাকে পৃথিবীর একজন সেরা বিজ্ঞানী হিসেবে তৈরী করতে চাই। পৃথিবীর হিসেবে আমার বয়স ১৩০ বছর। কিন্তু সেটি তৃতীয় মাত্রার জগত। এখানে আমরা চতুর্থ মাত্রায় অবস্থান করছি। আমরা ইচ্ছেমত সময়ের নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এই জগতের হিসেব অনুযায়ী আমার বয়স প্রায় ৬৫ বছর। বুঝতেই পারছ খুব বেশি দিন আমি বেঁচে থাকবো না। আমার জীবন-যৌবন ক্ষয় করে গড়ে তোলা এই জগতের নিয়ন্ত্রণ আমি তোমার হাতে রেখে যেতে চাই।
তানজিল চিৎকার করে উঠল-আমি বাচ্চা মানুষ, আপনি এসব কি বলছেন? কোন সমস্যা নেই, আমি সব তোমাকে শিখিয়ে দিব। আমি দীর্ঘদিন আমেরিকায় ছিলাম। দেশে ফিরে সিদ্ধান্ত নিলাম আর যাব না। গ্রামে গিয়েছিলাম বেড়াতে। সুবল ডাকাত আমার সব লুট করে নিয়ে যায়। একমাত্র ছেলে তাসমিনকে ও স্ত্রী-নাজরীনকে খুন করে। আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। টানা ২ বছর পাগলের মত গবেষণা করে চতুর্থ মাত্রার একটি স্পেস আবিষ্কার করি। সুবল ডাকাতকে সব চেলাসহ টেনে নিয়ে আসি এখানে। আমার ডিজাইনে একটু ত্রুটি ছিল। অনেকটা সেরেছি। একটি এখনো বাকী আছে। যেমন তুমি যে রোলারের মুখে পড়েছ সেটি একটি। তোমার কোন ক্ষতি হয়ে গেলে আমি কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। সুবল ডাকাত ও ২ জন চেলা এমন একটি ত্রুটিতে মারা যায়। বাকীরা এখনো এখানে বন্দি আছে। সেই থেকে নিয়মিত বাংলাদেশের সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ ও অন্যান্য ক্ষেত্রের বড় মাপের অপরাধীদের ধরে এনে এখানে আটকে রাখি। এই যে দেখছ বেডে শুয়ে আছে লোকজন এরা সব অপরাধী। বর্তমানে এদের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। যখন কারো স্বাভাবিক মৃত্যু হয়, তাকে তার ঠিকানায় ইজেক্ট করে দিই।
আমাকে নিয়ে আপনি কি করতে চান? তুমি তোমার স্বাভাবিক পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। যখন দরকার আমি নিয়ে আসব। কাজ শেষে আবার চলে যাবে। যখন যেখানে থাক এখানে আসতে কোন সমস্যা হবে না। তখন যদি ডিজাইনের ত্রুটির মধ্যে পড়ি? তোমাকে এখনি প্রটেকশনের আওতায় নিয়ে নিচ্ছি। বিস্তারিত পরে কথা হবে। তোমার মা-বাবা চিন্তা করছেন। একটি চেয়ার পাঠাচ্ছি। তুমি শুধু বসবে। স্ক্রিন অফ হয়ে গেল।
সামনেই তানজিল একটি কাঠের চেয়ার দেখল। দ্রুত বসে পড়ল। এক মিনিটের মাথায় চেয়ার তাকে দিয়ে বিশাল এক প্রান্তরে প্রবেশ করল। হাজার হাজার খাটে মানুষ শুয়ে আছে। কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে। একটি কাঠের টুকরায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক উড়ে যাচ্ছেন ড. আফিফ।
এর পাঁচ বছর পর
তানজিল ফোর ডাইমেনশনাল ওয়ার্ল্ড ‘প্রতিকার’ এর প্রধান নিয়ন্ত্রক। কয়েকদিন আগে ড. আফিফ সিদ্দিকী ইন্তেকাল করেছেন। যথাযথ মর্যাদায় তার অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী ‘প্রতিকার’ এর কমান্ড সেন্টার এর উঠোনে তাকে সমাহিত করা হয়। তানজিল সিস্টেমকে আরো ডেভেলপ করে। কারো নিরাপত্তার প্রয়োজন, আত্মগোপন করা দরকার, মূল্যবান কোন জিনিস সংরক্ষিত রাখা প্রয়োজন ইত্যাদি বহুবিদ কাজে ‘প্রতিকার’ কে ব্যবহার করা হয়। প্রতিকার হয়ে উঠে জুলুমের বিরুদ্ধে মজলুমের হাতিয়ার।